আমার দেশের সংবিধান সংশোধনের ইতিহাস ময়না তদন্ত করলে দেখতে পাই ইতোমধ্যে চৌদ্দবার সংশোধিত হয়েছে, কিন্তু শুদ্ধ বা বিশুদ্ধ হতে পারেনি। সংশোধনের নামে বরং একে অশৌচই করেছে।এটোঁ করেছে। অর্থাৎ খেয়ে খেয়ে রেখেছে। সবটা খেতে পারেনি। আবার যেটুকু খেয়েছে তাতে না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা। পুরোপুরি ইসলামীও না, তবে লেবাস আছে। বাম তো নয়ই, আবার ধনবাদে যাবার আকুতিও প্রকট নয়। জগা খিচুরি অবস্থা।
বরাবরই শাসকগোষ্ঠী তাদের মতামতকে সর্বোচ্চ রায় মনে করে এ সব পরিবর্তন এনেছেন। জন মতামতের কোন ধার ধারেনি। ৭২ এর সংবিধান ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এবারই প্রথম গণমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনার বৃষ্টি নেমেছে। কোথাও কোথাও কালো মেঘের আবাসও রয়েছে। এ নিয়ে ঝড় আসলেও অবাক হব না। কারণ পৃথিবীর জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব যেমন বাংলাদেশে পড়েছে তেমনি বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাবও আমাদের জাপটে ধরে আছে। এ জাপটা আমার একান্ত অনুভূতির দেশটাকে দূরে সরিয়ে নিতে চাচ্ছে।
অথচ আমার পূর্ব পুরুষ তেহরান, কাবুল বা কোন আরব দেশ থেকে আসেনি। আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর শরীর, মন ও মনন এ দেশের মাটি, জল আর বাতাসে বেড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে। যারা যাদের পূর্ব পুরুষ অন্য দেশ থেকে এসেছে বলে গর্ব ভরে দাবি করে তাদের কাছে আমি এ দেশে অনাহুত নাগরিক।
আমরা দেশ নিয়ে কিছু লিখতে গেলে আমার আমার লিখি। যেমনঃ আমার মা—আমাদের নয়। আমার না বললে মনে হয় যেন ভাগীদার আছে। তেমনি আমার দেশ। আমার জাতীয় সংগীত ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ আমার পতাকা। আমার না হলেও আমার দেশের সংবিধান। দেশটাই যে আমার। তাইতো ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন’।
এই আমিটা কে? কি আমার পরিচয়? আমি আত্ম পরিচয়ের সন্ধানে বের হয়েছি। একজন নারীবাদীর কাছে আমি শুধুই একজন নারী। সে নারী যে ধর্মের, যে সংস্কৃতির, যে সমাজের, যে দেশের বা যে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিরই হই না কেন? নারী পরিচয়ই প্রাধান্য পায় তার কাছে।
বাংলাদেশের একজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর কাছে আমি একজন বাঙালী নারী। আগে বাঙালী পরে নারী। এক কথায় আমি একজন বাঙালী নারী।
একজন জামাত নেতা বা কর্মীর কাছে আমি একজন হিন্দু নারী। আগে হিন্দু পরে নারী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী। দুটো পরিচয়ই অস্পৃশ্য। প্রকাশ্যে ছোঁয়া যায় না।
একজন বামপন্থী নেতার কাছে আমি একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী।আর্থ- সামাজিক লেজসহ পরিচয়।
একজন মৌলবাদী হিন্দুর কাছে আমি বৈশ্য সম্প্রদায়ভূক্ত একজন বিবাহিত হিন্দু নারী।
আমি কিন্তু একটুও বদলাইনি। যদিও ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয়ে গেছে আমার পরিচয়।আসলে আমি কে? আমি কী নিজে পারি আমার মতো করে পরিচিত হতে!পারি না। পরিবার আমাকে সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সমাজ আমাকে বেঁধে রেখেছে এর রীতিনীতি দিয়ে।ধর্ম আমার কপালে চিহ্ন এঁকে রেখেছে। রাষ্ট্র আমাকে বিভাজিত করে রেখেছে।
আমি গীতা দাস না হয়ে পূরবী খীসাও হতে পারি। হতে পারি জয়মালা সাঁনতাল। অথবা শ্বেতা মানখিন।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমার মর্যাদাসম্পন্ন পরিচয় কোনটি? কোন পরিচয়ে আমাকে মনে হবে আমি মূলস্রোতের অংশ!
আমি গীতা দাস, পূরবী খীসা, জয়মালা সাঁনতাল অথবা শ্বেতা মানখিন তো আমার বা আমার মা বাবার ইচ্ছায় হইনি। হাজার বছরের বিব্ররতিত নৃ-গোষ্ঠি, প্রবাহিত সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম আমার ও আমাদের এ পরিচয় দিয়েছে।
আমার পরিচয় দিতে গিয়ে সংবিধানের অনেক ধারা আমার জিহ্বায় কাঁটার মতো বিঁধে।
আমি ইচ্ছে করলেই এ কাঁটার ঘা থেকে মুক্তি পেতে পারি না। আমি সিঁদুর পরি না। তাই বলে কী আমি আমার হিন্দুত্ব মুছে ফেলতে পারছি ? পূরবী খীসা কী করে তার চেহারার আদল বদলাবে ? অন্যের মন ও মননের সাথে যে আমাদের পরিচয় জড়িত।
এদেশের সংখ্যালঘু প্রায়ঃশই দেশের সংখ্যাগুরুর কাছে উপেক্ষিত। দেশের সরকারের কাছে অবহেলিত। প্রাকৃতিক দুযোর্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর খাদ্যাভাসকে বিবেচনায় রাখা হয় না। সব দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় আবেগ বেশী, এর মধ্যে আবার যদি হয় গরীব তবে তো কথাই নেই। দুটো অধঃস্তনতা সূক্ষ্ম এক যন্ত্রণাবোধ হয়ে তাদের কুড়ে কুড়ে খায়।
গরীবের ধর্মীয় আবেগ বেশী। অনেক হিন্দুর কাছে গোমাংসের বার্গার বা পিজ্জা খাওয়া ততটা সংস্কারে না বাধলেও গরীবের বাঁধে। বাংলাদেশের গ্রামীণ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে গোমাংস এক মহা নিষিদ্ধ জিনিস। ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় প্রচলিত গালি ছিল — ‘ তুই যদি এটা করিস তবে গরুর মাংস খাস।’ অর্থাৎ ঐ কাজটি গোমাংসের মতোই নিষিদ্ধ। বা গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায়ে বলা হতো ‘ এ কথাট ফাঁস করে দিলে তুই গরুর মাংস খাস।’
বকলমের উদ্দেশ্যে, নিরক্ষর কাউকে লক্ষ্য করে অথবা লেখা পড়ায় নিতান্তই অমনোযোগী শিশুকে গালি দিতে ব্যবহৃত হয় — ‘তোমার কাছে তো ক অক্ষর গোমাংস।’ অর্থাৎ অস্পৃশ্য বিষয়।
সেই গোমাংস দিয়ে খিচুরী রেঁধে প্রাকৃতিক দুযোর্গের সময় আশ্রয় কেন্দ্রে বিতরণ করা হয়। এ নিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ আমি দেখেছি। তবে প্রতিবাদ দেখিনি। জিজ্ঞেস করেছি— প্রতিবাদ করলেই পারেন?
উত্তর — কিছু বলতে গেলে ভাববে আমরা সংস্কারাচ্ছন্ন ও সাম্প্রদায়িক।
শেখ মজিব আর জিয়া উভয়ের মৃতুবার্ষিকীর কাঙালী ভোজে গরুর মাংসের খিচুরীই একমাত্র ভোজ্য। আয়োজকরা কখনোই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গরীবদের কথা ভাবে না।
এ দেশে গরীবদের কোন নেতা নেই, আর সংখ্যালঘু গরীবদের তো আরও নেই।
-চলবে-
আমি আপনার প্রবন্ধের শিরোনাম মানতে পারলাম না। মুক্তমনা তে সংখালঘু আর গুরু আসবে কি করে? এখানে তো সবাই মুক্তমনা হওয়ার কথা!!!!
ফরিদ, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” —
এটা যে অমানুষেরা বুঝে না।
সংখ্যালঘুদের প্রতি সম অধিকার বা তাদের সুবিধে অসুবিধের প্রতি সম্মান করা মনে হয় আধুনিক সভ্যতার একটি পরিচয়। এককালে রাষ্ট্র হত পুরোপুরি ধর্মভিত্তিক, রাজার ধর্মই হত প্রজার ধর্ম। সংখ্যালঘু বলতেই কিছু থাকার উপায় বাস্তবিকভাবে থাকার উপায় ছিল না। এখনো কোন কোন দেশে এই অবস্থা আছে, আবার কেউ কেউ তেমন সমাজ গঠনের খায়েশ দেখেন।
পূর্ব ও পশ্চীম দুদিকের সভ্যতার মাঝেই কিছু তূলনামূলক ভাল খারাপ পয়েন্ট আছে। তারমধ্যে পাশ্চাত্যের সংখ্যালঘুদের সম্মান করার দিকটা খুবই শিক্ষনীয়। হয়ত ধর্ম নিয়ে তারা তত মাথা ঘামায় না বলেই এটা সম্ভব হয়।
@আদিল মাহমুদ,
সবাইকে মন থেকে মানুষ ভাবলেই আর সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু বলে কিছু থাকে না।
@ফরিদ আহমেদ,
হ্যা, সেটাই আমি বলি।
ধর্ম পালন করতে হয় করুন না, যত খুশী নিজের মত আল্লাহ ঈশ্বর গড কে ডাকাডাকি করেন। কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত চক্রের বাইরে টেনে আনতে গেলেই অবধারিতভাবে গোল বাধবে। তখনই শুরু হবে কে গুরু কে লঘু, কার গড আসল কারটা নকল এসব অর্থহীন বিতর্কের।
ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে সংখ্যালঘু বলা আর বর্নের ভিত্তিতে কাউকে সংঘ্যালঘু শ্রেনীভুক্ত করার মাঝে মৌলিক কোন তফাত নেই।
সেদিন এখানে ধার্মিক ব্যক্তিরাও যে কত মহত, উদার, সহনশীল হতে পারেন তার একটা বাস্তব উদাহরন নিজের চোখে দেখলাম।
যাচ্ছিলাম আরেক শহরে এক শ্যালিকার হঠাত ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়েতে। আমার স্ত্রীকে তার বিয়ের কিছু উপকরন কিনতে স্থানীয় ইন্ডিয়ান বাজারে নিয়ে গেলাম। সেখানে সে দোকানদারকে বর্ণনা করছিল সে কি চায়। আমি সেসব বুঝি না তাই সে পার্টে যাচ্ছি না। ডালা, কুলা, প্রদীপ কি কি সব।
দোকানে উপস্থিত ছিলেন একজন মধ্যবয়ষ্ক হিন্দু ভদ্রলোক (বুঝতে পেরেছি হিন্দুদের ট্র্যাডিশনাল কিছু চিহ্ন যেমন দই এর ফোটা তিলক এসব দেখে)। ভদ্রলোক খুব কৌতুহল ভরে শুনছিলেন, তারপর নিজেই কিছু পরামর্শ দিলেন কি নিতে পারি বলে, ইতোমধ্যে জেনেও গেছেন এটা মোসলমান বিয়ে।
এরপর ভদ্রলোক পকেট থেকে দুডলারের একটা কয়েন বের করে আমার স্ত্রীর হাতে দিলেন বিয়েতে তার আশীর্বাদ হিসেবে। এমন ভাবে দিলেন যে না করার কোন উপায় নেই। টাকা তো বড় কথা নয়, কিন্তু তিনি যে মন থেকে আশীর্বাদ করলেন এতে তো কোন সন্দেহ নেই।
এমন ধরনের ঔদার্য সবাই দেখাতে পারলে তো ধর্মের খারাপ দিকগুলি চাপা পড়ে যায়।