ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির

 

ফরিদ আহমেদ

 

আমার বাসার পাশেই পাবলিক লাইব্রেরীর ছোট্ট একটা শাখা আছে। বই কিংবা ডিভিডির খোঁজে প্রায়শই ঢু মারা হয় ওখানে। একটা বই এনে রেখেছিলাম অনেকদিন আগে। আলসেমি করে পড়াতো হয়নি, ফেরতও দেয়া হয়নি সময় করে। প্রায়ই লাইব্রেরী থেকে ফোন আসে। আর আমি লাইব্রেরীর আইডি দেখেই ফোন অফ করে দেই। কে যায় কম্প্যুটারের কচকচানি শুনতে। তবে একদিন হুট করে হুশ ফিরলো আমার। যে পরিমাণ জরিমানা হচ্ছে বইটা বেশিদিন আটকে রাখার ফলে তা দিয়েতো আমি ওই বইটা কিনেই ফেলতে পারতাম। বোধিজ্ঞান হবার সাথে সাথেই বই ব্যাগে ভরে বিদ্যু গতিতে বের হলাম আমি। বই ফেরত দিয়ে লাইব্রেরীর দরজার ঠিক বাইরে বিক্রির জন্য রাখা বইগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। এই লাইব্রেরীটা কিছুদিন পরপরই খুব স্বল্পমূল্যে কিছু বই বিক্রি করে থাকে। বেশিরভাগ যদিওবা ফিকশন ধরনের। অনেকসময় হুটহাট করে  খুব ভাল বইও পেয়ে যাওয়া যায়। ভাল কোন বই পেলে আমি প্রায়শই কিনে ফেলি। পয়সা বাঁচানোর খুব সহজ রাস্তা এটা। একবার হিলারী ক্লিনটনের লিভিং স্টোরী বইটা কিনেছিলাম মাত্র সিক্সটি নাইন সেন্টস দিয়ে।

 

বইগুলোতে চোখ বুলোতে বুলোতে হঠা করে শেলফের নীচের তাকে চোখ গেলো। মুহুর্তের মধ্যে যেন জমে গেলাম আমি। সমস্ত শরীরে অজানা শিহরণ বয়ে গেল। নীচের শেলফে খুব নিরীহ ভঙ্গিতে শুয়ে আছে আমার কৈশোরের এক টুকরো স্মৃতি। গভীর ভালবাসায় আমি স্মৃতিটুকুকে তুলে নিয়ে বুকের কাছে আনি। মমতার হাত বুলোই সারা গায়ে। সাথে নিয়ে কাউন্টারে চলে আসি আমি। আমার হাতে লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরীর ডিভিডি দুটো দেখে কাউন্টারের মহিলারও চোখ দুটোও স্বপ্নিল হয়ে উঠে। হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে বলে আমার অসম্ভব প্রিয় একটা সিরিজ। আমি বলি, আমারও। খুব ছোটবেলায় দেখেছি। পাশেই অল্পবয়েসি আরেকটা মেয়ে ছিল। সে বেশ অবাক হয়ে বললো, কোথায় দেখেছো? বললাম যে, দেশে থাকতে টিভিতে দেখেছি। মেয়েটা অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে বললো, এটা তোমাদের টিভিতে দেখাতো। বেশ একটা ভাব নিয়ে গর্বিত হাসি উপহার দেই ওকে। দুই ডলারে দুটো ডিভিডি কিনে বাসার দিকে রওনা দেই আমি। চারপাশে কত লোক। অথচ কেউ জানতেও পারে না যে, কত তুচ্ছ পয়সা দিয়ে আমি কিনে নিয়েছি আমার বহু বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের এক টুকরো সোনালী স্মৃতিকে। 

 

                           প্রথম প্রকাশিত হবার সময়কার প্রচ্ছদ

 

বাংলাদেশের টেলিভিশনে লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরী কবে দেখিয়েছে? বিরাশি না তিরাশি সালে? কিছুতেই মনে করতে পারছি না এখন আর। আমার স্মৃতিশক্তি এমনিতেই দুর্বল। কৈশোরের প্রায় সব স্মৃতিই ফিকে হয়ে গিয়েছে। অবশ্য সেখানে আমার ইচ্ছাকৃত অবদানও আছে অনেকখানি। নিজে নিজেই আমি মুছে দিয়েছি আমার অনেক অনেক স্মৃতি। ভয়ংকর শক্ত দেয়াল তুলে কবর চাপা দিয়েছি সেগুলোর। ছোট্ট একটা চৌদ্দ ইঞ্চি সাদাকালো নিক্কন টেলিভিশন ছিল আমাদের। ভাষাগত সীমাবদ্ধতায় সেই কৈশোরে অনেক কিছুই বুঝতাম না ছবিটার। তারপরেও ইঙ্গাল পরিবারের সুখ দুঃখ আনন্দের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে যেতে কোন বাধাই টের পেতাম না।

 

লরা ইঙ্গালস তার শৈশব কাটিয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকার মিডওয়েষ্টে। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লরা ১৯৩২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এই এক দশকে লিটল হাউজ সিরিজের আটখন্ড গ্রন্থ রচনা করেন। এর তিন নম্বরটার নাম ছিল লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরী। এই বইগুলোর ভিত্তিতেই ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী নয় বছরে এনবিসি টেলিভিশনে খন্ড খন্ড ভাবে চলচ্চিত্রায়ন করা হয়। পারিবারিক টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে সত্তুর এর দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল হিসাবে জায়গা করে নেয় লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরী। শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টেলিভিশনে দেখানো হতে থাকে ছবিটি। ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে এটি।

 

httpv://www.youtube.com/watch?v=bhHrOgOkXZw

 

লিটল হাউজ সিরিজের দুটো অনুবাদ করা বই পড়েছি আমি। কীভাবে কীভাবে যেন সেই কৈশোরে হাতে এসে গিয়েছিল আমার। টিভি সিরিজ দেখার আগে পড়েছিলাম বই দুটো নাকি পরে সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। দুর্দান্ত কাব্যিক নাম ছিল দুটো বইয়েরই। লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরীর অনুবাদ করেছিলেন আতোয়ার রহমান, ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির নামে। আর অন দ্য ব্যাংকস অব প্লাম ক্রীক এর অনুবাদ করেছিলেন জাহানারা ইমাম। নাম ছিল নদীর তীরে ফুলের মেলা

 

শৈশব আর কৈশোরের সুখ স্মৃতিই নাকি মানুষের শ্রেষ্ঠতম স্মৃতি। যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তার জীবনের সেরা সময় কোনটা। মোটামুটি সকলেই বলবে যে তাদের শৈশব অথবা কৈশোর। এদিক দিয়ে আমি ব্যতিক্রম। আমার শৈশব, কৈশোর এবং প্রথম তারুণ্য বলে কিছু নেই। যা কিছু আছে তাকে সুখের স্মৃতি হিসাবে বিবেচনা করা যায় না কিছুতেই। তমস্যাচ্ছন্ন সেই শৈশব, কৈশোর আর প্রথম তারুণ্যকে তাই আমি তিমিরের হাতেই তুলে দিয়েছি। খুব খুব সচেতনভাবে স্মৃতিগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে উপড়ে ফেলেছি আমি। এদিক দিয়ে জেসন বোর্ন এর সাথে আমার মিল রয়েছে। তার মতই একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে আমার কোন স্মৃতি নেই। শুধু পার্থক্য হচ্ছে এটুকুই যে বোর্নের স্মৃতিগুলো উপড়ে ফেলেছিল অন্যেরা, আর আমারগুলো করেছি আমি। সে কারণেই হয়তো শৈশব কৈশোর নিয়ে আমার হাহাকারটুকুও অনেকের চেয়ে অনেক বেশি। একটা আনন্দময় শৈশবের জন্য, একটা দুরন্ত কৈশোরের জন্য, একটা স্বপ্নময় তারুণ্যের বিনিময়ে আমি হয়তো এই বিশাল পৃথিবীটাকেও দিয়ে দিতে পারি যে কাউকে। এই আমি, আজকের এই আমার জন্ম হয়েছে আমার জৈবিক জন্মেরও অনেক বছর পরে। অসম্পূর্ণ একজন মানুষ আমি। জীবন চক্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় সীমাহীন শুন্যতা আমার। থিকথিক করে বিশাল অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে সেখানে।

 

এতো নিষ্ঠুরভাবে উপড়ে ফেলার পরেও কেমন করে যেন কোন গহীন অতল থেকে মাঝেই মাঝেই ঝিলিক দিয়ে উঠে টুকরো টুকরো দুই একটা স্মৃতি। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মধ্যে জেগে উঠে দূর শৈশবে দেখা চিকচিকে বালু আর স্বচ্ছ কাঁচের মত জলের এক অপূর্ব নদী। পূর্ব পুরুষের গ্রাম ছুঁয়ে যাওয়া মায়াবতী নদী মধুমতি। সেই বালক বয়সের পর থেকে আর কখনোই ওই গাঁয়ে  যাওয়া হয়নি আমার। আর কখনোই দেখা হয়নি প্রিয়তম সেই নদীটির সাথে। কে জানে কেমন আছে আমার শৈশবের সেই অতি ভালবাসার নদী।

 

প্রথমবার বিদেশ থেকে দেশে ফিরে রিকশা করে আমি একা একা সন্ধ্যাবেলায় ঘুরে বেড়াতাম খিলগাঁও, মালীবাগ আর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা। প্রথমবার যখন দেশ ছাড়ি তখন জানতাম আবার ফিরে আসবো আমি। এই যাওয়া চিরদিনের যাওয়া নয়। কিন্ত প্রথমবার দেশে ফিরে গিয়েই বুঝলাম, ফেলে আসা সময়ে আর কখনোই ফিরে যাওয়া হয় না, ফিরে যাওয়া যায় না আসলে। এটাই আমার শেষ আসা। সবুজ কোমল এই অতি প্রিয় মাটিতে আর কখনো ফেরা হবে না আমার।

 

সময়ের সাথে সাথে কত দ্রুতই না পালটে যায় অনেকদিনের চেনা মানুষগুলো। কাছে থাকলে একই গতিতে নিজেও পালটানো হয় বলে বোঝা যায় না তেমনভাবে। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভূমিতে পরিবর্তনের মাত্রা হয় ভিন্ন। ফলে, সময়ের পার্থক্যে ভিন্নতাটুকু প্রকট হয়ে দেখা দেয়। একদিনের সব পরিচিত জায়গায় নিজেকেই অচেনা লাগে, অনাহুত মনে হয়। মনে হয় মৃত্যুর পরে আমার প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে সব পরিচিত জায়গায়, পরিচিত মানুষজনদের মাঝে। কিন্তু সেই চেনা মানুষেরাই আমাকে দেখছে না, আমাকে চিনছে না।

 

এরকমই একদিন খুব সন্ধ্যায় চুপি চুপি গিয়ে হাজির হই খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ঘাসবিহীন রুক্ষ মাঠে। বুকের মধ্যে দলা পাকানো জমাট কান্না নিয়ে ধূসর অন্ধকারে আমি নিথর দাঁড়িয়ে থাকি শুকনো খটখটে মাঠের পাশে। এই মাঠেই যে কেটেছে আমার শৈশব, আর কৈশোর। হোক না সে যতই অন্ধকারাচ্ছন্ন, যতই যন্ত্রণাময়। তবুওতো সে আমারই শৈশব, আমারই কৈশোর। স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থেকে বহু বছর আগের হারিয়ে যাওয়া এলোমেলো উশকো খুশকো চুলের এক দুরন্ত বালককে দেখি আমি, দেখি রোগা লিকলিকে মুখচোরা এক কিশোরকে। বিপন্ন বিস্ময়ে সেই কিশোর একদিন আবিষ্কার করেছিল যে ভুল সময়ে, ভুল গ্রহে, ভুল মানুষদের মাঝে তাকে ফেলে দিয়ে গিয়েছে দয়ামায়াহীন চরম নিষ্ঠুর কেউ একজন। জীবনের কোন অভিজ্ঞতা হবার আগেই আচমকা একদিন জেনে গিয়েছিল চরম সত্যকে সে।  জীবন বড় কৃপণতা করেছে তার সাথে, বড় অনুদার আচরণ করেছে সিন্ডারেলার বিমাতার মত। তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে পায়ে দলে এমনই এক জালে আটকে ফেলা হয়েছে তাকে, যার থেকে কোন মুক্তি নেই তার আর কোনদিন।  নেই কোন নিস্তার এই জনমে আর।

 

 

মানুষের নাকি বয়স যত বাড়ে ততই সে ফিরে যেতে চায় তার হারানো শৈশব আর কৈশোরের কাছে। যে সময়টার কোন মূল্য এক সময় ছিল না বললেই চলে, সেই সময়টাই অমূল্য হয়ে উঠে তার কাছে তখন। যে স্মৃতিগুলো অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছিল ভাঁড়ার ঘরে, সেই স্মৃতিগুলোই অনেক অনেক দামী হয়ে ফিরে আসে লিভিং রুমে। বুড়ো বয়সের একমাত্র সম্বলই যে হারিয়ে যাওয়া সব স্মৃতিমালা। এর জাবর কাটা ছাড়া আরতো কোন উপায়ই নেই কারো। কে জানে আমার মত সবাই-ই হয়তো বুকের গভীরে সযত্নে লালন করে চলে লরাদের সেই ঘাসের বনের ছোট্ট কুটিরের স্বপ্নকে।

 

ধূর ছাই! এই ডিভিডি দুটো কেনাটাই মনে হচ্ছে বিরাট ভুল হয়েছে আমার। এদের কারণেই হারিয়ে যাওয়া সব স্মৃতিরা এসে একযোগে হামলে পড়ছে আমার উপর। এতো স্মৃতির ভার সহ্য করার ক্ষমতা যে আমার নেই। এতো স্মৃতিবিধুরতাও যে আমাকে মানায় না। বড় স্মৃতিহীন মানুষ যে আমি।