ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির
ফরিদ আহমেদ
আমার বাসার পাশেই পাবলিক লাইব্রেরীর ছোট্ট একটা শাখা আছে। বই কিংবা ডিভিডির খোঁজে প্রায়শই ঢু মারা হয় ওখানে। একটা বই এনে রেখেছিলাম অনেকদিন আগে। আলসেমি করে পড়াতো হয়নি, ফেরতও দেয়া হয়নি সময় করে। প্রায়ই লাইব্রেরী থেকে ফোন আসে। আর আমি লাইব্রেরীর আইডি দেখেই ফোন অফ করে দেই। কে যায় কম্প্যুটারের কচকচানি শুনতে। তবে একদিন হুট করে হুশ ফিরলো আমার। যে পরিমাণ জরিমানা হচ্ছে বইটা বেশিদিন আটকে রাখার ফলে তা দিয়েতো আমি ওই বইটা কিনেই ফেলতে পারতাম। বোধিজ্ঞান হবার সাথে সাথেই বই ব্যাগে ভরে বিদ্যুৎ গতিতে বের হলাম আমি। বই ফেরত দিয়ে লাইব্রেরীর দরজার ঠিক বাইরে বিক্রির জন্য রাখা বইগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। এই লাইব্রেরীটা কিছুদিন পরপরই খুব স্বল্পমূল্যে কিছু বই বিক্রি করে থাকে। বেশিরভাগ যদিওবা ফিকশন ধরনের। অনেকসময় হুটহাট করে খুব ভাল বইও পেয়ে যাওয়া যায়। ভাল কোন বই পেলে আমি প্রায়শই কিনে ফেলি। পয়সা বাঁচানোর খুব সহজ রাস্তা এটা। একবার হিলারী ক্লিনটনের লিভিং স্টোরী বইটা কিনেছিলাম মাত্র সিক্সটি নাইন সেন্টস দিয়ে।
বইগুলোতে চোখ বুলোতে বুলোতে হঠাৎ করে শেলফের নীচের তাকে চোখ গেলো। মুহুর্তের মধ্যে যেন জমে গেলাম আমি। সমস্ত শরীরে অজানা শিহরণ বয়ে গেল। নীচের শেলফে খুব নিরীহ ভঙ্গিতে শুয়ে আছে আমার কৈশোরের এক টুকরো স্মৃতি। গভীর ভালবাসায় আমি স্মৃতিটুকুকে তুলে নিয়ে বুকের কাছে আনি। মমতার হাত বুলোই সারা গায়ে। সাথে নিয়ে কাউন্টারে চলে আসি আমি। আমার হাতে লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরীর ডিভিডি দুটো দেখে কাউন্টারের মহিলারও চোখ দুটোও স্বপ্নিল হয়ে উঠে। হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে বলে ‘আমার অসম্ভব প্রিয় একটা সিরিজ’। আমি বলি, ‘আমারও। খুব ছোটবেলায় দেখেছি’। পাশেই অল্পবয়েসি আরেকটা মেয়ে ছিল। সে বেশ অবাক হয়ে বললো, ‘কোথায় দেখেছো?’ বললাম যে, ‘দেশে থাকতে টিভিতে দেখেছি’। মেয়েটা অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘এটা তোমাদের টিভিতে দেখাতো’। বেশ একটা ভাব নিয়ে গর্বিত হাসি উপহার দেই ওকে। দুই ডলারে দুটো ডিভিডি কিনে বাসার দিকে রওনা দেই আমি। চারপাশে কত লোক। অথচ কেউ জানতেও পারে না যে, কত তুচ্ছ পয়সা দিয়ে আমি কিনে নিয়েছি আমার বহু বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের এক টুকরো সোনালী স্মৃতিকে।
প্রথম প্রকাশিত হবার সময়কার প্রচ্ছদ
বাংলাদেশের টেলিভিশনে লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরী কবে দেখিয়েছে? বিরাশি না তিরাশি সালে? কিছুতেই মনে করতে পারছি না এখন আর। আমার স্মৃতিশক্তি এমনিতেই দুর্বল। কৈশোরের প্রায় সব স্মৃতিই ফিকে হয়ে গিয়েছে। অবশ্য সেখানে আমার ইচ্ছাকৃত অবদানও আছে অনেকখানি। নিজে নিজেই আমি মুছে দিয়েছি আমার অনেক অনেক স্মৃতি। ভয়ংকর শক্ত দেয়াল তুলে কবর চাপা দিয়েছি সেগুলোর। ছোট্ট একটা চৌদ্দ ইঞ্চি সাদাকালো নিক্কন টেলিভিশন ছিল আমাদের। ভাষাগত সীমাবদ্ধতায় সেই কৈশোরে অনেক কিছুই বুঝতাম না ছবিটার। তারপরেও ইঙ্গাল পরিবারের সুখ দুঃখ আনন্দের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে যেতে কোন বাধাই টের পেতাম না।
লরা ইঙ্গালস তার শৈশব কাটিয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকার মিডওয়েষ্টে। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লরা ১৯৩২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এই এক দশকে লিটল হাউজ সিরিজের আটখন্ড গ্রন্থ রচনা করেন। এর তিন নম্বরটার নাম ছিল লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরী। এই বইগুলোর ভিত্তিতেই ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী নয় বছরে এনবিসি টেলিভিশনে খন্ড খন্ড ভাবে চলচ্চিত্রায়ন করা হয়। পারিবারিক টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে সত্তুর এর দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল হিসাবে জায়গা করে নেয় লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরী। শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টেলিভিশনে দেখানো হতে থাকে ছবিটি। ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে এটি।
httpv://www.youtube.com/watch?v=bhHrOgOkXZw
লিটল হাউজ সিরিজের দুটো অনুবাদ করা বই পড়েছি আমি। কীভাবে কীভাবে যেন সেই কৈশোরে হাতে এসে গিয়েছিল আমার। টিভি সিরিজ দেখার আগে পড়েছিলাম বই দুটো নাকি পরে সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। দুর্দান্ত কাব্যিক নাম ছিল দুটো বইয়েরই। লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরীর অনুবাদ করেছিলেন আতোয়ার রহমান, ‘ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির’ নামে। আর অন দ্য ব্যাংকস অব প্লাম ক্রীক এর অনুবাদ করেছিলেন জাহানারা ইমাম। নাম ছিল ‘নদীর তীরে ফুলের মেলা’।
শৈশব আর কৈশোরের সুখ স্মৃতিই নাকি মানুষের শ্রেষ্ঠতম স্মৃতি। যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তার জীবনের সেরা সময় কোনটা। মোটামুটি সকলেই বলবে যে তাদের শৈশব অথবা কৈশোর। এদিক দিয়ে আমি ব্যতিক্রম। আমার শৈশব, কৈশোর এবং প্রথম তারুণ্য বলে কিছু নেই। যা কিছু আছে তাকে সুখের স্মৃতি হিসাবে বিবেচনা করা যায় না কিছুতেই। তমস্যাচ্ছন্ন সেই শৈশব, কৈশোর আর প্রথম তারুণ্যকে তাই আমি তিমিরের হাতেই তুলে দিয়েছি। খুব খুব সচেতনভাবে স্মৃতিগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে উপড়ে ফেলেছি আমি। এদিক দিয়ে জেসন বোর্ন এর সাথে আমার মিল রয়েছে। তার মতই একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে আমার কোন স্মৃতি নেই। শুধু পার্থক্য হচ্ছে এটুকুই যে বোর্নের স্মৃতিগুলো উপড়ে ফেলেছিল অন্যেরা, আর আমারগুলো করেছি আমি। সে কারণেই হয়তো শৈশব কৈশোর নিয়ে আমার হাহাকারটুকুও অনেকের চেয়ে অনেক বেশি। একটা আনন্দময় শৈশবের জন্য, একটা দুরন্ত কৈশোরের জন্য, একটা স্বপ্নময় তারুণ্যের বিনিময়ে আমি হয়তো এই বিশাল পৃথিবীটাকেও দিয়ে দিতে পারি যে কাউকে। এই আমি, আজকের এই আমার জন্ম হয়েছে আমার জৈবিক জন্মেরও অনেক বছর পরে। অসম্পূর্ণ একজন মানুষ আমি। জীবন চক্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় সীমাহীন শুন্যতা আমার। থিকথিক করে বিশাল অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে সেখানে।
এতো নিষ্ঠুরভাবে উপড়ে ফেলার পরেও কেমন করে যেন কোন গহীন অতল থেকে মাঝেই মাঝেই ঝিলিক দিয়ে উঠে টুকরো টুকরো দুই একটা স্মৃতি। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মধ্যে জেগে উঠে দূর শৈশবে দেখা চিকচিকে বালু আর স্বচ্ছ কাঁচের মত জলের এক অপূর্ব নদী। পূর্ব পুরুষের গ্রাম ছুঁয়ে যাওয়া মায়াবতী নদী মধুমতি। সেই বালক বয়সের পর থেকে আর কখনোই ওই গাঁয়ে যাওয়া হয়নি আমার। আর কখনোই দেখা হয়নি প্রিয়তম সেই নদীটির সাথে। কে জানে কেমন আছে আমার শৈশবের সেই অতি ভালবাসার নদী।
প্রথমবার বিদেশ থেকে দেশে ফিরে রিকশা করে আমি একা একা সন্ধ্যাবেলায় ঘুরে বেড়াতাম খিলগাঁও, মালীবাগ আর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা। প্রথমবার যখন দেশ ছাড়ি তখন জানতাম আবার ফিরে আসবো আমি। এই যাওয়া চিরদিনের যাওয়া নয়। কিন্ত প্রথমবার দেশে ফিরে গিয়েই বুঝলাম, ফেলে আসা সময়ে আর কখনোই ফিরে যাওয়া হয় না, ফিরে যাওয়া যায় না আসলে। এটাই আমার শেষ আসা। সবুজ কোমল এই অতি প্রিয় মাটিতে আর কখনো ফেরা হবে না আমার।
সময়ের সাথে সাথে কত দ্রুতই না পালটে যায় অনেকদিনের চেনা মানুষগুলো। কাছে থাকলে একই গতিতে নিজেও পালটানো হয় বলে বোঝা যায় না তেমনভাবে। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভূমিতে পরিবর্তনের মাত্রা হয় ভিন্ন। ফলে, সময়ের পার্থক্যে ভিন্নতাটুকু প্রকট হয়ে দেখা দেয়। একদিনের সব পরিচিত জায়গায় নিজেকেই অচেনা লাগে, অনাহুত মনে হয়। মনে হয় মৃত্যুর পরে আমার প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে সব পরিচিত জায়গায়, পরিচিত মানুষজনদের মাঝে। কিন্তু সেই চেনা মানুষেরাই আমাকে দেখছে না, আমাকে চিনছে না।
এরকমই একদিন খুব সন্ধ্যায় চুপি চুপি গিয়ে হাজির হই খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ঘাসবিহীন রুক্ষ মাঠে। বুকের মধ্যে দলা পাকানো জমাট কান্না নিয়ে ধূসর অন্ধকারে আমি নিথর দাঁড়িয়ে থাকি শুকনো খটখটে মাঠের পাশে। এই মাঠেই যে কেটেছে আমার শৈশব, আর কৈশোর। হোক না সে যতই অন্ধকারাচ্ছন্ন, যতই যন্ত্রণাময়। তবুওতো সে আমারই শৈশব, আমারই কৈশোর। স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থেকে বহু বছর আগের হারিয়ে যাওয়া এলোমেলো উশকো খুশকো চুলের এক দুরন্ত বালককে দেখি আমি, দেখি রোগা লিকলিকে মুখচোরা এক কিশোরকে। বিপন্ন বিস্ময়ে সেই কিশোর একদিন আবিষ্কার করেছিল যে ভুল সময়ে, ভুল গ্রহে, ভুল মানুষদের মাঝে তাকে ফেলে দিয়ে গিয়েছে দয়ামায়াহীন চরম নিষ্ঠুর কেউ একজন। জীবনের কোন অভিজ্ঞতা হবার আগেই আচমকা একদিন জেনে গিয়েছিল চরম সত্যকে সে। জীবন বড় কৃপণতা করেছে তার সাথে, বড় অনুদার আচরণ করেছে সিন্ডারেলার বিমাতার মত। তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে পায়ে দলে এমনই এক জালে আটকে ফেলা হয়েছে তাকে, যার থেকে কোন মুক্তি নেই তার আর কোনদিন। নেই কোন নিস্তার এই জনমে আর।
মানুষের নাকি বয়স যত বাড়ে ততই সে ফিরে যেতে চায় তার হারানো শৈশব আর কৈশোরের কাছে। যে সময়টার কোন মূল্য এক সময় ছিল না বললেই চলে, সেই সময়টাই অমূল্য হয়ে উঠে তার কাছে তখন। যে স্মৃতিগুলো অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছিল ভাঁড়ার ঘরে, সেই স্মৃতিগুলোই অনেক অনেক দামী হয়ে ফিরে আসে লিভিং রুমে। বুড়ো বয়সের একমাত্র সম্বলই যে হারিয়ে যাওয়া সব স্মৃতিমালা। এর জাবর কাটা ছাড়া আরতো কোন উপায়ই নেই কারো। কে জানে আমার মত সবাই-ই হয়তো বুকের গভীরে সযত্নে লালন করে চলে লরাদের সেই ঘাসের বনের ছোট্ট কুটিরের স্বপ্নকে।
ধূর ছাই! এই ডিভিডি দুটো কেনাটাই মনে হচ্ছে বিরাট ভুল হয়েছে আমার। এদের কারণেই হারিয়ে যাওয়া সব স্মৃতিরা এসে একযোগে হামলে পড়ছে আমার উপর। এতো স্মৃতির ভার সহ্য করার ক্ষমতা যে আমার নেই। এতো স্মৃতিবিধুরতাও যে আমাকে মানায় না। বড় স্মৃতিহীন মানুষ যে আমি।
যদি কখনো ভুলে যাও আমপাকা বৈশাখ
এলোমেলো পথ হাটা, গাঁয়ের মেঠো পথ,
স্মৃতির আ-ড়া-লে যদি হারায় সবি-
চলে এস মোর কাছে, আমি দেখাব
শৈশব, শৈশব, সেই প্রিয় শৈশব… জেমসের এই গানের মত ফরিদ ভাইয়ের লেখা ছুয়ে গেল হৃদয়। পৌষের শিশির ভেজা সকালে ভাপ উঠা গরম ভাপা পিঠা, ধান ক্ষেতের আল ধরে ঘুড়ি হাতে ভোঁ দৌড়, বর্ষার দুরন্ত দুপুরে সাঁতরে নদী পার হওয়া কিম্বা বিকেলের পড়ন্ত রোদে গোল্লাছুট। কখনো কখনো দিনমান বাটুল হাতে ছুটে বেড়ানো পাখির পিছে পিছে। নষ্টালজিয়া… কম বেশী সবার কাছে শৈশব মানেই এমন সোনায় মোড়ানো সব স্মৃতি। কিন্তু আপনার স্মৃতিগুলো আপনাকে আনন্দ দেবার বিপরীতে হামলে পড়ছে আপনার উপরে! একটু মন খারাপ হয়ে গেলো শেষটা পড়ে। ভালো থাকবেন।
সৈকত চৌধুরী,
তানভীকে চাচা হবার কুফল আমিই ব্যাখ্যা করে ভয় দেখিয়েছিলাম, উনি তারপর থেকে মামুতেই সন্তুষ্ট। আর মামা কথাটি চাচা থেকে মনে হয় শ্রুতিমধুর, চাচাবাড়ির আবদার বলে তো কিছু নেই। যত আবদার মামার কাছেই।
ছোটবেলার এই দিনগুলোয় ফিরে যেতে কে না চায়? তবে এখন মনে হয় যা চলে গেছে তাকে ফেরানোর চেষ্টা না করাই মনে হয় ভাল। তার থেকে সেইসব সোনালী দিনগুলি স্মৃতিতে সোনালী হয়ে থাক।
ফরিদ ভাই,
অসংখ্য ধণ্যবাদ এই প্রিয় সিরিজ়টার কথা মনে করিয়ে দেওয়ায়। আমার মনে আছে অন্তত ৮১-৮২ সালের কিছুদিন এটা দেখানো হত, খুব সম্ভবত সোমবার বিকেলে। আমিও সেসময় ইংরেজী তেমন কিছুই বুঝতাম না, তাই মারামারি দাঙ্গাহাঙ্গামা ছাড়া তেমন কিছুই ভাল লাগত না। কিন্তু এ সিরিজ়টা দেখতাম, বাবা বড় বোনদের কথাবার্তা থেকে কিছু কিছু বুঝতে চেষ্টা করতাম। মন হয় ইঙ্গেলস পরিবারের সহজ সরল জীবন আকর্ষন করত।
তবে এখানকার লাইব্রেরীতে এ জাতীয় বেশীরভাগ পুরনো টিভি সিরিজই পাওয়া যায়। অর্ল্যান্ডোর লাইব্রেরীতে প্রায়ই দেখতাম। সেসময়ের মাপেট শো, সিসেম ষ্ট্রীট, ব্রেডিস বাঞ্ছ এর কথাও খুব মনে পড়ে। সে আমলে আসলে টিভি ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম, তাই মনে হয় আমাদের মাঝে সে সময়কার টিভি সিরিজগুলো গভীর ছাপ ফেলে আছে।
আমি এর আরেকটি বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম “ছোট্ট শিশুর গল্প শোনা”, কার লেখা আজ আর মনে নেই। মন্দ ছিল না।
শৈশব স্মৃতিচারন আমারো খুব প্রিয় অভ্যাস। তবে আজকাল আরেকটু বাস্তববাদী হয়েছি সাথে, কারন অনেকটা আপনার মতই বুঝতে পেরেছি যে শৈশব স্মৃতিচারন মনে হয় মনে হয় মনে মনে করাই ভাল, তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলে সেই সুখস্মৃতিই হয়ত ফিকে হতে থাকে।
@আদিল মাহমুদ,
বাংলাদেশে এখন সিসেমি স্ট্রিট এর মতই USAID এর অর্থায়নে ছোটদের জন্য সিসিমপুর নামে একটি প্রোগ্রাম হয়।দারুন একটা অনুষ্ঠান( আমার মত ধামড়া পোলা ও ঐ অনুষ্ঠানের অন্ধ ভক্ত 😀 !! তবে গত এক বছর একটু কম দেখা হয়) । সারা যাকের,মুস্তফা মনোয়ার ,মুহম্মদ জাফর ইকবাল এরকম গুনী মানুষেরা এই অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে একে দারুন একটা রূপ দিয়েছেন( ক্লাস টেন আর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার আমি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাসায় এসে দুপুর আড়াইটায় বিটিভি ছেড়ে বসে থাকতাম শুধু এই প্রোগ্রাম দেখার জন্য!! 😀 )
আর প্রেইরি সিরিজের বইএর কথা পড়ে এর মাঝে লোডশেডিং এ আমার নিজের বই গুলো ঘাটতে গিয়ে,প্রেইরি সিরিজের মত আমার আরেকটা প্রিয় বই আরন্যক চোখে পড়ে গেল। এটাও আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মত আকর্ষন করে। দারুন একটা বই।প্রেইরি র বই গুলোর মত এতেও আছে সরল জীবন,আকর্ষনীয় মন্ত্রমুগ্ধ পরিবেশের অপার সৌন্দর্যের দারুন বর্ণনা। বিভূতিভূষন মানেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য,যা শুধু আকর্ষনই করে না,পাঠককে টেনে নিয়ে যায় একদম বর্ণনা স্থলে।
অসাধারন একটি বই। মামুর পরা না থাকলে পড়ে নিতে পারেন।
পাগল হয়ে যাবেন।বিভুতির প্রেমে পড়ে যাবেন, গ্যারান্টি দিচ্ছি।(!!) 😀
@তানভী,
ঘটনাচক্রে কালই আমাদের বাড়ির কাছের একটি ছোট মিউজিয়মে গেছিলাম, সেখানে ১৫০ বছর আগের একটি ছোট পাড়া সে আমলের আদি কয়েকটি বাড়ি জিনিসপত্র সমেত প্রায় একই রকম রেখে দিয়েছে। দেখলে মনে হয় বাড়ির লোকেরা সব রেখে মাত্র কোথাও গেছে, এখনই এসে আবার কাজ শুরু করবে। অনেকটাই সে আমলের আমেজ অনুভব করা যায়। এমনকি একটা জেনারেল ষ্টোরও দেখলাম। কি সরল জীবন, তবে প্রতিপদে কঠিন কায়িক শ্রম। শুধু বাথরুমের ব্যাবস্থায় তেমন খুশী হওয়া যায় না এই আর কি।
আরন্যক, চাদে অভিযান (ঠিক নামটা মনে করতে পারছি না, কি আজব) বহু আগেই মামুর পড়া হয়েছিল, আসলেই প্রকৃতির বর্ণনায় বিভূতির তূলনা নেই। স্কুলে থাকতেই কোন পাজী যেন বইটা মেরে দেয়। এই আমলে বুদ্ধদেব গূহ বেশ প্রকৃতিওয়ালা বই লেখেন, তবে ওনার বর্ণনা কেমন যেন নীরস লাগে।
@আদিল মাহমুদ,
তানভীর চাচা হতে রাজি হন নি। কিন্তু মামা হতে গিয়ে উভয়টাই হারালেন বোধহয় :-)) । মামা শব্দটি শুনলেই আমার কিন্তু আবার মামাবাড়ি মানে ছেলেবেলার কথা স্মরণ হয়ে যায়।
ফরিদ ভাইয়ের লেখাটায় যে ব্যাকুলতা ফুটে উটেছে তা অনেকটাই আমাকে ছুঁয়ে গেল। শৈশবে সবাই ফিরে যেতে চায় কিন্তু টিক কেন যেন আমি চাই না।
@আদিল মাহমুদ,
বইটার নাম চাঁদের পাহাড়। কালকে মাত্র কিনে আনলাম কিনা! তাই ভুলিনি। 😀
আমি বিভূতি পড়ে তার বইয়ের মত প্রকৃতিপ্রেমী অন্য লেখকের বই খুঁজে পড়েছিলাম(আসলে আরন্যক বইটার ভূমিকাতেই বইটার কথা দেয়া ছিল) বই টার নাম প্যন। নরওয়ের লেখক নূট হামসুনের লেখা।নোবেল পাওয়া বই। ভূমিকাতে বইটার অনেক গুন গাওয়া হয়েছিল।তাই কিনে পড়া শুরু করেছিলাম।কিন্তু পড়ে দেখি কিসের সাথে কি! বিভূতি নূট হামসুন থেকে অ অনেক উপরে। নুট হামসুনের বর্ননা নিরস ঃ-( ।কোন সময়ই যোগ্য লোকেরা যোগ্য পুরস্কার পায় না।
মামা!! দারুন!
শৈশবকাল আমার শ্রেষ্ঠ সময় অবশ্যই। আপনি না পাওয়ার বেদনায় কাঁদেন,আর আমি পেয়েও হারিয়ে ফেলার বেদনায় কাঁদি( ধরে তো রাখতে পারি না! তাই কান্নাই ভরসা)
যাই হোক বই দুটো আমিও পড়েছি,সেবা প্রকাশনীর অনুবাদে। কিশোর ক্লাসিকে রূপ দিতে গিয়ে তারা অঅনেক কাট ছাট করে ফেলেছে,তবুও সেবা প্রকাশনীর অনুবাদে মূল সুর টা ঠিক থাকে বলে পড়ে আমিও ওই প্রেইরিতে হারিয়ে গেছি।
দারুন বই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এইযে আমর সিরিয়াল টা দেখতে পাইনি,এবং আরো দুঃখের বিষ্য এইযে বিটিভি এখন আগের মত সুন্দর সব সিরিয়াল দেখায় না বললেই চলে । মাঝে তাও আলিফ লায়লা দেখিয়েছিল(!!)। এখন তাও দেখায় না।
শ্রদ্ধেয় জাহানারা ইমাম কর্তৃক অনুবাদকৃত বইটি কোন প্রকাশনীর কেউ জানাতে পারবেন কি?
@তানভী (মামু),
সেবা থেকে এর অনুবাদ বেরিয়েছে জানতাম না, নাম কি? আনাতে চেষ্টা করব। সেবার অনুবাদ আমার মতে বাংলা ভাষায় বেষ্ট। একই বই এর অন্য অনুবাদ এমনকি ভারতীয় অনুবাদও পড়ে দেখেছি, সেবার কাছে কিছুই লাগে না।
আমার কৈশোর স্মৃতির মাঝে সেবা একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। আজকাল আর সেই দিন নেই, তবে আমাদের সময় সেবা যে কিভাবে একই বাড়ির দাদা, বাবা মা, ভাই বোনকে যাদুমন্ত্রের মত বেধে রাখত তা দেখেছি। স্কুলে বাড়িতে কত বড় ঝামেলায় পড়েছি সেবার বই নিয়ে। তবে আমার মনে হয় নেহায়েত গল্প ছাড়াও সেবার বই থেকে অমূল্য অনেক কিছু শিখেছি। এক সময় সেবার প্রায় সব বই ছিল, হাতে টাকা পেলেই ছুটির দিনে নীলক্ষেত আর বাংলাবাজারের ফুটপাথ ঘুরে ঘুরে খুজতাম। এখনো দেশে গেলে বাক্স ভরে নিয়ে আসি।
আশা করি ভাগ্নে অপ্রাপ্ত বয়সে আলীফ লায়লা পড়ে ফেলেননি, জানি সেবার ৭ খন্ডে সেই অনুবাদও আছে।
@আদিল মাহমুদ,
এটা একদম ১০০% সত্যি কথা যে সেবার অনুবাদ বাংলাদেশের সেরা। অন্য গুলা চরম বিরক্তিকর লাগে মাঝেমাঝে। সেবার গুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়।
এখন অনেক নতুন নতুন থ্রিলার অনুবাদক গজিয়েছে যারা অনুবাদের নাম করে সেবার মাসুদ রানা থেকে মেরে দেয়( চোরের উপর বাটপারি!!)
বই গুলার নাম ইংরেজি নামেই রেখে দেয়া হয়েছে। তবুও দিয়ে দিলাম। এই সিরিজের চারটা বইএর অনুবাদ সেবা থেকে এসেছে।
১-অন দ্য ব্যাঙ্কস অভ প্লাম ক্রীক।
২-লিটল টাউন অন দ্য প্রেইরী।
৩-ফার্মার বয়।
৪-লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরী।
তবে এগুলোকে কিশোর ক্লাসিক সিরিজের জন্য রূপ দিতে গিয়ে বেশ ছোট করে ফেলা হয়েছে আমার মনে হয়( যদিও আমি আসল ইংরেজি বই গুলো দেখিনি)
আর সেবার বই কলেজের ক্লাসটাইমে ক্লাসে বসে পড়তে পড়তে এমন অবস্থা হয়েছিল যে কেউ আমাকে সেবার বই ছাড়া কল্পনাই করতে পারতো না!
আলিফ লায়লা ছোট বেলাতেই পড়েছি ,তবে সেবার টা না।ছোটদের জন্য অনূদিত কোন এক প্রকাশনীর বই।
সেবার টা পড়ার সুযোগ এখনো হয় নি। যখন বলেছেন,তাহলে পড়েই দেখবো এবার! 😀
@তানভী,
ধণ্যবাদ, বইগুলি নোট করে নিলাম। দেখি চেষ্টা তদবির করে আনানো যায় কিনা।
সেবার বই এর ঠেলায় আমি আর অন্য কোন বই ই প্রায় পড়তাম না, এমনি সুনীল, শীর্ষেন্দ্ হুমায়ুন আহমেদ এদের লেখাও ধরেছি অনেক পরে। আমি আরেকটু ভাগ্যবান কারন কাজী সাহেবের সাথে তার বাড়িতে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে কবার, আমার পরিবারের এক সদস্য সেবা থেকে একসময় কিছু বই লিখেছিলেন সে সুবাদে। অনবদ্য এক ব্যক্তিত্ত্ব এই কাজী সাহেব। মাসুদ রানার প্রথম ১০০ টা, জুলভার্নের বইগুলি, কিছু পুরনো উপন্যাস এখনো কিছুদিন পর পরই পড়ি। সাহিত্যের মান কি আছে না আছে সেসব আতেল বিচারের পরোয়া করি না। মাসুদ রানা প্রথম পড়েছিলাম ৫ এ থাকতে, তারপর আর থামিনি, যদিও নুতনগুলো ভাল লাগে না।
আমিও ক্লাস ৪ এ প্রথম ছোটদের আরব্য উপন্যাস পড়ি, ভালই লেগেছিল তখন রুপকথা হিসেবে পড়তে। যদিও খোজা নফর জাতীয় ব্যাপার স্যাপারের আসল মাজেজা তখন বুঝতে পারিনি। বলাই বাহুল্য বড় হবার পরে আর পড়ার উতসাহ পাইনি। ৯৭/৯৮ এর দিকে দেখতাম এটা আর এ জাতীয় বেশ কিছু সিরিজ টিভীতে দেখাচ্ছে, পাবলিকে সন্ধ্যাবেলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখছে।
ফরিদ,
অতি পুরাতন কথা আবার নতুনও, শৈশব স্মৃতি বেদনাময় এবং মধুরও। ফিরে পেতে ইচ্ছে করে, অথচ অসম্ভব। আমার এ জ্বলুনী থেকেই তখন ও এখন লেখা।
কিন্তু তোমার ব্যথার জায়গাটি কিন্তু ধরতে পারলাম না, ফরিদ।
@গীতা দাস,
খোলসা করেতো কিছু বলিনি দিদি। ধরবেন কি করে?