প্রথম পর্ব

রাষ্ট্র মানেই একটা নাম থাকে, একটা পতাকা থাকে,একটা মানচিত্র থাকে, লিখিত হোক বা অলিখিত হোক একটা সংবিধান থাকে, জাতীয় সংগীত থাকে ।
বিশ্বকাপ ফুটবলে দেখেছি খেলার আগে অংশগ্রহণকারী দেশের জাতীয় সংগীত গায় সে দেশের পাতাকা নিয়ে। অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় দেখেছি কোন দেশের প্রতিযোগী জয়ী হলে সে দেশের পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। নিজের দেশের প্রতিযোগীর জয়ী হবার তেমন সাক্ষী হতে না পারলেও অন্য দেশের খেলোয়ারদের আবেগে আপ্লুত মুখমন্ডল দেখে ঐ সব দৃশ্য অনেকের মতো আমাকেও আলোড়িত করে। অনেক সময় চোখের কোণায় জলও অনুভব করি।
সেখানে ভূখন্ড না গেলেও রাষ্ট্র যায়,দেশ যায়। সরকারও যায়। কারণ সেখানে নিয়ম কানুন আছে। খেলোয়াররা সুশৃঙ্খল থাকে। নিজের আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অনুগত থাকে। খেলোয়ারের নিজের থেকে নিজের রাষ্ট্রকে – নিজের দেশকেই সমুন্নত করা হয়।অলিম্পিকে কে শব্দটির চেয়ে কোন দেশ কয়টি সোনা জিতল — এ খবরই প্রাধান্য পায়। কাজেই এ বিষয়ে দেশের মুখকে উজ্জ্বল — সমুজ্জ্বল করা হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়।
ছোটবেলায় পৌরনীতিতে পড়েছি চারটি উপাদান নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত। সেগুলো হলোঃ নির্দিষ্ট ভূখন্ড(যা মানচিত্রে প্রতিফলিত),সরকার, জনগোষ্ঠি ও সার্বভৌমত্ব।যে কোন রাষ্ট্রের এ চারটি উপাদান থাকতেই হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের কি নেই বা থাকা উচিত নয় তা বলা হয়নি।
কোন এক রাষ্ট্র বিজ্ঞানীর মতে রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ধারণা। আমি সে সব তাত্ত্বিক আলোচনায় যাবার মতো যোগ্যতা রাখি না। আমার মতে, রাষ্ট্রের নেই এবং থাকাও উচিত নয় নির্দিষ্ট—ধর্ম,ভাষা, লিঙ্গ, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি, রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দল।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমার রাষ্ট্রের ধর্ম আছে। জন্মের সময় ছিল না। আমার রাষ্ট্রকে ১৯৮৮ সালে ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে খৎনা করিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতা থেকে ধর্মামান্তরিত করা হয়েছে। ধারাঃ ‘২।ক । প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’

যে নীতিতে, যে আদর্শে, যে শর্তে, যে অনুপ্রেরণায় এবং যার জন্যে এ দেশের সব ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি যুদ্ধ করেছিল — প্রাণ দিয়েছিল তা থেকে সরে এসে আরোপিত হলো নতুন লেবাস। অবশ্য ১৯৭৭ সালেই বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জন্মের পরিচয়কে মুছে ফেলা হলো।
প্রস্তাবনা শুরু হলো ‘ বিসমিল্লাহির- রহমানিও রহিম ( দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে)’

এবং প্রস্তাবনায় সংযোজিত হলোঃ “আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে,যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্ধুদ্ধ করিয়াছিল সর্বশক্তিম্মান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;”
১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল” ১৯৭২ সালের প্রস্তাবনায় ছিলঃ“আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে,যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্ধুদ্ধ করিয়াছিল – জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;”

তবে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে ১৯৭২ সালেও রাষ্ট্র ধর্ম থেকে দূরে থাকেনি। তখনও রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার মূল অর্থ থেকে দূরে ছিল। উপরন্তু তখনকার সরকার প্রধান ইসলামী সম্মেললে যোগ দিয়েছিল। শুধু ১৯৭৮ সালে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন’ অনুচ্ছেদে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল ধারা ২৫।(২) “রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত,সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।
১৯৭৮ সালের আগেই অর্থাৎ ১৯৭৫ এর আগের সরকার সংবিধানের সংশোধন না করেও মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত,সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট ছিল।
রাষ্ট্রকে যখন ধর্মামান্তরিত করা হয় তখন অন্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠি ছিল প্রায় ১৩%। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ১৩% খুবই নগণ্য হলেও মানবাধিকারের প্রশ্নে অগ্রগন্য হওয়া উচিত।
অনেকেই বলেন রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হওয়াতে সংখ্যালঘুদের কী সমস্যা হয়েছে ? ইসলামী প্রজাতন্ত্র তো আর করা হয়নি?
শুধু কী নয় — কী কী সমস্যা হচ্ছে এর সুদীর্ঘ তালিকা তৈরি করা যায়।
আমার পালটা প্রশ্ন — রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম না হলে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের কী কী সমস্যা হতো ?
আমার এ প্রশ্নের কী কোন প্রগতিশীল ও ইতিবাচক উত্তর আছে!

জন্ম থেকেই আমার রাষ্ট্র যে অপবাদ নিয়ে শুরু করে তা হলো ভাষা। বাঙালী ছাড়া অন্য প্রায় ৪৪ টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির বাংলা ছাড়া ৩৯টি ভাষার (মতান্তরে) অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের ভাষা হলো বাংলা। বাঙালী ছাড়া অন্য জনগোষ্ঠির শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষা শুরুর কোন সুযোগ রাষ্ট্র দেয়নি। ধারাঃ “৩। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা।”

আমাদের সংবিধানে জাতীয় সংস্কৃতি বলতে বুঝায় বাঙালী সংস্কৃতি। আমার দেশের সংবিধানের ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ অনুচ্ছেদের ধারাঃ ২৩। রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সু্যোগ লাভ করিতে পারেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে জাতীয় ভাষা ও সাহিত্য বলতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকেই এবং জাতীয় সংস্কৃতি বলতে বাঙালী সংস্কৃতিকেই বুঝানো হয়েছে। যদিও ১৯৭৮ সালে ‘নাগরিকত্ব’ অনুচ্ছেদের ধারা ৬কে ভাগ করে ১ও ২ উপধারা বানিয়ে ২ এ বাঙালীর পরিবর্তে নাগরিকদের বাংলাদেশী পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়েছেন। জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাংলাদেশী বানানো যে ছিল এক রাজনৈতিক চালবাজি ;পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি সৃষ্টিই তা প্রমাণ করে।
বর্তমান ট্যাকনোক্র্যাট আইনমন্ত্রী সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে সচতুরতার সাথে বলেছেন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলেও বিসমিল্লাহির- রহমানিও রহিম পরিবর্তন হবে না।
১৯৭২ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে সংবিধান স্ফীত হয়েছে। সব সরকারেরই সংবিধান মোটাতাজাকরণ নীতি ছিল। ধর্ম, ভাষা ও জাতীয়তার এ বৈষম্য দূর করার মতো কোন রাষ্ট্র নায়কের আবির্ভাব বাংলাদেশে এখনো হয়নি। এ জন্মে সে নেতার দেখা পাবার সম্ভাবনা নেই। আমার পরবর্তী প্রজন্মও পাবে না বলেই আমার হতাশা।
-চলবে-