সংবিধান ও ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি
একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল প্রজা রাষ্ট্রের চোখে সমান। সেখানে কোন ধর্ম বিভেদ, ভাষা বিভেদ, অঞ্চল বিভেদ বা জাতি বিভেদ থাকতে পারে না। এটাই প্রজাতন্ত্রের মূল মন্ত্র। মুসলিম, হিন্দু, খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের যেমন রয়েছে ধর্ম পালনের অধিকার, তেমনি রয়েছে অধার্মিকদের কোন ধর্ম না পালনের। একজন মানুষের যেমন শুদ্ধ বাংলা বলার অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে আরেকজনের আঞ্চলিক ভাষা বা আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের। প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতি নীতি পালনের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের যেমন ব্যক্তি পর্যায়ের মানুষের ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রনের অধিকার নেই তেমনি রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি থাকাও উচিত নয়।
রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ, ভাষা নিরপেক্ষ এবং সংস্কৃতি নিরপেক্ষ। সংবিধানে সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্যে সচেষ্ট হতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে সকল ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা জ্ঞাপন নয় এবং রাষ্ট্রের পক্ষে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা প্রদানও সম্ভব নয়। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে বুঝায় রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা। রাষ্ট্রের কোন নিজস্ব ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্র যেমন নাস্তিকতায় মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করবে না তেমনি রাষ্ট্র অন্য ধর্ম পালনেও বিরত থাকবে। ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ যেকোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশেষ কোন ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে নিতে পারে না।
ধর্মের মত সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকে বিরত থাকা উচিত। নজরুল না রবীন্দ্রনাথ – কে হবেন আমাদের দেশের কবি এই জাতীয় তর্কের রাষ্ট্রের যাওয়া উচিত নয়। এখানেও ব্যক্তি পর্যায়ে বা বেসরকারী পর্যায়ে যে যার মত নজরুল, রবীন্দ্র, লালন জয়ন্তী করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে সমান ভাবে মর্যাদা দেওয়া সম্ভবপর নয়। এবং এইসব কারণেই জাতিতে বিভক্তি আসে। ইংরেজী, না আরবী, না বাংলা নববর্ষ উৎযাপন করা হবে এই ধরণের বিষয়ে রাষ্ট্রের নাক না গলিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। একই কথা প্রযোজ্য খেলাধুলার উপর। ফুটবল না ক্রিকেট না হাডুডু- কোন খেলায় রাষ্ট্র অগ্রাধিকার দিবে, না সকল খেলায় সমান ভাবে বা আনুপাতিক হারে সাহায্য করবে এই সব রাষ্ট্রের চিন্তা হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারই নিশ্চিত করতে পারছে না সেখানে এই সব ব্যপারে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। এর ফলে সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়, ধর্ম মন্ত্রনালয়, ক্রীড়া মন্ত্রনালয় এর মত মন্ত্রনালয়গুলোতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা নষ্ট হবার হাত হতে রক্ষা পাবে।
ভাষার ব্যাপারটি কিছুটা ভিন্ন , ধর্ম বা সংস্কৃতির তুলনায়। রাষ্টের ধর্ম বা সংস্কৃতির প্রয়োজন না থাকলেও যোগাযোগের মাধ্যমের জন্য কোন না কোন একটি ভাষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ভাষা এবং ভাষাশহীদদের অবদানের কথা বিবেচনা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের ব্যবহারের জন্য প্রথম পছন্দ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে সকল ভাষার সমান অধিকার নিশ্চিত হয় না। এ কারণে অঞ্চলভেদে যারা যার আঞ্চলিক ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। সবশেষে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজী ভাষাকে তৃতীয় পছন্দ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। এভাবে জনগণের সামনে তিনটি বিকল্পের যেকোন একটি বেছে নেবার সুযোগ থাকে।
অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন তা নয়, বিশেষ করে সংস্কৃতির ব্যাপারে। কারণ এতে দেশীয় সংস্কৃতি বা দেশীয় খেলাধুলা বা আমাদের ভাষা ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তবে আমার মতে পরিবর্তন বা বিবর্তন যদি হয়ই , তা সময়ের প্রয়োজনেই হয় এবং সেই পরিবর্তন আমি বা আপনি অস্বীকার করতে পারি কিন্তু ঠেকাতে পারবো না।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। এবার আর সুবিশাল বলছি না :)).
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে সঠিক ধারণাটা আরেকবার ব্যক্ত করার জন্য ধন্যবাদ।আমার অবাক লাগে যে দেশের স্থপতিরাও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আসলে কোন অর্থে নিয়েছিলেন?নইলে সাংবিধানিকভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশ ও,আই,সি -তে যোগ দিল কি করে?এ নিয়ে আরেকটা ব্যাপারও মনে পড়ছে।নটর ডেম -এ ছাত্র থাকাকালীন রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সন্ন্যাসীকে (বাংলাদেশের একটি মঠের অধ্যক্ষ) আমাকে বলেছিলেন যে ,ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের উচিত ছিল সংখ্যালঘু হিসেবে অনুদান চাওয়া।কারণ রামকৃষ্ণ কোন একক ধর্মের নয় এবং রামকৃষ্ণ মিশন হিন্দু সংগঠন নয়।আশা করছি বিপ্লবদা এ বিষয়ে অনেক ভালো বলতে পারবেন।কাগজে কলমে অবশ্য উনি ঠিকই বলেছিলেন বলে আমার ধারণা!
ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ খুব সম্ভবত অর্থনৈতিক সহযোগিতার আশ্বাসেই মুসলিম বনে গিয়েছিল।অবশ্য সে সময়ে সেটা অস্বাভাবিক ছিল না।সব মিলিয়েই আরব দেশগুলো তাদের ধর্মব্যবসা প্রসারিত করার আরেকটা বড় সুযোগ পেয়ে যায়।
সংস্কৃতির যেসব সংজ্ঞা পড়েছিলাম তাতে কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্র অনেক বড়, যা প্রকৃতপক্ষে পুরো জীবনযাত্রাকেই নির্দেশ করে।প্রচলিত অর্থে সংস্কৃতি বলতে সঙ্গীত-নাট্য-কাব্যকে বোঝায়।আপনি ব্যাপক অর্থে বোঝালে আরেকটু বিশদ আলচনা করতে পারতেন।নজরুলকে তাঁর সৃষ্টির জন্য জাতীয় কবি করলে দুঃখ ছিল না।আফসোস জাতীয় কবি হিসেবে তাঁর মুসলিম নামটিকে সম্মানিত করে আসলে তাঁর প্রতিভাকে চূড়ান্তভাবে অপমান করা হয়েছে।আর রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন না এটাও অনেকেই জানে না।পুর্ব বাংলায় রবীন্দ্রনাথও জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছিলেন,মুক্তিযুদ্ধে তাঁর রচনার অবদানও ভাস্বর।ষাটের দশক জুড়ে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলেছিল তা রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই।কাজেই জাতীয় কবি নির্বাচনটা ফেয়ার হলে সহজ হত না!তবে আপনার সাথে সহমত যে এ ধারণাটাই অবান্তর।আমি তো দুজনেরই ভক্ত।সমালোচনার যোগ্যতা আমার নেই।আর এটাও দেখেছি রবীন্দ্রবন্দনা বা রবীন্দ্রনিন্দা – অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফ্যাশন।নজরুলবন্দনা আজকাল বাজারে খুব চলছে। শিগগিরই নজরুলের নামেও একখানা ‘বিশ্বভারতী’র মত ঘেরাটোপ গড়ে উঠতে দেরি নেই!যে উদ্দেশ্যে রবিন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী গড়েছিলেন,তার অযোগ্য অনেক চেলা চামুণ্ডাই তার থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গেছে।
সংস্কৃতিতে কোন কিছু ঠেকানোর কোন মানে নেই।যদি আমাদের সংস্কৃতির সর্বজনীন ও সর্বকালীন কোন আবেদন থাকে তবে তা টিকবেই।তবে রাষ্ট্রীয় ভাবে দেশীয় সন্সকৃতির পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো উচিত।