ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার পর চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেছে? প্রতিবারই এরকমটা হয়- শুধু ছাত্রদল নয়, ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও। নতুন কমিটি হওয়ার পর চারদিকে সমালোচকেরা ছি ছি করতে থাকেন। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের কাণ্ডারী বা তাদের মুরুব্বিরা অবশ্য এসব ঢি ঢি বা ছি ছি-কে পাত্তা দেন না। এসবকে আমলে আনলে তো রাজনীতি করা যাবে না! ভোটের আগে ঢি ঢি বা ছি ছির প্রাবল্য বাড়লে অবশ্য ভিন্ন কথা।
তো এবার চারদিকে ঢি ঢি পড়ার কারণ কী? পত্রপত্রিকা ঘেঁটে কয়েকটি কারণ বের করা গেলো এবং আলোচনার বহর, ফ্রিকোয়েন্সি ও লেখকদের দেওয়া গুরুত্ব অনুসারে সেগুলো সাজানো হলো-
কারণ ১. নতুন কমিটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিবাহিত।
কারণ ২. কমিটির কেউ কেউ ইতোমধ্যে সন্তানের পিতা হয়েছেন।
কারণ ৩. কমিটির সভাপতি ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন।
কারণ ৪. কমিটির সদস্যদের বয়স বেশি। তারা কেউই আর তরুণ নেতা নন।
কারণ ৫. কমিটির সদস্যরা মোটামুটি আদুভাই গোছের। তারা কেউই আর ছাত্র নন।
উপরের তালিকাগুলো আমার বোধবুদ্ধিজাত নয়, সেটা আগেই পরিষ্কার করেছি। কমিটি গঠিত হওয়ার পরদিন থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আসা প্রতিক্রিয়া-মন্তব্য পড়ে কে কোন কারণটি উল্লেখ করেছেন বা কোন কারণটির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন, তা দেখে মোটামুটি এই পাঁচটি কারণ চিহ্নিত ও গুরুত্ব অনুযায়ী সাজিয়েছি। খুবই বিস্মিত হয়েছি যে,, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে সাংবাদিক মহল (ব্যতিক্রম বাদে) সবাই মোটামুটি এই ক্রমানুযায়ী বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করেছেন। কারো কারো মন্তব্যে শেষ দুটি প্রসঙ্গ একেবারেই আসে নি।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ছাত্রদলের কমিটিকে খারিজ করে দেওয়ার জন্য বা বিএনপির ভবিষ্যতে রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে (কারণ অনেকে ছাত্রদলের বর্তমান নেতৃত্বকে ভবিষ্যৎ বিএনপির জন্য বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন), সেই বিষয়টি বুঝার জন্য যে কারণগুলো উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো কারণ হিসেবে যথাযোগ্য কিনা?
*****
ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্বকে সমালোচনা করার মানসে প্রথম কারণটি যারা উল্লেখ করেছেন, তাদের এই সমালোচনার ধারা আমি একেবারেই বুঝতে পারি নি। বাংলাদেশের আইন অনুসারে, ১৮ বছর বয়স হওয়ার পর একজন নারী এবং ২১ বছর হওয়ার পর একজন পুরুষ আইনগতভাবে বিয়ের অধিকারী হন। এ সময় তিনি যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, চাইলে বিয়ে করতে পারেন। আধুনিক সংস্কৃতি, বেকারত্ব বা অন্য যে কোনো কারণে হোক, ১৮ বা ২১ বছর বয়সে লেখাপড়া করা শিক্ষিত তরুণরা সাধারণত বিয়ে করেন না বা বিয়ের প্রতি (হয়তো) খুব একটা আগ্রহ দেখান না। সেটা ভিন্ন কথা, কিন্তু কেউ যদি বিয়ে করেন এবং পাশাপাশি রাজনীতি করেন, তাহলে তাতে সমস্যা কোথায়? কোনো ছাত্রসংগঠনের গঠনতন্ত্রে কি এটা লেখা আছে যে, বিয়ে করলে ছাত্ররাজনীতি করা যাবে না? বা বিয়ে করলে কারো ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাবে? আমার জানামতে নেই। আর যদি না থাকে, তাহলে ছাত্রদলের কমিটি বা নেতৃত্বকে খারিজ করার জন্য এ প্রসঙ্গটিকে কেন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বিয়ে তো কোনো অপরাধ হতে পারে না! ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, রাষ্ট্র যদি মানুষের খাওয়া-পরার দায়িত্ব গ্রহণ করতো, তাহলে অধিকাংশ তরুণ আইনানুসারে ১৮ বা ২১ বছর বয়সেই বিয়ে করতো (আমি নিজেই ২১ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন অবশ্যই বিয়ে করতাম)। এ বয়সে মানুষের যে শারীরিক ও যৌথ জীবনযাপনের মানসিক চাহিদা গড়ে উঠে, সেটাকে নানান সমাজ-বাস্তবতায় উপেক্ষা করা হয়। এখন কোনো ছাত্রনেতা বা ছাত্রকর্মী যদি বিয়ে করেই ফেলে, তাহলে সেটিকে কেন ছাত্ররাজনীতির প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা হবে? বিয়ে করলে মানুষের কি এমন কোনো গুণ লোপ পায় যা ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে যায়? এই দুটো সামাজিক উপাদানের মধ্যে আদৌ কোনো বিরোধ আছে কি? না থাকলে সুস্থ-সুন্দর একটি সামাজিক বন্ধনকে ছাত্ররাজনীতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করা হচ্ছে কেন?
যেকোনো মূল্যে ছাত্ররাজনীতির বিরোধিতা করা আমাদের বর্তমান ফ্যাশনের অংশ। বুঝে বা না বুঝে- এক ধরনের উন্নাসিক ফ্যাশন-মনোভাব নিয়ে অনেকেই ছাত্ররাজনীতির বিরোধিতা করি। আর সেটা করতে গিয়ে এর বিরুদ্ধে দুনিয়ার যাবতীয় তর্ক-কূটতর্কগুলো হাজির করি- এসময়টায় তর্ক এবং কূটতর্কের মধ্যকার পার্থক্য বুঝার ক্ষমতাও বোধহয় আমাদের লোপ পায়। ছাত্রনেতৃত্বের বিয়ের প্রসঙ্গটি তেমনই একটি কূটতর্ক ছাড়া আর কিছু বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় না।
*****
এবার আসি সন্তানের পিতা হওয়া প্রসঙ্গে। রাজনীতির সঙ্গে বিয়ের যদি কোনো দ্বৈততা না থাকে, তাহলে সন্তান হওয়ার সঙ্গেও ছাত্ররাজনীতির কোনোপ্রকার বিরোধ না থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ এটিকেও বেশ গুরুত্ব দিয়ে রসালোভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। দুনিয়ার কোথায় এমন নিয়ম আছে যে, সন্তান হলে ছাত্ররাজনীতি করা যাবে না? সন্তান জন্ম দেওয়া তো একটি জৈবিক, সৃষ্টিশীল ও অবশ্যম্ভাবী কাজ- আর এই দারুণ কাজটি ছাত্ররাজনীতির মতো ইতিবাচক প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো কেন?
এখানেও কিছু মানুষের যুক্তির অসারবত্তা দেখা যায়। এসএসসি-এইচএসসি পাশ করার পর সাংবাদিকরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে ‘আমরা রাজনীতি বুঝি না, বুঝতে চাইও না’-জাতীয় কথাবার্তা শুনতে যান এবং পরের দিন মোটামুটি গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো প্রকাশ করেন। যে সমাজ-রাষ্ট্র চলছে রাজনীতির ভেতরে থেকে, যে মানুষের দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্ম, উন্নয়ন এবং বিকাশ রাজনীতি ছাড়া সম্ভব নয় (রাজনীতিটাকে একেবারেই সীমিত অর্থে না ধরলে), সেই সমাজ-রাষ্ট্রের রাজনীতি ‘বুঝতে চাই না’ কিন্তু মানসিক দৈন্যতারই পরিচায়ক! যারা এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তাদের অধিকাংশই রাজনীতি বিষয়টা না বুঝেই বলেন বলে মনে হয়। আর যারা এগুলো বলান বা অন্যদের বলতে প্রভাবিত করেন, সরাসরিই বলি, তাদের একটি বিরাট অংশ সমাজকে ‘বিরাজনীতিকরণ’-এর ধান্ধায় লিপ্ত- যে তথাকথিত ‘বিরাজনীতিকরণ’ স্বল্পসংখ্যক সুবিধাভোগী মানুষের আর্থিক ক্ষমতাকে বিকশিত করার হাতিয়ারস্বরূপ। ফ্যালাসিকে লজিকের মোড়কে উপস্থাপন করে চমক সৃষ্টি করা এবং সে অনুযায়ী সুবিধা ভোগ করার মতো একটি গোষ্ঠী সমাজে ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্রনেতৃত্বের সন্তান থাকার প্রসঙ্গটি সেরকমই একটি বিষয় এবং সাম্প্রতিক সময়ে সেটিকে অনাবশ্যকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে।
(এই ফাঁকে বলে রাখি, ওই ২১ বছর বয়সে বিয়ে করলে মোটামুটি বিয়ের ১০ চান্দ্রমাস ১০ দিন পর আমি সন্তানের পিতা হতামই হতাম। আহারে! আমার একটি সন্তানের শখ কতোদিনের!)
*****
তৃতীয় কারণটি সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত। ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন। ছাত্রদলের সভাপতি হওয়ার পর এটিকেও তার দোষের মধ্যে ফেলা হয়েছে। আমি যতদূর জানি, আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৫ বছর হওয়ার পর সুস্থ মস্তিষ্কের যে কেউ সংসদ নির্বাচন করতে পারেন এবং ৩৫ বছরের বেশি হলে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য লড়তে পারেন। তাহলে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর দলের সভাপতি হলে দোষ কোথায়? যারা এটাকে দোষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তারা কেউই এই ‘দোষ’-এর পক্ষে কোনো ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন নি। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন- সংসদ নির্বাচন করার পর ছাত্রসংগঠনের সভাপতি হয়েছেন, এমন উদাহরণ তারা আগে আর দেখেন নি। তাদের কাছে প্রশ্ন, দেখেন নি বলে ভবিষ্যতে দেখবেন না চিন্তা করে মনটাকে যে বদ্ধ করে রেখেছেন, সেটা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত? আমাদের দেশে একজনের ছাত্রত্ব শেষ হতে হতে মোটামুটি ২৭-২৮ বছর পেরিয়ে যায়, আর এর মাঝে কেউ ২৫ বছর বয়সে সংসদ নির্বাচন করে পরাজিত হলে পরবর্তী সময়ে আবার ছাত্ররাজনীতির মধ্যে আসলে তাতে রাজনীতির কোন দিকটা কীভাবে অশুদ্ধ হয়ে যায়, সেটা সমালোচনাকারীদের কেউ বুঝিয়ে বলবেন কি?
*****
শেষ দুটো কারণ নিয়ে সমালোচনা চলতে পারে, বরং বলা ভালো ছাত্রদলের এই কমিটি নিয়ে সমালোচনা করলে প্রথম তিনটি পয়েন্ট বাদ দিয়ে শেষ দুটো পয়েন্টই নিয়েই আলোচনা করা উচিত। কারণ ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে বয়স একটা ফ্যাক্টর আর ছাত্রত্ব তো মূল ফ্যাক্টর। তাছাড়া কারণ দুটোর একের সঙ্গে অপরের সম্পর্ক খুবই নিবিড়।
বয়সের প্রসঙ্গে আসি। ছাত্রদল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বয়স ৪০-এর বেশি! ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে এ বয়সটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। একজন শিক্ষার্থী কতো বছর পর্যন্ত রাজনীতি করতে পারবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাস্তবতার কারণেই আমাদের দেশে সেটা বেধে দেওয়া সম্ভব নয়। যতদূর জানি, ছাত্রসংগঠনগুলোর গঠনতন্ত্রে ছাত্রনেতা বা কর্মীর বয়স সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। ঠিক তেমনি ছাত্রত্বের সংজ্ঞাটাও সেখানে পরিষ্কার নয়। এসব সংজ্ঞায় যা যা বলা আছে, সেগুলো আবার নানা ধরনের বিভ্রান্তিও তৈরি করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় একজন শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত হতে পারবে কিনা, সেটা যেমন ওইসব সংজ্ঞা থেকে জানা যায় না; ঠিক তেমনি পঞ্চাশ বছর বয়সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের চেষ্টায় রত কেউ চাইলে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হতে পারবে কিনা- সেটাও স্পষ্ট নয়। নিরক্ষর একজন মানুষ শেষ বয়সে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় ভর্তি হলে (অর্থাৎ শিক্ষার্থী হলে) ছাত্ররাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত পাওয়াটাও তাই দায়। এরকম একটা উদাহরণ আছে বৈকি- শেষ বয়সে উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উত্তরবঙ্গের রাজনীতিসচেতন একজন মানুষ ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হতে চেয়েছিলেন।
তাছাড়া ছাত্রনেতা হওয়ার আশায় অনেকে বছরের পর বছর ফেল করে কিংবা পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখে। এবং তারাই আস্তে আস্তে দলের শীর্ষপদে চলে যায়। এ প্রবণতার বিরুদ্ধেও গঠনতন্ত্রে কিছু বলা নেই। আমাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর গঠনতন্ত্র হলো এমন এক বিষয় যেখানে মোটামুটি দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলা যায়, কিন্তু যারা উদ্ধার করবে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা নেই।
ছাত্রত্বের সঙ্গে বয়সের সম্পর্কটা আরও গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, যখন নানা কারণে একটির শেষ সীমানা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না, তখন আরেকটি দিয়ে ছাত্ররাজনীতি করার সীমানাটা নির্ধারিত হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ছাত্রসংগঠনগুলোর গঠনতন্ত্রে এ ধারাগুলো সুস্পষ্ট তো নয়ই, বরং চাইলে একজন আদুভাইয়ের মতো মোটামুটি শেষ বয়স পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতি করে যেতে পারবে। ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি মোটামুটি এই দুটি দোষেই দুষ্ট, অথচ এগুলো নিয়েই মানুষজন সবচেয়ে কম কথা বলেছে। যতো দোষ গিয়ে চাপছে বিয়ে করা আর বাপ হওয়ার উপর!
*****
এখানে খোলাসা করি, আমি ছাত্রদল বা বিএনপির রাজনীতির সমর্থক নই (হাজার শুকরিয়া!); কিন্তু যে পদ্ধতি বা কারণ ধরে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটিকে সমালোচনা করা হচ্ছে বা স্বভাবত ছাত্রলীগের নতুন কমিটিকে করা হয়, তারও সমর্থক নই। সমালোচনা দরকার অবশ্যই, কিন্তু সেটার ভিত্তি কী হবে তা যারা বুঝেন না, তাদের এ নিয়ে সমালোচনা না করাই বোধহয় শ্রেয়। এতে রাজনীতি পরিশুদ্ধ তো হয়ই না, বরং যারা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বেহালা বাজান, তাদের টিউনটাকে আরও শক্তিশালী করা হয়। বাংলাদেশে রাজনীতি বা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আলোচনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়- আমরা আনপ্রোডাক্টিভ সিস্টেমের উদাহরণ দিয়ে প্রোডাক্টিভ সিস্টেমকে যাচাই করি, প্রোডাক্টিভ সিস্টেমের কথা মাথায় রেখে রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম বদলাতে চাই। আর এই করতে করতেই একেকজন বিশেষজ্ঞ বনে যাই, টক শো, আড্ডা, আলাপ সবজায়গাই নিজের অবস্থান পোক্ত করি।
*****
(চা খেতে যাওয়ার আগে একটি রিয়েল লাইফ জোকস্)
আমি তখন একটি ছাত্রসংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ হল শাখার সাধারণ সম্পাদক। কোনো এক তপ্ত দুপুরে মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রনেতৃত্বের এই বয়স ও ছাত্রত্বের সংজ্ঞা নিয়েই আমার সংগঠনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতির সাথে বচসা হচ্ছিলো। আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করছেন- অপরাপর সংগঠনের সাথে ফাইট করে টিকে থাকার জন্য (কারণ সেখানে ছাত্রনেতারা বেশি বয়সী), ছাত্ররাজনীতিকে বিকশিত করার জন্য প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার করে, কয়েকবছর ড্রপ দিয়ে হলেও ছাত্ররাজনীতি চালিয়ে যাওয়া উচিত। আমার উত্তর ছিলো- রাজনীতি করার জন্য যদি কেউ পড়ালেখায় ড্রপ দেয়, তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা উচিত- সংগঠন করার মূল শর্ত না মানার জন্য। পুরো দুপুর মোটামুটি এ নিয়ে বেশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলে।
রাতে হলে দলীয় প্রোগ্রাম। উপস্থাপক আমি, বিশেষ অতিথি এই সভাপতি এবং প্রধান অতিথি অন্য একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। অনুষ্ঠান শুরুর আগে সভাপতি ওই বিশেষ ব্যক্তির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সংগঠনের উদীয়মান তরুণ নেতা বলে (যদিও তখন আমি মাস্টার্সে পড়ি, ছাত্ররাজনীতিতে এই সময়ে উদীয়মান ও তরুণ বলে বুঝানোর মাজেজটা স্পষ্টই বুঝি)! অনুষ্ঠানের শেষ দিকে বিশেষ অতিথির বক্তব্যর সময় উপস্থাপক আমি মাইকের ঘোষণা দিলাম- ‘এ পর্যায়ে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন অমুক সংগঠনের সভাপতি, কেন্দ্রীয় অমুক ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা, বর্ষীয়ান ছাত্রনেতা অমুক।‘
পরবর্তী দৃশ্যাবলী আপনি কল্পনা করে নিন।
এই অধম পাঠকের জানামতে বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে সর্বদা বলা হয়ে থাকে মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক প্রাণী। কি হাস্যকর!
যেহেতু চিরন্তন বলে কোন কথা নেই তাই আজকের বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে এসব জঞ্জাল ময়লা আবর্জনা পোকামকড় শেওলা কচুরিপানা একদিন থাকবে না।পশ্চিমা বাতাস কিনা বইতে শুরু করেছে।
লন্ডন আমেরিকা ভারত মালশিয়া চিন জাপান কানাডার মত শিক্ষার পরিবেশ হতভাগা আমাদের সবুজ শ্যামল ব-দ্বীপেও একদিন আসবে।ছাত্ররা শুধু পড়তে যাবে,শিক্ষকরা শুধু পড়াতে যাবেন।আজকের গৌতমের এই ছাত্র নেতার বিয়ে করা বাপ হওয়া সন্তানের জন্ম দেয়া পাপ হওয়া নাহওয়া মৌলবাদীর হাজার শুকরিয়া! কিংবা তারঁ খোদ ছাত্ররাজনীতির মধুপান করা যেমন যেকোন উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে কোন অর্থ বহন করে না তেমনি উন্নত বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে একদিন কোন বহন করবে না।
খাদ্য অখাদ্য বুঝতে আমাদের হয়তো সময় লাগবে।
এক্ষেত্রে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।চার বছরের শিক্ষা তখন ঠিক চার বছরেই হবে ৯,১০,১১,বা১২,১৩বছরে নয়।
বিবর্তন অবশ্যম্ভাবী!
গৌতম আসলে যা যা যুক্তি দিয়েছেন তা তত্ত্বীয় দিকে থেকে সবই ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাবহারিক দিক থেকে তো সমস্যা আসলে আরো মুলে। ছাত্ররাজীতি আমাদেরই কেবল এত কেন দরকারী তার কি কারন? পাশ্চাত্য দেশগুলো নাহয় বাদ থাকল, কিন্তু পাশের দেশ ভারতেও ছাত্ররাজনীতি বলতে গেলে নামমাত্র আছে, এত মারাত্মক মাত্রায় নেই। স্বৈরাচারী এরশাদ বিদায় নেবার পর আসলে আমাদের ছাত্ররাজনীতির প্রয়োযন শেষ হয়ে গেছে।
ছাত্ররাজনীতির নামে যা চলছে তা হল দখলবাজী, জুলুমবাজী…আরো কত বাজী তার হিসেব দেওয়া যাবে না। কেউ একটু যুক্তি দিয়ে বোঝান যে ছাত্ররাজনীতি দিয়ে আমরা এই এই জিনিসগুলি পাচ্ছি। আমাদের একজন শিক্ষক সবসময় আমাদের জিজ্ঞাসা করতেন কোন ছাত্র সংগঠন কে কোনদিন দেখেছো যে তোমাদের লাইব্রেরীর বই বাড়াতে মিছিল করছে? যেদিন করবে সেদিন আমি শিক্ষক হয়েও তাদের মিছিলে যোগ দেবো। ভাল মন্দ সবকিছুরই আছে, কিন্তু তার একটা ব্যালেন্স থাকতে হবে তো। ছাত্ররাজনীতির বিষ বাষ্পে যে কত ছেলের জীবন নষ্ট হয়েছে তার হিসেব কে রেখেছে? সরকারী সম্পদ ধ্বংস বা অপচয় নাহয় আমাদের দেশে তেমন কোন গুরুতর ব্যাপার না।
পাকিস্তান আমলেও শুনেছি যে মেধাবী ছাত্ররাই নেতা হতেন, তাদের মানুষ ভক্তি শ্রদ্ধা করত, আর আজ ছাত্রনেতা নাম শুনলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের সামনে লেখাপড়ার সাথে সম্পর্কবিহীন, চাদাবাজ, সন্ত্রাসী এমন কোন চেহারা ভেসে উঠে। এটা শুধু ফোবিয়া থেকে হয়নি। অত্যন্ত বাস্তব কারন আছে।
আর স্রেফ দলীয় পদের জন্য কেউ ছাত্রত্ব বজায় রাখবেন তার মানে হল তিনি জেনুইন কোন ছাত্র যে আসলেই ওই ডিগ্রী করতে চায় তার সুযোগ নষ্ট করছেন, এতে সরকারেও অযথা অপচয় হচ্ছে, কারন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারকে বহু টাকা খরচ করতে হয়। অথচ আদুভাই নেতা স্রেফ দলীয় পদে থাকতে, হলের সীট দখল বানিজ্যে অংশ নিতে বছরের পর বছর নামখাওয়াস্তে অই পদ দখল করে রাখছেন। এটাকে কি কোনভাবে সমর্থন করা যায়?
আমরা তো আর রামছাগল নই যে কেন বিবাহিত সন্তানের পিতা আদুভাইরা কোন মহত শিক্ষালাভের উদেশ্যে বুড়ো বয়সে ক্যাম্পাসে আসেন তা বুঝতে পারি না। আর দেশসেবার নিয়ত নিয়ে তারা এসব করে বেড়ান শুনলে দেশের দেওয়ালেও হাসবে।
তবে সমাধান ও মনে হয় আছে। আমাদের দেশনেত্রী একবার তার ছাত্রদলের কমিটিতে অছাত্রের স্থান পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করায় খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন যে ছাত্ররাজনীতি করতে ছাত্র হতে হবে এমন কোন আইন আছে নাকি? খুবই ভাল কথা, এটা সবাই মেনে নিলে অন্তত ছাত্রনেতাদের কবল থেকে শিক্ষাংগনগুলি মুক্তি পাবে। তারা শিক্ষাংগনের বাইরে থেকে রাজনীতি করলেই পারেন।
গৌতম, আপনার লেখাটি পড়ে একধরণের মিশ্র অনুভূতি হল। এটা ঠিক, বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা হওয়া ছাত্র-রাজনীতির অন্তরায় কোনভাবেই হওয়া উচিৎ নয়, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আদুভাইদের নিয়ে। যারা রাজনীতির নামে বছরের পর বছর ‘ছাত্রত্ব’ জিইয়ে রাখে। এর ছাত্র রাজনিতির নামে নামে মাস্তানি করে, চাঁদাবাজি করে, টেন্ডারবাজি করে, আর পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিয়ে বাচ্চা, তাফালিং সবই করে। এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন বিবাহিত আদুভাইকে নতুন কমিটির প্রধান করলে সমালোচনার তীর আসবেই। কিন্তু মুশকিল হল বাংলাদেশে সমালোচনার তীরগুলো ঠিকভাবে প্রক্ষীপ্ত হয় না প্রায়শঃই। বিয়ে আর সন্তানের ব্যাপারটা আসা উচিৎ সবার পরে, সবার আগে নয়। সবার আগে আসা উচিৎ চাঁদাবাজি করে, টেন্ডারবাজি, ম্যাডামবাজি, আপাবাজির মত উপসর্গগুলো। আর ছাত্র-দল, ছাত্রলীগ – এইগুলো দল যে আদর্শিক রাজনীতি করে তাদের কাছ থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশাও করা যায় না।
@অভিজিৎ, আমি নিজেও বিষয়টি নিয়ে লেখার সময় দ্বিধায় ছিলাম। যে কারণে বিবাহিতের বিষয়টিকে একেবারে খারিজ করে দিই নি; কিন্তু কারণ হিসেবে এটিকে অন্তত শেষে রাখা হোক। যারা রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করেন না, কিন্তু তড়িৎ মন্তব্য ছুঁড়ে দেন, বিবাহিতের বিষয়টি তাদের মন্তব্যে আসতে পারেন। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলামmdash; যারা রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করেন, রাজনীতি-গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তারা পর্যন্ত বিভিন্ন টকশো বা আড্ডায় এগুলোকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।
আমি আপনার সাথে একদমই একমত যে- বাংলাদেশে সমালোচনার তীরগুলো ঠিকভাবে প্রক্ষীপ্ত হয় না প্রায়ই। সে কারণেই এই লেখাটি তৈরি করলাম।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।