গেল শতাব্দীর বিশের দশকে মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী অত্যাচারিত কৃষক শ্রেণীর অনুসারীদের নিয়ে টাঙ্গাইলের অত্যাচারী সাম্প্রদায়িক জমিদার মহারানী জাহ্নবীর রাজপ্রাসাদ বারকয়েক অবরোধ করেন। স্থানীয় সামন্ত শক্তির সাথে ভাসানীর এ বিরোধের কারণে বৃটিশরাজ কুখ্যাত রাউলাট আইনের বলে তাঁকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জিলা (টাঙ্গাইল সে সময়ে ময়মনসিংহের অর্ন্তগত ছিল) থেকে বিতাড়ন করে। পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে ভাসানী প্রাগুক্ত জমিদার বাড়ীটি জবর দখল করেন। প্রিয় পাঠক, মাফ করবেন, এই মহান নেতাকে সমকালীন জবর দখলকারী, যারা ইতোমধ্যেই ‘ভূমিখেকো’, ‘বনখেকো’, ‘নদীখেকো’ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত তাদের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। এই সব লুটেরা গোষ্ঠী ব্যক্তিগত ভোগ-লালসায় খাস কিংবা জনগণের সম্পত্তি জবর দখল করে থাকে। কিন্তু মজলুম জননেতা ভাসানীর ‘বেআইনি’ কাজকর্ম কিংবা ‘জবর দখল’ ছিল জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে নিবেদিত।
হ্যাঁ, আইনের চোখে ভাসানী ছিলেন আইন ভঙ্গকারী। তা সত্ত্বেও আমজনতা তাঁকে আইনের চোখে বিচার করেনি। বরং গণমানুষের নৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন বিরোধী কার্য্যক্রমে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের জন্য জনতা তাকে জানিয়েছে সশ্রদ্ধ অভিবাদন। তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য ছিল গরীবের মুক্তি এবং এ কারণে তিনি সারা জীবন অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, বহুবার হয়েছেন নির্যাতনের শিকার। সাদাসিধা জীবনযাপনকারী এই মহান নেতা জমিদার বাড়ীটি নিজের ভোগের জন্য দখল করেননি। বরং তিনি এ বাড়ীটিতে টাঙ্গাইলের গণমানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেন একটি উচ্চ শিক্ষালয় যা বর্তমানে মৌলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত। অত্যাচারী, শোষক জমিদারের সম্পত্তির উপর জনগণের হক রয়েছে- এ আদর্শের ভিতেই জনগণের জন্য যে এ বাড়ীটি তিনি দখল করেন সে কথা বলাই বাহুল্য। শুধুমাত্র জমিদার বাড়ী নয়, ভাসানী এবং তার অনুসারীদের আন্দোলনের মুখেই প্রতাপশালী সামরিক শাসক আয়ুব খাঁন ঢাকার তৎকালীন বিলাস বহুল হোটেলে শাহ্বাগ (যা এক সময় ছিল ঢাকার নবাব পরিবারের জলসাঘর) বন্ধ করে সেখানে একটি হাসপাতাল স্থাপনে বাধ্য হন। আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাসপাতাল ভাসানীর সেই আন্দোলনের ফসল বললে অত্যুক্তি হবে না।
আইনি এবং নৈতিক অধিকার সব সময় সমান্তরালে চলে না। মধ্যযুগে ক্রীতদাস রাখা এবং তাদেরকে কারণে অকারণে নির্যাতন করা আইনের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু নৈতিকতার মাপকাঠিতে একাজটি সে যুগেও ছিল অনৈতিক, অমানবিক।
আইনি বনাম নৈতিক অধিকারের প্রশ্ন খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ীর বিষয়েও প্রযোজ্য। সরকার কতৃক খালেদা জিয়াকে বাড়ীটি ছেড়ে দেওয়ার প্রজ্ঞাপন প্রদান এবং এর প্রেক্ষিতে বিএনপি-র আইনি এবং রাজনৈতিক লড়াইয়ের ঘোষনা ইতোমধ্যেই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। খালেদার পক্ষে সমলোচকদের বক্তব্য, ক্যান্টনমেন্টের এ বাড়ী বিষয়ক সরকারের এ উদ্যোগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। অবশ্য একটি রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে কোন রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অন্যায্য বলা যায় না। তবে সরকারের এ উদ্যোগকে সময়োচিত বলে অ্যাখ্যা দেওয়া যায় না। বিশেষ করে ক্যান্টনমেন্টের এ বাড়ী উদ্ধারের চেয়েও জাতীয় পর্যায়ে সরকারের কর্ম তালিকায় যে সব জরুরী বিষয়াবলী রয়েছে (যেমন- বিদ্যুৎ ব্যবস্থা উন্নয়ন, সত্যিকার অর্থে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন) সে সবকে প্রাধান্য দেওয়াই ছিল সরকারের আশু কর্তব্য।
ক্যান্টনমেন্টের এ বাড়ীটির উপর খালেদার আইনি অধিকার রয়েছে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে আদালত। কিন্তু দেশের একজন সাধারণ সচেতন নাগরিক হিসেবে এ বাড়ীটির উপর খালেদা জিয়ার নৈতিক অধিকার আদৌ আছে কি না সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৮১ সনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যার পর বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিএনপি সরকার গুলশানের অভিজাত এলাকার একটি বিশাল বাড়ী সহ ক্যান্টনমেন্টের এ বাড়ীটি খালেদা জিয়াকে নাম মাত্র মূল্যে দীর্ঘ্য মেয়াদী লীজ প্রদান করে। এছাড়াও জিয়ার দুই পুত্রের সাবালকত্ব অর্জন করা পর্যন্ত সরকার তাদের জন্য বিশেষ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার আকষ্মিক মৃত্যুতে তার অসহায় পরিবার যাতে আর্থিক দৈন্যদশায় পতিত না হয় সে বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা বিধান করাই ছিল সরকারের উদ্দেশ্য। বিষয়টা সম্পূর্ণ মানবিক বিধায় সে সময়ে জনমনে কোন প্রশ্ন ওঠেনি।
কিন্তু কয়েক দশক পরে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার পরিবারের নাটকীয় উত্তরণ ঘটেছে। আর্থিক বিবেচনায় খালেদা জিয়া আর অসহায় মহিলা নন। ইতোমধ্যে তিনি দেশে তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন এবং বর্তমানে বিরোধী দলের নেত্রী। তার দুই পুত্র, যেভাবেই হোক, আজ দেশের প্রথম সারির ধনিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। তাই সঙ্গত কারনেই প্রশ্ন ওঠে, খালেদা জিয়ার এখন কি আদৌ ক্যান্টনমেন্টের বাড়ীটির উপর নৈতিক অধিকার রয়েছে? ক্যান্টনমেন্টের এ বাড়ীটি ছেড়ে দিলেও গুলশানের অভিজাত এলাকায় সরকার প্রদত্ত তাঁর রয়েছে দ্বিতীয় বাড়ী। তাঁর কি প্রয়োজন ক্যান্টনমেন্টের এ বাড়ীটিও ভোগ দখলে রাখা? কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন, যেহেতু প্রয়াতঃ রাষ্ট্রপতি জিয়া কর্ম জীবনের বড় একটি অংশ এ বাড়ীটিতে কাটিয়েছেন, জিয়ার স্মৃতি বিজড়িত এ বাড়ীটি খালেদা পরিবারের অমূল্য এক সম্পদ। হ্যাঁ, বিষয়টি আমলে নেওয়া যেত যদি খালেদা বাড়ীটিকে ইতোমধ্যেই ‘জিয়া জাদুঘরে’ রূপান্তরিত করতেন। সম্ভবতঃ সেক্ষেত্রে জনগণই সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করতো। হাসিনা যেক্ষেত্রে নৈতিকবোধের তাগিদে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ধানমন্ডি ৩২নং বাড়ীটি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে রূপান্তরিত করেছেন, ব্যক্তিগত বৈষয়িক লোভের কারণে খালেদা সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
বাড়ীটি প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় আলোচনা করা সঙ্গত। বাড়ীটির অবস্থান দেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং সংরক্ষিত এলাকা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। আমাদের মতো একটি দেশে, যেখানে সেনা বাহিনী প্রায়শঃই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে দেশের একটি প্রধান দলের শীর্ষ রাজনীতিকের বাড়ী ক্যান্টনমেন্টে থাকা সঙ্গত নয়।
পরিশেষে, আইনি নির্দেশে নয় বরং নৈতিক তাড়নায় জন আকাঙ্খার সাথে সঙ্গতি রেখে বেগম খালেদা জিয়া জনগণের সম্পত্তি জনগণকে ফিরিয়ে দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ী বিষয়ক বিতর্কের অবসান ঘটাবেন সেটিই কাম্য। কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একজন নেত্রীর ব্যক্তিগত লোভ-লালসা পূরণের রাজনীতি সমর্থন করতে পারে না। অতি সমপ্রতি বিএনপি-র সংসদে ফিরে যাওয়ার শর্ত হিসেবে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ী ইস্যু জুড়ে দেওয়া শুধুমাত্র অনভিপ্রেত নয়, অনৈতিকও বটে।
শুধুমাত্র জমিদার বাড়ী নয়, ভাসানী এবং তার অনুসারীদের আন্দোলনের মুখেই প্রতাপশালী সামরিক শাসক আয়ুব খাঁন ঢাকার তৎকালীন বিলাস বহুল হোটেলে শাহ্বাগ (যা এক সময় ছিল ঢাকার নবাব পরিবারের জলসাঘর) বন্ধ করে সেখানে একটি হাসপাতাল স্থাপনে বাধ্য হন। আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাসপাতাল ভাসানীর সেই আন্দোলনের ফসল বললে অত্যুক্তি হবে না।
হোটেল শাহবাগকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয় ১৯৭১ এর জুনের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। সে সময় ভাসানী ও তার অনুসারীরা যে ঢাকায় থেকে আন্দোলন করছিলেন এই তথ্য জানা ছিলো না আমার। কিপ আপ ইয়োর গুড ওয়ার্ক