একুশের চেতনা বিনির্মাণে নারী
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বিখ্যাত নারী নামক কবিতায় বলেছেন যথার্থভাবেইঃ
”জগতের যত বড় বড় জয় বড়বড় অভিযান
মাতা ভগ্মী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কতমাতা দিল হৃদয় উপাড়ি ত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মতিস্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?”
এই উদ্ধৃতিটি বিশ্বের ইতিহাসেও যেমন সত্য তেমনি সত্য আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসেও। আমরা ক‘জন জানি, ২১শে ফেব্রয়ারী,৫২ সালে যখন পুলিশ গ্রেফতারী এ্যাকশন শুরু করে তখন নারীরাই প্রথম মিছিল বের করেছিল? এ নিয়ে আলোচনা লেখালেখি হয়নি বললেই চলে। আর ভূমিকা নয় আসুন ঘটনাপঞ্ছির আলোকে জেনে নেই ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা।
১৯৪৭ সালের ১৫ ই নভেম্বর তারিখে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক ইস্যুকৃত পত্র নং ২১৪৭-ই ( পি ) তে দেখা যায় যে ,পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য যে মোট ৩১টি বিষয় নির্ধারন করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে উর্দু,ফরাসী,জার্মান এমনকি হিন্দী সহ মোট ৯টি ভাষা।তখন পাকিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে এর অন্তুর্ভুক্ত করা হয়নি। এই পটভূমিতে ১৭-১১-৪৭ তারিখে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্টভাষা করার দাবী জানিয়ে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নিকট এক স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এত অন্যান্যদের মধ্যে শামসুন্নাহার মাহমুদ( শিক্ষাবিদ) , আনোয়ারা চৌধুরী ( প্রাদেশিক পরিষদসদস্য) লীলা রায় প্রমুখ মহিলা নেতৃত্ব স্বাক্ষর করেন। ৬-১২-৪৭ তারিখে মর্নিং নিউজ এ করাচীতে অনূষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উদুর্কে পাকিস্তানের রাষ্টভাষা করার স্বর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হলে সেদিনই ঢাবি‘র অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে যে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানেও অন্যান্যদের সাথে কল্যানী দাষ প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ১৯৪৮ এর ১১ই মার্চ পালিত হয় প্রদেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ঢাকায় সর্বাত্বক হরতাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় আব্দুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে যে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় , সেখানও বিপুল সংখ্যক ছাত্রী অংশ নেয়।
২১-৩-৪৮ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষনা করেন: উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে,অন্যকোন ভাষা নয়। “ ২৪-৩-৪৮ তারিখেঅনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত কনভোশেন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ পুনরায় ঘোষনা করেন ” There can, However be one lingual franca ,That is the language for inter Communication between the various provinces of the state and that language should be urdu and cannot be any other “. এই মন্তব্য করলে ছাত্র-ছাত্রীরা তার বক্তব্যেও মধ্যেই , No, No ধ্বনী দিয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। সেদিনই সংগ্রাম পরিষদেও প্রতিনিধি দল জিন্নাহর সাথে সাক্ষাত করেন যেখানে লিলি খান প্রমুখ ছিলেন। জিন্নাহ কঠোর ভাষায় তাদেরকে শাসিয়ে দেন: “যে কোন অসাংবিধানিক আন্দোলন কঠোর হস্তে দাবিয়ে রাখা হবে”।
২৭-১-৫২ তারিখে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পাকিস্তানের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম্দ্দুীন ঘোষনা করেন “ প্রদেশের ভাষা কি হবে তা প্রদেশবাসীই স্থির করবে কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু । এই ঘোষনার পরিপ্রেক্ষিতে ৩১-১-৫২ তারিখে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা ভাষানীর সভাপতিত্বে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরীতে অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রনেতা কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে “যুবদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ” গঠন করা হয় ।
৪-২-৫২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সমগ্র ঢাকা শহরেও ধর্মঘট পালন করা হয়। ২০-২-৫২ তারিখে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং এক মাসের জনর্য সভা শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয় । এ প্রেক্ষিতে গভীর রাত পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গেও গোপন প্রস্তুতি নেয়।
২১ শে ফেব্রয়ারী ১৯৫২ তারিখে বেলা ১১ টায় ঢাবির আমতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রসভা শুরু হয়।আব্দুল মতিন ও গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গেও পথে জোরালো বক্তব্য রাখেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গে ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আসামাত্রই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলে নিতে থাকে।এমতাবস্তায় তত্ কালীন ডাকসু জিএস শাফিয়া খাতুন (ড.) সুফিয়া আহমেদ ( জাতীয় অধ্যাপক ) , শামসুন্নাহার আহসান, সারা তৈফুর , রওশন আরা বাচ্চু, হালিমা খাতুন (ড.) মাহফিল আরা ,খোরশেদী খান প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্রীরা মিছিল করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে।এরপর রাস্তায় নেমে আসে ছাত্র-ছাত্রীর ঢল। মিছিল ঠেকাতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ছোড়ে এবং লাঠিচার্জ করে। এরপর শুরু হয় প্রচন্ড গুলিবর্ষন ।গুলিতে আবুল বরকত , সালাউদ্দিন আব্দুল জব্বার ও রফিক উদ্দিন নিহত হন এবং ১৭ ব্যক্তি আহত হন।এরপর শুরু হয় প্রচন্ড বিক্ষোভ । ২২ শে ফেব্রয়ারী ১৯৫২ নবাবপুরে আবার গুলী চলে। সালাম, শফিউর রহমান আরো কয়েকজন নিহত হন।
অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে নারীদের অবস্থান ছিল এবং গুরুত্বপূর্ন ভাবেই । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের । একুশ নিছক একটি দিবস নয় , এটি আমাদের অন্যতম জাতীয় চেতনা । আর এই চেতনা বিনির্মানেও যে নারীরা রেখেছে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা তা‘ আমরা ভুলে যাব কিভাবে?
(সমকালে ১৮ ফেব্রু ২০০৭ তারিখে প্রকাশিত । )
নুরুজ্জামান মানিক বরাবরই স্বল্প পরিসরে — কম কথায় মূল্যবান ইতিহাস তুলে ধরেন ।‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদের নাম’এর পর ‘একুশের চেতনা বিনির্মাণে নারী’ তাঁর নারীবাদী চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি? ‘
সাথে যোগ করা যায় —-
‘আমার বোনদের সংগ্রামী চেতনা একুশে ফেব্রুয়ারী/আমি যে স্মরণে রাখি’।
ধন্যবাদ মানিককে।