তখন ও এখন
গীতা দাস
(২৭)
‘হিন্দুর দাড়ি
মুসলমানের নারী
গাং পাড়ের বাড়ি
এ তিনটির কোন স্থায়িত্ব নেই।’
প্রচলিত গ্রামীন ধারণা। নিঃসন্দেহে বির্তকিত কথা। হিন্দু ব্যক্তিও দাড়ি নিশ্চয়ই রাখতে পারেন। বিশেষ করে ‘মুসলমানের নারী’র স্থায়ীত্ব নেই মানে সাম্প্রদায়িক কথা। তবে ছোটবেলায় মুসলমানের নারী শব্দটি নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। বুঝেও বলিনি। নদীর পাড়ের বাড়ির ছেলেমেয়েদের সাথে ঝগড়া লাগলে তাদের ঘায়েল করতে গিয়ে মুসলমানের নারী চলে আসত; যারা আমাদের ঝগড়ার পটভূমি বা দৃশ্যপটের কোথাও থাকার কথা নয়।
ছোটবেলায় না বুঝে অন্যের মনে আঁচড় কাটার মত প্রবচনের চর্চা করেছি, আর এখন দেখি ও শুনি কী করে জেনে শুনে বুঝেই অন্যের শরীর ও মনে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়।
‘ঐ যে ঢুকতেই সামনের টেবিলে বসে হিন্দু মহিলাটি, উনাকে জিজ্ঞেস করলেই হবে। ’ — এ ধরণের পরিচয় শুনতে বা কাউকে এভাবে চিহ্নিত করা হলে আমার ভাল লাগে না। ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিচয়ে ক্ষুণ্ণ হই। ভাল না লাগার কারণ হয়তো বা হীনমন্যবোধ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্বের হীনমন্যতা।
পরে নিজে নিজেই বিশ্লেষণ করলাম — আমিও কী এ রকম করে বলি?
আবিষ্কার করলাম— বলি।। বড়বেলায়ও বলি।
বলি না যে ‘ঐ যে ঢুকতেই সামনের টেবিলে বসে মুসললিম মহিলাটি, উনাকে জিজ্ঞেস করলেই হবে।
কিন্তু বলি বোরখা পরা মহিলাটি। বা ফর্সা মহিলাটি, অথবা কালো লোকটি। মনের অজান্তেই একটি বিশেষণ জুড়ে দিই।
অন্যকে যা করতে দেখলে অস্বস্থিবোধ করি তা আবার নিজেই করি ভেবে লজ্জা পেলাম। তবে এ থেকে পরিত্রাণের পথ পেলাম না। তবে বড়বেলায় আমার এ বোধ অন্তঃত হয়েছে যে আমি নিজেও অনেক অস্বস্থির জন্ম দিই বা উৎস হই। ছোটবেলায় এ বোধ কাজ করত না।
গত ২৩ আগস্ট, ২০০৮ নারীপক্ষ ( বাংলাদেশের একটি নারী সংগঠন) কার্যালয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিষয়ক এক আলোচনা সভা। সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধ করার জন্যেই এ সভা। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বেশি সংঘটিত হয় এবং আমরা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নির্মূলে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে — সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে কী কী পদক্ষেপ ও কর্মসূচি নিতে পারি —– এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এতে অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও বলছিলাম।
আলোচনায় একজন বলল যে, তাদের পরিবারে কখনো হিন্দু মুসলিম বা এটা হিন্দুদের বা এটা মুসলিমদের এমন কোন আলোচনা কখনও হয় না। অথচ এ পরিবারেরই একজন সাত বছরের শিশু বাজার থেকে আনা মাংস প্রসঙ্গে বলল, মাংস বললে কেন? মাংস তো হিন্দুরা বলে। গোসত বল।
পরিবারের অন্যরা অবাক হলেও জানতে পারে শিশুটি তা তার স্কুল থেকে শিখেছে।
কথা প্রসঙ্গে আরও কিছু সাম্প্রদায়িক শব্দের কথা শুনলাম। হিন্দু পরিবারে পানি বলা যায় না। জল বলতে হয়। পানি বললে কি জলের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়?
মুসলিম পরিবারে জল দিয়ে ওজু করলে কি শুদ্ধ হয় না ?
হিন্দুরা উপোস করে পূজা করে আর মুসলমানেরা রোজা রাখে — উপোস নয়। রমজান মাসে কোন
মুসলমানকে বলা গর্হিত কথা —- আপনি কি উপোস করছেন ?
আর পূজার জন্য উপোস করছে এমন কাউকে বলা যায় না — আপনি কি রোজা রেখেছেন ?
ভাষার উৎপত্তিগত ইতিহাস, শব্দের রূপান্তর যারা পড়েনি তাদের কাছে এ থেকে বেশি আশা করা কী বোকামী!
শব্দের সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিচয় তো আছেই। এখন দেখি শব্দের জাত পাত আছে। ধর্ম আছে।
ছোটবেলায় এমনই একটি গল্প পড়েছিলাম। হিন্দু পরিবার ১৯৪৭ সালে দেশ ত্যাগের সময় একটি কাকাতুয়া রেখে গেছিল এক মুসলিম পরিবারে। এ কাকাতূয়াকে ঐ মুসলিম পরিবার চাচাতুয়া বলে ডাকত। কারণ কাকা হিন্দু সম্বোধন। কাকা থেকে মুসলিম সম্বোধন তো চাচাই হবে। আবারও ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভাজিত দেশ ভাগের পর পর।
অবশ্য এখনও ফরিদপুর অঞ্চলে হিন্দু মুসলিম নির্বিশাষে কাকু সম্বোধন করে।
এমন আরও শব্দ আছে। এক লোক পানি কচু নিয়ে বাজারে যায়। আরেক লোক জানতে চায় সে কি নিয়ে বাজারে যাচ্ছে।
উত্তর পায় — পানিকচু।
প্রতিত্তোর – জলকচু বলেন। হিন্দু মানুষ।
সাথে সাথেই আরেক জন জলপাই নিয়ে যাচ্ছিল। তাকেও কি নিয়ে বাজারে যাচ্ছে প্রশ্ন করা হলে উত্তর আসল – পানিপাই।
এ কেমন জিনিস?
কেন? আমি তো মুসলমান। জলপাইকে নিশ্চয়ই পানিপাই বলব।
এসব কিন্তু গাল গল্প নয়। সত্যি গল্প। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের সেই ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে এক আলোচনায় শুনেছিলাম পানিচ্ছ্বাস শব্দটি ব্যবহার করতে।
শব্দ নিয়ে এ সাম্প্রদায়িক মনোভাব বদলানোর উপায় বের করা প্রয়োজন।
গীতা দাস
১৯ মাঘ, ১৪১৫/ ১ ফেব্রুয়ারী , ২০০৯
সহমত।