আল মাহমুদের কবিতার চিত্রকল্পে নারীর সৌর্ন্দয ও যৌনতা

 

নুরুজ্জামান মানিক

 

আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি কবিতার শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকুলতা নির্মানে তিনি নিঃশংসয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় একজন অগ্রগামী কবি প্রখ্যাত সময়ালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন -“সমকালীন যে দুজন বাঙালী কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ , অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্রোপাধ্যায় । “   অধ্যাপক ডঃ রাজীব হুমায়ুনের মতে , তিনি চল্লিশ দশক পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি , নতুন কবি রাজীব হুমায়ুন তাঁর মৌলিকত্ব এবং নতুনত্ব দেখেছেন আল মাহমুদের গাঁয়ে ফেরার পিপাসায়  এবং অনিবার্য শব্দ, উপমা , চিত্রকল্পে সে পিপাসার প্রকাশে পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি আল মাহমুদ গ্রামে ফিরলেন এবং গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে গিয়ে রচনা করলেন –

 

           এখন  কোথায় যাওয়া যায় ?

           শহীদ এখন টেলিভিশনে শামসুর রাহমান

           সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন হাসানের বঙ্গজননীর নীলাম্বরী বোনা

          আমার দ্বারা হবে না জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান

          অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না , কেননা :

          আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে (আমার সমস্ত গন্তব্যে )

 

বিধায় , আল মাহমুদ লোকজ  অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক  বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন তার নির্মিত পটভুমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতা ই আত্মবিশ্বাস জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পুর্ন ভিন্ন প্রকৃতির কবি   কারো প্রতিধবনি নয় , নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন :

 

                                     

]                              আমার বিষয় তাই , যা গরীব চাষীর বিষয়

                   চাষীর বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর

                   কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন 

                   সীমাহীন মাঠ

                   চাষীর বিষয় নারী

                   উঠৌনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা

                   পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী (কবির বিষয় )

 

 

স্পন্দমান আবগের ভুগোল , দেশজ চেতনা   ,লেককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি যেমন তিনি তার শ্রেষ্ট কর্ম  সোনালী কাবিন এ মাতৃভুমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনিষঙ্গসমুহ তিনি এখানে শক্তিমত্তার সাথে রোমান্টিসজম প্রবেশ করিয়েছেন যা সোনালী কাবিন সনেট গুচ্ছকে করেছে মহিমান্নিত

 

সোনার দিনার নেই , দেন মোহর চেয়ো না হরিনী

                          যদি নাও , দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি

                           আত্মবিক্রয়ের স্বর্ন কোনকালে সঞ্চয় করিনি

                           আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি ;

    ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি । “

 

 

সোনালী কাবিনসনেটগুচ্ছ কবি উপমা -রুপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন , আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন , নদীর চরের প্রতি কৃষানীর পতির অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমানিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙখার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীন  প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে –

       

ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ

তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায় । “

 

বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে হলে আমাদের    আল মাহমুদের কবিতার দরজায় নক করতেই হবে

                     

                      কবিতা কি ?

                       কবিতা তো শৈশবের স্মর্তি

   কবিতা চরের পাখী , কুড়ানো হাসের ডিম , গন্ধভরা ঘাস

                     স্নান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর

                  কবিতাতো মক্তব্যের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার । “ ( কবিতা এমন )

 

 

কবিতা সহ সাহিত্যের কোন শাখায় নর-নারীর মিলঙ্কে অস্বীকার করা যায় না হুইটম্যানের কবিতায় ভাবের এক বে আব্রু প্রকাশ দেখে আমরা তাই আতঙ্কিত হলেও খুব্ধ হইনা :

 

It is I , you women , I make my way

I am stern acrid , undissuble , but I have you

I do not hurt you any more than is necessary for you

I pour the stuff to starts sons and daughters fit for these states

I  press with slow rude muscle

I brace myself effectually. I listen to no entreaties

I dare not with draw till deposit what has so long accumulated within me.

 

 

তখন আমরা মু্গ্ধ হই এই ভেবে যে , মানব মনের একটি অদৃশ্য ও আদিমতম কামনার জোয়ারকে কবি বিন্দুমাত্র বাঁধা না দিয়ে তার প্রবাহমানতাকে আরো স্বচ্ছন্দ দিয়েছেন আল মাহমুদ সোনালী কাবিনকাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপুর্ব চিত্রায়ন পুর্বক আদি ও অন্ত পর্যন্ত চিরন্তন রোমান্টিক ধারাকে প্রজ্জ্বল করেছেন :

           

                  তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী

            খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ

            শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি

           তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ “( সনেট ১০ )

 

আল মাহমুদ যে মৌলিক ও নতুন কবি তা আগেই বলা হয়েছে একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাকরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মানে সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তার কবি হূদয় সর্বদা সুন্দরের পুজারী তিনি তার কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মান করেছেন

 

বক্ষমান রচনায় আমাদের বিবেচনা তার নারী সৌন্দর্য বন্দনা আল মাহমুদের নারী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক , কামোদ্দীপক ও সৌন্দর্যময় এক্ষেত্রে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের মনতব্যাটি যথার্থ : “তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদাম করে তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিকার অভাবের অজগর তার টোটেম যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানকৌড়ি পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে সে কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন । ” (একজন খাটি কবি , উপমা , পৃ ২৫ )

 

নারী দেহের স্তনের বর্ণনা দিতে বিদ্যাপতি রাধিকার স্তনকে বলেছিলেন -“হেম  কমলন জনি অরুণিত চঞ্চল ।” সৈয়দ আলী আহসান সহসা সচকিত এর ৩১ নং কবিতায় উল্লেখ করেন –

 

                               কভু মনে হয় পদ্ম কোরক

                   দেহ তরঙ্গে বিকশিত

                   শিশির উষার সুর্যের তাপে

                    যেন আশংকা বলসিত

 

আল মাহমুদ নারী স্তনের সৌন্দর্য যেভাবে কল্পনা করেন –

 

 * শঙ্খমাজা স্তনদুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি

                                                      (সিম্ফোনি : লোক লোকান্তর)

 

*তার দুটি মাংসের গোলাপ থেকে নুনের হাল্কা গন্ধ আমার

                                  (চক্রবর্তী রাজার অট্রহাসি : মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে)

 

*চোখ যেন

রাজা মহীপালের  দিঘী আর বুক দুটি

মিথুনরত কবুতর

                ( অস্পস্ট স্টেশনঃ আরব্যরজনী্র রাজহাঁস )

 

*ইস্পাহানের হলুদ আপেল বাগান আমার হাতে দুলে দিয়েছে

তার সুপক্ক দুটি সোনালি ফল

তোমার ব্লাউজের বোতাম খো্লো ….

                ( অভিযোজনা ঃ আমি , দুরগামী )

 

আল মাহমুদ এখানে স্তনের সৌন্দর্য উপমার চিত্র কল্পনা করেছেন ঃ শঙ্খমাজা শ্বেতপদ্ম কলি, মাংসের গোলাপ , মিথুনরত কবুতর ,সোনালি ফল ইত্যাদির সাথে

 

নারী দেহের প্রধান সৌন্দর্য অংগ তার যোনী মধ্যযুগের বেশ কিছু কবি যোনীকে পুস্পের সাথে তুলনা করেছেন আধুনিক কবি সৈয়দ আলী আহসান যোনীকে দ্বিদল ফুলের সাথে তুলনা করেছেন –

 

                   প্রাচী্ন কাব্যে উরু সংযো্গ

                   যেনবা অমোঘ দ্বিদল ফুল

 

আল মাহমুদ রমনী দেহের যোনীকেও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিভিন্ন উপমায় শোভিত করেছেন যেমন –

 

*আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো বুকের গঠন

লুকানো যায়না তবু অনিবার্য যৌবনের ফুলপ্রতীকের মত যেন জেগে থাকে তোমার জঘন

(অহোরাত্রঃ লোক লোকান্তর)

 

*সর্প বিতানের কোনো ফলবান বৃক্ষের শিকড়ে

খুলে দিয়ে দুটি উষ্ণ উরুর সোপান

ঢেকে আছে নগ্নযোনি গহরফলক

( শিল্পের ফলক : ঐ )

 

*আঘাত থকে আসবে ছেলেগুলো

নাভির নিচে উষ্ণ কালসাপ

( মাংসের গোলাপ : কালের কলস)

 

* তোমার নাভিমূলে দেখেছি একা আমি

নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ

( শোনিতে সৌরভ : সোনালী কাবিন )

 

* চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাজ

উগোল মাছের মতো খুলে দাও শরীরের ভাজ

(আষাড়ের রাত : আরব্যরজনীর রাজহাস )

 

*আবার বুকের কাছে মুখ ঘামে ভেজা মাংসের কিষান

তৃপ্ত করে জ্যামিতির গুল্মময় ত্রিকোন কর্দম । ( ঐ)

 

 

* তবুওতো চাদ উঠে জনপদে ব্রাকের

আপার মতো ঠাট

চান্দেরী শাড়ির নিচে জোছনা দেখানো গুঢ রাত

(খরা সনেট ৪: দোয়েল ও দয়িতা )

 

* ত্রিকোন আকারে যেন

ফাক হয়ে রয়েছে মৃন্ময়ী

(প্রকৃতি , সোনালী কাবিন )

 

* জলজ তুনের মতো ফের

জন্ম নেবে ধরত্রীর মুত্রভেজা যোনীর দেয়ালে

( ভারতবর্ষ , বখতিয়ারের ঘোড়া )

 

 

* তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী

খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ

 (সনেট , সোনালী কাবিন)

 

নারীর যোনীকে আল মাহমুদ প্রতীকের মত জঘন, গহরফলক,উষ্ণ কালসাপ,নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ ,  চরের মাটির মতো শরীরের ভাজ,ত্রিকোন কর্দম ,গুঢ রাত , ত্রিকোন মৃন্ময়ী ,মুত্রভেজা যোনীর দেয়াল, যৌবন জরদ  ইত্যাদি উপমায় সুশোভিত করেছেন

 

 

আল মাহমুদের ইসলামি কবিতা বাদে প্রায় সব কবিতায় নারী দেহের সৌন্দর্য , উপমা ও যৌনতা প্রকাশ পেয়েছে তিনি নারী নিসর্গ  প্রেম ভালবাসায় কৃত্রিমতার বা রাখ ঢাকের খোলস নির্মান করেননি তিনি মার্ক্সিস্ট থেকে ইসলামের বিশ্বাসি হয়েছেন কিন্তু তারপরও

তার কবিতায় আমরা দেখছি মাংসের গোলাপ , মিথুনরত কবুতর , ত্রিকোন কর্দম কারন তিনি প্রথমত কবি শেষত ঐ কবিই

 

ষাটের মান্নান সৈয়দ কে আমরা দেখেছি নারী নগ্নতার মধ্য দিয়ে পরাবাস্তবাতা ও আধ্যাত্মার কথা বলতে একই দশকের শ্রেস্ট কবি নির্মলেন্দু গুনের কাম বিষয়ক কবিতার সমগ্রও আমরা হাতে পেয়েছি

 

নর-নারীর যুথজীবন যাত্রায় নগ্নতা , রম্যতা , জীবন ঘনিস্টতা অতি বাস্তব এই বাস্তবতাকে উপমা -চিত্রকল্পে যথার্থ  করা -শব্দের এবং চিত্রের অর্থ্ময়তা ও আনন্দময়তা যে কবি যতবেশি দান করতে পারেন নব নব শিল্প চিত্রনে সে তত বড় কবি

 

আল মাহমুদ তাই আমাদের প্রিয় কবি -জনপ্রিয় ত বটেই

 

আল মাহমুদের কাব্য যাত্রা সচল থাকুক