যিশুর মৃত্যু রহস্য
এমন ঢাকা কিছুই নেই যা প্রকাশ পাবে না,
এমন গুপ্ত কিছুই নেই যা জানা যাবে না।
–যিশু খ্রিস্ট
‘জ্ঞানী কোথায়? শাস্ত্রবিদ কোথায়? এ যুগের বাদানুবাদকারী কোথায়? ঈশ্বর কি জগতের (মানুষের) জ্ঞানকে মূর্খতায় পরিণত করেন নি? কারণ ঈশ্বরের জ্ঞানকে যখন নিজের জ্ঞান দ্বারা মানুষ জানতে পারেনি, তখন প্রচারের মূর্খতার মাধ্যমেই বিশ্বাসীদের উদ্ধার করতে ঈশ্বরের ইচ্ছা হলো। কেনোনা ইহুদিরা প্রমাণ চায় এবং গ্রিকরা জ্ঞানের অন্বেষণ করে আর আমরা ক্রুশে নিহত যিশুকে প্রচার করি।’…
ঠিক এইভাবে, ধূর্ত সেন্ট পল-এর মিথ্যাচারিতার মধ্য দিয়ে প্রায় দু’হাজার বছর আগে প্যালেস্টাইনে শুরু হয়েছিলো খ্রিস্টধর্মের যাত্রা। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, সত্যিকারভাবে ক্রুশে যিশুর মৃত্যু হয়নি। ক্রুশবিদ্ধাবস্থায় তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর নামে আজগুবি, গাঁজাখুরি বিভিন্ন গপ্পো ফেঁদে, জীবিত যিশুকে মৃত বানিয়ে, তাঁর মড়াকে খাড়া করে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন চালিয়াৎ খ্রিস্টপাণ্ডা-পুরুতগণ। একজন রক্তমাংশের মানুষকে ঈশ্বরের পুত্র বানিয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়; ঈশ্বর এবং যিশু উভয়কে একত্রিত করে তারা বলে বেড়ান-‘চিরশান্তিদাতা যিশু মানেই ঈশ্বর; ঈশ্বর মানেই যিশু-ক্রুশবিহীন- পরিত্রাণ নেই।’ অথচ সেই ত্রাণকর্তা, চিরশান্তিদাতা যিশুই কিনা বাইবেলে বলেন
ডাঃ ওয়াহিদ রেজা বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যিক। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।
যিশুর বিষয়ে গল্প বলেছেন শুধু সুসমাচার লেখকরা, ঐ সময়ে আর কেউ যিশু সম্পকে লেখেনি। প্রথম শতকে রোম সাম্রাজ্যে অন্তত ষাট জন ঐতিহাসিক লিখেছিলেন, তারা কেউ যিশুর উল্লখ করেন নি। কেননা তারা ইতিহাস লিখছিলেন, কিংবদন্তী তৈরি করছিলেন না।
দেখুন, প্রচলিত ঈশ্বর কন্সেপ্টটাই আমার কাছে একটা ধাপ্পাবাজী বলে মনে হয়। কারন, তা যদি নাই হবে, তবে বৃটিশরাজের মতো এমন হীন মানের ডিভাইড এন্ড রুল পদ্ধতিতে জগত রাজ্য চালাবেন কেন তিনি? তাঁর এক একজন অবতার আসবেন আর এক একধরনের ইজ্ম দেবেন, তাতে সরলপ্রাণ মানুষগুলো ফাঁপরে পড়ে খাবে হাবুডুবু। ওরাতো নিজেরা নিজেরা মারামারি করেই জীবন পাড় করে দেবে। তাঁর তোষামোদ করবে কখন?
ঐতিহাসিক জীশু ছিলেন কি নেই-তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটা আমাদের করা উচিত, সেটা হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশ কেন ইউরোপের খ্রীষ্ঠানদের মধ্যে ঘটল? এমন একটা ধর্মের মধ্যে, যা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সব থেকে কুঃসংস্কারাচ্ছন্ন এবং বিজ্ঞানের প্রগতিকে বিরোধিতা করেছে। এই বৈপরত্যের কারন কি? অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্ম, যা বিজ্ঞানের প্রগতিকে বিরোধিতা করে না-তা হাজার বছর ধরে ভারতের রাজধর্ম হয়েও সভ্যতাকে সামান্যই এগিয়ে দিতে পেরেছে। তাদের জ্ঞান চর্চা ভাববাদী খাতেই খরচ হয়েছে। তাহলে ইতিহাস আজ আমাদের কি শিক্ষা দেয়?
এটা নিয়ে মুক্তমোনার পাঠকরা কি ভাবছেন, তা ভাবলে বাধিত হই। আমার এই ব্যাপারে নিজস্ব কিছু চিন্তা আছে।
(১) ধর্ম আসলেই শাসকশ্রেনীর হাতে পুষ্ট একটি অস্ত্র ব্যাতীত আর কিছু নয়। মানুষকে শাসন করার বস্তুবাদি কারনেই এর ব্যাবহার-রাজনীতি ব্যাতীত ধর্মের অস্তিত্ব শুধু ভাববাদি কারনে থাকতে পারে না।
(২) ইউরোপে যখন চেতনা মুক্তির আন্দোলন শুরু হয়েছে-সেই ১৪০০-১৬০০ সালকে যদি আমরে রেফারেন্স ধরি-তাহলে কি দেখতে পাচ্ছি? ইটালীর ছোট শহরগুলিতেই এই আন্দোলনের শুরু। কেন? আমার মনে হয়েছে এর কারন শহর গুলি বাণিজ্য করে প্রভূত ধণী হচ্ছিল এবং তাদের মূল প্রয়োজন ছিল দুটি। প্রথমত যেহেতু জনসংখ্যা নেই-দরকার উন্নততর অস্ত্র এবং ব্যাণিজ্যের প্রয়োজনে নতুন উদ্ভাবন। সেই সময় অটোমান এম্পায়ারের হাতে গোটা ইউরোপের পতন প্রায় অবসম্ভাবী হয়ে ওঠে। সুতরাং বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাঁচতে, শাসক শ্রেনীর বিজ্ঞান & প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করা ছাড়া উপায় ছিল না। ফলে শাসক শ্রেণী নিজেদের স্বার্থেই চার্চ ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর নির্ভর করতে বেশী বাধ্য হয়েছে। যা টেলিস্কোপ, ছাপাখানা থেকে উন্নত মানের কামানের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং সম্পূর্ণ বস্তুবাদি কারনেই, শাসক শ্রেণী ধর্মকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে।
(৩) ভারতে বৌদ্ধদের স্বর্ণ যুগে এই পরিস্থিতির সৃষ্টী হয় নি।অর্থাৎ রাজাদের শাসন কার্যে নালন্দা বা তক্ষশীলার জ্ঞান কখনোই কাজে আসে নি। নালন্দা বা তক্ষশীলাতেই ইঞ্জিনিয়ারিং বা বাস্তুবিদ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। ফলে প্রযুক্তির সাহায্যে শক্তিশালী রাষ্ট্রের গঠন সম্ভব সেই চেতনাটাই ভারতে আসে নি। এর কারন ও সেই এক। দীর্ঘদিন বহিঃশত্রুর আক্রমনের অভাব। রাজারা নিজেদের মধ্যে যুদ্দ করত। রাজা বদলালেও প্রজাদের ধর্ম বা সংস্কৃতিতে আঁচ পড়ত না। সেটা ইউরোপিয়ানদের ক্ষেত্রে সত্য নয়। অটোমান সাম্রাজ্যের হাতে পড়ে, গোটা ইউরোপ ইসলামে ধর্মান্তরিত হবে-এই ভয়টা ১৫০০-১৭০০ সাল পর্যন্ত ইউরোপে তীব্র ভাবে ছিল। এবং অটোমানদের বিশাল বাহিনীকে খ্রীষ্ট নয়-একমাত্র উন্নতি প্রযুক্তি আটকাতে পারে-এই ধারনা শাসককুলে তীব্রভাবেই ছিল। কারন লোকবল ইউরোপের ছোট সিটী স্টেটগুলির হাতে ছিল না।
(৪) অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র মুক্তিচেতনার আন্দোলনে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়নে, ধর্মকে সরিয়ে বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেবে কি না-তা নির্ভর করছে, শাসক শ্রেনী কোনটাকে নিজেদের জন্যে গুরুত্বপূর্ন ভাবছে। যেহেতু ভারতে গত দশ বছরে প্রচুর আন্তর্জাতিক ব্যাবসা এসেছে, যার জন্যে উন্নত মানের “ম্যান পাওয়ার” দরকার, ভারত সরকার, একদশকে বিজ্ঞান গবেষনা খাতে বাজেট প্রায় তিন গুন বাড়িয়েছে। আই আই টীর সংখ্যাও দ্বিগুন করছে। শিক্ষিত যুবকদের সামনে একটা “হোপ” তৈরী হয়েছে-যে উন্নত মানের শিক্ষায় আরো ভাল চাকরি পাওয়া যাবে। অবশ্য আরেকটা শ্রেণী সেই অন্ধকারেই পড়ে আছে। তাও মানতেই হবে, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষনা খাতে সরকার অনেক বেশী খরচ করা শুরু করেছে, দেশের স্বার্থে। ডিফেন্স গবেষনাতেও খরচ বেড়েছে চারগুন। হিন্দুত্ববাদি আন্দোলন দেখা যাচ্ছে গত পাঁচ বছরে রাম ছেড়ে উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে এটা তারা করে নি-যেখানে জনগণ তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে।
(৪) বাংলাদেশের শাসক শ্রেনী বিজ্ঞানের চেয়ে ইসলামকে বেশী প্রাধান্য দিচ্ছে এর নানা বিধ কারন আছে। প্রথমটা হচ্ছে-দেশটাকে ইসলামিক রাখতে পারলে, আরবের সাহায্য আসবে-যার কাট মানি তাদের চাই।দ্বিতীয়টা হচ্ছে ভারতের দিক থেকে আক্রমনের ভয় নেই-বলা যায় বাংলাদেশ ভারত দিয়ে সুরক্ষিত। তাই বাংলাদেশের মিলিটারীকে সেই অর্থে শক্তিশালী করার কোন প্রয়োজন পড়ে নি। তাই বাইরে থেকে অস্ত্র কিনে কাট মানি খাওয়া ছাড়া শাসক শ্রেনীর মিলিটারী গবেষনাখাতে কোন দায় নেই। মিলিটারী গবেষনা যেকোন দেশের জন্যে গুরুত্বপুর্ণ-আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, ভারতের আই আই টীর গবেষনার ৭০% আসে মিলিটারী গবেষনা থেকে। তৃতীয়ত, ইসলামের আফিঙে গরীব জনগনকে পায়ের তলায় রাখার অনেক সুবিধা। ৫০% লোকের পেটের আগুনে জল ঢালার চেয়ে ইসলাম দিয়ে ব্রেইন ওয়াশ করা ছাড়া আর কি আছে? বাংলাদেশের শাসক শ্রেনীকে বিজ্ঞানমুখী করতে, সুষ্ঠ গণতন্ত্রে এবং শাসক শ্রেনীর জন্যে আরবের সাহায্য বন্ধ হওয়া প্রযোজন। তেলের অর্থনীতি শুয়ে পড়লে ( যা শুরু হয়ে গেছে), ইসলামিক দেশগুলিতেও খাবারের প্রয়োজনেই তীব্র চেতনামুক্তির আন্দোলন শুরু হবে বলে আমি মনে করি।
বস্তুবাদি কোন কারন ছাড়া, চেতনামুক্তির কোন আন্দোলন শুরু হতে পারে না। এবং খ্রীষ্ঠান ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞানের শুরুই প্রমাণ করে ধর্মটা আসলেই কোন ফ্যাক্টর না-বস্তুবাদি কারনগুলিই সমাজে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে এগিয়ে দেয়।
ইতিহাসের ‘যীশু’ চরিত্রটি বিভিন্ন মিথ এবং অতিকথনে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে গেছে যে এর থেকে আসল সত্য উদঘাটনই এখন দূরূহ হয়ে পড়েছে। যীশুর ভার্জিন বার্থের উপাখ্যান, অলৌকিক উপায়ে রোগ সারানো, ক্রুসবিদ্ধ হওয়ার পরও তার পুনুরুত্থানের কাহিনী – এ সমস্ত অনেক কিছুই প্রমাণ করে যীশুর অনেক কিছুই আসলে স্রেফ কল্পকাহিনী। যীশুর সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে কেউই যীশু সম্বন্ধে একটি বাক্যও লিখে যাননি। এর মধ্যে Josephus, Philo, Suetonius সহ অনেকেই আছেন। যীশুর মত এত বড় ব্যক্তিত্ব – যার এত হাজার হাজার অনুসারী ছিলো – তার অস্তিত্বের কোন ইতিহাসভিত্তিক দলিল সমসাময়িক লেখকদের লেখা থেকে কিন্তু পাওয়া যায় না। বাইবেলের যে চারটি গসপেল (ম্যাথু, মার্ক, লুক এবং জন) এর উপর ভিত্তি করে যীশুর অস্তিত্বের দাবী করা হয় সেগুলোও পরস্পর বিরোধী – এবং সবগুলোই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো যীশুর মৃত্যুর অনেক পরে। এ ধরণের অনেক কিছুই সত্যিকার যীশুর অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। আমি একটা বই পড়েছিলাম ‘জেসাসে’স পাজেল’ নামে – যেখানে লেখক দাবী করেছেন – no historical Jesus ever existed। আমি বইটা যোগাড় করে পড়তে অনুপ্রাণিত করব।
মুক্তমনায়ও আজ Jim Walker এর এ সংক্রান্ত একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে – Did a historical Jesus exist?
লেখাটা চিন্তার খোরাক যোগায় নিঃসন্দেহে।
যাহোক, যীশু থাকুক আর নাই থাকুক, ক্রুসবিদ্ধ যীশুর পুনরুত্থানের কাহিনী যে অসত্য আর বানানো তাতে কোন সন্দেহ নেই।