আমরা মুক্তমনা। ‘মুক্তমনা’ শব্দটি ইংরেজী ফ্রিথিঙ্কার শব্দের আভিধানিক বাংলা (এ প্রসঙ্গে পড়ুন – মুক্তমনা কি?)। ‘মুক্ত-মনা’ মূলতঃ বাঙ্গালী ও দক্ষিণ এশীয় মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী এবং মানবতাবাদীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত অলাভজনক আলোচনা চক্র। মুক্ত-মনা আমাদের বর্তমান সমাজে বিদ্যমান অদৃষ্টবাদ, ভাববাদ আর বিশ্বাস নির্ভর লাগাতার প্রকাশনা আর প্রচারণার বিপরীতে একটি বিজ্ঞান মনস্ক এবং যুক্তিবাদী ধারা প্রবর্তনে বদ্ধ পরিকর। মুক্ত-মনার আত্মপ্রকাশ তাই শতাব্দী প্রাচীণ ভাববাদী দর্শনের বিপরীতে, আজন্ম লালিত ধর্মীয় ও সামাজিক নিবর্তনমূলক সকল অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। ২০০১ সালের ২৬ শে মে তারিখে আলোচনাচক্রের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই মুক্ত-মনা মানবমনের বৌদ্ধিক বিকাশকল্পে যুক্তি-বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার উপরে গুরুত্বপ্রদানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই সাইটটি আন্তর্জালে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ফ্রিথিঙ্কার, মানবতাবাদী, নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী এবং যুক্তিবাদীদের পদচারণায় ধন্য, এবং বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল প্রগতিশীল এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী সাইট হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত (এ প্রসঙ্গে পড়ুন দৈনিক ডেইলিস্টার পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের সাক্ষাৎকার) ।
মুক্ত-মনার মাধ্যমে আমরা – একদল উদ্যমী স্বাপ্নিক তরুণেরা – দীর্ঘদিনের একটি অসমাপ্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পরিচালনা করতে চাই, যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠবে ‘চেতনামুক্তির’ লড়াই – যার মাধ্যমে জন চেতনাকে পার্থিব সমাজমুখী করে তোলা, প্রতিটি শোষণ ও বঞ্চনার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা সম্ভব। মুক্ত-মনার পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাতাবরণ তৈরীতে বিগত বছরগুলোতে অতিমাত্রায় জোর দেওয়া হয়েছিল তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মন-মানসিকতা গঠণের উপর। মুক্ত-মনা মনে করে, বিজ্ঞানমনস্ক মন-মানসিকতা এমনি এমনি গড়ে ওঠে না, বরং মানসিকতা গড়ে ওঠে যুক্তির পথ ধরে, নিরন্তর এবং ব্যাপক বিচার-বিতর্কের পথ ধরে। আজ ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্বাস এবং যুক্তির সরাসরি সংঘাতের ভিত্তিতে যে সামাজিক আন্দোলন বিভিন্ন ফোরামগুলোতে ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, তা মুক্ত-মনারা মনে করে প্রাচীনকালের ব্রাক্ষ্মণ-চার্বাকদের লড়াইয়ের মত বিশ্বাস ও যুক্তির দ্বন্দ্বেরই একটি বর্ধিত, অগ্রসর ও প্রায়োগিক রূপ। এ এক অভিনব সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বাঙ্গালীর এক নবজাগরণ যেন। গত কয়েক বছরে স্বচ্ছ চিন্তাচেতনা সম্পন্ন মুক্ত-মনা যুক্তিবাদীদের বিশাল উত্থান ঘটেছে বিভিন্ন ফোরাম এবং আলোচনাচক্রে, যা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে সম্ভব ছিল না মোটেই। জনগণের মধ্যে বিভিন্ন মত থাকা খুবই স্বাভাবিক এবং বিভিন্ন মতামতের দ্বন্দ্ব প্রয়োজনীয়, উপকারী এবং অনিবার্য। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বচ্ছ এবং সুস্থ বিতর্কের অবকাশ সৃষ্টি হলে জনগণের মধ্যে মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবোধের উপর আকর্ষণ বাড়বে এবং মিথ্যা বিশ্বাস পরিত্যাগ করে তারা যুক্তিনিষ্ঠ হয়ে উঠবে ক্রমন্বয়ে। যুক্তিনিষ্ঠ মন-মানসিকতাই অবশেষে জনগণকে পরিচালিত করবে আধ্যাত্মবাদ পরিত্যাগ করে মানবমুখী সমাজ বিনির্মাণে, সামিল করবে বঞ্চনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সংগ্রামে। মুক্ত-মনার সংগ্রামী সদস্যরা তাদের ‘শখের তর্ক-বিতর্ক’কে ভিন্নমাত্রায় উত্তোরিত করে জনচেতনাকে একটি সঠিক পথ দেখাতে সর্বদা উন্মুখ।
ছবি – ২০০৭ সালে মুক্তচিন্তার আন্দোলনে আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উজ্জল ভূমিকা রাখার জন্য মুক্তমনা ওয়েবসাইটকে ২০০৭ সালে জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক দেয়া হয় (বিস্তারিত দেখুন এখানে)।
মুক্তমনা সদস্যরা শুধু তর্ক বিতর্ক এবং আলোচনাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং সব সময় থেকেছে সামাজিক অনাচারের প্রতিবাদে দায়বদ্ধ । ‘ধর্মকে অবমাননা’র দায়ে পাকিস্তানের কারাদণ্ড প্রাপ্ত ফ্রিথিঙ্কার ড. ইউনুস শেইখ যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন তখন মুক্তমনা ইউনুস শেইখকে বাঁচাতে বিশ্বময় আন্দোলন গড়ে তুলে। সে সময় আমাদের সক্রিয় সহযোগী ছিল ‘IHEU, Rationalist International, Amnesty International, Dhaka Rationalist and Secularist Union’ এবং ঢাকার মুক্তমনাদের ‘Save Dr. Yunus Shaikh Committee’, যারা রাস্তায় নেমে দিনের পর দিন আন্দোলন, মিটিং, মিছিল, সেমিনার, পথসভা ও পাকিস্তানী দূতাবাসের সামনে প্রেসিডেন্ট মোশাররফের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন কবির চৌধুরী, বিচারপতি আবদুস সোবহানসহ দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও প্রগতির পক্ষের মানুষ। মুক্তমনা সদস্যরা আন্দোলন গড়ে তুলেছলো শাহরিয়ার কবিরের সপক্ষে তাঁর মুক্তির লক্ষ্যে, যখন তৎকালীন সরকার বিমান বন্দরে গ্রেপ্তার করেছিলো দেশদ্রোহিতার অভিযোগে। মুক্তমনারা সবসময়ই থেকেছে সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন প্রকাশ সামপ্রদায়িক নির্যাতনের বিরূদ্ধে সবর্দাই উচ্চকণ্ঠ : আমরা মৌলবাদীদের হাতে মুসলমান বা হিন্দু যেই নির্যাতিত হয়েছে তাঁর পক্ষে দাড়িয়েছি, মৌলবাদী সম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি আমাদের সীমিত শক্তি নিয়ে। গুজরাটে মুসলিম জনগোষ্ঠির উপর গনহত্যায় আমরা ধিক্কার জানিয়েছি। নরেন্দ্রমোদীর অপসারণের দাবীতে আমরা ভারতীয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে স্মারক লিপি ও প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছি, ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে একসাথে কাজ করেছি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে। আমরা জনমত গড়ে তুলেছি ইরাকে মার্কিন নগ্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, প্যালেস্টাইনের অধিকার রক্ষায়, কিংবা কাশ্মিরী স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের পাশে । ঠিক একইভাবে ২০০১ সালে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হত্যা, লুণ্ঠণ, ঘরবাড়ি অগ্নি সংযোগ বৃদ্ধিপেলে মুক্তমনা দেশের সেক্যুলার শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে এর বিরূদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা অধ্যাপক অজয় রায় অন্যান্য মুক্তমনা ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সামপ্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যানারে। তারা গঠন করেছিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে ‘গণ তদন্ত কমিশন’, যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ২০০২ সালে এবং তাৎক্ষণিকভাবে অমাদের ওয়েব সাইটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়। প্রবাসী মুক্তমনার সদস্যরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং রাস্ট্রপতিকে প্রতিবাদ পত্র প্রেরণ করেন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চালিত নির্যাতন বন্ধের দাবীতে। ব্রহ্মপুত্রের চরে রৌমারী গ্রামে বন্যাবিদ্ধস্ত এবটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল আমরা পুননির্মাণ করেছি , এবং আমরা এর পরিচালনার দায়ভার গ্রহণ করেছি। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি স্থম্ভ গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করেছি এবং সে উপলক্ষে কয়েক হাজার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার সম্মেলন করেছি এবং স্মৃতি স্তম্ভের শিলান্যাস করেছি। এর পাশাপাশি আমরা সম্মিলিত উদ্যোগে ইন্টারনেটে গড়ে তুলেছি মুক্তযুদ্ধের আর্কাইভ।
এ সমস্ত মানবতাবাদী কাজের পাশাপাশি মুক্তমনার সদস্যরা নিয়মিতভাবে প্রতিবছর প্রকাশ করে চলেছেন প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানমনস্ক বইপত্র (এ প্রসঙ্গে পড়ুন বইমেলায় মুক্তমনা লেখকদের কিছু বই)। দেশের বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়া হাজারো অপন্যাস আর লঘু বইপত্রের ভীরে মুক্তমনা সদস্যরাই তৈরি করেছে যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানমনস্ক বইয়ের চাহিদা। আমরা উদযাপন করেছি যুক্তিবাদী দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং ডারউইন দিবস। মূলতঃ মুক্তমনার কল্যানেই অখ্যাত এবং অপরিচিত ডারউইন দিবস জনগনের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে পেয়েছে এত ব্যপ্তি। মুক্তমনা আজ শুধু একটি ব্লগ সাইট নয়, এটি একটি সফল আন্দোলনের নাম। মুক্তমনা শব্দটির ব্যপ্তি আজ এতোই গভীরে, যে বিভিন্ন ফোরাম এবং ব্লগ সাইটে সমমনা প্রগতিশীল লেখকদের আজ ‘মুক্তমনা লেখক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অশেষ অবদান সৃষ্টি এবং মুক্তচিন্তার আন্দোলনে আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উজ্জল ভূমিকা রাখার জন্য মুক্তমনা ওয়েবসাইটকে ২০০৭ সালে জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশের আর কোন ওয়েবসাইট এই সম্মানে ভূষিত হয়েছে – এমন কোন নজির নেই ( এ প্রসঙ্গে পড়ুন – জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক : আমাদের কাজের স্বীকৃতি)।
মুক্তমনা সামগ্রীকভাবে একটি অরাজনৈতিক মাধ্যম। কিন্তু এর সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন নয়। লেখকদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রজ্ঞা সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে বলে মুক্ত-মনা বিশ্বাস করে। মুক্তমনা ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের ঘোষণার প্রতি আস্থাশীল এবং তার নিরিখে যে কোন গঠণমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানায় এনং মানবিক অধিকারের জন্য দায়বদ্ধ। পাঠক এবং সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া প্রবন্ধ মুক্তমনার উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলে তা বাংলা ব্লগ এবং ইংরেজী ব্লগের মাধ্যমে মুক্তমনা সাইটে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া সদস্যরা মুক্তমনা ইয়াহুগ্রুপের মাধ্যমেও বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিতে পারেন (যোগাযোগের ঠিকানা : [email protected] এবং [email protected])।
আমি একজন ১০০% নাস্তিক। ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পেরে, কিছু করতে না পেরে খুব হতাশায় এবং ডিপ্রেশনে ভুগছি। মুক্তমনাদের সাথে যুক্ত থাকতে চাই।