লিখেছেন: দীপ্ত সুন্দ অসুর
ইংরেজি ভাষায় লিখিত বিজ্ঞানের বইগুলো পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, যদি বাংলাতে এই বিষয়গুলো পেতাম, কী ভালোই না হতো। হয়ত এ নিয়েও অনেকে বিতর্ক করবেন।
শিল্পবিপ্লবের পরে,ইউরোপে বিজ্ঞানচর্চার একটা জোয়ার এসেছিল, বলতে পারি একটা প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে কিন্তু এই প্রয়োজনীয়তার হাত ধরে বিজ্ঞানচর্চার সূচনা হয় নি। নিছক শিক্ষাবস্তু হিসাবেই বিজ্ঞান পঠিত হয়েছে। দ্বিজেন শর্মার “বিজ্ঞান শিক্ষা ও আমাদের দায়বদ্ধতা” বইটির একাধিক স্থানে এই ব্যাপারটির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছ।
পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই আমাদের জন্য বিজ্ঞান অনেকটা সীমাবদ্ধ থাকলেও ইউরোপের বিজ্ঞানচর্চার ঢেউ কিন্তু আমাদেরকেও আন্দোলিত করেছিল। আমরা বিজ্ঞান নিয়ে একটু আধটু ভাবতে শিখছিলাম। জীবনের পরতে পরতে বিজ্ঞানের বিস্ময় দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। তবে ভাষাগত একটা সমস্যা ছিলই। তবুও আস্তে আস্তে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখালিখি শুরু হয়েছিল। বাঙ্গালী অনেক বিজ্ঞানী বাংলা ভাষায় লিখতে শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও লিখলেন “বিশ্ব পরিচয়”, বিজ্ঞান নিয়ে বাংলাভাষায় রচিত একটি অনন্য বই।
এদিকে বিজ্ঞানের অগ্রগতিও খুব বেগে চলতে থাকল। নিত্য নতুন আবিষ্কার, বিশেষত পরমাণু জগতের বিস্ময় জানার পর বিজ্ঞানীরা সব কিছুকে দেখার নতুন চোখ ফিরে পেলেন। জীবন যে রাসায়নিক প্রক্রিয়া ছাড়া কিছু না তাও জানা হতে লাগল জৈব রসায়নের গবেষনায়। অন্য দিকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্যের পাপড়ি খোলা শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে মত দিচ্ছেন। রহস্য খোজার চেষ্টা করছেন মহাবিশ্বের গোড়ায় যেতে যেতে।
প্রশ্ন শীল মানুষ ‘ঈশ্বরের ধারণাকে’ অনেক আগে থেকেই কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যুক্তি দিয়ে কেউ কেউ উড়িয়েও দিয়েছিল। মহাবিশ্ব তো আপনা আপনি সৃষ্টি হতে পারে না? যুক্তি তৈরীর চেষ্টায় বলা হল সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয় কেউ না কেউ আছে। অর্থাৎ একেবারে গোড়ায় গেলেও ‘ঈশ্বরের কনসেপ্ট’টাকেই মেনে নিতে হচ্ছে অনেকের।
এদিকে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি যে হতে পারে এ ব্যাপারে অনেক কাঁচামাল সংগ্রহ করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। তারাও বৈজ্ঞানিক ভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে নাকচ করে দিয়েছেন।
এখানে দাঁড়িয়ে অনেকে ভাবতে পারেন, বিজ্ঞানীদের কাজ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা। তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে প্রশ্ন তুলবে কেন?
হ্যা,এটা এখনো অনেক মেধাবী বিজ্ঞানীও মেনে চলেন। তারা কেউ কেউ ঈশ্বরকে মানেনও, মাঝে মাঝে তার পিছনে যুক্তিও দেন। তবে না মানাদের, বলতে পারি, অবিশ্বাসীদের সংখ্যাও কম নয়। তাদের কথা হচ্ছে বিজ্ঞান জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। তাহলে কেন বিশ্বাসের ভাইরাস কালচার নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না? প্রতিটি ধর্মই বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে। তবে, বাংলা ভাষায় উচ্চতর বিজ্ঞানের আলোকে এই সব নিষিদ্ধ স্থানে প্রবেশ করেছন অভিজিৎ রায়রা। যার জন্য দরকার হয়ে থাকে সাহসের, প্রয়োজন পড়ে দক্ষতা আর পরিশ্রমের। মুক্তমনা প্লাটফর্ম যেখানে এই কথাই বলে।
স্কুল কলেজে বিজ্ঞান অনেকই পড়েছে, কিন্তু জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখার মতো মন সেখানে তৈরী হয়নি। বায়োকেমিস্ট্রি কেউ যদি ঠিকঠাক বোঝে তাহলে সে বুঝেই যাবে, জীব জগতের এত সব রহস্যের মূলে কিন্তু ওই রসায়নই। শুরু থেকেই। যেখানে কোনরকম সৃষ্টিকর্তার দরকার হয় নি। আমাদের প্রেম-ভালোবাসা, কত বিচিত্র অভিব্যক্তি, কত বিচিত্র আচারণ। সবকিছুর মূলে ওই রাসায়নিক প্রক্রিয়া।
“ভালোবাসা কারে কয়” বইটিতে সেই কথাই বারবার ধ্বনিত হয়েছে। বিবর্তন যেখানে কার্যকরী করে তুলেছে প্রত্যেকটা ঘটনাকে। বাংলাভাষায় সরাসরি এভাবে অর্থাৎ রসায়নের হাত ধরে বিবর্তনের পথ ধরে মানব মনের এত উচ্চপর্যায়ের সুন্দর বিশ্লেষণমূলক বই এটিই প্রথম।
শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনা তথা এর বৈজ্ঞানিক গবেষণার একেবারে সদ্য পাওয়া তথ্যগুলো দিয়ে অভিজিৎ রায় এবং মিজান রহমান সুন্দর সহজবোধ্য ভাষায় লিখেছেন,”শূন্য থেকে মহাবিশ্ব “সৃষ্টির কথা। যা কিনা বাঙালী পাঠকের চিন্তায় একটা নতুন মাত্র যোগ করেছে। প্রশ্ন তুলতে তুলতে গোড়ায় গিয়ে অবশেষে ‘ঈশ্বর’ আছেন -এই সিদ্ধান্ত আর নিতে হচ্ছে না। কেননা, এখানে ‘কিছু না’র থেকেই ‘কিছুর’ সৃষ্টি হচ্ছে যা কিনা বাংলা ভাষায় তুলে ধরেছেন খুব অনবদ্য ভাষায়। আর মীজান রহমান গাণিতিক শূন্যতাকে যেন ধীরে ধীরে আবিষ্কার করেছেন।
সব মিলিয়ে বলতে পারি, বাঙালির থমকে যাওয়া বুদ্ধির চর্চাকে এই বইটি বেগবান করেছে, যা কিনা বাংলা ভাষায় প্রথমই বলতে পারি।
“বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর”-এই ধাচের কত কত কথা আমাদের বিশ্বাসের ভিতকে পোক্ত করতে চায়। কিন্তু যখন ওই বিশ্বাসের জন্যই জ্বলে হিংসার আগুন, ছোটে রক্তের ফিনকি, একই মানুষ বিভক্ত হয়ে যায় বর্ণে বর্ণে-তখন কি বলা হবে? তাহলে কি বিশ্বাসে আর কি আস্থা রাখা যাচ্ছে? যেহেতু যাচ্ছে না সেহেতু প্রশ্ন তুলতে হবে। এই প্রশ্ন তোলা আর তার উত্তর খোজার মধ্যে দিয়ে “বিশ্বাসের ভাইরাস”(অভিজিৎ রায়) এবং “অবিশ্বাসের দর্শন” (অভিজিৎ রায় ও আবীর রায়হান) দুটো বই যেন আলোকিত করছে অনেক অন্ধকারাচ্ছন্নকে।
এই দিকটা নিয়ে বাংলাভাষায় কিছু কিছু লেখা হলেও বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই বই দুটিতে। খণ্ডন করা হয়েছে অনেক প্রচলিত মিথকে, যা কিনা অন্যন্য।
এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আমরা বলতেই পারছি, অভিজিৎ রায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় একটা নতুন মাত্রা যোগ করে গেছেন। যেটার খুব দরকার ছিল। সাহস, বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা আর নিরলস পরিশ্রম করে তিনি আমাদেরকে চিন্তা করার এক একটি সহজ পথ দেখিয়েছেন। সৃষ্টি করে গেছেন অসংখ্য লেখক-লেখিকা নিজস্ব অনুপ্রেরণা-নির্দেশনায়। তবে আমার লেখক হয়ে ওঠার সেই সুযোগ হয় নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি যদি বেচে থাকতেন,তবে আমার লেখাও অন্যরকম হতো হয়তোবা। আমাকেও লিখতে বলতেন মুক্তমনায়। কিন্তু যেটা বাস্তব, তিনি নেই। হয়তো,মেডিকেল ছাত্রদের পড়াশোনায় ব্যবহৃত হচ্ছেন নতুবা এখনো শুয়ে আছেন সুরক্ষিত!!নিরাপত্তায়!! দারুণ নিরাপত্তায়!!!
শুভ জন্মদিন দাদা। ইতিহাস ঠিকই খুজে নেবে তোমাকে। অন্ধকার কার ভালো লাগে? আলোর পথে আসবেই,তোমার সেই খুব চিন্তার অন্ধকারচ্ছন্ন দেশগুলো!!!
অভিজিৎ রায় – অভিজিৎ রায়ই। লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
হ্যা,অভিজিৎ রায় যে চিন্তার দিকনির্দেশ করে গেছে আমরা সেই দিকে হাটতে হাটতে অনেক আলো আনতে পারবো।
ধন্যবাদ আপনাকেও। লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
বাহ্, পরিচ্ছন্ন এবং সহজবোধ্য বক্তব্য পড়ে ভালো লাগলো বেশ। নিজে অকৃত্তিম থেকে সহজ প্রশ্ন তোলা, সহজ ভাবনাকে তুলে ধরা দ্বায়িত্ববোধ থেকে উৎসারিত। এমনি সহজ ভঙ্গির লেখা মুক্তমনায় উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ।
” নিজে অকৃত্তিম থেকে সহজ প্রশ্ন তোলা, সহজ ভাবনাকে তুলে ধরা দ্বায়িত্ববোধ থেকে উৎসারিত।”
ধন্যবাদ দাদা।হ্যা,প্রশ্ন তুলে তার উত্তরে খুজে সেটাকে তুলে ধরার সত্যিই একটা দায়িত্ববোধ কাজ করে ভিতরে ভিতরে।