ঝোপের আড়ালে বসে আছে কামাল। অন্ধকার। মশাগুলো যেন নির্মোহ শয়তানের মত চুষে খেয়ে নিচ্ছে ওর সবটা। তবুও খুব বেশী নড়তে চড়তে পারছে না। কারণ বেশী নাড়াচাড়া করলেই চোখে পড়ে যাবে, আর পুরো প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে। এই সন্ধ্যা পেরুনো রাতে ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করছে ফারুকের জন্য। গত দুইদিন ধরে ও দেখেছে ফারুক লুকিয়ে লুকিয়ে ফুটবল প্র্যাকটিস করছে। একমাত্র তীর ছোঁড়া আর যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত খেলা ছাড়া আর সব খেলা “শান্তি”-র ধর্মে নিষিদ্ধ, তাই এখানেও নিষিদ্ধ, এটা সবাইই জানে। কিন্তু জেনেশুনেও ও এত বড় অপরাধ করছে, তাও আবার লুকিয়ে, এই অপরাধের শাস্তি না দিয়ে থাকা যায় না। তার উপর আবার গতকাল ও মাগরিবের নামাযের সময়ে মসজিদে না গিয়ে খেলছিলো। কী ভয়াবহ অপরাধ! এই জঘন্য অপরাধের শাস্তি একটাই, শান্তির পথে কাঁটা হয়ে উঠতে থাকা অশান্তিগুলোকে বিদেয় করে দেয়া। ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘাড়ে এক জোড়া আঘাত করবে বলে ঠিক করেছিলো, কিন্তু কালকের বিষয়টা চোখে পড়ার পর ঠিক করেছে দুই জোড়া আঘাত করবে। এখন অবশ্য কোনো স্কুল নেই, সব মাদ্রাসা, কিন্তু ওরা যখন ছোট ছিল তখন স্কুল ছিল, সেই স্কুলের ফুটবল টিম ছিল, সেই টিম সবসময় হারতো ফারুকদের টিমের কাছে। তখন থেকেই একটা চাপা ক্ষোভ ছিল কামালের। তবে আজকে সেই ক্ষোভকে কোনো কারণ হিসেবে মানছে না সে। সে শুধু জানে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাকে এটা করতেই হবে। “উফ! মশা দূর করার কোনো দোয়া যদি থাকতো, তাহলে এ দফায় বাঁচা যেতো। আছে নিশ্চয়ই খুঁজে দেখতে হবে।” ভাবতে ভাবতে ফারুকের অপেক্ষায় সচেতন শান্তির দূত কামাল।
ফারুক তার পিঠের ব্যাগে বলটা ঢুকিয়ে নিয়েছে। কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না আজকাল। কখন যে কী করে ফেলে। তাই একটু আঁধার হলে তারপর বেরোয়। এজন্যে গতকাল মাগরিবের নামায মিস করেছে, ভাবতে খারাপই লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই, যেখানে প্র্যাকটিস করছে ওখানেও খুব সাবধানে করতে হয়। ও অনেকবার অনেককে বুঝিয়েছে,”দেখো, ক্রিকেটে আমাদের শান্তির ভাই পাকিস্তান আজ ভাল খেলছে বলেই তো সবাই ওকে সাপোর্ট করতে পারছি, কিন্তু ফুটবলে তো এখনো কেউ দাঁড়াতে পারলো না। আমাদের দাঁড়াতে হবে, অন্তত শান্তির স্বপক্ষের একজন প্রতিনিধি হলেও থাকা উচিৎ। নইলে আজীবন তো ইহুদি নাসারাদেরই সাপোর্ট করে যেতে হবে। কিন্তু কেউই মানতে চায় না। সবার একটাই কথা। খেলাধুলা নাকি হারাম! কীযে বলে, নিশ্চয়ই কোনো ভুল অনুবাদ। আমি বিশ্বাস করিনা শান্তির সাথে খেলার কোনো বিরোধ আছে। ওরা বলে, খেলা নিয়ে মারপিট হয়, ঝগড়া হয় এইজন্যে খেলা অশান্তির কারণ। কিন্তু এর জন্যে তো যারা খেলে তারা দায়ী না, কেউ যদি ঠিকমত খেলা না দেখে তাহলে খেলোয়াড়ের দোষ? নিশ্চয়ই সবার ভুল হচ্ছে, খেলা হারাম হতেই পারে না। আমি যেদিন দেশ পেরিয়ে খেলতে যাবো, খেলায় জিতে সবাইকে আনন্দে মাতাবো সেদিন সবাই বুঝবে।” এইসব ভাবতে ভাবতে মোড়ের কাছে আসতেই হঠাৎ –
চোখের পলকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ফারুক। তার ঘাড় বরাবর দুজোড়া কোপ। পেছন ফিরে দেখার সময়টা আর পায়নি।
রক্তাক্ত চাপাতিতে লেগে থাকা নাপাক রক্তগুলো পানিতে ধুয়ে খুব সন্তুষ্ট মনে ঘরে ফিরতে লাগলো কামাল। অদ্ভুত এক অনুভূতি। অশান্তি দূর করে শান্তির পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া, আর সেখানে তার নিজের অবদান রাখা। ভাবতেই গর্বে বুক ফুলে উঠছে কামালের। ফারুকের ঘরে খবরটা পাঠিয়ে দিয়ে এখন নিজের ঘরে ফিরছে।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই শোরগোল শোনা গেল। কীসের এত আওয়াজ?
দৌড় দিলো কামাল। লাশ পড়ে আছে ওর বোনের। ওর ছোট্ট বোনের।
তাকানো যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়েছে ওর ছোট্ট মুখে।
চিৎকার করে উঠলো,
“কে করলো এই কাজ? কেন করলো?”
ভিড়ের মাঝে একজন বলে উঠলো,
“পাশের বাড়ির জহির ওকে মেরেছে পাথর দিয়ে। আর বলেছে, বোরকা পরে বের না হয়ে ও ছেলেদের খারাপ করে ফেলছে। এইজন্যেই এই শাস্তি।”
আরো তীব্র হল কামালের চিৎকার,
“আমার বোন তো হিজাব পরতো।”
“কিন্তু হিজাব তো সঠিক পোশাক না। পুরো শরীর ঢেকে রাখা দরকার। এমনকি চোখের সামনেও একটা পর্দা থাকতে হয় যাতে মেয়েরা নিজেরাও কোনো পরপুরুষকে দেখতে না পারে।”
ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলো,
“তাই বলে মেরে ফেলবে? এটা কেমন কথা?”
আরেকজন সাথে সাথে বললো,
“না, মারাটা আসলে ঠিক হয়নি, তবে ওরও উচিৎ ছিল পুরো শরীর ঢেকে রাস্তায় নামা।”
অমনি আরেকজন চিৎকার করে উঠলো,
“ঠিক হয়নাই মানে, কী বলতে চান আপনি? অবশ্যই ঠিক হইছে। এইসব বেগানা মাইয়ারা রাস্তায় ঘুরে বইলাই এত অশান্তি।”
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কামাল। থেমে গেল। “ভুল বলেনি কেউ। এটাই তো হওয়ার কথা। শান্তির পথে কষ্ট আছে। নবী তার পুত্রকে যদি জবাইয়ের জন্য নিতে পারে সেখানে আমি আমার বোনকে হারানোর শোকটা মানতে পারবো না? কেন এই ভুল করলি? কেন?”
বোনকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বারবার ওর জহিরের কথা মনে পড়ছিলো। জহির ওর বোনটাকে অনেকবার বাজে প্রস্তাব দিয়েছিলো সাড়া দেয়নি, তাই এভাবেই প্রতিশোধ নিলো ও। যত যা-ই হোক ওরও প্রতিশোধ নেয়া চাইই, নিতেই হবে।
হঠাৎ করেই মাথায় খেলে গেল, জহিরের চেহারাটা, দাড়ি নেই। হ্যাঁ, ওর এত বড় সাহস দাড়ি রাখে না। কাল একেবারে ভোরবেলা করে ওকে মারতে যেতে হবে।
এদিকে ফারুকের বাসায় কান্নার রোল। ওর বাবা-মাও জানতো না যে, ফারুক আড়ালে ফুটবল প্র্যাকটিস করে। সবাই ওদের দোষারোপ করছে, কেন ওদের ছেলেটা ফুটবল খেলতে গেল, নইলে তো আজ এই অবস্থা হতো না। ফারুকের ছোটভাইটা কোন সময় ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে কেউ দেখেনি। কোথায় ও?
গভীর রাত। বোনের লাশটা দাফন করে ঘরে ফিরছে কামাল। বারবার মনে পড়ছে স্মৃতিগুলো। একটাই মাত্র বোন ছিল। একটাই। বাবা নেই, মা নেই। শুধু এই বোনটাই। চিন্তায় চিন্তায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো, তাই হয়তো দেখেনি পেছন থেকে কেউ একজন খুব কাছাকাছি চলে এসেছে ওর। মুহূর্তেই সব শেষ। মাটিতে পড়ে গোঙাতে লাগলো কামাল। পেছন ফিরে দেখতে পারলে ফারুকের ছোটভাইটাকে দেখতো ও।
পরদিন ভোরে কামালের লাশের চারপাশে দাঁড়ানো সবাই বলাবলি করছিলো, ইশ, ছেলেটা গোড়ালির ওপর পরলো না কেন প্যান্টটা, তাহলেই তো আর সমস্যা হত না।
“শান্তি আক্রান্ত পৃথিবী”-তে আপনাকে স্বাগতম…
সত্যিকারের চিত্র।এটাই হতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি।
আমরা এখন কোন পৃথিবীর বাসিন্দা? সংখ্যাগরিষ্ঠ দের মন ক্যান্সারাক্রান্ত। প্রচন্ড ঘৃণায় জর্জরিত প্রজন্ম তাই খুব সহজেই মানুষ জবাই করে ফেলে।ছোটবেলায় তাদের ভেতর পুঁতে দেওয়া ঘৃণার বীজ আজ তার ডালপালা মেলে এক বিশাল মহীরুহ। তার ফল ভোগ করছে আজ গোটা পৃথিবী।
যদি না মানুষ নিজের পায়ে মানুষের মত দাঁড়ায়, তা’হলে আসলে এইটাই হবে অদূর ভবিষ্যৎ। কোনই সন্দেহ নাই 🙁