প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

১৯৬০ সালে আসাম ভাষা আইন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে বরাক উপত্যকায় শুধু যে বাংলা ভাষাভাষীদের অধিকার বিপর্যস্ত হয়েছিলো, তা নয়। অন্যান্য ভাষাভাষীদের ভবিষ্যৎ জীবনও অন্ধকারে ডুবতে বসেছিল। তাই নিজেদের আলাদা ভাষা থাকা সত্ত্বেও অন্য ভাষাভাষীরা বাংলা ভাষা আন্দোলনে সচেতন ভাবে অংশগ্রহন করেছিলেন। এই আন্দোলনকে সার্বজনীন রূপ দেবার জন্য বিভিন্ন ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের নেতারা কঠোর পরিশ্রম করেন। বিধান সভার সদস্য পদ ত্যাগ করে ” বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের চা বাগান ” ও অন্যান্য এলাকায় ঘুরে ঘুরে আন্দোলন সংগঠিত করেন। মণিপুরি নেতা সন্তু সিংহ, মদন মুখার্জি,নন্দকিশোর সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে মণিপুরি গ্রামে গ্রামে সভা বৈঠক হয়। করিমগঞ্জ শহরে অনুষ্ঠিত জনসভায় কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র শিক্ষানুরাগী ড.ত্রিগুণা সেন ও পশ্চিম বঙ্গের ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নন্দগোপাল ভট্টাচার্য এই আন্দোলনকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন।
সেদিন যারা নিজ নিজ জীবন উৎসর্গ করে বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তাঁরা হলেন- কমলা ভট্টাচার্য (ছাত্রী), সুকোমল পুরকায়স্থ, শচীন্দ্র পাল, হিতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর,কানাইলাল নিয়োগী, সতেন্দ্র দেব, তরনীচন্দ্র দেবনাথ, কুমুদরঞ্জন দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর ও সুনীল সরকার। ১৯৬১ সালে সফল ভাষা আন্দোলনের পরও বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার উপর আন্দোলন বন্ধ হয় নাই। মণিপুরি ভাষার উপরও আক্রমণ এসেছে। ১৯৭২ সালে শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার দাবী জানাতে গিয়ে আত্মউৎসর্গ করেন বাচ্চু চক্রবর্তী।
১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ সফর করেন। এই কালপর্বে আসাম সরকার নতুন ভাবে বরাক উপত্যকার সকল স্কুলে অসমীয়া ভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ জারি করে। ২১ জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর আগমনের দিন উক্ত নির্দেশ বাতিলের দাবিতে করিমগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচী পালন করা হয়। পুলিশ ঐ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে দু’জন যুবক নিহত হয়। এই দুই যুবকের নাম জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাশ। এই দু’জন নিয়ে নিহতের সংখ্যা দারায় ১৩ তে। এভাবে করিমগঞ্জে আরেকটি ভাষা দিবসের উন্মেষ ঘটে। বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় বারবার আন্দোলন ও প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বরাক উপত্যকা ভাষা আন্দোলনের পীঠভূমি হয়ে উঠেছে। শুধু বাংলা ভাষার জন্য নয়, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে এখানে মণিপুরি কন্যা সুদেষ্ণাকেও প্রাণ দিতে হয়েছে।
মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ এবং রক্তদান পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এই গৌরব ও অহংকারের অধিকারী আমাদের বাংলাদেশ আর ভারতের বরাক উপত্যকা। পৃথিবীর আর কোন দেশ এ রকম সম্মানের অধিকারী জানা নেই। একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের এক মহান অর্জন। জাতির যেকোনো দুর্যোগ-দুর্দিনে একুশ একটি প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। একুশ আমাদের পথ দেখায়, আলোর সন্ধান দেয়। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একুশ আমাদের অন্যতম প্রধান একটি হাতিয়ার। ঠিক তেমনিভাবে বরাক উপত্যকাবাসী বিশেষকরে সেখানকার বাংলা ভাষাভাষী জনগণের কাছে ১৯ মে একটি বড় অবলম্বন। বাংলাভাষী জনগণের সকল অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার আলোকস্তম্ভ ১৯ মে। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা আন্দোলনের উদ্বোধন ঘটেছে ২১ শে ফেব্রুয়ারিতেই। আর বরাকবাসীকে সচেতন করে তুলেছে ১৯ মের আন্দোলন। নিজেদের অধিকার রক্ষা আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার তাগিদ উপলব্ধিতে ১৯ মে বরাক উপত্যকা বাসীকে উজাড় করে দিয়েছে সাহস, প্রেরণা আর শক্তি। ভাষা আন্দোলনে বিজয়ের গৌরব আএ সুমহান উত্তরাধিকার নিয়ে বিশাল ভারতের এক প্রান্তিক এলাকা বরাক উপত্যকা সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বরাক উপত্যকার ভাষা-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা ও উৎকর্ষ সাধনে মহান ১৯ মে এক অবিনাশী ও অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।