কেশব অধিকারী

(ফেব্রুয়ারী ২১, ২০১৩)

একুশের এই প্রহরে আমার সমস্ত আবেগ, যৌক্তিকতা বোধ আর ভালবাসা আজ বাংলার এই প্রজন্ম চত্ত্বরে সমবেত তরুণ যুবাদের জন্যে নিবেদিত হলো। যে স্বপ্ন আমি দেখতাম আজ সেই স্বপ্ন বাস্তব! আমি তোমাদের পাশে ছিলাম, আছি আর থাকবো। কোথায় পেলে এই অদম্য সাহস! তোমাদের সাথে আজ আমরাও জেগেছি। বাংলা জেগেছে। জয় বাংলা! এই জাগরণ চিরজীবি হোক। স্মরণীয় হোক। ইতিহাস হোক। বাংলাদেশের মানুষ যে আশায় বেঁধেছিলো বুক, বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলো, একটা মহান জাতির স্বপ্ন দেখেছিলো, তোমরা সত্যি সেই মহান জাতির অগ্রগামী প্রতিনিধি। তোমরা অমর হয়ে রইবে চিরকাল। তোমরাই যোগ্য বাংলার রেনেসাঁ সৃষ্টির জন্যে।

বিশ্ববাসী দেখো, বাংলা আজ সত্যিই জেগেছে! তোমরা দেখো আমাদের সন্তানেরা কি বর্ণাঢ্য ইতিহাস সৃষ্টি করতে জানে! আমরা আমাদের দেশকে নিজস্ব আবেগ, ভালোবাসা, মমত্ব আর অনিঃশেষ বীরত্ত্বে স্বাধীন করেছিলাম। অনেকেই তোমরা সেদিন আমাদের এই বিজয়কে দেখতে চাওনি, পাশে থাকোনি। কেউ কেউ বরং আমাদের বিরুদ্ধে শক্তি আরোপের স্পর্ধা দেখিয়েছিলে! কিন্তু আজ দেখো, আমরা বড় হয়ে উঠতে পারি। সেই আত্মবিশ্বাস আর প্রত্যয় আমাদের চিরকালই ছিলো। আজও আছে। প্রায় ৫৪৩ খৃষ্টপূর্বাব্দে বাংলার বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করে ইতিহাস হয়ে রয়েছেন! গৌড়ের রাজা গোসাল হত্যার প্রতিশোধ নিতে একদল শসস্ত্র বাঙ্গালী যোদ্ধাসহ কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যকে শিক্ষা দিতে সমতল থেকে দুর্গম পাহাড়ে অভিযান চালিয়েছিলেন অষ্টম শতাব্দীতে! আমাদের দামাল ছেলেরা ঐ বর্বর পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলো প্রায় শুণ্য হাতে একাত্তরে! আমাদের প্রতিবেশী ভারত সেদিন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো বন্ধু সুলভ হাত বাড়িয়ে এই অসম যুদ্ধের শেষ দিকে। আমরা আমাদের দৃঢ়তা দিয়ে আর তাদের সাহায্য নিয়ে মোকাবেলা করেছিলাম বিশ্বের বর্বরতম অসম ভারসাম্যের এক শক্তিকে! সেদিন যে অসাধ্য সাধন আমরা করেছিলাম সেই মনোবল আজো অটুট আমাদের মাঝে। স্বাধীন দেশ গড়তে গিয়ে আমরা হোঁচট খেয়েছিলাম! তাও সেটি ছিলো আন্তর্জাতিক ভাবে পরিকল্পিত চক্রান্তের ফল! তোমরা কেউ কেউ সেদিন আমাদের ভেতরে সেঁধিয়ে থাকা বেঈমানদের যোগ সাজসে তা বাস্তবায়ীত করতে পেরেছিলে! আজ আমাদের ছেলে-মেয়েরা জেগেছে, আমাদের জাগিয়েছে। আমরা নতুন সূর্যদয় দেখতে পাচ্ছি দিগন্তের ঐপারে! আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। চোখ কচলে এক আশ্চর্য ভোরের হাতছানী আমাদের আপ্লুত করেছে। আজ আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। আমাদের তরুণেরা তা বুঝেছে। আর কারো সাধ্য নেই আমাদের পেছনে টানে। আজ আমরা এগোবোই।

 

১৯৭১ এ দেশকে শত্রুমুক্ত করে আমরা ভেবেছিলাম আমাদের শ্যামল ভূমিকে শান্তিময় করে গড়ে তুলবো। আমরা উৎপাদন করবো খাদ্য-বস্ত্র, নির্মান করবো ঘর। আমরা চিকিৎসায়, বিজ্ঞানে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, ব্যবসা-বানিজ্যে কীর্তিমান হবো। কিন্তু পরাজিত শক্তির এদেশীয় অনুচরেরা সেদিন তা হতে দেয়নি। ১৯৭৫ সালে আমাদের রাষ্ট্রনায়ককে হত্যার মধ্যদিয়ে তাদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বীজ রোপন করে। দেশে পরাজিত আলবদর রাজাকারদের ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের পুনর্বাসিত করা হয়। তাদের হাতে আমাদের পবিত্র পতাকাকে তুলে দিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ আর এজাতির পরম ত্যাগকে চরম ভাবে পরিহাস করা হয়। সেই স্পর্ধা যারা দেখিয়েছিলো ক্ষমা নেই তাদের। আমাদের সন্তানেরা কোনদিন তাদের ক্ষমা করবে না। আজ হিসাবের দিন সমাগত। এতোদিন গুমরে কেঁদেছিলাম। আমাদের ছেলেরা বলেছে, “ওরা কাঁদতে আসেনি, ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছে”, এইসব প্রবঞ্চকদের শায়েস্তা করতে এসেছে। পাকিস্তান নামের ঐ বর্বর দেশটি আজও আমাদের কাছে সামান্যতম দুঃখ প্রকাশ করার সৌজন্যতা দেখায়নি। ফিরিয়ে দেয়নি যা আমাদের ন্যায্য দাবী ছিলো। ধর্মের নামে আজও তারা তাদের প্রভু সমেত আমাদের খামচে ধরতে উদ্যত!

বিগত ৪২ টা বছর যে মা, যে বাবা তাঁর হারানো সন্তানের বেদনা বয়ে বেড়িয়েছেন, যে যোদ্ধা অপমানিত হয়ে দ্বারে দ্বারে ফিরেছিলো, যে বোন তাঁর সম্ভ্রম হারিয়ে গুমড়ে মরেছিলো, যে বীর তাঁর অঙ্গ হারিয়ে অন্ন সংস্থানের ক্ষমতা বিসর্জন দিয়েছিলো, যে সন্তান তাঁর বাবা কিংবা মা-কে হারিয়ে অসহায় হয়ে এই কালিমালিপ্ত সমাজেরই কোথাও আনাচে-কানাচে অবহেলিত হয়ে বেড়ে উঠেছে নতুবা অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে। আজ সময় এসেছে তাদের কাছে আমাদের হিসেব দেবার। সেদিন ওঁরা আত্মত্যাগের মহীমায় সমুজ্জ্বল ছিলো। কিছুই প্রত্যাশা না করেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাঙ্গালীর জন্যে রাষ্ট্র তারা প্রতিষ্ঠা করেছিলো। কিন্তু শুধুমাত্র সেই কারনেই তাদের পরবর্তীতে লাঞ্চিত হতে হয়েছিলো। এই ক’দিন আগেও একজন মুক্তি যোদ্ধাকে আমাদের ইঞ্জিনীয়ার্স ইনস্টিটিউটে পদাঘাত করার দুঃসাহস কেউ কেউ দেখিয়েছিলো! রাজশাহী, চট্টগ্রাম আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী, সন্তানদের ওরা আর ওদের রক্তবীজের মতো বেড়ে উঠা কীটেরা হাত পায়ের রগ কেটে দিয়ে পঙ্গু করে রেখেছে, শিক্ষককে হত্যা করে সেফটি ট্যাঙ্কে মৃতদেহ ঢুকিয়ে রেখেছে, অধ্যাপক মুহূরীকে মাথায় গুলি করে তাঁর নিজ বাসভবনে হত্যা করেছে! ২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগীদার হয়ে আমাদের জায়া, জননী, কণ্যার সম্ভ্রমে হামলা করেছে। ওদের পাকি প্রবৃত্তির পরিবর্তন কখনোই হয়নি। ক্ষমা নেই ওদের ক্ষমা নেই।

সৌদীআরবের পোট্রোডলার আর পাকি ষড়যন্ত্রে অধুনা এদেশে ওরা অর্থনৈতিক আধিপত্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে। জায়গায় জায়গায় গড়ে তুলেছে রকমারী মাদ্রাসা। অধুনিক শিক্ষা থেকে শিশুমনকে বঞ্চিত করে এদেশের শিশুদের মানসিক ভাবেই পঙ্গু করে রাখা হয়েছে, সম্পূর্ন অসদুদ্দ্যেশ্যে! এই সব শিশুরাই একটু বড় হয়ে ক্রীতদাসে, সন্ত্রাসীতে  নতুবা ভিক্ষুকে পরিনত হয়। এরা আফগানিস্তানে, সিরিয়ায় ইসলাম কায়েম করতে যায়! পরে দেশে ফিরে এসে সন্ত্রাসীতে পরিনত হয়, বাংলা ভাইদের মতো। ঐ পেট্রোডলারের জোরে এদেশে ওরা গড়ে তুলেছে ব্যাংক, বীমা কোম্পানী, ছোট-বড় খামার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান, ছোট-বড় চিকিৎসা কেন্দ্র, মেডিক্যল কলেজ, অসংখ্য ক্লিনিক, দাতব্য চিৎসালয়, মেডিক্যল স্টোর, ঔষধ কোম্পানী, অসংখ্য দৈনিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা, রেডিও সম্প্রচার কেন্দ্র, টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র, সাংবাদিক দের সংগঠন, আইন-বিচার সংশ্লিষ্ট সংগঠন সহ রকমারী পেশাগত সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, বহুতল আবাসিক ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর গোপন সামরিক প্রশিক্ষন কেন্দ্র। এমন ভাবে আমাদের সমাজে এরা বিস্তার লাভ করেছে যে আমাদের দৈনন্দিন কাজে ওদের কোন না কোন একটা প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ আমাদের প্রায় হতেই হয়। আমাদের পূর্বসূরীরা এবং আমরা ওদের এমনভাবে সুযোগ করে দিয়েছি যে, ওরা আমাদের প্রায় মাথায় চড়ে বসার স্পর্ধা দেখাতে এতোটুকুও দ্বিধা করেনা কখনো। এই পেট্রোডলারের কারণে এদের যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এবং মাফিয়া চক্রের সাথে গভীর মেলবন্ধন রয়েছে ইতোমধ্যেই তার নমুনা আমরা পেয়েছি। আমাদের বিগত সরকারের আমলে সরকারী আনুকুল্যে বিপুল পরিমান অবৈধ অস্ত্র আমাদের চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যক্টরী জেটিতে ধরা পরেছিলো। আজ স্পষ্ট যে সেই সব অবৈধ অস্ত্র আমদানীর সাথে আমাদের বিগত সরকার তার প্রশাসন আর এই পরিত্যাজ্য পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির একটা যোগ সাজশ ছিলো। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত অত্যন্ত নির্লজ্জ্ব ভাবে আজকের যুদ্ধাপরাধীদের নাটের গুরু গোলাম আজমের কাছে একবার দোয়া চাইতে গিয়েছিলেন! কি হাস্যকর একবার ভাবুন! ইনিই নাকি আমাদের জাতির পিতার সন্তান!

সেই জন্যে আজকের প্রজন্মের কাছে আমি নতশিরে ক্ষমা চাই। এগুলো আমাদের-ই ভুল। আমরাই লোভে লালসায় কিংবা গোয়ার্তুমি করে আমাদের মেধা বিকাশের পথ গুলো কে রুদ্ধকরেছি। আমরা আস্থা হারিয়েছি নিজেদের উপর থেকে, বিশ্বাস হারিয়েছি পরষ্পরের আর আমাদের যে স্বজাত্যবোধ-জাত্যাভিমান, তা স্বযত্নে চাপা দিয়েছি পশ্চিমী আলখেল্লা-হিজাবের নীচে। নিজেদের দেশটিকেই আর এখন নিজেদের বলে মনে করিনা। একধরনের সংকীর্নতা গ্রাস করে আমাদের। যদি বলি, আমরা বাঙ্গালী, বলতে আসলে সংকোচ করি অনেকে, মনে মনে ভাবি যে শুনলো সে বোধ হয় ভাবলো আমি ভারতপন্থী! হয়তো কেউ কেউ বলবে আমরা বাংলাদেশী, বাঙ্গালী নই, কারন বাঙ্গালী তো ভারতেও আছে, ওরা হিন্দু! কি অদ্ভূত উপলব্ধি! মুসলমান হিসেবে আমরা নিজেদের আলাদা করে নিয়েছি। বিচ্ছিন্ন করেছি নিজেদের নিজেদের কাছ থেকেই। ফলে কি হয়েছে, এইসব অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মধ্যযুগীয় মানসিকতার পরিত্যাজ্য লোক গুলোর বয়ানের মাধ্যমে কোরাণ-হাদিসের মর্ম আমাদের এবং আমাদের শিশুদের বুঝতে বাধ্য করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতা আজও বর্তমান। দিনকে দিন আমরা দেখেছি আমাদের টেলিভিশন গুলো এই সব যুদ্ধাপরাধীদের সেটের সামনে বসিয়ে আমাদের ধর্মীয় জ্ঞান দেবার ব্যবস্থা করেছে! আমাদের পাঠ্যসূচী, বিশেষ করে ধর্মীয় পুস্তক গুলো, যেগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে, যান গিয়ে দেখুন, কিভাবে সেখানে শিশুকে তার সহপাঠীর প্রতি বিদ্বেষ শেখানো হয়! জেনে শুনেই এসব আমরা করেছি। যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোনদিনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। চিরকালই যেনো আমরা হয়ে থাকি পশ্চাদপদ আর অন্যের করুণার আধার, পরষ্পরের বিরোধী, বিভাজিত। আমাদের যা কিছু নিজস্ব সবই আমরা হেলায় হারিয়েছি। সংকীর্ন মনোবৃত্তির বেড়াজালে আমাদের আবদ্ধ করা হয়েছে। এই দেশ আমাদের। এই দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা এক সাথে বেড়ে উঠবো, গান গাইবো, মাথা উঁচু করে বিশ্ববুকে আমাদের সার্বজনীনতাকে তুলে ধরবো। অথচ দেখুন, ধর্মীয় ভাবেতো বটেই এমনকি এদেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠীকে পর্যন্ত অস্বীকার করে গোটা দেশটিকেই পশ্চাদপদ করে তোলা হয়েছে। পাহাড়ের জনপদ আজ রক্তাক্ত। শান্তি চুক্তি করা হয়েছিলো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই তাঁর বিগত সেশনে তা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবায়ন হলোনা কেনো? কোন অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে আজ সেখান থেকে আমাদের পশ্চাদপসরণ? আমরা জানতে চাই। এদেশ আমাদের সবার। বাঙ্গালী যেমন থাকবে তাদের আপন আবাস ভূমিতে ঠিক তেমনি এখানে আমাদের সাথেই থাকবে এই মাটিতেই বেড়ে উঠা খাসিয়া, মগ, চাকমা, মারমা সহ সবাই। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি, ভাষা, সামাজিকতার প্রসারের মধ্য দিয়েই এই দেশকে এক বৈচিত্র্যময় জগতে রূপান্তর করবে। আজকের তরুণ প্রজন্মের এইটেই ধ্যান এইটেই জ্ঞান। অথচ এখানে মানুষের সহজাত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে অবদমিত করা হয়েছে নানান কৌশলে। ধর্মীয় আফিমে আর অবৈধ কিংবা সহজপথে অর্থোপার্জনের প্রতিযোগীতায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে গোটা জনগোষ্ঠীকেই দুর্নীতিপরায়ন করে তোলা হয়েছে। সেই জন্যে আজ যেদিকেই তাকাবেন দেখবেন সমাজের প্রতিটা স্তর আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জ্বিত। শিক্ষক থেকে সুইপার  অথবা ভিখিরী থেকে প্রধানমন্ত্রী কেউই আজ বুকে হাত রেখে বলতে পাবেন না যে দুষ্টনীতির কালিমা তারা শ্পর্শ করেননি। এই পঙ্কিলতা থেকে আজ আমাদের বেড়িয়ে আসতেই হবে যদি জাতি হিসেবে আমাদের টিকে থাকতে হয়।

এইতো যখন আমাদের তরুণেরা শাহবাগের প্রজন্ম চত্ত্বরে যুদ্ধাপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে সোচ্চার, জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ ঠিক তখনই রাজাকারদের একালের কুশীলবেরা মতিঝিলে অগ্রনী ব্যাংকের লিফ্টম্যান জাফর মুন্সীকে মাথায় লোহার রডের অঘাতে হত্যা করে! অথচ যারা এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আর যারা আজ দেশের গর্বে উচ্চকীত এরা সবাই সমবয়েসী! কি বৈপরীত্য তাদের কার্যকলাপে ভাবা যায়? অথবা দেখুন, ঢাকায় যখন আমাদের উত্তর প্রজন্ম দেশমাতৃকার সম্ভ্রমহানীর প্রতিশোধে উন্মাতাল ঠিক তখনি ঐ সরকারী রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের ছেলেরা ব্রজমহন কলেজের নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ্য শংকর চন্দ্র দত্তকে প্রকাশ্য রাজপথে পেটাচ্ছে! কে এই অধিকার দিয়েছে তাদের? এই স্পর্ধা তারা কোথায় পেলো? কেনো এই বৈপরীত্য? শুধু তাই নয়, এই একই সময়ে বগুড়ার আদালত থেকে আসামী ছিনতাই করেছে যুব দলের নেতারা! এই হলো আমাদের ছাত্র-যুব রাজনীতির বাস্তবিক চিত্র। দেশের রাজনীতি বিশারদেরা যখন আখের গুছাতে ব্যাস্ত, চাকুরেরা যখন ঊর্দ্ধতনকে তেল সরবরাহে ব্যাস্ত, ব্যাবসায়ীরা যখন জনগনের কষ্টার্জিত অর্থ যেতেন প্রকারে কুক্ষীগত করতে পরিকল্পনায় মাতোয়ারা, ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবিরা যখন তাদের পেশাকে ব্যবসায় রূপান্তরে মোহাচ্ছন্ন; তখন এদেশেরই লক্ষ-কোটি তরুণ-কিশোর-জনতা দেশমাতৃকার অপমানের প্রতিশোধ নিতে বজ্রমুষ্ঠিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করছে! এই দৃশ্যগুলো পাশাপাশি কল্পনা করুন! দেখুন একটুও লজ্জ্বাবোধ হয় কিনা! জানি আমাদের অধিকাংশেরই হয় না, কারন আমরা আর মানুষ নেই, অপদার্থ নতুবা জন্তুতে রূপান্তরিত হয়েছি। আর যাদের হয়, তাঁরা বিবেকের টানেই ছুটেছেন তাঁদেরই সন্তান সম এই সব তরুণ-কিশোরদের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে সামিল হতে।

 

একটা জাতিকে অবদমিত করতে হলে কিংবা সেই জাতির মহাপ্রয়াণের জন্যে তার ভাষা আর সংস্কৃতিকে দুর্বল করতে পারলেই যথেষ্ট। আর সেই মোক্ষম কাজটি শুরু হয়েছিলো নব্যপাকিস্তানে ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার উপড়ে নগ্ন হস্তক্ষেপের মধ্যদিয়ে। বাহান্ন-র ভাষা আন্দোলনের পথধরে আমাদের শেষ পর্যন্ত পৌঁছুতে হয়েছিলো ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। আজো চলমান। যা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। যা আমাদের উত্তর প্রজন্মের চোখে স্পষ্ট দৃশ্যমান! আর তাই তারা আজ সমবেত, ঐক্যবদ্ধ এবং দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ। পেছনে হাঁটার সুযোগ আর নেই। হয় জয় নয় মৃত্যু! আজ আমাদের অর্জনের দিন সমাগত। আমাদের চূড়ান্ত বিজয় আজ সময়ের ব্যাপার বলেই প্রতিভাত। এই ক্রান্তিকালে কার কি কর্তব্য তা তাকেই ঠিক করতে হবে। আমরা এই দেশের স্বাধীন নাগরিক, মানুষের মতো বাঁচতে চাই। বিশ্বের বুকে অর্থনৈতিক ভাবে তো বটেই, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে শিক্ষায়-রূচিতে প্রথম কাতারের আসন আমরাই প্রত্যাশা করতে পারি যদি আমাদের গৌরবের অতীত বিস্মৃত না হই। সেই জন্যে নিশ্চিত ভাবে আমাদের অর্জন করতে হবে,

১) আমাদের সংবিধান কে যুগপোযোগী করা, সেখান থেকে আজকের উচ্চারিত তরুণ প্রজন্মের চেতনার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ গুলোর সামঞ্জ্যস্যতা বিধানের মধ্য দিয়ে।

২) দেশে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক তৎপরতার বিলোপ সাধন সহ রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথককীকরণ।

৩) সর্ব্বোচ্চ সাজার বিধান সহ যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি কোন ধরনের অনুকম্পা প্রদর্শনের সকল পথ চিরতরে রুদ্ধ করার বিধান।

৪) শিক্ষা এবং কৃষির পাশাপাশি পরিবেশ সহনশীল শিল্পদ্যোক্তাগকে অগ্রাধিকার দেওয়া আজকের বিশ্বায়নের পেক্ষাপটে জরুরী। শিক্ষাকে একই জাতীয় সিলেবাসের আওতায় এনে মাদ্রাসা শিক্ষার সংকোচন আর বিজ্ঞান এবং শিল্পকলাকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষাকে অপশনাল রেখে পুরো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। বিদেশী সিলেবাস সম্পূর্ন নিষিদ্ধ করতে হবে যাতে শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য সৃষ্টি না হয়।

৫) ১৯৭২ এ আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশ চেতনার পরিপন্থী সব ধরনের কার্যকলাপ, প্রকাশ্য কিংবা গোপন যেকোন তৎপরতা সম্পূর্ন ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষনা করতে হবে। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ, আঞ্চলিকতা সহ সব ধরনের বৈষম্যের বিলোপসাধন করতে হবে।

৬) আজকের জাতীয় এ সংকট কালের অন্যতম কারণ হলো শিক্ষা-গবেষনায় পশ্চাদপদতা। অক্ষমতা এর কারণ নয়, অনিচ্ছাই কারণ। অনুৎপাদনশীল সামরিক খাত সর্ব্বনিম্নে রেখে শিক্ষা-গবেষনায় এবং অবাধ তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রগুলোতে সর্ব্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। যেমন স্ক্যন্ডেনেভিয়ান দেশ গুলো, সিঙ্গাপুর, দক্ষিন কোরিয়া, অধুনা চীন এবং মালয়েশিয়ার কথা উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে।

৭) যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা শিক্ষা-গবেষনা, ব্যবসা-বানিজ্য এবং কৌশলগত উন্নয়নের অন্তরায়। এক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতা সহ অন্যান্য সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

এই সাতটি দাবী আমি মনে করি আজকের প্রক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্ত্বের সাথে বিবেচিত হতে পারে। আমাদের স্বাধীকারের যুদ্ধ এবং মুক্তির আকাঙ্খা ততদিন অধরাই থেকে যাবে যতদিন না আমাদের চলার পথ থেকে ঐসব আবর্জনা অপসারিত না হবে। আর সেই আবর্জনা অপসারণ সম্ভব হবে কেবল মাত্র চেতনা বিকাশের মধ্য দিয়েই। আজ যখন এই ভাষা আন্দোলনের মাসে যে চেতনার প্রকাশ ঘটলো আমাদের শাহবাগের প্রজন্ম চত্ত্বরে সেই চেতনার ধারাবাহিকতার জন্যেই হয়তো তা হবে ‌আগামীদিনে বাংলা রেনেসাঁর জন্ম কাল। কারণ ভাষা শহীদদের রক্তে ভেজা এই দৃপ্ত চলার পথটিই যে দেশের বিবেক খ্যাত বিদ্যাপীঠের বুক চিরে এই চত্ত্বরে এসে মিলেছে! যদিও এই বিদ্যাপীঠটি সাম্প্রতীক কালে একদল শ্বাপদের দাপিয়ে বোড়াবার অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে! তবুও আমি আজ প্রাণোচ্ছাসে ভরপুর এই জন্যে যে সময়ের তারুণ্যের সম্মিলিত উচ্চারণের কাছে এরা নিতান্তই তুচ্ছ! আজকের রণাঙ্গনের উদ্ভাসীত তারুণ্যের সোচ্চারিত ভাষা রাজনৈতিক ষন্ডাদের রক্তচক্ষুকে থোড়াই কেয়ার করে। আমি জানি আমাদের ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো অমর বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, পটুয়া কামরুল হাসান, সূর্য সেন, বিশ্ব কবি, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, কবি সুফিয়া কামাল, শিল্পী জহির রায়হান, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, প্রীতিলতারা সহ এই বাংলার অমর আজস্র অম্লান সূর্যসন্তানেরা  আজ তোমাদেরই মাঝে। কার সাধ্য ওদের আকাশ ছোঁয়া উদ্দ্যোম আর উচ্চারণকে ডিঙ্গিয়ে যায়? জয় এখানে সুনিশ্চিত। আমি আবারো আমার প্রত্যয় আর দৃঢ় অঙ্গীকারে তোমাদের পাশে রইলাম, তোমাদেরই সাথে। বিদ্রোহী কবির ভাষায়-

হে তরুণ ওরে আমার বাছা

আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

বি.দ্র.: ছবিগুলো দৈনিক প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত