পাথরের সভ্যতা।।
আমাদের ভবন ছিল শহরের উত্তর দিক ঘেঁষে। কয়েক পা পিছনে গেলেই শহরের শেষ সীমারেখা। উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের ওপারে কী আছে আমরা জানি না। আমরা অনেক কিছু বলতে পারি কিন্তু ঠিকঠিক বলতে পারবো না ওপাশে কী আছে। আদৌ কিছু আছে কিনা! আমাদের বাবা দাদারাও পারতেন না। সামনে মানে দক্ষিণ দিকে সারি সারি বিল্ডিং। বিল্ডিং এর পর বিল্ডিং, পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা বিল্ডিং। একসময় নাকি বিল্ডিং তোলার প্রতিযোগিতা হয়েছিল- কে কত বড় আর উঁচু ভবন তুলতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। কয়েক হাজার বছর ধরে চলেছিল সেই প্রতিযোগিতা। একজন প্রথম হয় তো মুহূর্তেই তাকে ছাড়িয়ে যায় আর একজন। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন প্রতিযোগী, সমস্ত বিশ্বের মানুষ জাত বর্ণ ধর্ম শ্রেণি-বিভেদ ভুলে একজোট হয়ে নেমেছিলেন সেই প্রতিযোগিতায়। এ ছাড়া আর কোনো বিষয়ে তাদের একমত হতে দেখা যায় নি। খাওয়া ঘুম হারাম করে তারা মত্ত ছিলেন সেই খেলায়। পৃথিবী ইতিহাসে এত দীর্ঘতম ও এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ প্রতিযোগিতা আর কখনও হয়নি। তারপর একসময় আকাশে ঠেকে গেল তাদের বাড়ি। ছাদে উঠলেই মাথা ঠেকে যায় আকাশে। শত চেষ্টাতেও আর ওপরে ওঠে না। আশেপাশের জায়গা ফুরিয়েছে কবেই। তারপর থেকেই মানুষজন লেগে গেল আকাশ ছিদ্র করতে। আকাশ কি আর সহজে নড়ে? স্বয়ং ঈশ্বরের রক্ষা কবজ সেটি। কিছু মানুষ পিছু হটলো- না, ঈশ্বরের ঘরে আঘাত? এতো বড় পাপ সইবে না কিছুতেই। ধ্বংস হব আমরা। কিচ্ছু থাকবে না। কিছু লোক এগিয়ে গেল দা, কুড়াল, শাবল, ছেনি, ড্রিল মেশিন নিয়ে- এইবার দেখা যাবে ঈশ্বর পালায় কোথায়! আরাম করে আসমানে থাকা তাঁর ঘুচবে এখন। না থাকলে তো হলই, আমরা আগেই বলেছি ওসব ঈশ্বর বলে কিছু নেই। আর কিছু লোক এই দু-দলের দিকে তাকিয়ে রইল- তারা এখনই কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চায় না। কয়েকশ বছর ধরে চলছে সেই আকাশ ফুটো করার মিশন।
পাথরের গাছ।।
যেহেতু শহরের ভেতরে কোনো মাটি নেই, সেহেতু সত্যি কারের গাছও নেই। পাথরের ওপরে গজিয়ে আছে পাথরের গাছ। রঙ বে রঙের গাছ। অন্ধকার হলেই গাছগুলো জ্বলে ওঠে সূর্যের ন্যায়। গাছে আবার ফলও আছে, থোকায় থোকায় ফল। দেখতে হুবহু ফলের মতো। কখনও খসে পড়ে না। ফলগুলোও জ্বলে। যেহেতু গাছগুলো আলো দেয়, যেহেতু গাছগুলো দেখতে সুন্দর, যেহেতু গাছগুলো পাতা ছুড়ে শহরকে কখনও নোংরা করে না, যেহেতু গাছগুলোর ফল সবসময় সজীব, সেহেতু আসল গাছগুলো মানুষ একটার পর একটা উপড়ে ফেললো। পৃথিবী জুড়ে শুরু হল বৃক্ষ-নিধন অভিযান। বড় বড় সব বিশ্ব-শান্তিকামী সংগঠন হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলো পৃথিবীর নোংরা অপসারণে। যে শহরে একটিও গাছ রইল না, সেই শহরের মেয়রকে পুরস্কৃত করা হল। এক সময় পুরস্কৃত হল পৃথিবীর তাবৎ মেয়র। তারপর আর কাউকে পুরস্কৃত করার প্রয়োজন পড়লো না। পৃথিবী হল ঝকঝকে তকতকে। রইল না দিন রাতের তফাৎ বিশেষ।
পাথরের বৃষ্টি।।
যেহেতু গাছ রইল না পৃথিবীতে, যেহেতু নদী রইল না কোনোখানে, সেহেতু মেঘ জমলো না আর আকাশে। আকাশ জুড়ে তখন কেবলই বিল্ডিং আর বিল্ডিং। সমস্ত আকাশ পাথরের দখলে। সেদিন ছিল বেজায় গরম। শহরের সমস্ত হিমাগারগুলো ভরে গিয়েছিল মানুষে। মৃত মানুষ রাখার ড্রয়ারে ড্রয়ারে ঢুকে পড়েছিল জীবন্ত মানুষ। এমনই একটা দিনে শুরু হল বৃষ্টি। পাথর বৃষ্টি। প্রথমে ছোট ছোট তারপর পাহাড় সমান দলাদলা পাজাপাজা পাথর বৃষ্টি। কেউ কেউ বলল- ভূমিকম্প হচ্ছে, ভেঙ্গে পড়ছে ভবন সব। কেউ কেউ বলল- ঈশ্বরের ঢেলা এগুলো। ঈশ্বর আজ এতোদিনে সত্যি সত্যি খেপেছেন! আর কেউ কেউ কিছুই বলল না।
পাথরের পাখি।।
মেয়রকে পুরস্কৃত করার কিছুদিন পরের এক সকাল বেলায় আমি বারান্দায় গিয়ে দেখি, একটি পাখি এসে বসে আছে গ্রিলের ওপাশে। অমন অদ্ভুত পাখির কথা আমি জীবনেও শুনিনি। সমস্ত শরীর-জুড়ে পাথর। পাথরের পালক, পাথরের ঠোঁট। পাথরের পা, পাথরের নখ। পাথরের মাঝখানে ছোট্ট দুটি চোখ তিরতির করে জ্বলছে। জ্বলছে আর নিভছে। বেশ ভয় পেলাম দেখে, শিশুর খেলনা ভেবে সাহস যোগালাম মনকে, একটু উসকে দিতেই উড়ে গেল পাশের বারান্দায়। উড়ছে তো পাথরে পাথরে বাড়ি খাওয়ার শব্দ। দিনে দিনে সমস্ত শহর ভরে গেল পাথরের পাখিতে। পাখিরা ওড়ে, শব্দ হয় পাথর ভাঙ্গার, পাখার বাড়িতে ভেঙ্গে যায় ভবনের কোণা, টাওয়ারের ডানা। পাখিরা ডাকে শব্দ হয় গাড়ির হর্নের মতো পিলে চমকানো। কিংবা আরও বীভৎস ও কুৎসিত শব্দ। শিশুরা পাখি দেখলেই শিউরে ওঠে বাঘ দেখার মতো। সুযোগ পেয়ে মায়েরা বলেন- খাও, নইলে পাখি ডাকবো। শিশুরা খায় গপাগপ। শহরের সমস্ত শিশু তখন বিনা বাক্যে খায়। এই একটা সুবিধাকে কিছুতেই খাটো করে দেখা যায় না।
সত্যিকারের পাখিগুলো একটা একটা করে নেই হয়ে গেল। কেউ বলে পাথরের পাখিগুলো পাখি ধরে ধরে খায়। ওরা পাখি খেকো পাখি। কেউ বলে পাথরের পাখিগুলোর ভয়ে সত্যিকারের পাখিগুলো দেয়ালের ওপাশে নির্বাসনে গেছে- একে একে এবং দলে দলে।
কিছুদিন পর, কয়েক বছর পর, আমরা সব পাথরের পাখিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। সত্যিকারের পাখির জন্যে মনটা সবার কেঁদে উঠলো। আমরা পাখিদের ভিডিও চালিয়ে বসে রইলাম টিভি কম্পিউটারের সামনে। পাখির ছবিযুক্ত পুরনো ক্যালেন্ডারগুলো সেটে দিলাম দেয়ালে। তারপর একদিন শহরের সবাই ছুটে গেলাম চিড়িয়াখানার দিকে। গিয়ে দেখি চিড়িয়াখানা খালি পড়ে। কারা যেন সব চিড়িয়া সরিয়ে ফেলেছে আগেই। আমরা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলাম। কাঁদতে কাঁদতে পিচ্ছিল হল শহর।
অনেক অনেক দিন পরে একদিন ঐ পাখি চোরগুলো সত্যিকারের পাখি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করলো। আমরা ছুটে গেলাম। শহরের সকলেই গেল। অনেক অনেক টাকা খরচ করে টিকিট কেটে সত্যিকারের পাখির মেলায় গেলাম। সমস্ত গ্যালারি পাখির ছবিই ভরা। অনেক অনেক আগের তোলা সব ছবি। অনেক অনেক আগের সব পাখি। অনেক অনেক ভিনদেশী পাখিও ছিল। আমরা চেনা জানা পাখিগুলোর পাশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। যেন অনেক আগে গত হওয়া সব আত্মীয় স্বজন আজ আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। রুমে রুমে প্রজেক্টরে দেখানো হচ্ছে পাখিদের ভিডিও চিত্র। সেগুলোও পুরনো। তারপর একে একে পুলিশ প্রহরায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্যালারির সবচেয়ে গোপন কক্ষটিতে- ওখানে রাখা হয়েছে সত্যিকারের পাখি। একটি নয়, দুটি নয় গুনে গুনে দশ দশটি পাখি। পাখিগুলো রসকষহীন বৃক্ষের মতো তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। আমাদের চোখ জলে ছল ছল করছিল। ছলছল করছিল পাখিদের চোখও। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইলাম। পাখিদের ডাকতে বলা হলো, এমন সত্যিকারের পাখির ডাক আমরা কতকাল শুনিনি! পাখিগুলো ডেকে উঠল পাথরের পাখিদের নকল করে। আশ্চর্য হলাম আমরা, আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখলাম, চোখের সামনে পাখিগুলো কেমন একটু একটু করে পাথরের পাখি হয়ে যেতে লাগলো।
তাহলে শহরের সব পাথরের পাখিই একদিন সত্যিকারের পাখি ছিল! গাছগুলো ছিল সত্যিকারের গাছ!
আমরা চুপচাপ বেরিয়ে এলাম। এমন করেই একদিন একটু একটু করে সত্যিকারের মানুষগুলো পাথর-মানুষ হয়েছে।
গল্প অনেক ভালো লেগেছে। কোথায় ড্রাফ্ট করেছেন পাথরের কাগজ আর পাথরের কলম দিয়ে না পাথরের কম্পিউটারে। :)) :)) :))
===========================
@জটিল বাক্য, সবকিছুই যখন পাথরের তখন অক্ষরগুলোও পাথরে খোদায় করা হবে হয়ত। হাহা।
এই লেখাটির ক্যাটাগরি রম্য রচনা কেনো? 😕
@বিপ্লব রহমান, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোন ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়! গল্প হল কিনা সন্দেহ হচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে আর যায় হোক রম্য হয়নি। ধন্যবাদ পড়ার জন্যে।
(Y) (Y) (Y)
@সুবিচার, ধন্যবাদ।
খুব ভাল লাগল গল্পটা পড়ে। অন্য ধরনের গল্প।
আমরাও পাথুরে শহরে বাস করছি। এখনো কিছুটা মাটি রয়েছে, কিছু গাছ, খাল, নদী, পাখি দেখা যায় এখনো, তবে একদিন সব পাথরের দেশ হয়ে যাবে! মেয়রবৃন্দ পুরুষ্কৃত হবে সবচেয়ে পাথুরে বৃক্ষময় শহর উপহার দেয়ার জন্য।
এই লাইন কি খুব দরকার ছিল?
@কাজি মামুন, ঐ লাইনটা না দিলেও চলতো বোধহয়। কি জানি ! ধন্যবাদ মামুন ভাই।
এই প্রতিকী গল্পের মর্ম অনেক ব্যাপক। আজই একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম রাজধানী সিউলে। বিভিন্নদেশের টি.ভি চ্যানেল গুলো সচল ছিলো। ৭/৮ টা দেশের টি.ভি চ্যনেলের দিকে নজর ছিলো আমার। তার মধ্যে বাংলাদেশের একুশে চ্যনেল-ও ছিলো। ওতে হচ্ছিলো সংবাদ। ২/৩টি দেশের চ্যনেলে বন্যপ্রাণীরা যে কিরকম অনুভূতিপ্রবন সে বিষয়ে ডকুমেন্টারী চলছিলো, বাকী গুলোতে গোটা বিশ্বের জায়গায় জায়গায় এ সপ্তাহের চ্যালেন্জিং বিষয় গুলো নিয়ে অনুষ্ঠান চলছিলো, নতুবা ষ্টুডিওতে ধারনকরা কোন রম্যানুষ্ঠান। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদে অজগর সাপ নিয়ে একটি খন্ড সংবাদে দেখলাম রাস্তা পাড় হবার সময় একটি ট্রাক অজগরটিকে কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে কিকরে চিড়েচ্যাপ্টা করে দিয়ে গেলো সেদৃশ্য! আর ভাষ্যে বলা হলো এই নিরীহ সাপটিকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কিছু ভুল ধারনা রয়েছে! ব্যাস! অবশ্য এই অসভ্যের দেশে যেখানে পথচারী সাধারণ মানুষেরই নিরাপদ পথ চলার গ্যারান্টি নেই, সেখানে একটি বিলুপ্তপ্রায় অজগরের জীবনের কতোটুকুইবা মূল্য থাকতে পারে অনুমান করা যেতে পারে। তবে আপনার রূপক গল্পটি বোধ হয় আর রূপক থাকবে না একেবারেই দিবালকের মতোই স্পষ্ট প্রতিভাতঃ হবে অচীরেই। উপড়ে স্বপন মাঝি শতবর্ষ পরে এরকমটি আশা করছেন, নিজে দেখে যেতে চান না, নাতি পুতিদের উপহার দিয়ে যেতে চান! আমার ধারনা, আমরা নিজেরাও দেখে যেতে পারবো যে, কি রকম পরিবেশ আর সভ্যতা আমরা তাদের জন্যে তৈরী করে দিয়ে গেলাম! লেখাটি পরিবেশ সচেতনতায় মানস পটে প্রভাব ফেলুক, আমরা সত্যি ওরকম পাষান সভ্যতা চাইনা আমাদের উত্তরসূরীদের জন্যে।
@কেশব অধিকারী, ধন্যবাদ আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবার জন্যে।
বাহ, খুব ভালো লাগলো। শক্ত কথা অথচ সহজ আর গতিময়। খুব ভালো লাগলো।
সূর্যের ন্যায় না বলে সূর্যের মত বললে ভালো লাগবে মনে হয়।
(C)
@কাজী রহমান, আচ্ছা। ঠিক করে নেবো। ধন্যবাদ ভাইয়া।
(Y)
@ভক্ত, ধন্যবাদ।
আজি হ’তে শত বর্ষ পরে – আপনার লেখা পড়ে কেউ কেউ হয়তো বলবে, ‘হে পূর্বজগণ, এতটাই যদি দেখতে পেয়েছিলে, তাকে থামালে না কেন?’
আজকের যুগে সচেতনতা বা জানার মানে শুধু ঘরে বসে তৃপ্তির ঢেঁকুর নয়, প্রয়োগ। তা না হলে পরিণতি হবে আপনার গল্পের মত।
ধন্যবাদ।
@স্বপন মাঝি, ধন্যবাদ স্বপন ভাই। কেমন আছেন আপনি?
@মোজাফফর হোসেন,
যে-রকম লেখা বেরুচ্ছে, তাতে কি আর ভাল থাকা যায়? আপনি আমার ঘুম হারাম করেছেন, দেখি নিজে না পারলেও অন্যের লিংক দিয়ে, আপনার ঘুমে বিঘ্ন উৎপাদন করতে পারি কী-না?
http://stephaniemcmillan.org/2012/06/18/free-trade-rules/
@স্বপন মাঝি, আমি এমনিতেই কম ঘুমায়। কাজে চেষ্টা করে লাভ নেই। হাহা।
দুঃখিত খেয়াল করিনি শেষাংশ ,মানুষও পাথরের হয়ে গেল ।যাহোক পাথরত মাটির কঠিন অবস্থা ।
@নিগ্রো, তা বেটে। ধন্যবাদ পড়ার জন্যে।
@মোজাফফর হোসেন, **বটে
মানুষ গুলি কি রক্তমাংসের নাকি ওরাও পাথরের ?পাথরে পৃথিবী বানানোর পিছনে এদেরইতো অবদান । :-Y