মুম্বাই এ ফিদাইন হানা – একটি বিশ্লেষণ

-বিপ্লব  পাল 

 

http://www.smh.com.au/ffximage/2008/11/27/mujmbai2_wideweb__470x267,0.jpg

গোটা বিশ্বের চোখে এখন আমচি মুম্বাই  ৯/১১ এর পর আজ আরেকটি কালোদিনের সাক্ষী গোটা পৃথিবী  ভারতে  এই  বছরেই একের পর এক সন্ত্রাসবাদি আক্রমন হয়েই চলেছেভারতের গুপ্তচর সংস্থাগুলির অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না তাই নিয়ে সবার মনেই আজ বিরাট প্রশ্ন চিহ্নইস্রায়েল এবং ইরাকের থেকে ভারতের কোন পার্থক্য রইল না 

 প্রথমে আসি আত্মঘাতি জঙ্গীপনা বা ফিদাইনদের কথায়প্রায় ৫০ জন ফিদাইন জ়ঙ্গী সবমিলিয়ে ৫ টা বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক আক্রমন করল-অর্থা এরা মিডিয়া এটেনশন চাইছিলসেই দিক থেকে তাজ এবং ওবেরয় হোটেল আক্রমনে- উদ্দেশ্য শতকরা ১০০ ভাগ সিদ্ধকিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই সব তরুন যুবকরা কেন আত্মঘাতি পথ বেছে নিচ্ছে? এটাত কোন বস্তুবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা হয় নাএকমাত্র স্বর্গের লোভেই ফিদাইনরা প্রাণ দিতে পারেকোন সুস্থ লোককে ১০০ বিলিয়ান ডলার দিলেও কি সে আত্মহত্যা করবেগ্রুপের স্বার্থে আত্মবিসর্জন প্রাণী জগতে বিরল নয়- তবে এখানে সেরকম কিছু দৃষ্টিকোন খুব কষ্ট করে বার করতে হয়গুজরাটের ২০০২ সালের দাঙ্গা দিয়ে, তারপর ঘটে যাওয়া প্রায় ত্রিশটি জঙ্গী হানার কোন ব্যাখ্যা হয় নাকারন সন্ত্রাসবাদিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাকিস্থানিএমনকি তাদের সাথে জোটা  ভারতীয় সংস্করন “ভারতীয় মুজাদিহিন” দের মধ্যে গুজরাটি মুসলমান কোথায়তাহলে প্রশ্ন উঠবে ইসলামিক ভাতৃত্ব বোধ থেকেই ভারতে প্রতি মাসে একটা করে সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপ করে, গুজরাটের প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছেএটাও অতিসরলিকরন

  আমি মনে করি না এই পৃথিবীতে কেও মরতে চাই  ফিদাইনরাও চাই নাপার্থক্য হচ্ছে তারা ভাবে স্বর্গের অনন্তসুখ হাসিল করার জন্যে -খোদার খাসি হওয়া খুব জরুরী  এই জন্মের পৃথিবীটা একদম অর্থহীনযদিও এরা মুসলিম বলে মনে হতে পারে কোরান থেকেই  তারা এধরনের অনুপ্রেরনা পাচ্ছেসেক্ষেত্রে একথাও মনে রাখা উচিত পৃথিবীতে সব ধর্মেই ইহকাল অপেক্ষা পরকালেই পুরষ্কারের ওপর অনেক বেশী জোর দেওয়া হয়েছেকোরান কোন ব্যাতিক্রম কিছু নয়তাহলে প্রশ্ন উঠবে ইসলামে আত্মঘাতি সন্ত্রাসী বেশী কেন? মনে রাখতে হবে তামিল টাইগার-যারা শ্রীলংকান হিন্দু, তারাই এই ফিদাইন সন্ত্রাসবাদের জন্মদাতামুসলমান জঙ্গীদের তারাই পথ প্রদর্শক সুতরাং লোকে কেন আত্মঘাতি জঙ্গী হয়, তার পেছনে যেমন ভাববাদি ধর্মের হাত আছে-ঠিক তেমন ই বস্তুবাদি আর্থ সামাজিক বিশ্লেষন না করলে, কারা কেন জঙ্গী হচ্ছে-তার সম্পূর্ণ বিশ্লেষন সম্ভব নয় 

    তাই এই সন্ত্রাসবাদের প্রতিবাদি চরিত্র” এবং “আন্তর্জাতিকতার”  বিশ্লেষন ভীষন ভাবে আবশ্যকএক্ষেত্রে দুটি পার্টি ছিলপ্রথমটা ভারতীয় মুজাদিহিনযারা নিষিদ্ধ সংগঠন সিমির সন্ত্রাসী উইং  তাদের সাহায্য করেছে পাকিস্থানের লস্কর ই তইবাউভয়ের শ্রেণী চরিত্রে কিছু পার্থক্য আছে ভারতীয় সংগঠনটি উচ্চ শিক্কিত মুসলমান যুবকদেরপাকিস্থানের এল ই ট্ আসলেই নিম্বমধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমানদের যারা পাকিস্থানের  সুবিধাভোগী “এলিট” শ্রেণীটির সাথে শ্রেনী দ্বন্দে লিপ্তলস্কর ই তৈবার “প্রতিবাদি” অবস্থান মার্ক্সীয় বিশ্লেষন দিয়ে পরিষ্কার বোঝা যায়স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্থান ভোগ করেছে গুটিকয় পরিবার সুতরাং শ্রেণী সংঘর্ষ সেখানে আসতই-কিন্ত্র এই দ্বন্দটাকে সেখানকার বামপন্থী বা কমিনিউস্টরা কাজে লাগাতে ব্যার্থ হয়েছে  কেও ব্যার্থ হলে ত আর শ্রেণী দ্বব্দ বসে থাকে না-কোন না কোন আদর্শবাদ সেই প্রতিবাদি চরিত্রকে হাইজ্যাক করবেই  ইসলাম জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিবাদি-তাই দ্বন্দকে হাইজ্যাক করতে অসুবিধা হয় নিশুধু দ্বন্দের ডাইমেনশনটা পালটে মধ্যযুগীয় আরব সংস্কৃতি বনাম পাশ্চাত্য সংস্কৃতি হয়েছেসেটা বামপন্থীদের হাতে গেলে ধনাট্য সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের শোষনের বিরুদ্ধে  সমাজমুক্তির আন্দোলন হতে পারতকিন্তু সেরকম কিছু হয় নি-প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে পরে, ওই সুবিধাবাদি পাকিস্থানী এলিটদের হাত আরো শক্ত হয়েছেউগ্র ইসলামিক পার্টিগুলি বামপন্থীদের কাছ থেকে শ্রেনীদ্বন্দকে পাকিস্থান এবং বাংলাদেশ- উভয়দেশেই ছিনিয়ে নিয়ে-শোষনের হাতকে আরো শক্তিশালী করেছেফলে শত শত ইসলামিক জ়ঙ্গীদল তৈরী হয়েছেএবং ইসলামিক দেশগুলিতে বামপন্থার এই পরাজয়ের পেছনে-“ধর্মের সাথে আপোস” করে চলা নীতিই মূলত দায়ীধর্মের সাথে আপস করে চললে, বস্তুবাদি মার্ক্সিয় বামপন্থীরা সহজেই হাপিস হয়ে যাবে-কারন প্রতিটা ধর্মেই সাম্য এবং প্রতিবাদি চরিত্র বর্তমান  ফলে ইসলামের ভাববাদি সাম্যবাদ বা প্রতিবাদি চরিত্রকে মেনে নিতে গিয়ে  ইসলামিক দেশের বামপন্থীরা আত্মহত্যা করেছেন ইরান, পাকিস্থান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া-সর্বত্র আমরা একই দৃশ্য দেখিএর কারনটা ফুকোর “জ্ঞান এবং ক্ষমতার” তত্ত্বে খুব পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়  একটা দেশে ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি কিছু “আদর্শবাদ” ঘিরেই আবর্ত্তিত হয়সেক্ষেত্রে ইসলাম যদি গরীবদের বড়লোকদের হাত থেকে মুক্তির নিদান শোনায় এবং বামপন্থীরাও যদি সেটা মানে-তাহলে ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি ইসলামের হাতেই যাবে-কারন অধিকাংশ লোক সেটাই মানছেঅন্যদিকে ইসলামিক আদর্শবাদিরা কিন্তু নাস্তিক্যবাদি মার্ক্সের বস্তুবাদি সাম্য মানছেন না-ফলে, ইসলামিক দেশগুলির সাধারন যে কনসেনসাস -সেটা ইসলামের প্রতিবাদি এবং সাম্যবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ক্ষমতার কেন্দ্রগুলিকেই শক্তিশালি করছেআলকায়দা তথা সমস্ত ইসমালিক জঙ্গীদের এটাই মূল রাজনৈতিক শক্তি-যা আমেরিকার  সুবিধাবাদি বিদেশনীতি  আরো শক্তিশালী করেছেআমি অনেক ক্ষেত্রেই দেখি, আমরা পাকিস্থান বা বাংলাদেশের বুর্জোয়া পার্টিগুলিকেই ইসলামিক মৌলবাদের উত্থানের জন্য গালাগাল দিই কিন্ত আমি এটা বুঝি না-কেন এই বুর্জোয়া পার্টি গুলি, ইসলামিক মৌলবাদকে সাপোর্ট করবে নাশ্রেণী দ্বন্দটাকে ছিনিয়ে নিয়ে, গরীবদের প্রতিবাদি চরিত্রটাকে ছিনতাই করে, ইসলামিক মৌলবাদ ত এদের সবথেকে বড় হাতিয়ারনইলে গরীব গুর্বোগুলোর পেটের আগুনে এরা অনেকদিন আগেই কফিন হয়ে যেত

  ভারতীয় মুজাদিহিনদের ক্ষেত্রে অবশ্য মার্ক্সিস্ট বিশ্লেষন খাটে নাকারন এদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত ফ্যামিলি থেকে আসা উচ্চশিক্ষিত মুসলমান যুবক-যারা বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিতাহলে এরা কেন জ়ঙ্গীহচ্ছে? কেন ফ্যানাটিক ইসলামে বিশ্বাস করছেইসলাম এবং মুসলমানদের ওপর ভারতে অত্যাচার হচ্ছে এমন ধারনা থেকে ইসলামিক ভাতৃত্ববোধে উদবুদ্ধ হয়ে তারা এই কাজ করছে-এটাত আমরা ওপর থেকে দেখছিভেতরের খেলাটা কি? ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের পর থেকেই মুসলীমদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা গোপনে বা প্রকাশ্যে ছড়ানো হচ্ছেআমি বলছি না মুসলমানরা ধোয়া তুলসী পাতা-ঘৃণাটা তাদের দিক থেকেও কম কিছু নয়আসলে সবাইত মানুষ-বিবর্তনের মায়াজালে ঘৃণা এবং ভালোবাসা দুটোই আমরা পেয়েছিবিবর্তন ধর্মী ঘৃণাটা তখন ই উস্কে ওঠে যখন একটা গোষ্ঠির সাথে আমরা নিজেদের কে আইডেন্টিফাই করি গণতন্ত্রে  সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এই ঘৃণাটা সর্বত্র কাজে লাগানো হয়প্রশ্ন হচ্ছে একজন আধুনিক মুসলিম যুবক নিজেকে ভারতীয় মনে না করে কেন “মুসলীম” বলে আইডেন্টিফাই করছে? তার জন্যে কি সে দায়ী? না রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ তাকে মুসলমান ভাবতে বাধ্য করাচ্ছেভারতে কোন ধর্ম নিরেপেক্ষ পার্টি নেইরাজনীতি থেকে সমাজের প্রতিটা পদে তাকে বলা হচ্ছে, বোঝানো হচ্ছে তুমি মুসলমান-তাই তুমি এটা পেলে বা পেলে নাসে মানুষ নয়, ভারতীয় নয়, সে মুসলমান -এই ভাবেই আমরা তাকে ঠেলে দিচ্ছিতারপর সে ধর্মীয় পরিচয় গাঢ় করতে ধর্মের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেধর্মের পাঁকে ডুবলে সবারই মানবিক অস্তিত্ব লোপ পায়

   আমাদের হিন্দুদের কোন দোষ নেই-সবদোষ শালা মুসলমানদের-বা সব দোষ হিন্দুদের-এমন ঘৃণা এবং প্রতিহিংসার বৃত্ত থেকে আমাদের মুক্তি চাই কেও হিন্দু বা মুসলমান হয়ে জন্মায় নি, মারাও যাবে না-সমাজের ইতিহাস এবং শ্রেনীদ্বন্দই তাকে হিন্দু বা মুসলমান বানিয়েছে এই একবিংশ শতাব্দিতে যখন জেনেটিক্স এবং বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতিতে  রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ ইত্যাদির ধারনা গুলোর বৈপ্লবিক পরিবর্ত্তন হচ্ছে-তখন মধ্যযুগীয় ধর্মগুলির আত্মিক উন্নতির কিছু বানী ছাড়া আর কিছুই আমাদের দেওয়ার নেইসেই আত্মিক উন্নতির নিদান ধর্ম ছাড়াও বিজ্ঞান থেকেই পাওয়া যায়-তবুও কেও আত্মিক উন্নতির জন্য ধার্মিক হলে আপত্তি করার কিছু  নেই কিন্তু ধর্মপালন যখন তার হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়বোধকে উস্কে দিচ্ছে-সেটা খুব ভয়ঙ্কর  ধর্ম থেকে সেই বিষটাকে আলাদা করতে না পারলে, এগুলো আমাদের সভ্যতার ক্যান্সার হয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংশ করবে

 

 

. বিপ্লব পাল, আমেরিকাতে বসবাসরত পদার্থবিদ, গবেষক এবং লেখকএক সময় ভিন্নমতের মডারেটর ছিলেন, বর্তমানে www.fosaac.tv সম্পাদনার সাথে জড়িত