আমি সিরাজুল আলম খান : একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য বইতে জয় বাংলা স্লোগানের ইতিহাস বেশ ভাল মতন উল্লেখ করা আছে। এই স্লোগান কীভাবে জনপ্রিয় হয় এবং কারা এর বিরোধিতা করেছিল তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে। পাঠকের সুবিধার্থে এখানে তুলে দেওয়া হল, (কিন্ডেল পৃ.১০২-১০৮)। আজকাল প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই যেভাবে নতুন নতুন ইতিহাস লেখা শুরু করেছেন তাই এসব ইতিহাস সবার কাছে রাখা জরুরী হয়ে পড়েছে।
“১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, সোমবার। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা ছিল। মধুর ক্যান্টিনের সে সভায় ১৭ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষা দিবস’ যৌথভাবে পালনের কর্মসূচী প্রণয়ন নিয়ে আলোচনা চলছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আহূত সে সভায় আলোচনার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা (তৎকালীন জিন্নাহ হল, বর্তমানে সূর্যসেন হলের) আফতাবউদ্দিন আহমাদ “জয়বাংলা’’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন। সভা চলাকালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই তিনি সকলকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে “জয়বাংলা” স্লোগানটি দেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও সাত-আট জন কর্মী সমস্বরে তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। সেদিনের সেই সভায় আফতাব বেশ কয়েকবার ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি দেন। শেষের দিকে উপস্থিত ছাত্রলীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীরাও তার সঙ্গে এই স্লোগানে যোগ দেয়। এভাবেই কিছুক্ষণ ঐ স্লোগান চলল। সেটাই এ বাংলার বুকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের সর্বপ্রথম উচ্চারণ। স্লোগানদাতাদের সকলেই ছিলেন ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘স্বাধীনতা বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’-এর সদস্য। উল্লেখ্য, ‘‘স্বাধীনতা বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ তখন হাতে লেখা তিন পাতার একটি পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিল, যার নাম ছিল ‘জয়বাংলা’।
১৯৭০ সালের ১৮ জানুয়ারি, রবিবার। সেদিন পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায় আমি ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি দিয়েছিলাম। স্লোগানটি সেদিন সকলের ভাল লেগেছিল। সকলেই আন্তরিকতার সঙ্গে ও গবীর আবেগে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানটি গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও এ স্লোগানটি বেশ মনে ধরে। এরপর ১৯৭০-এর ৭-জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় তাঁর ভাষণে তিনি সর্বপ্রথম স্লোগানটি ব্যবহার করেন।
‘জয়বাংলা’ স্লোগানের বিষয়ে ছাত্রলীগের দুই-একজন এবং আওয়ামী লীগের সবারই (বঙ্গবন্ধু) ঘোর আপত্তি ছিল। আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিতেও বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভারত-ঘেঁষা রাজনীতি করার অপপ্রচারকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান না দেওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়। শুধু জাতীয় কমিটির সে সভাতেই নয়, সাধারণভাবেও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলেই (তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া) ‘জয়বাংলা’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
বস্তুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বৃহত্তর অংশ সে সময় ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের সরাসরি বিরোধিত করে। তাঁরা এ স্লোগানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগও করেন। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি উত্তর ছিল, “এ বিষয় নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই।“ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কোনো রকম সমর্থন না পেয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের বিরোধিতাকারীরা এরপর ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। তারা ‘জয়বাংলা’ স্লোগানকে ভারতের ‘জয় হিন্দ’ ও সিন্দুর ‘জিয়ে সিন্ধ’-এর সঙ্গে মিলিয়ে এক ধরনের বিদ্রূপ করত। আর সুযোগ পেলে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দেওয়া ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করত।
১৯৭০ এর ৪ জানুয়ারি, রবিবার। সেদিন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানের শুরুতে “জয়বাংলা’ স্লোগান দেওয়া শুরু হলে দুই-একজন তাতে আপত্তি করেন এবং এ স্লোগানটি বন্ধ করতে বলার জন্যে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অনুরোধ জানান। তা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানে সেদিন বারবার ‘জয়বাংলা’ স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর বক্তব্য প্রদানকালে ‘জয়বাংলা’র পক্ষে-বিপক্ষে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করলেন না। বিষয়টি বুঝতে পেরে ‘নিউক্লিয়াস’-এর কর্মীরা চার-পাঁচজন করে মিলে একটি গ্রুপ হয়ে সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন কলেজের হল-হোস্টেলগুলোতে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিত। রাতের অন্ধকারে হাতে লেখা পোস্টার লাগান হতো ঢাকা শহরের সর্বত্র। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আপত্তি ও অভিযোগ এক পর্যায়ে মুজিব ভাই পর্যন্ত গড়াল। আপত্তিকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে কে এম ওবায়েদুর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠানো হয়। ওবায়েদুর রহমান বঙ্গবন্ধুর কাছে ‘জয়বাংলা’কে একটি গুরুতর আপত্তিকর স্লোগান হিসেবে তুলে ধরেন। আমি ঐ সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মুজিব ভাই কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি সুরাহা করবেন বলে জানান।
আসলে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত বা সুরাহার কাজটা ছিল সে সময় অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। স্বাধীনতার লক্ষ্যে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের গুরুত্ব বিবেচনা নিয়ে এ বিষয়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ‘নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষ থেকে আমাকে দেওয়া হয়।
১৯৭০-এর ১৮ জানুয়ারি, রবিবার। সেদিন পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভা। আমাদের বিবেচনায় দিনটি ছিল স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর এক সন্ধিক্ষণ। সেদিনের কর্মসূচি সফল করার দায়িত্ব বর্তেছিল ‘নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষ থেকে আমার ওপর। বলা বাহুল্য, সে দিনের গুরুত্বের কারণেই আমার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬৫-৬৬ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি। ছাত্র রাজনীতির পর তিনি ‘বিজ্ঞাপনী’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, যার অফিস ছিল জিন্নাহ এভিনিউতে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ)। সে সময় কামলার আহমেদ (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) ছিলেন একজন খ্যাতিমান অঙ্কন শিল্পী। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বয়সে তিনি আমার চাইতে বড় হওয়া সত্ত্বেও আমার সঙ্গে তার সখ্য ছিল। সেদিন শিল্পী কামাল আহমেদকে আনা হলো ‘বিজ্ঞাপনী’ প্রতিষ্ঠানে। সে সময় রবিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি দিন। সৈয়দ মাজহারুল হক বাকি ও কামাল আহমেদকে আমি ৪*১০ ফুট মাপের এক টুকরো কাঠের ওপর ‘জয়বাংলা’ শব্দটি লিখে দিতে বলি। লেখার পর কাঠটিকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। তখন বেলা তিনটা। পাঁচটায় আওয়ামী লীগের জনসভা শুরু হবে। সে সময়ে শহরে আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য পনেরো-বিশ জনের বেশি ছিল না। বাকিরা সবাই খ্যাতিমান এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানের (বঙ্গবন্ধুর মামা) নেতৃত্বাধীন ৬-দফার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)-এ চলে যায়। ফলে আওয়ামী লীগের জনসভা ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে ‘নিউক্লিয়াস’ সদস্যদেরই দায়িত্ব পালন করতে হতো। তখনই ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং হিসেবে ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ (বিএলএফ) গঠন করা হয়। এ সময়ে ঢাকা শহরের সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের সবকটি ওয়ার্ডে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের পাশাপাশি ‘বিএলএফ’-এর সদস্য সংখ্যাও খুব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গোটা বাংলাদেশের অবস্থা তখন এ রকম। শুধু ঢাকা শহরেই ‘বিএলএফ’-এর সদস্য সংখ্যা তখন প্রায় সাড়ে তিন হাজারে পৌঁছে গেছে। আর জেলা ও থানা (বর্তমানে উপজেলা) পর্যায়ে এই সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। এ সংখ্যা গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান পর্ব পেরিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামকালে প্রায় সাত হাজারে উন্নীত হয়।
সেদিনের জনসভায় লোক সমাগম, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ‘বিএলএফ’ সদস্যদের ওপর দেওয়া হয়। মূল দায়িত্বে ছিলেন কাজী আরেফ এবং মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)। অন্যান্য জনসভার মতো সেদিনও কবিয়াল শফি আহমেদ সভার প্রারম্ভে প্রায় ঘণ্টা-ব্যাপী তার জনপ্রিয় গান গেয়ে শোনালেন।
কামাল আহমেদের রংতুলিতে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান লেখা সেই কাঠের খণ্ড দুটির একাংশ আগেই বেশ উঁচু করে নির্মাণ করা মঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় শামিয়ানায় আটকানো হার্ডবোর্ডের ওপর লাগিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি অপর অংশ লাগান হয় জনসভা শুরু হওয়ার দশ-পনেরো মিনিট আগে। বেলা চারটা নাগাদ জনসভায় আগত মানুষের দ্বারা পল্টন ময়দানের আউটার স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। যেসব খুঁটিতে মাইক লাগ হয়েছিল, প্রত্যেকটি খুঁটির গোঁড়ায় দুজন করে ‘বিএলএফ’ সদস্য নিয়োজিত ছিল। তাদের হাতে দেওয়া হয়েছিল একটি করে ‘চিরকুট’। নির্দেশ ছিল আমি যখন মঞ্চ থেকে স্লোগান দেব ঠিক তখন এ ‘চিরকুট’ খোলা হবে। প্রায় ১০০টি মাইকের হর্ন লাগান বাঁশের খুঁটির গোঁড়ায় ছাড়াও গোটা পল্টনের বিশেষ বিশেষ জায়গায়ও ‘বিএলএফ’ সদস্যদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। নিচে, মঞ্চের সামনে, পেছনে এবং চারপাশেও ‘বিএলএফ’ সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। একমাত্র মসজিদটি ছাড়া তখনকার আউটার স্টেডিয়ামে বলতে গেলে আর কোনো স্থাপনা ছিল না। পেছনে ডেআইটির (বর্তমানে রাজউক) দিকে বাস্কেটবল খেলার জন্য ছোট ছোট কাঠের গ্যালারির মতো কয়েকটি স্থাপনা ছিল। সে সময় পল্টন ময়দানে এক লক্ষ্যের মতন লোকসমাগম হতে পারত। লোকে লোকারণ্য অবস্থায় ১৯৭০ সালের ১৮ জানুয়ারির জনসমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষভাবে নির্মিত সভার বক্তৃতা মঞ্চটি বেশ কিছুটা উঁচুতে। মঞ্চের শামিয়ানায় আটকানো হার্ডবোর্ডের ওপরে লাগান কাঠের খণ্ডে উজ্জ্বল লাল রঙের দুটি শব্দ ‘জয়বাংলা’ জ্বলজ্বল করছিল। মঞ্চটি বেশ উঁচু হওয়ার কারণে দর্শকরা দূর থেকেও তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। সভার শুরুতে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তব্য রাখলেন। সভাপতি ছিলেন মুজিব ভাই।
মঞ্চে মুজিব ভাই, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও গাজী গোলাম মোস্তফা ছাড়া আর কোন আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন না। গাজী গোলাম মোস্তফার ওপর একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, স্লোগান দেওয়ার জন্য মুজিব ভাই যেন আমাকে অনুরোধ করেন। তাজউদ্দীন আহমেদের বক্তব্যের সময় মুজিব ভাই বললেন, “সিরাজ, স্লোগান দে”। কথাটি তিনি দুবার বললেন। আমিও এই মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম। আমি অত্যন্ত আবেগমিশ্রিত ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে জনতার উদ্দেশে করে বললাম, “বাংলাদেশের জন্য আজকের এই দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আপনারা দেখছেন ঐ ওপরে জ্বলজ্বল করছে দুটি শব্দ ‘জয়বাংলা’। আসুন, সাত কোটি মানুষের পক্ষ হয়ে আমরা সকলকে জানিয়ে দিই, আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালি। আসুন, যার কণ্ঠে যত জোর আছে সবটুকু দিয়ে আমরা একই সঙ্গে বলি উঠি, ‘জয়বাংলা’। আজ থেকে ‘জয়বাংলা’-কে আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আসুন, আমরা সবাই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আওয়াজ তুলি ‘জয়বাংলা’। আমি আবারও বললাম ‘জয়বাংলা’। লক্ষ কণ্ঠের গগনবিদারী ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের ধ্বনি পল্টনকে মুখরিত করে তুলল। প্রত্যেকটি খুঁটির গোঁড়ায় চিরকুট ইতোমধ্যে খোলা হয়ে গেছে। তাতে নির্দেশ ছিল মঞ্চের ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘জয়বাংলা’ বলার। শুধু পল্টনেই নয়, সভা শেষে ফিরে যাবার সময়ও সকলের মুখে মুখে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘জয়বাংলা’। প্রত্যয়দীপ্ত এক শব্দ ‘জয়বাংলা’, বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের ঘোষণা ‘জয়বাংলা’। সে থেকে বাংলাদেশের মানুষ ‘জয়বাংলা’ স্লোগানকে তাদের রণধ্বনি ও বিজয়বার্তা হিসেবে গ্রহণ করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ)-এর সিদ্ধান্ত অনুসারে সেদিন আওয়ামী লীগের ঐ জনসভাতেই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ও জনসমক্ষে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের উদ্বোধন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমেদের পর একে একে বক্তৃতা দিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও মনসুর আলী। সবশেষে সভাপতি হিসেবে বক্তব্য দিলেন মুজিব ভাই। মুজিব ভাইকে বক্তব্য দেওয়ার আহবান জানানোর সময় আমি আবারও ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিলাম। তখন সভা থেকে লক্ষ কণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলো- ‘জয়বাংলা’। লক্ষাধিক বাঙালির বাঁধভাঙ্গা আবেগ আর প্রত্যাশায় এ ছিল এক নবজাগরণের ইঙ্গিত।
মুজিব ভাই বক্তৃতা করছেন, সে সুযোগে মঞ্চে বসা খন্দকার মোশতাক আহমেদ আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, “ভাইডি, কামডা সাইরা দিসো। তুমি বলেই পারলা, আর কেউ পারত না! পৃথিবীর ইতিহাসে আর একজন মানুষ রাশিয়া বিপ্লবের স্লোগান হিসেবে দিয়েছিল, ‘জমি, রুটি, স্বাধীনতা’। জানো, সে লোকটা ক্যাডা? লেনিন, লেনিন।“ মুজিব ভাইয়ের বক্তৃতা শেষ। জনসভার লক্ষাধিক মানুষের কণ্ঠে একই আওয়াজ-‘জয়বাংলা’। এ স্লোগান ১৯৭১-এ বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আর সশস্ত্র যুদ্ধকে করেছিল ত্বরান্বিত। এ স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে। রণাঙ্গনে বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী ছিল এ ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি। আন্দোলন-সংগ্রাম এমনকি সশস্ত্র যুদ্ধের কোনো পর্যায়ে কোনোদিন বাঙালিরা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ কিংবা ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ বলেনি। সময়ের ব্যবধানে সে ‘জয়বাংলা’ আজ ষোল-সতেরো কোটি মানুষের প্রিয় স্লোগান। মুজিব ভাই তাঁর ৭-মার্চের ভাষণ ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়েই শেষ করেছিলেন।
আজকাল দুই-একজন অতি পাণ্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, বঙ্গবন্ধু নাকি তাঁর ৭-মার্চের ভাষণে ‘জয়বাংলা’ বলার পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন। এরা আসলে পঞ্চম বাহিনীর লোক। এরা পাকিস্তান থাকতে পাকিস্তানিদের দালালি করত। ২৫ মার্চের আগের দিন পর্যন্ত এরা পাকিস্তানিদের হয়েই কাজ করেছে। শেষে না পেরে এরা ‘বাঙালি বন্ধু’ হয়ে ওঠে।“
শেষ লাইনে কাকে উল্লেখ করা হয়েছে শামসুর রাহমান না হুমায়ূন আহমেদ?
বিশেষ কোন ব্যক্তিকে না।