বাংলাদেশের লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে মানসিক বিকারগ্রস্থ জনৈক শহীদুন্নবী জুয়েল নামের একব্যক্তিকে কয়েক হাজার মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। মেরেই ক্ষান্ত হয়নি তার মরদেহ আগুনে নিক্ষেপ ক’রে পুড়িয়ে দিয়েছে। কী অপরাধ জুয়েলের? তিনি নাকি ধর্ম অবমাননা করেছেন? রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুলের শিক্ষক জুয়েল মানসিক অবসাদগ্রস্থ ছিলেন। এই একজন মানসিক অবসাদগ্রস্থ শিক্ষককে সমাজের তথাকথিত সুস্থ ধর্মপ্রাণ মানুষেরা পাশবিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়ে বাংলাদেশে ধর্মের মান বাঁচিয়েছে!আমরা কোন্ অসভ্য দেশে বাস করছি, ভাবতে পারেন?
একজন মানসিক রোগী – যাকে আমরা ভুল করে পাগল বলি, সেই একজন পাগলের অবমাননায় যদি ১৮০ কোটি মানুষের যাপিত ধর্ম এবং সে ধর্মের মালিক ওরফে স্রষ্টা বিপদে পড়েন, তবে সে ঠুনকো ধর্ম এবং সর্বশক্তিমান স্রষ্টার দরকার আছে কি?
যাঁরা প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে এই সব না-দেখা সর্বশক্তিমানের শক্তিমত্তার প্রার্থনা করেন, তাঁরা একটু দয়া করে ভেবে দেখবেন। আর যদি পারেন তবে জুয়েল নামের এই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটার পরিবারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। কেননা, “এ আমার এ তোমার পাপ”।
(২)
ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তিথি সরকারকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিথি সরকারের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে ধর্ম নিয়ে কটুক্তির অভিযোগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং-মানববন্ধন হয়েছে। জানি না, জীবন বাঁচাতে নাকি, নিহত হয়েই নিখোঁজ হয়ে গেছে মেয়েটি।
আমি কোনোদিনই বুঝি নি, আজও বুঝি না; ঈশ্বর, যাকে আমরা ভগবান বা আল্লাহ বা যিশু বা বুদ্ধ বলি, এতোই স্পর্শকাতর তিনি বা তাঁর অস্তিত্ব?এতো সর্বশক্তিমান, এতো ক্ষমতাধর, এতো কিছু করছেন- মৃত ও জীবিত হাজার হাজার কোটি মানুষের পাপ-পুন্যের হিসেব রাখছেন, অথচ কোথাকার কোন্ চুনোপুটিকে তার বিরুদ্ধে বলার জন্য শায়েস্তা করতে পারছেন না? আর আমরা যাঁরা ওই স্রষ্টার উপর অসীম বিশ্বাসী, তাঁরাও একটু ধৈর্য ধারণ করে দেখতে পারছি না, দেখি স্রষ্টা কী বিচার করেন?
(৩)
আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী এখন কী বলবেন?ফ্রান্সের স্কুল শিক্ষক কার্টুন প্রদর্শন করে গর্হিত অন্যায় করেছিলেন। আর ১৮ বছরের চেচেন নাদান বালক ধর্ম অবমাননার ক্ষোভ থামিয়ে রাখতে না পেরে “গর্দান উড়াইয়া” দিয়েছে। ফ্রান্সের পুলিশ অন্যায় করেছে এই বালককে বাঁচিয়ে না রেখে।
গাফফার ভাই,আপনার সব যুক্তিই মেনে নিয়েছিলাম সেদিন আপনার কলাম পড়ে। আপনি ফ্রান্সে মৃত্যু দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন কিন্তু বাংলাদেশে বিচার-বর্হিভুত হত্যাকান্ডে ব্যথিত হোন না কেন? বাংলাদেশে মৃত্যুদন্ডের পক্ষেও তো অসংখ্য কলাম লিখেছেন আপনি-ই।
আরেক ধর্মপ্রাণ তিউনিশিয়ান নাদান আজকেই তিনজনকে হত্যা করেছে ফ্রান্সের এক গীর্জায়। ৭০ বছর বয়সের এক বৃদ্ধার “গর্দান উড়াইয়া” দিয়েছে। ওই বৃদ্ধার কী দোষ ছিল, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আপনি বলতে পারবেন?
ধর্মের নামে, জাতীয়তাবাদের নামে এই সব বর্বরতাকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনোভাবেই সমর্থন করতে নেই। হিংসা-ঘৃণা-নৃশংসতা কোনো অজুহাতেই কোনো স্থানেই সমর্থন যোগ্য নয়। তাহ’লে আপনি চিনের উইঘুর কিংবা ভারত-বসনিয়াসহ নানান জায়গার সাম্প্রদায়িকতাকেই সমর্থন করলেন, আপনি সমর্থন করলেন হিটলারের নাৎসিবাদকেও।
এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে ফ্রান্সসহ ইউরোপ-আমেরিকার সব জায়গায় যদি ধর্মীয় উগ্রবাদীর উত্থান ঘটে, তাহ’লে আমি-আপনি কোথায় গিয়ে লুকাবো, গাফফার ভাই? আপনি না হয় ধর্ম প্রাণ মানুষ কিন্তু আপনার একই জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসের জন্য আমাকেও ধর্ম-কর্ম বিশ্বাস না -করেও যে আপনার সাথে “গর্দান পাতিয়া” দিতে হতে পারে, গাফফার ভাই!
(৪)
আসলেই আমি, আমরা অনেকেই এখন ক্লান্ত-অবসন্ন-বিষাদগ্রস্থ। জানি না, এ বর্বরতার শেষ কোথায়? নাকি কেবল শুরু? এক সময় কবিতা লিখতাম। খুব খারাপ লিখতাম তা নয়। এদিক ওদিক প্রকাশিতও হতো। সমাজ বদলের স্বপ্নটা কে ঢুকিয়ে দিয়েছিল মনে নেই। তবে ভাবতাম কবিতা দিয়েই সমাজ বদলে দে’য়া যায়। আসলেই কি সেটা সম্ভব? সামনে মহীরূহ ছিলেন অনেকেই। এঁদের প্রবন্ধ-কলাম পড়ে অনুপ্রাণিত হতাম। তখন প্রগতিশীল দৈনিক বলতে “দৈনিক সংবাদ”। কবিতা নয় ভাবলাম প্রবন্ধ লিখলে অনেকের কাছেই পৌঁছে দিতে পারা যাবে বার্তা। অনেক কলাম লিখেছি তখন।
বাংলাদেশ বদলায়নি। ক্রমশঃ বাংলাদেশ দেখেছে সরকার ও রাস্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা তোষণ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নিয়ে সমাজে এত্তো এত্তো বিভাজন। কোনো ধর্মকে আঘাত না ক’রেই অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছি “মুক্তমনা” নামে এক আলোকিত অন-লাইন পত্রিকা ও ব্লগে। এক ছোটো খাটো বই হয়েছে সে লেখাগুলো নিয়ে। সময়ের হিসেবে আজ থেকে দেড় দশক আগে। “আলো হাতে চলা আঁধারের” সহযাত্রীটি প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু যাঁদের জন্য লেখালেখি তাঁরা একটুও বদলায় নি।
কতো গর্ব ভরে বলি, পৃথিবীতে আর কোনো কবি-লেখকের রচনার প্রভাব একটি জাতিগোষ্ঠীর জীবনে এমনভাবে পড়েছে কিনা- যা ঘটেছে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালির জীবনে। বাঙালির জীবনবোধের আত্মপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যি কি তাই? এসব পুঁথিগত কথা। বাঙালির বাংলাদেশ আজ ধর্মের উন্মত্ততায় মত্ত। কোথায় কাজী নজরুলের সাম্যবাদ, কোথায় লালন সাঁইজির সহজিয়া? আসলে সাহিত্য-কবিতা-গান দিয়ে কিছু কি হয়? সমাজ বদলের জন্য চাই রাজনীতির বদল। আমাদের রাজনীতিই আজ ধর্মের মোহে মোহাচ্ছন্ন।
রবি ঠাকুরের গানের মতোই আজ বাংলাদেশের অবস্থা –
“এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি—
মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!
কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ, কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ—
কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা?
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা?।“
( ভজন সরকারঃ অক্টোবর ২৯, ২০২০)
সাহিত্য দিয়ে সমাজ বদলানো তখনই সম্ভব,যখন এগুলো পড়ে বোঝার মত শিক্ষিত জাতি তৈরি হবে।সেজন্য শিক্ষা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করা আবশ্যক।এ দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রের,কিন্তু রাষ্ট্রই তো ধর্মীয় নিগড়ে বন্দি।তবে আলো পৌঁছাবে কে???
এই খানে বুদ্ধের নামটী না লিখলে ভালো হতো কারন তিনি সৃষ্টিকর্তাও নয় হর্তা কর্তা ও নয় ওনি শিক্ষক সত পথের পদ প্রদর্শক 🙏🙏🙏
মানুষকে দাবিয়ে রাখার, অসহায় মানুষকে
নিজের বেহেশত্ লাভের বাসনায় পুড়িয়ে ফেলা, হত্যা করা, হূমকি দেয়া, দেশ ত্যাগে বাধ্য
করা কোনোকিছুই সভ্য, সুশিক্ষিত আর সুচিন্তিত মানুষের লক্ষন নয়।প্রশ্নের উত্তর যদি
না জানি তাহলে থ্রি ইডিয়টসের ভীরু সহাস্রুবুদ্ধির মতো মাথা খাটিয়ে আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ বললেই হয়। মানব হত্যা এবং হত্যায় সমর্থন কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ হিসেবে এ লজ্জা কোথায় রাখি???
পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আসলে মানুষ মানে আমরা যারা এখন সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানাচ্ছি। কি আর বলার আছে যুগ পাল্টাচ্ছে মানুষ এখন অন্যকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। কেন ভয় পায় সেটা তো বুঝতে পারছেন আর কথা বাড়ালাম না। শুধু একটা কথাই বলবো যা করছেন মানে যা লিখেছেন তাতে আপনাকে ধন্যবাদ।
বাংলাদেশের এই যে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটছে, তা কোনো ভাবেই এনলাইটেন করা যাইতেছে না। চাটুকারিতা, ভণ্ডামি আর পাওয়ার মিসইউজের প্রোটোকলে অন্ধ হয়ে গেছে। বাঙালি মবের রিএকশনগুলা রিডিকিউলাস। যে কোনো সময় যে কোনো মানুষের কথা অপছন্দ হলেই এরা সেই লোকটার ফাঁসি চায়। কতটা স্যাডিস্ট ব্যাপার!