অনুবাদ করেছেন: এ্যান্ডি যোসেফ কস্তা
[নাইজেল ওয়ারবার্টনের “ফিলোসফিঃ দা বেসিকস্” -এর কিছু অংশের অনুবাদের প্রয়াস। এখানে বিজ্ঞান সম্পর্কীয় যে দর্শন তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি পাঠকগণ বিজ্ঞান সম্পর্কে এই নিরপেক্ষ ও যুক্তিযুক্ত আলোচনায়, নতুন আঙ্গিকে বিজ্ঞান বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করবেন, তবে বিজ্ঞান চর্চার জন্য তা প্রয়োজনীয় নয়।]
১ম পর্ব
ভূমিকা
বিজ্ঞান আমাদের যক্ষা রোগ নিরাময়ে সক্ষম করেছে, আণবিক বোমা, মোটর গাড়ি, উড়োজাহাজ, টেলিভিশন, কম্পিউটার এবং আরো অসংখ্য যন্ত্রপাতি আবিষ্কারে সহায়তা করেছে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবণযাপনের ধারা বদলিয়ে দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সাধারনত সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা আমাদের প্রাকৃতিক বিশ্বের স্বরূপ উদ্বঘাটনে ও পূর্বাভাস প্রদানে সহায়তা করে। সকল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই মানবজাতির জন্য কল্যানকর হয়েছে তা নয় – সুনিশ্চিতভাবেই দেখা গেছে বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন মানব জীবণ ধ্বংষ এবং উন্নয়ন উভয় কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে। তারপরও বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক জগতকে বশে আনার সফলতাকে অস্বীকার করা কঠিন হবে। বিজ্ঞান যেখানে ফলাফল উৎপন্ন করেছে, সেখানে ডাইনিবিদ্যা, যাদু, অধিবিশ্বাস এবং বিভিন্ন ঐতিহ্য তুলনামূলকভাবে সমান্যই ফলপ্রসু হয়েছে।
অতীত পদ্ধতি অপেক্ষা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, জ্ঞানার্জনের একটি অত্যুন্নত ধাপ।
বিজ্ঞান “কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত সত্য” কে প্রতিস্থাপন করেছে, এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য।
কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত সত্য দ্বারা বোঝানো হয়, বিভিন্ন “কর্তৃপক্ষ”-এর দৃষ্টিভঙ্গীকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টোটল (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪- ৩২২) এবং খ্রীষ্ট ধর্ম শিক্ষা – যা কিছু দাবি করা হয় তার কারণে নয় তবে যে ব্যক্তি দাবি করেছিল সেই কারণে কোন ব্যাপারকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা।
এর বিপরীতে, কোন কিছু দাবি করার পূর্বে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি,
পরীক্ষা চালানোর প্রয়োজনীয়তার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে,
যেখানে বিশদভাবে তার ফলাফলগুলো নিরীক্ষণ করা হয়।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কি? এটি কি বাস্তবিকই এত নির্ভরযোগ্য যা সাধারণত সবাই ভেবে থাকে? কিভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি(Progress) হয়? এই জাতীয় প্রশ্নগুলো বিজ্ঞানের দার্শনিকগণ করে থাকেন। এখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রকৃতি সম্বন্ধে কিছু সাধারণ প্রশ্ন বিবেচনা করা হবে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কীয় সাধারণ ধারণা
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে একটি সাধারণ কিন্তু সর্বজনীন ধরণা নিন্মরূপঃ
একজন বিজ্ঞানী পৃথিবীর কোন নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে প্রচুর পরিমাণ নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। যেমনঃ পানি তাপ দিয়ে গরম করার ফল কি ? এই নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ঠ (objective) হতে হয়। বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য থাকে যাতে তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সংস্কারমুক্তভাবে(unprejudiced) তাদের উপাত্ত/তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। যখন তিনি নিরীক্ষণ সাপেক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করেন, তার পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে, একটি তত্ত্ব বা ধারণা(theory) তৈরি করা যা প্রাপ্ত ফলাফলের ধারাসমূহকে(pattern) ব্যাখ্যা করতে পারে। যদি তত্ত্বটি ভাল হয়, তাহলে তা অতীতের ঘটনাবলী সম্বন্ধে ভাল ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে তারও সঠিক বর্ণণা দিতে পারবে। যদি ভবিষ্যতে প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে তত্ত্বের প্রদত্ত ব্যাখ্যার সামঞ্জস্য না থাকে, তাহলে বিজ্ঞানীরা সাধারণত ঐ তত্ত্বের কিছু পরিবর্তন করে থাকেন। যেহেতু প্রকৃতি জগতে অনেক কিছুই তাদের গতানুগতিক প্রথায় চলে, বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভুল হয়ে থাকে।
উদাহরণসরূপ, কোন বিজ্ঞানী স্বাভাবিক অবস্থায়, ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপে পানি ফোটানো শুরু করতে পারেন। তিনি নিরীক্ষণ করতে পারেন যে, পানি ফুটতে শুরু করেছে ও বাষ্পীভূত হচ্ছে। বিভিন্ন তাপমাত্রা ও চাপে পানির কিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে ঐ ব্যাপারে, উনি হয়ত আরো গোটা কয়েকবার তা নিরীক্ষণ করতে পারেন। এরপর প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে উক্ত বিজ্ঞানী একটি তত্ত্বপ্রদান করতে পারেন, যা তাপমাত্রা ও চাপ সাপেক্ষে পানির স্ফুটুনাঙ্ক-এর মাত্রা সম্পর্কীয় হবে। তত্ত্বটি কেবলমাত্র কোন নির্দিষ্ট সংগৃহীত নিরীক্ষণের ব্যাখ্যা করেনা, তা যদি ভাল তত্ত্ব হয় তাহলে তা ভবিষ্যতে গৃহীত যে কোন তাপমাত্রা ও চাপ সাপেক্ষে পানির স্ফুটুনাঙ্কের(boiling temperature) সঠিক মান প্রদানে সক্ষম হবে।
এই দৃষ্টিকোন থেকে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রক্রিয়া সাধারণত নিন্মরূপঃ
নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু
প্রাপ্ত ফলাফল হতে তত্ত্ব প্রণয়ন
এবং ফলস্রুতিতে কোন ব্যাপার বা বিষয় সম্বন্ধে সর্বজনীন-করণ (generalization) (সর্বজনীন বিবৃতি), যা উক্ত ব্যাপারে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ঘটনার পূর্বাভাস প্রদানে সক্ষম হয়ে থাকে।
এই সর্বজনীনকরণ যদি উৎকৃষ্টমানের হয়ে থাকে, তাহলে তাকে প্রকৃতির একটি সূত্র (প্রাকৃতিক সূত্র) হিসেবে বিবেচনা করা হবে। (Law of nature).
বিজ্ঞান নিরপেক্ষভাবে বস্তুগত (Objective) ফলাফল উৎপাদন করে, যেখানে যদি কেউ সেই ফলাফল যাচাই করতে চান, তাহলে ঐ একই পরীক্ষার পুনারাবৃত্তি করে তা পরখ করে দেখতে পারেন।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্বন্ধে এই ধারণা আশ্চর্যরূপে সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান, এমনকি যারা বিজ্ঞান বিভাগের সাথে সরাসরি জড়িত তারাও এই ধারনা পোষণ করে থাকেন। এতদসত্ত্বেও এই ধা্রণা অনেক দিক দিয়েই অসন্তোসজনক। এর মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো হচ্ছেঃ নিরীক্ষণের প্রকৃতি এবং আরোহ-প্রণালীভিত্তিক তর্ক সম্বন্ধীয়।(Inductive argument)।
২য় পর্ব
সহজসরল ধারণার সমালোচনাসমূহ
নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া
আমরা দেখেছি যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে সহজসরল ধারণাটি হচ্ছেঃ
বিজ্ঞানীরা তাদের তত্তীয় পর্যায় শুরুর পূর্বে, নিরপেক্ষভাবে তাদের নিরীক্ষণ কাজ করেন।
তবে সহজসরল ধারণাটি নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি সঠিকভাবে বর্ণণা করতে ব্যর্থ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ধরে নেয়া হয় যে, আমাদের জ্ঞান ও প্রত্যাশা (expectation), নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ার উপর কোনরূপ প্রভাব ফেলেনা, অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ উপায়ে নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব।
বইইয়ের পূর্ব একটি অধ্যায়ে “দেখার প্রক্রিয়া” (perception) আলোচনায় নীচের ব্যাপারটি উল্ল্যেখ করা হয়েছিল যে,
দেখার কাজটি শুধু চোখের অক্ষিপটে ছবির প্রতিরূপ ভেসে উঠা নয় অথবা দার্শনিক এন.আর.হ্যানসন(১৯২৪-৬৭) যেভাবে বর্ণণা করেনঃ
“চোখ দিয়ে দেখার বাইরেও দেখার অনেক কিছু আছে।”
‘There is more to seeing than meets the eyeball.’
কোন কিছু দেখার সম্ভাবনার ব্যাপারে, উক্ত বিষয়ে আমাদের যে জ্ঞান ও প্রত্যাশিত ধারণা থাকে ,
তা আমরা বাস্তবে যা দেখি, ঐ ব্যাপারটির উপর প্রভাব ফেলে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন আমরা টেলিফোন একচেঞ্জের বিভিন্ন তারের দিকে খেয়াল করি, তাহলে এলোমেলোভাবে জড়ানো নানা রংয়ের কিছু তার দেখে থাকি,
আর সেই একই তারগুচ্ছ যখন একজন টেলিফোন ইঞ্জিনিয়ার লক্ষ্য করেন, তখন তিনি বিভিন্ন সংযোগের ধারা এবং আরো অনেক কিছু দেখতে পারেন। উক্ত টেলিফোন প্রকৌশলীর দক্ষতার ক্ষেত্রের ভিত্তিতে, তার যে ধারণাসমূহ রয়েছে , তা উনি বাস্তবে যা পর্যবেক্ষণ করছেন, তার উপর প্রভাব ফেলেছে।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, টেলিফোন প্রকৌশলী আর আমি একই দৃশ্য অবলোকনের অভিজ্ঞতা লাভ করছি, আর তাকে ভিন্নভাবে ব্যখ্যা করছি; কার্যকারণ বস্তবাদী নিরীক্ষণ তত্ত্ব (Causal realist theory of perception) দাবী করে থাকে যে,
দেখার অভিজ্ঞতাটি, দেখার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আমাদের নিজস্ব যে বিশ্বাস বা ধারণা থাকে, তা হতে পৃথক করা সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে আরেকটি উদাহরণ হলঃ
একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী একটি ইলেকট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্রের ভেতর দিয়ে যা দেখেন আর বিজ্ঞান সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ কোন ব্যক্তি যখন সেই একই যন্ত্র দিয়ে যা দেখতে পারেন তার পার্থক্য নিন্মরূপঃ
পদার্থবিজ্ঞানী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের বিভিন্ন অংশের পারষ্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে অবগত থাকবেন। উনি জানবেন কিভাবে যন্ত্রটি ব্যবহার করতে হয় এবং কি কি উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করা যায়। তবে বিজ্ঞান সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ ব্যক্তিটির কাছে তা কতিপয় ধাতু ও তারের তৈরি অদ্ভুত কোন বস্তু মনে হতে পারে যা কোন রহস্যময়ভাবে বিভিন্ন তারের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে।
এটা সত্য যে, বিভিন্ন দর্শক কি দেখছেন তার মাঝে অধিক্রমন (overlapping) বিদ্যমান রয়েছে, তা না হলে, আমাদের পারষ্পরের সাথে যোগাযোগ করা অসম্ভব হয়ে পরত। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে সহজসরল ধারণাটি, নিরীক্ষণ সম্বন্ধীয় এই গুরূত্বপূর্ণ ব্যাপারটি উপেক্ষা করে যে, আমরা যা দেখি, তা শুধু আমাদের অক্ষিপটে ধারণকৃত কোন ছবি নয়।
আমরা যা দেখি, সচারাচর তা আমাদের “মানুষিক কাঠামো ”-র উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ আমাদের জ্ঞান,অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা, আমাদের সংস্কৃতি শিক্ষাও এর আওতায় আসে।
তা সত্ত্বেও এটি বিবেচনায় রাখা উচিত যে, কিছু কিছু নিরীক্ষণযোগ্য বস্তু রয়েছে যা আমাদের বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়না।
যদিও আমি জানি, যে দিগন্তের সীমায় হেলে থাকা বড় চাঁঁদ অপেক্ষা
ঠিক মাথার উপর ঝুলে থাকা চাঁদ দেখতে তুলনামূলকভাবে ছোট,
তবে প্রকৃতপক্ষে তা একই বস্তু এবং তাদের আকারও অপরিবর্তিত রয়েছে,
তারপরও তা আমরা তা আকারে বড় ও ছোট দেখি।
এক্ষেত্রে আমার চাঁদ দেখার অভিজ্ঞতাটি, আমার সচেতন প্রাসঙ্গিক বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেনা। আর নিশ্চিতভাবেই, আমি এই ব্যাপারটিকে “বড় দেখাচ্ছে” হিসেবে ব্যাখ্যা করব, যদিও তা সত্যিকারভাবে “বড় নয়”, আর তা তত্ত্বীয় ধারণার(Theory) উপর নির্ভর করে।
কিন্তু এটি এমন একটি দৃষ্টান্তের প্রকাশ যেখানে “দেখার অভিজ্ঞতা” আমার নিজস্ব বিশ্বাস বা ধারণার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এটা দেখাচ্ছে যে, আমরা যা জানি এবং যা দেখি: এদুয়ের মাঝে যে সম্পর্ক তা অতটা সহজবোধ্য নয়, যা মাঝে মাঝে ধারনা করা হয়, তা হচ্ছেঃ
আমাদের ধারনালব্ধ গতানুগতিক জ্ঞান, কখনোই কোন বস্তু বা ঘটনার নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেনা।
তবে এদ্বারা বিজ্ঞানের সহজসরল তর্ক -এর বিরোধী যুক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়না, যেহেতু প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমাদের নিরীক্ষণ ক্রিয়া, আমাদের ধারনাকৃত মানষিক অবকাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
চমৎকার বর্ন!!!
ধন্যবাদ!
ভালোই লেগেছে..আরো ভালো পোষ্ট হবে সেটাই আশা করি..
সুখ পাঠ্য। ভালো লেগেছে।