তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করলেও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে তাজউদ্দীন অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ৭৪ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরের পূর্বে মার্কিন আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচক তাজউদ্দীনকে পদত্যাগ করানো হয়। যদিও রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে তাজউদ্দীন নিজেই পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তিনি আর ঐ মন্ত্রী সভায় থাকতে চাচ্ছিলেন না। তবে তিনি নিজ থেকে তিনি পদত্যাগ পত্র দিলে বঙ্গবন্ধু বিব্রত হতে পারেন তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর পদত্যাগের আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন।
২৬শে অক্টোবর দুপুর ১২.২২ মিনিটে তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে অফিস থেকে ফোন করে তাঁর স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে জানালেন- লিলি, আমি মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছি। ১২টা বেজে ২২ মিনিটে আমি পদত্যাগপত্রে সই করেছি। ফোনের মধ্যেই জোহারা তাজউদ্দীন স্বামীকে অভিনন্দন জানালেন। জোহরা তাজউদ্দীন ৭২ সাল থেকেই বলে আসছিলেন তাজউদ্দীন এই মন্ত্রীসভায় বেশিদিন টিকতে পারবেন না, স্বাধীনভাবে তাঁকে কাজ করতে দেবে না।
তাজউদ্দীন আহমেদ এমন একটি সময় পদত্যাগ করেছেন যখন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যাচ্ছে, সরকার চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না (কিংবা করছে না)। তাই পত্রিকার পাতায় তাজউদ্দীনের পদত্যাগের সংবাদের সাথে সাথে দুর্ভিক্ষের সংবাদও নজরে আসে।
ঐতিহাসিক চরমপত্রের রচয়িতা ও পাঠক এম আর আখতার মুকুল তাজউদ্দীনের পদত্যাগ সম্পর্কে লিখেছেন, মন্ত্রীসভা থেকে তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। মনে হল বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে শাণিত তরবারি অদৃশ্য হয়ে গেল। … ছায়ার মতো যে নির্লোভ ব্যক্তি অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেছেন এবং নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ দিয়ে বহু বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন এক গোপন চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে শেখ সাহেব সেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন।
তাজউদ্দীন বাকশাল বা একদলীয় শাসনের বিরোধী ছিলেন। বাকশাল থেকে শুরু করে দেশ চালানো বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীনের দূরত্ব তৈরি হয়। তাই তো তাজউদ্দীন বলেন- ‘মুজিব ভাই, এই জন্যই কি আমরা ২৪ বছর সংগ্রাম করেছিলাম? যেভাবে দেশ চলছে, আপনিও থাকবেন না, আমরাও থাকবো না, দেশ চলে যাবে রাজাকার- আলবদরদের হাতে।’
তাজউদ্দীনের পদত্যাগের পর তাজউদ্দীনকে সরকারী নজরদারীতে রাখা হয়েছিল। তাজউদ্দীনের পদত্যাগের ঘটনায় মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জমিরউদ্দিন আহমেদকে ডেকে পাঠালেন সে দেশের জাতির জনক টুংকু আব্দুর রহমান। তিনি জানালেন যে, তাজউদ্দীনের এই সরিয়ে দেয়াটাকে তাঁরা ভাল মনে করছেন না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান অর্থমন্ত্রী যাঁকে সবাই চেনে, যিনি বাংলাদেশের জন্য সব দিকে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁকে কেন হঠাৎ সরিয়ে দেয়া হল? জমিরউদ্দিন আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে চিঠির মাধ্যমে এবং ঢাকায় এসে মুজিব কাকুকে সরাসরি মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিক্রিয়া জানালেন। বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, আমি কাকে মন্ত্রী রাখি না রাখি তাতে ওদের কি রে?’ রাষ্ট্রদূত জবাব দিলেন, ‘এটা অন্য কেউ নয়, তাজউদ্দীন। আমাদের মতো গরিব দেশে তাজউদ্দীন যে কয়দিন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, শুধু ভিক্ষা করেই বেড়িয়েছেন। কিন্তু ভিক্ষুকেরও যে ডিগনিটি, আত্মমর্যাদা থাকতে পারে তা তাজউদ্দীনের ছিল। তাই তিনি সবার মনে দাগ কেটেছেন। কাজেই তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাবেই।
এবার বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে মজার একটা তথ্য দিই। বাংলাদেশে ৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয় এতে সরকারী হিসাবে ২৭ হাজার মানুষ আর বেসরকারী হিসেবে ২ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। অথচ এই ৭৪ সালেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি (৭২-৭৩) দেখানো হয়েছিল ৯.৬! মানে সরকারী ডাটা যে কতো বড় ভাঁওতাবাজি এর জলজ্যান্ত প্রমাণ এই রিপোর্ট। মানুষ যখন মারা যাচ্ছিল তখন তাদের ঘাড়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৬ শতাংশ। কয়েক বছর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী সেই প্রবৃদ্ধি নিয়ে সংসদে দাঁড়িয়েও গর্বও করেন!
“বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন আমলে। দেশের প্রথম বাজেট দেয়া হয় ১৯৭২-৭৩ সালের অর্থবছরে। এরপর ১৯৭৪ সালে দেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৭ শতাংশ মতান্তরে ৯.৬ শতাংশ। এরপর আর কোন বছরই জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়নি। জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় এসব কথা উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।”
এইসব ফ্যাক্টস যাতে জনগণের ভেতর প্রচারিত না হতে পারে সেজন্য আইন করা হয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম আর প্রবাসী সরকার পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকার প্রকৃত মূল্যায়ন এখনও হয় নি। তিনি শক্ত-হাতে হাল না ধরলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কোন দিকে যেত তা বলা যায় না। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে তিনি হয়ে গেলেন অপাংক্তেয়! দুঃখজনকভাবে আজকাল তাজউদ্দীন আহমদের কর্মজীবনের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা হলেও স্বাধীনতার স্বপক্ষেরই কেউ কেউ হটাত শঙ্কিত হয়ে উঠে যেন কিছু একটা ধামা-চাপা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন! পক্ষ-বিপক্ষ যাই হোক ঐতিহাসিক তথ্যের নির্মোহ এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ ছাড়া কেবল আইন বানিয়ে কি ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করা যায়?
আপনার গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।
গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ! ধন্যবাদ শুভ।
ধন্যবাদ সৈকত দা