আমার হৃদয়-ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধুর যে সুবিশাল মূর্তমান প্রতিচ্ছবির প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার সূত্র হলো আমার ছোটবেলা, আমার বাবা, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, তাঁর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য-ভাষন, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, তাঁর প্রতি রাগ-বিরাগের অনুবর্তী নানান মতামত-বিশ্লেষন-বিতর্ক সঞ্জাৎ বই-পত্র-পত্রিকা এবং অন্তর্জালের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা বিশ্ব মানসের প্রকাশিত পক্ষ-বিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গী। আমার অনুভবের ডালায় সাজানো কথার মালায় গ্রণ্থিত শব্দকল্পের কয়েকটির সম্যক বিশ্লেষন আজ এখানে নিবেদিত হলো। এই মুহূর্তে একই সাথে একটি বেদনাহত বিউগলের ছন্দময় প্রচ্ছদে নতুন করে চোখ মেলবার ভৈরবের মৃদু-শান্ত-সৌম্যের মূর্ছনা সঞ্চারিত হয়ে চলেছে চতুর্দিকে। আমি এই সুর-মুর্চ্ছনার জলদগম্ভীর আলাপটুকুতেই আপাততঃ স্থির থাকতে চাই।
আজ-কালকার রাজনৈতিক অলঙ্করণের বাহ্য আভরণে ব্যক্তিত্বের মূল সুরটুকু শুরুতেই অযাচিত ভাবে হারিয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটা সস্তা-বালখিল্য ধরনের চরিত্র চিত্রনে, উৎসবের চাকচিক্যে এবং ভবিষ্যতের কিংবা নিকট ভবিষ্যতের অযাচিত প্রত্যাশায় মহত্ত্বের এই সব সৃষ্টি-কর্ম কিংবা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত বহির্দেশীয় রাজনৈতিক শিল্প-কর্মের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনেকটা ফিকে হয়ে বাহুল্যতায় পর্যবশিত হয়। এসব তৎপরতার বেশীটাই স্ব-স্বার্থ তাড়নার নির্যাস। তদুপরি আছে ঠুনকো অযুহাতে বিভাজিত মনোবৃত্তির ভীষন দর্শণ থাবা। গুটিকয় অস্থির চিত্তে এই যে বিভাজন, আপাতঃ দৃষ্টিতে তা সামান্য মনে হলেও এর প্রভাব সুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই যে, কালোত্তীর্নের চরিত্র-চিত্রনের আয়োজন, এটি একটি বিশালাকার যজ্ঞ। অথচ শুধুমাত্র মানসিক অস্থিতিশীলতা, স্বজ্ঞানে আস্থহীনতা এবং সর্ব্বোপরি তপস্যাভাবে চরিত্রের খন্ডিতাংশে সামগ্রীকতার নিরীখে ব্যক্তিত্ত্বের বিশালতাকে আমরা আতিশয় তুচ্ছ করে তুলি। ফলশ্রুতিতে তাই এক মহান রাজনৈতিক চরিত্রকে আমরা এতোটাই ক্ষুদ্রজ্ঞান করি যে তিনি বা তাঁর সত্ত্বা আমাদের হাতে কার্যতঃ এক শিশুতোষ ব্যক্তি চরিতরূপে পরিগনিত হন। তাতে আমাদের বর্তমানের প্রয়োজন মেটে বটে কিন্তু ভবিষ্যতকে নিশ্চিত ভাবেই হত্যা করা হয়। অবোধের চোখে অযাচিত ভাবে ঐতিহাসিক বাস্তবতার সুবিশাল প্রচ্ছদ বর্তমানের স্থান-কাল-পাত্রের ক্ষুদ্রতায় তুলনীয় বলে পরিগনিত হয়। আর এ সব সুযোগ সৃষ্টিতে আমরাই কার্যকর ভাবে ভূমিকা রাখি। ফলে সমাজের অখ্যাত কিংবা গৌন কোন ব্যাক্তিত্ত্ব এ মহান চরিত্রের পাশে স্থান করে নেবার নিষ্ফল তাড়নায় সাময়িক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ আমাদের হীনতা, নীচতা কিংবা পরশ্রীকাতরতা জাত স্বভাব। তাতে প্রকৃত মান্যবরের শেখরশীর্ষ মর্যাদায় কিছুমাত্র দাগ লাগেনা বটে কিন্তু ভবিষ্যৎকে তার শেকড় সন্ধানে অতিরিক্ত মূল্য গুনতে হয়। উত্তর প্রজন্মে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য খন্ডিত ভাবে ইতিহাস চর্চায় সেই অতীতের মাধুর্য্য, অতীতের সংগ্রাম, ত্যাগ ও অর্জিত নতুন চেতনালোকে কালিমা লেপনের সুযোগ সৃষ্টির ফলে প্রতিক্রিয়াশীলের নষ্ট ও ত্যজ্য চেতনার পুনর্জন্ম ঘটে। সেটা সমাজ, কাল ও দেশ ও পাত্র নির্বিশেষে সর্বত্র এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
মহাকালের যাত্রাপথে ধ্রুবনক্ষত্রের মত যাঁরা সভ্যতার আগামী গন্তব্যকে নির্দেশ করেন, তাঁরা ক্ষণজন্মা। কালের নির্দিষ্ট সীমায় পরিমাপ করতে গেলে তাঁদের বিরাটত্বের প্রায় সর্বাংশই ছেঁটে ছোট করে আনতে হয়। ফলে সভ্যতার অগ্রযাত্রায় তাঁদের সৌকর্য্যময় যে শাশ্বত মূর্তি, তা প্রকারান্তরে অতিমাত্রায় মলিন হয়। আমাদের নৈমিত্যিক যাপিত-জীবনের নিমিত্যের প্রেক্ষাপটে তাঁদের প্রকৃত আদর্শিক দান, মহত্ত্ব ও সৃষ্টিকে যথাসম্ভব কিঞ্চিৎকর হিসেবে বিচার করার প্রয়াস পাই। কেননা মানব-ইতিহাসের কালের যাত্রার রেখাচিত্রে মহত্ত্বের যে অবয়ব শেষ পর্যন্ত থেকে যায়, সে ভাবমূর্তি থেকে প্রকৃতির অনন্ত সম্ভাবনার নিয়ন্ত্রণের নিয়মে তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের স্ববিরোধীতা, আত্মবিরোধ সহ আত্মখন্ডনের অনিবার্য জটিল ও বিচ্ছিন্ন দাগ গুলো মুছে যাবার কথা। অথচ আমাদের আত্মবিপর্যয়ে বোধের ক্ষুদ্রতায় সেগুলো অতি আকস্মিক ও ক্ষণকালের জন্যে মহত্ত্বকে, ব্যক্তির নিজস্ব বৃত্তে ক্ষুদ্র করে তুলে। অথচ তবুও সত্য এই যে, প্রনম্যের সুসংহত ভাবমূর্তি সভ্যতার সিঁড়ির ধাপে ধাপে চিরন্তন হয়ে টিকে থাকে। এ আলোচনার সার্থকতা সেখানে, যদি আমাদের কালের সহযাত্রীদের মাঝে সেই পরিদৃষ্ট শাশ্বত ভাবের আধুনিকতম রূপ রূপায়নের প্রয়াস মেলে।
আজকের বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক ভাবমূর্তির হরণ, বিকৃতি, কালের দেয়ালে অসততার কালিমা লেপন, অন্তঃ ও আন্তঃ-রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বিরোধ, কাল বাদে পরশু হয়তো তা থাকবে না। সাময়িক অপরিণামদর্শী উচ্চাকাঙ্ক্ষা, রাজনীতির বিভিন্ন সমীকরণসহ যুক্তিহীন অহংবোধের অভিপ্রায় গুলো লুপ্ত হবেই আগামীর কৌশলগত উন্নয়নের বিশ্বমঞ্চে। আজকের রাষ্ট্রচালকদের অভিপ্রায় গুলো নানান গোষ্ঠী-স্বার্থ ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক শক্তি সমূহের নানামুখী তৎপরতার এক জটিল আবর্তে আবর্তিত। সেখানে কে ঠিক, তার নির্ধারণ এক অবিমৃষ্যকারীতার নামান্তর এবং অনিশ্চয়তা সূত্রের সম্ভাবনার সমীকরণে যে আপাতঃ উজ্জ্বল সম্ভাবনা বিন্দুর দেখা মেলে এখানে সেটাও থাকে অস্পষ্ট। তবুও ধরা যাক, আমাদের রাষ্ট্রিক সাফল্য সাধনার প্রেক্ষাপটে এবং রাষ্ট্র পরিচালকের ইস্পিত লক্ষ্যে আমরা উপনীত হয়েছি। যেখানে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির বিরোধ আপাততঃ নেই। তবুও আজকের দিনলিপির কোন ঘটনাটির আত্মপ্রকাশ মহাকালের ধুলাচ্ছাদিত প্রান্তরে দিক নির্দেশকের মতো মাথা তুলে থাকবে সেটাই বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে স্পষ্ট দেখতে পাই, আজ যাঁকে উপলক্ষ করে কিংবা যাঁর দৃষ্টির ভেতর দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার সংকল্পে আমরা বিভোর, তাঁর স্থান ঐ কালের যাত্রারথে ঠিক কোথায়, কোথায় তাঁর বিশিষ্টতা, এর নিরুপণ হবে অগ্রগন্য। এই নিরূপণ বহুমাত্রিক ভাবে একটি নিগূড়তম শাশ্বতের প্রতিষ্ঠা। সে একটি দেশ কিংবা জাতি, একটি দর্শন, একটি সভ্যতা কিংবা একটি সাংস্কৃতিক বোধের নবজন্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। তাই শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার নিরিখে তাঁকে বিবেচনা করাটা নিতান্ত মূঢ়তা, এমন কি সেই শাশ্বতের অবয়বে সাথে ব্যক্তির অভিব্যক্তি, প্রকাশ এবং তাঁর বাস্তব ও সচেতন ভাবে সঞ্চারিত দার্শনিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধ একটি বিপুল বৈভবের সমাহার আমাদের জন্যে হতে পারে। এই অবয়বের উপরে রেখাপাত, বিশেষ করে সমসাময়িক কালের নীরিখে একটা যোগ্যতম মাত্রা আরোপও বিশেষ যোগ্যতা বলে আজকের জটিল বিশ্ব-ভূ-রাজনৈতিক শিল্প সত্ত্বায় হতে পারে এক স্বীকৃত পান্ডিত্য। এক একটি সম্পর্কিত বিশেষ চরিত্র-স্পন্দনের নিরিখে ব্যক্তির গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলো বিবেচনা করলেও উপসংহারে সামগ্রিক সম-পাতিত ব্যক্তি-চরিত হিসেবে মহাত্মার সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গী একটি বিশেষ মাত্রার দর্শন হিসেবে প্রতীয়মান হবে। এইসব থেকেই সমন্বিত বোধ গুলোর পরম্পরা ও সম্ভাব্য প্রভাব ও তার ব্যাপ্তিকে সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করেই নির্ধারণ করতে হবে মহাত্মার সামগ্রীক রাজনৈতিক দর্শন। সুতরাং আমাদের ক্ষুদ্রতা দিয়ে নয়, বরং বর্তমানের অর্থ-কৌশল ও বিশ্ব-ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়েই আজ আমাদের বিবেচনা করতে হবে, যে শেকড়-শক্তির দৃঢ়তায়, বোধে, আধুনিকতায়, শিক্ষার মাধুর্য্যে আত্ম-বলীয়ান হয়ে সমগ্র বাংলাদেশকে, এর জাতিসত্তার অহংকারকে তিনি আপনার মাঝে ধারণ করেছেন সেই বোধ-শক্তিকে আজ যথাযথ ভাবে অনুভব করতে পারলেই আমাদের লক্ষ্যের মহাসড়কের সন্ধান হয়তো মিলবে। এ বোধ হচ্ছে সেই শক্তি যা কিনা নিকট অতীতে দ্বিজাতি তত্ত্বের অন্ধকারাচ্ছন্ন গহ্বরে বেড়ে উঠা অযুত মতের বিচ্ছিন্ন, স্থবির ও জড়ত্বকে ভীষণ স্পর্ধায় এক আঙ্গুল-ইশারায় এক লক্ষ্যে দাঁড় করিয়ে দেবার সচেতন আধুনিক সভ্য-রাজনৈতিক অহংকার। এ হল, বাঙ্গালীর সদ্য ভুমিষ্ঠ রাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমানায় আনা রূপান্তর আর বাঙালী মানসের পুনর্জন্ম। এর কারণ, সাম্প্রদায়িক আফিমে আচ্ছন্ন, সংকোচে সংকটাপন্ন, অনুগ্রহের লালসায় লীন ও মজ্জাগত আস্থাহীনতায় দৈন্য ও ক্রমশঃ নিঃশেষিত মৃতপ্রায় একটি জাতিকে শবাধার থেকে তুলে এনে তার প্রাগৈতিহাসিক সৌকর্যের পটভূমিতে পুনঃস্থাপন। শুধু তা নয়, শাশ্বত ধারনায় বঙ্গের ঐতিহ্যিক পটভুমি, আত্ম-বিশ্বাস, অহঙ্কার আর মাথা তুলে দৃঢ়তার সাথে পাশাপাশি দাঁড়াবার জন্যে জনপূঞ্জের গভীরে যে শেকড়ের সংযোগ টুকু দরকার হয় তা তিনিই মূলতঃ পুনঃনির্মাণ করেছেন, আমাদের হাতে সঁপে দিয়েছেন তাঁর সবটুকু অর্জন একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি জাতির আত্ম পরিচয়, ঠিকানা ও দিকনির্দ্দেশনার সংবিধান।
ক্ষুদ্রতা হেতু আভ্যন্তরীন বিপন্নতা ছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্তর থেকে ধেয়ে আসা উটকো, বেসুরো ঢেউ গাঙ্গেয় উপত্যকার পাললিক বাংলাকে সময়ে সময়ে কালের নিয়মে প্লাবিত করবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই ঢেউয়ে বয়ে আসা আগন্তুকেরা হবে প্রভাববিস্তারী, ক্ষমতা ও ন্যায়-দণ্ডের মান-বিচারী, আর আবহমানকালের বাংলার ইতিহাসের পথ বেয়ে যুগের ধারাবাহিকতায় আজকের প্রাণধারা, উৎকর্ষ চেতনা-ধারা সেইটেই হবে ম্লান, এই যে স্বাধীন ভূমে অগ্রহণীয় যন্ত্রণার আবির্ভাব – এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে ? এর পরিত্রাণের উপায়ও আমাদের আছে, সে আমাদের পিতা প্রদত্ত উত্তরাধিকার।
আমাদের পারষ্পরিক হানাহানি, অবিশ্বাস, অন্ধবিশ্বাস, মানহীন শিক্ষা ও ব্যক্তি ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী যুক্তিহীন তুলনা আমাদের ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করছে মানব সভ্যতার মহাকালের সোপান থেকে। তাই আজকের সভ্যতা যাত্রায় আমরা পরনির্ভরতায় আত্মপ্রসাদের প্রহর গুনি! আমাদের গনতান্ত্রিকতায়, আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, আমাদের ভোটাধিকারে ও তার ফলাফলে অন্যের তুষ্টির, দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকি। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতির এ কাম্য হতে পারে না। স্বভূমে কি করে আমরা পরাধীন হয়ে উঠি নিজেরই অজান্তে এর চেয়ে বোধ করি ভাল উদাহরণ আর হতে পারে না।
শাসনকর্তাদের দেয় বিষয় হল রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থাৎ সেখানে নিশ্চিত ভাবে থাকতে হবে রাষ্ট্রের জনগনের জন্যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদার সম্পূর্ন যোগান; খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, ও চিকিৎসা। চাহিদার ধারাবাহিকতা এবং কালের পরিক্রমায় স্বাধীন ভূখন্ডে আমাদের রাষ্ট্র তার অর্ধশতকের জন্ম-জয়ন্তীর দ্বার-প্রান্তে উপনীত। মৌলিক চাহিদার প্রথম দু’টির চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যহীন অপূর্নতায়ও কিছুটা স্বস্তি বোধের সুযোগ হয়তো এখন আছে। বাকী তিনটি চাহিদার বিদ্ধস্ত অবয়ব মূলতঃ আমাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের প্রতীক। এসবের সাথে পরিপূরক হিসেবে রাষ্ট্রের আইন বিভাগ ও জন-নিরাপত্তার দিকে আঙ্গুল তোলা যায় অনায়াশে। যদিও রাষ্ট্রের ক্রমশঃ বেড়ে উঠা শরীরে সেই কারণেই পোষাকী আদলে রয়েছে র্যাব, পুলিশ, সৈন্য-সামন্ত, বন্দুক, কামান, কাঁদানে গ্যাস। সমস্যা তাতে কমে নি, বরং ক্রমাগত ব্যাপ্তিতে ঐ দুটি প্রত্যঙ্গের যথাযথ কার্যকারীতা বিলুপ্তির পথে।
বৈদিক যুগে ভারতবর্ষে রচিত মহাকাব্যের পরে আমাদের এ কবিই রচনা করেছিলেন আর একটি মহাকাব্য।। সেই মহাকাব্যের পঙ্তিতে পঙ্তিতে ছড়িয়ে আছে আবহমান বাংলার সবুজ-শ্যামল রূপ। শুধু কি তাই? বাঙলার সৌর্য্য-বির্য়্যের শাশ্বত রূপের এ নিখূঁত বর্ণনা ত্রিমাত্রিক ফ্রেমে গেঁথে মঞ্চায়ীত করার দুর্লভ ক্ষমতা বোধ করি সহস্রাব্দেও বিরল। সে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বেদনা-বিদূর বর্ণীল অবয়ব। আমাদের আজকের মহাকাব্যের জন্ম মুহূর্তের যন্ত্রনা। অভূতপূর্ব এক সন্ধিক্ষনে এ জাতি তার শেকড় ছুঁয়ে এসেছিলো! শেকড়ের সন্ধান পেয়েছিলো। যে জড়ত্ব জাতি হিসেবে আমাদের গ্রাস করেছিলো দ্বিজাতিত্ত্বের অলীক জালে। সেই এঁদোবদ্ধতা থেকে যেনো মুক্তি, যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস। ইতিহাসের পরতে পরতে, যুগে যুগে, স্থানে স্থানে সর্বজন-গ্রাহ্য জনাকতক সাহসী মানুষ সেইসব জড়ত্বকে সক্রোধে প্রাণ-পণে আঘাত করেছেন, এবং জাতীয় ভাবে, আন্তর্জাতিক ভাবে মানুষের চিরন্তন গণ্য আত্মমর্যাদাকে জাগিয়ে তোলার কাজে ব্রতী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ক্ষণকালের প্রশাসনে, নিজ জীবনাচরণে সেই আদর্শ প্রয়োগে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বিশ্বময় মানুষের সাম্যতার জাগরণে নিজের আত্মপোলব্ধীকে শানিত করেছিলেন। এ জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করে সভ্যতার আলোয় অবমুক্ত করতে সংকল্পে ব্রতী হয়েছিলেন। নতুন করে বাঙ্গালী জাতির আদর্শিক দীপশিখাকে পুণঃপ্রজ্জ্বলনে পথে নেমেছিলেন। আত্ম-মর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে যথাযথ দৃঢ়তায় তাঁর আশু কর্তব্য গুলো সম্পাদনে করণীয় গুলোকে গ্রন্থিবদ্ধ করেছিলেন।
সেইকালে যেমন, আজও তেমন আমাদের ভীত ও পরস্পর সম্পর্কহীন চেতনা প্রাকারে প্রভুত্বের দুর্গ নির্মাণ করে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী, কর্পোরেট শক্তি সমূহের দাসানুদাসেরা। অস্ত্র-সম্ভার, আর জনপদের বাজার দখলের মতো সর্বগ্রাসী মদমত্ততার বিস্তার ঘটত না যদি আমাদের সময়োচিত উপলব্ধি, রাজনৈতিক হটকারীতা ও শিক্ষা সম্প্রসারণে পশ্চাদপদতা আশ্রয় না পেত। পরাভবের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সমূহ আমরা আমাদের নিজের ভেতর থেকেই যুগিয়েছি, এবং আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি যে, আজও তা যুগিয়েই চলেছি! বঙ্গবন্ধু আমাদের সেই আত্মকৃত পরাভবের সম্ভার থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। নবজন্মের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালীর ঐশ্বর্যের, বীর্যের নতুন উৎসারিত ফল্গুধারা গোটা বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে দিতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর কালে দিকে দিকে রাষ্ট্র সমূহের প্রশাসনিক শাসনকর্তারা, তাদের উন্মীলিত চক্ষে তাকানো জনতার ঢল বাংলার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবার সংকল্প করেছিলেন, করতে ব্রতী হয়েছিলেন, কেননা বিপুল বিক্রমে তাদের কারো কারো প্রভুত্বের ভিত্তি নড়ে উঠেছিলো। কিন্তু তা টেকেনি। কেননা টলে যাওয়া সে ভিত্তি ছিল আমাদেরই নির্বুদ্ধিতায়, স্বার্থপরতায়, হীনতায়, চিরায়ত সংকোচ ও বিহ্বলতায় রচিত। আজ অনায়াসে আমরা সেই বিপুল বিক্রমে অর্জিত চেতনালোকের বিপরীতে জগৎসমাজে নির্দ্দিধায় নির্বিকার ভাবে চলার প্রত্যয় ব্যক্ত করি! এ আমাদের সুস্পষ্ট পরাজয় এবং লজ্জ্বা। তবুও কেউ কেউ কখনো কখনো নিঃশঙ্ক-চিত্তে আমাদের সে অর্জিত চেতনাধারার সুনির্দ্দিষ্ট পথের দাবীতে তুলছি সচেতন আকাঙ্খা তাঁরই রচিত কাব্যের ছন্দের ঝঙ্কারে।
তাই আজ আমাদের জানতে হবে সেই সব উত্তুঙ্গ উত্তেজনাময় দিনের ঘটনাবলী। যখন তিনি করাচীতে এদেশের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে কিংবা একদেশ প্রশ্নে, ভাষার প্রশ্নে বৈঠক করলেন, নির্বাচনে সমগ্র দেশের জনমানুষের ম্যন্ডেট নিয়েও ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য ফিরানোর সংকল্পে অটল রইলেন, যিনি রিলিফের নিজের ভাগের কম্বলের দাবী তুললেন, যিনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে শরিক হলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি নিয়েও ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়ে সদস্যপদ নিলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতিতে থেকেও বাকশাল গঠন করলেন, যিনি আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে পদক্ষেপ নিয়েও মাদ্রাসা শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার মতো পশ্চাৎপদ শিক্ষাকে প্রশ্রয় দিলেন – এইসব বিতর্কিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের চোরাগলিতে এ মহাপুরুষকে যেন আমরা সীমাবদ্ধ করে না ফেলি। এসব সাময়িক সিদ্ধান্তে তাঁর ত্রুটি থাকতেও পারে যা তিনি নিজেই সচেতন ভাবে বার বার করে সতর্ক করেছিলেন, ভুল হলে তার শুধরানোর পথও আছে যা তিনি নিজেই বের করে আনতে জানতেন। এসব বাহ্য সিদ্ধান্তে তর্ক চলতে পারে কিন্তু তাঁর সমাগ্রীক ধ্যান ও মানসকে বাতিল করা চলে না। এই যে তাঁর অবিচলিত কর্ম নিষ্ঠা যা তাঁর সমগ্র জীবন কে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে, এই যে পরাজয়-হীন সততঃ ধাবমান সংকল্প-শকট, সবই তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। লক্ষ্যকে অবিতর্কিত ও সুস্পষ্ট রেখে সিদ্ধান্ত, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের ধারাবাহিক পরিক্রমার মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলাই অগ্রগতি। এই আত্মশক্তিই একজন মানুষের সমগ্র জীবনের, একটি জাতির প্রাগৈতিহাসিক ভিত্তিতে স্থাপিত চিরন্তন সম্পদ। নিত্য প্রয়োজনের যাপিত জীবনে নিত্য পরিবর্তনের ধারা বয়ে চলেছে। সুতরাং তাঁর এসব নিত্য প্রয়োজনকে অতিক্রম করে মহা-জীবনের যে মহিমা আজ আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হল তাকেই যেন আমরা শ্রদ্ধা করতে শিখি।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের এই বাঙ্ময়তা, আলো ও দীপ্তি আজ দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে দূর প্রান্তরেও সঞ্চারিত। আমাদের ম্লানতা-হীনতার যেটুকু আঁচড় রয়ে গেছে তটে কিংবা তটিনীর কুলে কুলে সেটুকুর অবলোপনও হবে তাঁর হাতের প্রদীপ্ত আলোয় উদ্ভাসিতের চেতনায় মঞ্জুরিত হয়ে।। তাঁর তেজদ্দীপ্ততাই রাজনীতির এক পরিণত সাধকের কীর্তি, অধিকার করে আছে মহাকালের আসন। আর তাই দারুণ অহংকারে কবি গুরু কে সবিনয়ে আর্জি জানিয়েছিলেন তাঁর মানুষ হওয়া বাঙ্গালীকে একবার দেখে যেতে।
পরিশেষে আমি আর যে কথাটি বলতে চাই তা হল, পূর্বপুরুষের পুনরাবৃত্তি করা মনুষ্য ধর্মের পরিপন্থী। অনগ্রসর প্রাণীকুল তাদের স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মের চক্রাকার-বৃত্তে নিপতিত থাকে। মানুষ নব নব আবিষ্কারে সৃষ্টি করে নতুন নতুন যুগ। নতুন চেতনা সম্ভার । পুরাতন সংস্কারকে দূরে ঠেলে দিয়ে আগামীর ভোরে বিস্ফারিত চোখে জগতটিকে নতুন করে দেখতে চায়, সুনির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ফিরে। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালীর যুগ যুগ ব্যাপী অন্ধত্ব, পরাধীনতা, মানসিক সংকীর্ণতার প্রাকার ভেঙ্গে যে দ্রোহের শিখা একদিক থেকে জাগিয়ে তুলেছেন, উত্তর প্রজন্মে আমাদের সংকল্প হোক সব দিক থেকেই সে দ্রোহকে প্রবল করে তোলা। জাতি ভেদ, ধর্ম-বিভেদ, কুসংস্কারের আবর্তে যতদিন আমরা চালিত হতে থাকবো ততদিন কার সাধ্য আমাদের চিত্ত-চেতনার মুক্তি ঘটান। ভোটের অঙ্কের চূল-চেরা বিশ্লেষণ আর তারই নিরিখে গড়ে তোলা কূট-চাল, সন্ত্রাস, সামাজিক অনিয়ম, সন্দেহ, নির্যাতন কোন জাতিকে কখনো দুর্গতির হাত থেকে মুক্তি দেয় না। যে জাতির সামাজিক জীবন-স্পন্দনের ভিত্তি নানান বাধা-বিপত্তিতে শতচ্ছিন্ন পর্যায়ে রয়ে যায়, পঞ্জিকার পাতায় পাতায় বয়ে বেড়ায় আবর্জনার স্তূপ, নির্বিচারে পুরুষানুক্রমে পাপা-স্খলনে মূঢ়চিত্তে বিশেষ ক্ষণে বিশেষ স্থানে হাজির হয়ে হাহাকার করে মরে, যারা মেধা-যুক্তি-বুদ্ধির অবমাননাকে আপ্তবাক্যের নামে হৃদয়ে পোষণ করে তারা কখনো এমন সাধনাকে আন্তরিক গভীরতায় হৃদয়ের মাঝখানে এমন ভাবে বইতে পারে না যে, সেই সাধনা অন্তরের ও বাহিরের সব ধরনের পরনির্ভরতার কিংবা দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে মনে স্বাধীন হতে পারে। কিংবা অর্জিত স্বাধীনতার বিপুল দায়িত্বভার নিয়ে সব ধরনের শত্রুর হাত থেকে বিপুল বিক্রমে তার মর্যাদা রক্ষা করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই যে, বহিঃশত্রুর সাথে লড়াইয়ে যে বীর্য-বিক্রমের দরকার নেই তার চেয়ে শতগুণ শক্তিধর সক্ষমতা চাই আপন চিত্ত-শত্রুর মোকাবেলায়, এখানেই থাকে মনুষ্যত্বের আসল পরীক্ষা। আজ যাঁকে আমরা অনুসন্ধান করবো বলে মনোনিবেশ করেছি এই পরীক্ষায় তিনি নিরঙ্কুশ ভাবে বিজয়ী ছিলেন। আজকের প্রজন্ম যদি সেই আত্ম-সংগ্রামের সাধনা তাঁর কাছ থেকে গ্রহণে ব্যর্থ হয় তবে এই আয়োজনের কানাকড়িও মূল্য নেই। আগামীর ব্যর্থতা আমাদের জন্যে সুনির্দিষ্ট হয়ে রইবে। তাই আজ আমাদের সাধনার আরম্ভ হল মাত্র, সত্যিকারের দুর্গম পথ আমাদের সামনে, যা অতিক্রম করেই আগামীর ভোরে পৌঁছুবার প্রত্যয় হোক সবার।
পুরাই ভাব গদগদ ভক্তিবাদী লেখা। এর বাইরে আর কিছুই বলার নাই।
অনেক ভালো লিখেছেন….