খুন করবো। একটি অতি প্রয়োজনীয় খুন।
এখন নুডলস রান্না করছি। রান্না শেষে ফ্রেশ হবো। ফ্রেশ হয়ে খাবো। খাওয়া শেষে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে হালকা বিশ্রাম নিবো। বিশ্রাম নিতে নিতে খুনের আগে মানসিক প্রস্তুতি সেরে নিবো। বুঝেনইতো, একটা প্রস্তুতির দরকার আছে। খুন জিনিসটা আট দশটা কাজের মত নয়। একজন মানুষকে খুন করবো, এটা হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, একনিষ্ঠতা এবং গভীর মনযোগ। বিষয়টা মানসিক। মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে খুন করা খুব কঠিন। তাছাড়া প্রতিশোধের খুন সম্পূর্ণ আলাদা। স্পেশাল।
এই ফাঁকে নিজের পরিচয় দিয়ে নিই। আমার নাম জাকারিয়া। এবিএম জাকারিয়া। আবদুল বাসিত মোহাম্মদ জাকারিয়া। বাবা রেখেছেন এই নাম। ভেবেছেন বড় নাম রাখলে ছেলে বড় লোক হবে। হয়েছি। গায়ে গতরে বেশ বড় হয়েছি। কিন্তু শরীরের ওজন দিয়েতো বড়লোক ছোটলোক মাপা হয় না, তাই কেউ নাম জিজ্ঞাসা করলে বলি জাকারিয়া। এবিএম জাকারিয়া বলি না। শুনলে লোকজন হাসবে। মালিকের চেয়ে কেয়ারটেকারের নাম বড় হওয়া উচিত নয়। আমার মালিকের নাম খান মিয়া। ছোট নাম। নাম ছোট হলেও ওজনটা খেয়াল করেছেন? তিনি খান, আবার তিনিই মিয়া। এই ভদ্রলোকের নামও তার বাবা রেখেছেন। আসলে তারা খান বংশের লোক। আমার মালিক যখন মায়ের গর্ভে, তখন গ্রামের মিয়া বাড়ির সাথে খান বাড়ির বিশাল মারামারি হয়। মারামারিতে মিয়া বাড়ির শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। মিয়াদের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি খান বাড়ির লোকজন দখল করে নেয়। শুধু সম্পত্তি দখল করে ক্ষান্ত হয়নি, মিয়াদের নামও দখল করেছে। খান বাড়ির মুরুব্বি তার সন্তানের নাম রেখে দেন খান মিয়া।
এই খান মিয়া এখন গাঁও গেরাম থেকে অনেক দূরে আছেন। ঢাকা শহরের মাঝারি সাইজের শিল্পপতি। বেশ টাকা পয়সার মালিক। প্রাসাদ সাইজের বাড়িতে থাকেন। আমি সেই বাড়ির কেয়ারটেকার কাম ড্রাইভার। গত ৫ বছর ধরে কাজ করি। খুব বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার। খান মিয়া আমাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করেন। তিনি যতই বিশ্বাস করুন না কেন, আজ তাকে খুন করবোই। গত পাঁচ বছর ধরে প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছি। আর নয়, এবার পোড়াবো।
কেয়ারটেকারের চাকরি নেয়ার চার মাসের মাথায় বিশ্বস্ততার প্রতিদান স্বরূপ মালিক আমার নাম পাল্টে দেন। বাবার শখ করে রাখা নাম হঠাৎ করে বদলে যাওয়া মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু মালিক বলে কথা। মেনে নিয়েছি। তাছাড়া নাম পাল্টানোর পর আমার মন খারাপ হয়েছে দেখে তিনি বেশ কিছু টাকা দেন। টাকার জন্য যদি সৌদি আমেরিকা এক ঘাটে জল খেতে পারে, একটি নাম মেনে নেয়া যাবে না কেন? খুশি মনে তার দেয়া নাম মেনে নিয়েছি। তিনি নাম দিয়েছেন টম। ভেবেছি টম হয়তো তার সন্তানের নাম। ছোট থাকতে মারা গিয়েছে। আমি খান মিয়ার ছেলের বয়সী, তাই ছেলে মনে করে আমার নাম টম রেখেছে। এসব ভেবে মনে মনে আরো বেশি খুশি হয়েছি। কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারি টম তার ছেলের নাম নয়। একটি কুকুরের নাম।
তো, এভাবেই আমার দিন যাচ্ছিলো। কুকুরের নামে নাম। তবুও মন খারাপ করিনি। ভাবলাম টম নিশ্চয় তার পোষা কুকুর। অনেক ভালোবাসতেন। কোন কারণে মরে গেছে। ভালোবাসার কুকুরকে মনে রাখতে প্রিয় কর্মচারীর নাম তার নামে রেখেছেন। অথচ এটাও ভুল ধারণা। টম তার কুকুরের নাম নয়। তিনি কখনো কুকুর পুষেননি। কুকুরের প্রতি তার কোন ভালোবাসা নেই।
টম ছিলো পাশের বাড়ির মিসেস আকলিমার কুকুর। বড় বজ্জাত কুকুর। সে নাকি প্রতিদিন সকালে খান মিয়ার বাড়ির গেইটে ঠ্যাং তুলে মুতে দিতো। একদিন এই দৃশ্যআমার মালিক নিজ চোখে দেখতে পান। মেজাজতো পুরো গরম হয়ে যায়। মেজাজ গরম হলেও চামড়ার উপর কামড়ে থেকে বিষয়টি মেনে নেন। কারণ মিসেস আকলিমা খুবই আকর্ষনীয় এক রমনী। ভারি সুন্দরী মহিলা। অত্যন্ত রূপসী। আজকাল নাকি এমন রূপসী দেখাই যায় না। যা হোক, এটা অনেকদিন আগের কথা। তখনো আমি চাকরিতে জয়েন করিনি। মিসেস আকলিমা এখন লন্ডনে থাকেন। তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তো, যেটা বলছিলাম, টম ছিলো হারামির হারামি। প্রতিদিন খান মিয়ার বাসার গেইটে হিসু করে, এটা একরকম নিয়মই ছিলো। কিছুদিন পর থেকে নাকি বদমাশটা গেইটের সামনে পটি করতে শুরু করে। আমার মালিকের মেজাজতো আরো খারাপ হয়। খারাপ মানে খুব খারাপ হয়। কিন্তু তিনি এবারও কিছু বলেননি। জাস্ট সহ্য করে গেলেন বিষয়টা। কারণ দিনে দিনে মিসেস আকলিমা আরো রূপসী হয়ে উঠেছেন। রূপসী প্রতিবেশীর কুকুর গেইটের সামনে পটি করলেই কী আর বমি করলেই কী। কুকুরের মালিকতো রূপসী।
তো, এভাবে মালিকের দিন কেটে যাচ্ছিলো। রূপসী, রূপসীর কুকুর, হিসু, পটি মিলিয়ে খুব জমজমাট জীবন। যা হোক, জীবনে প্রথম নুডলস রান্না করছি। এর আগে নিজে রান্না করাতো দূরে থাক, কাউকে রান্না করতেও দেখিনি। তাই বেশ গর্ব অনুভব করছি। ক্যাপসিক্যাম, কাঁচা মরিচ, টমেটো, মটরশুটি রেডি। এখন গরম পানিতে নুডলস সিদ্ধ করবো। পাক্কা দুই মিনিট সিদ্ধ করতে হবে। রেসিপিতে লেখা আছে।
আচ্ছা, টমের কথায় আসি। একদিন খান মিয়া টের পেলেন মিসেস আকলিমা বাসায় একা। গেইট খোলা পেয়ে ঢুকে গেলেন। ওমা, দরজাও খোলা। আবার ঢুকে গেলেন। সোফার উপর এলোমেলো বসে ছিলেন মিসেস আকলিমা। খান মিয়া সোজা গিয়ে হাত বাড়ালেন। খানের বাড়ানো নোংরা হাতে শক্ত দাঁতে কামড়ে ধরেন মিসেস আকলিমা। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালায় খান মিয়া। কিন্তু আঙ্গুল থেকে বিয়ের আংটিটা রয়ে যায় মিসেস আকলিমার মুখে। থুথুসহ আংটি ফেলে দেন ময়লার ঝুড়িতে। কাজের লোক সেই ময়লা ফেলে আসে বাসার পাশে সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে। সেখানে আংটিটা পায় মিসেস আকলিমার পোষা কুকুর টম। বিচক্ষণ কুকুর আংটি মুখে করে রওনা দেয় খান মিয়ার বাসার দিকে। এদিকে বিয়ের আংটি হারিয়ে খান মিয়ার গায়ে সারাক্ষণ চিকন ঘাম। বৌ টের পেলে লাত্থি মেরে ঘর থেকে বের করে দিবে।
টেনশনে আমাশয় হয়ে যায় খান মিয়ার। তলপেট চাপড়ে ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেইটের দিকে চোখ রেখে দেখেন প্রতিবেশীর কুকুর ঘুরঘুর করছে। একেবারে মোক্ষম সয়য়। আজ আর কুকুরের রক্ষা নেই। এক লাত্থিতে রাস্তার ওপাশে নিয়ে ফেলবেন। কুকুরের মালিক সুন্দরী হলেই কী আর না হলে কী। এতে খান মিয়ার কিচ্ছু যায় আসে না। খান মিয়ার গেইটের সামনে হাগামুতার ফল কত ভয়াবহ হতে পারে, একটু পরেই টের পাবে। সব ছিদ্র বন্ধ না করে খান মিয়া ছাড়বে না। হাগামুতা চিরদিনের জন্য বন্ধ। -এসব ভাবতে ভাবতে রাগে গরগর করে কাঁপতে কাঁপতে গেইট খুলে দেখেন একটি আংটি দাঁতে কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াচ্ছে মিসেস আকলিমার পোষা কুকুর টম। এটা দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সেন্সলেস। আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। হাঁটু গেঁড়ে বসে জড়িয়ে ধরে টমের নাকে চুমু খেলেন। চুমু খাওয়া শেষে নিজের দাঁতে কামড়ে টমের মুখ থেকে আংটি নিয়ে আঙ্গুলে পরে নেন। লেজ নাড়াতে নাড়াতে টম চলে যায় তার বাসায়। বৌয়ের উদ্দেশ্যে “কইগো সোনাপাখি, চলো না কোথাও ঘুরে আসি” বলতে বলতে খান মিয়া চলে যান তার বাসায়।
সেটাই। আমার মালিক অত্যন্ত মেধাবী লোক। কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভুগছে দীর্ঘদিন ধরে। জানতাম না। বিষয়টা জেনেছি মাস খানেক হলো। আসলে সে আমার সাথে অনেক প্রতারণা করেছে। অনেক। বিশ্বাস নিয়ে প্রতিনিয়ত খেলা করে গেছে। প্রতিদিন সকাল বেলা ফোন দিয়ে খুব ইমোশনাল কথা বলে। ভাবতাম সেতো খুব ভালোবাসে, তাই মনের কথা খুলে বলতে আরাম পায়। অথচ পরে জানলাম আমার সাথে কথা না বললে তার পেট পরিষ্কার হয় না। আসলে কপালটা খুব খারাপ, বুঝলেন? নইলে কেন জীবনটা এমন হলো? একটা মানুষ কমোডের উপর বসে কানে ফোন লাগিয়ে টানা এক ঘন্টার বেশি সময় কথা বলে যায়, আর আমি শুনি। একবার ভাবুন, বিষয়টা কত পৈশাচিক। কিন্তু কখনো বাবাকে এসব কথা বলিনি। বললে খুব কষ্ট পাবেন। আমি জানি।
ভাবছেন এসবের জন্য তাকে খুন করবো? না না। এগুলোতো সামান্য ব্যাপার। একদিন তাকে নিয়ে গাজীপুরের এক গ্রামে গিয়েছি। আমিই ড্রাইভ করছিলাম। হঠাৎ প্রচন্ড মুতে ধরে। রাত্রিবেলা, গ্রামের রাস্তা, দুপাশে ঝোঁপঝাড়। ডর ডর করছিলো। তাই হেড লাইট জ্বালিয়ে একটু দূরে গিয়ে সেই আলোতে মুততে গেলাম। মুতা তখনো শেষ হয়নি, শুয়োরের বাচ্চা পেছনে দাঁড়িয়ে বলে “বন্ধ কর।” অনেক কষ্টে বন্ধ করলাম। আমি কিছু বলার আগেই সে বলে তার গাড়ির উপর কেন মুতেছি। অবাক হয়ে বলি, “গাড়িতে কই, মুতলামতো ঝোঁপে।”
খবিশটা আমাকে যুক্তি শোনায়। বলে, “যে আলোতে দাঁড়িয়ে মুতলি, সেটা কিসের আলো? হেডলাইটের আলো। হেডলাইটটা কিসের? গাড়ির। তার মানে কী দাঁড়ালো? গাড়ির লাইটের আলোর উপর মুতা আর গাড়ির উপর মুতা একই কথা।”
অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে গেলাম। থামিয়ে দিলো। “আরে ব্যাটা, ওই গাড়িটা কার? আমার। তো, আমার গাড়ির উপর মুতা আর আমার গায়ের উপর মুতা যে একই কথা, এটা তোকে তোর কোন বাপে বুঝাবেরে ছোটলোকের বাচ্চা?”
দেখলেন, সে আমার বাবাকে ছোটলোক বলেছে। একজন স্কুল শিক্ষক কিভাবে ছোটলোক হয়? তাও আবার পরিমল মার্কা শিক্ষক নয়, আমার বাবা আসলেই ভালো শিক্ষক। এটা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। নিজের বাবা বলে যে মেনে নিচ্ছি না, বিষয়টা তা নয়। একজন শিক্ষককে ছোটলোক বলার পর এদেশের সব মানুষ সাথে সাথে ছোটলোক হয়ে যায়। অল্প জ্ঞানে স্পষ্ট বুঝতে পারি, ছোটলোকের ছাত্ররা আবার বড়লোক হয় কিভাবে?
আপনারা হয়তো বলবেন নিজের রান্না সবসময় সুস্বাদু মনে হয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নুডলস থেকে দারুন ঘ্রাণ বেরোচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে জিনিসটা খুব ভালো হবে। যদিও সব ভালো আসলে ভালো নয়। যেমন আমার মালিক। কতই না ভালো জানতাম, ভালো বাসতাম। অথচ, সব ছিলো ধোকাবাজির খেলা।
আজ বিকেলে বজ্জাতটা বলে তার স্বপ্ন হচ্ছে একজন হাই-প্রোফাইল গডফাদার হওয়া। নারায়াণগঞ্জের শামীম ওসমানের চেয়ে বড় গডফাদার। দিনে মিনিমাম একটি করে খুন করবে। না, খুন করে লাশ নদীতে ফেলবে না। পুঁতে ফেলবে গাজীপুরে কেনা বিশাল জমিতে। তারপর কবরের উপর গোলাপ ফুলের চারা রুইয়ে দিবে। সে গাছ বড় হবে, ফুল দিবে। এভাবে শত শত লাশের উপর হাজার হাজার ফুল ফুটবে। বাগানের চারপাশে বেড়া দিবে। গেইটে লেখা থাকবে ‘খান মিয়ার গোলাপ বাগান।’
তার স্বপ্নটা অত্যন্ত পছন্দ হয়। বলি “আপনি যদি গডফাদার হোন, আমি হবো কন্ট্রাক্ট কিলার। আপনার শখের ফুলের বাগানে কন্ট্রিবিউট করতে চাই।”
এ কথা শুনে হারামিটা বলে “এখন থেকে আমি গডফাদার। তুমি কন্ট্রাক্ট কিলার। রাতেই একটা খুন করতে হবে।” এত দ্রুত খুন খারাবি শুরু হয়ে যাবে ভাবিনি। একটু অবাক হলেও বিষয়টা খুব ভালো লাগে। বেশ উত্তেজনা হয়। বলি, “কাকে খুন করতে হবে বলুন। ফেলে দিয়ে আসি।” সে বলে, “এভাবে বলা যাবে না। তুমি এখন যাও, আমি সন্ধ্যার পর একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে টেক্সট করবো।” তারপর চলে আসি। টেক্সটের অপেক্ষা করি। দারুণ থ্রিলার, সাসপেন্স, এডভেঞ্চার। শ্লা’র জীবনে আর কী আছে! দুই চারটে খুনই যদি না করলাম, তো কী বালের জীবন?
সন্ধ্যার একটু পর অপরিচিত নাম্বার থেকে টেক্সট পাই “গুলশান নর্থ এভিনিউ, ক্যামেরা মিউজিয়াম, পান দোকান। কোড – ৫৫-২৫০এমএম।” সেখানে গেলাম, কোড বললাম। একটা শপিং ব্যাগ দিলো পান দোকানদার। ব্যাগের ভেতর চিরকুট খুলে দেখি কোন এক গাড়ির নম্বর লেখা আছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে এই নম্বরের প্রাইভেট কার পেয়ে যাই। গাড়িতে উঠার পর আবার মেসেজ আসে ফোনে। “ফ্রন্ট বক্স চেক করো।” চেক করে পাই একটা হোল্ডিং নম্বর। গুলশান এলাকারই বাড়ি। গেলাম সেখানে। দরজায় তালা। দরজার সামনে একটু পাশে ফুলের টব। টবের মাঝে চাবি। তালা খুলে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতে গিয়ে দেখি দরজার পেছনে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো কাগজের টুকরায় লেখা আছে “বেডরুম। ওয়ার্ডরোব। থার্ড ড্রয়ার। মিনি ড্রয়ার।” মিনি ড্রয়ার খুলে একটি নাইন এমএম (সম্ভবত) এবং আরেকটি চিরকুট। চিরকুটে যে ঠিকানা লেখা আছে, সেটা আমার বাসার পাশেই। রওনা দিই।
ওই ঠিকানায় গিয়ে পাক্কা দুই ঘন্টা বসে থাকার পর মেসেজ আসে “ফ্রন্ট বক্স চক করো।” চেক করে ছোট্ট একটি প্যাকেট পাই। প্যাকেটের ভেতর আরেক প্যাকেট। তারপর আরেকটি। শেষে পেলাম এক প্যাকেট ম্যাগি নুডলস। হাতে নিয়ে জাস্ট নুডলসের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাগে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। সইতে পারছিলাম না। বিশ্বাস করুন, বিষয়টা একেবারেই ভালো লাগেনি। কাঁপুনি আরো বাড়িয়ে দিয়ে ফোনের ভাইব্রেটর গোঁৎ গোঁৎ করে উঠে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে, “হাতের খেলনা মেশিনটা ফেলে দিয়ে বাসায় গিয়ে নুডলস রান্না করে খাও। মিয়া বাড়ির পোলাপানের কপাল এর চেয়ে ভালো হয় না।”
এতক্ষণ ধরে সেই নুডলস রান্না করেছি। একটু পর খাবো। তার আগে ফ্রেশ হবো। কিন্তু আমিতো মিয়া বাড়ির পোলা নই! আমাদের এরকম কোন বিশেষ বংশীয় টাইটেল নেই। তাহলে সে কেন আমাকে মিয়া বাড়ির পোলাপান বলেছে? অনেক ভেবে বিষয়টা বুঝতে পারলাম। শুয়োরের বাচ্চা চাকুরির বিজ্ঞাপনে লিখে দিয়েছিলো সিভিতে যেন চার পুরুষের নাম থাকে। তো, আমার এবং বাবার নামের সাথে মিয়া নেই। কিন্তু দাদার নামের সাথে মিয়া আছে। সোনা মিয়া। আবার দাদার বাবার নামের সাথেও মিয়া নেই। শুধুমাত্র দাদার নামের সাথে মিয়া থাকার কারণে মালিকের হাতে এভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে। এর প্রতিশোধ আমি নিবোই। তাকে খুন করবো। খুন করে তার গাজীপুরের জমিতে পুঁতে দিবো। কবরের উপর চারটি গোলাপের চারা লাগাবো। বিশাল জমির মধ্যিখানে চারটি গোলাপ গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। ফুল ধরবে। বাতাসে দুলবে।
বদমাশের পূর্বপুরুষরা মিয়া বাড়ির সম্পত্তি, নাম দখল করার পরও খায়েশ মিটেনি। এখনও মিয়াদের প্রতি তার অত্যাচারের শেষ নেই। আই হ্যাভ টু স্টপ ইট। ফুল স্টপ। যেহেতু দাদার নামের সাথে মিয়া আছে, সেহেতু মিয়া বংশের গৌরব উদ্ধার করা আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এই গৌরব উদ্ধার করবোই করবো।
কিন্তু খুন করার আগে অবশ্যই খান মিয়ার অনুমতি নিবো। আমার মতে অনুমতি ছাড়া কাউকে খুন করা উচিত নয়। আমি আমার বন্ধুদের মত নই। একদিন পাঁচ বন্ধু গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছি। তখন একটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। খুব সুন্দর মেয়ে। আমার বন্ধু সাফাত মেয়েটির পা পছন্দ করে। তারপর পা দু’টি নিয়ে সাফাত বাসায় চলে যায়। আরেক বন্ধু নাঈম পছন্দ করে মেয়েটির নিতম্ব। সেও নিতম্ব নিয়ে বাসায় চলে যায়। বাকি দুই বন্ধুর একজন নেয় পেট, আরেকজন বুক। অথচ মেয়েটির অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি। চোখের সামনে একটি মেয়ে লুটপাট হয়ে গেলো, ঠেকাতে পারিনি। আমার অবশ্য মেয়েটির কপালের টিপ খুব পছন্দ হয়। কিন্তু নিইনি। নিতে পারিনি। কারণ, টিপ চেয়ে নেয়ার সুযোগ হয়নি। বন্ধুদের লুটপাট দেখে ভয় পেয়ে আর চাইনি। শেষে শুধু কপালের টিপ নিয়ে মেয়েটি ঘরে ফিরে যায়।
এসব আমার পছন্দ না। একদমই না। এভাবে কিভাবে সম্ভব? একজনের কাছ থেকে একটা জিনিস নিবো, অথচ তার অনুমতির তোয়াক্কা করবো না, এটা কেমন কথা! সেটাই বলছি আরকি। খান মিয়ার জান নিবো, কিন্তু অনুমতি নিয়েই নিবো। জানি, এত সহজে রাজি হবে না। রাজি করিয়ে নিবো। তাকে বলবো মিয়া বংশের পক্ষে আমি আব্দুল বাসিত মোহাম্মদ জাকারিয়া, খানকে খুন করতে এসেছি। যেহেতু খান একজন বৃদ্ধ আর জাকারিয়া একজন জওয়ান, সেহেতু খানের পরাজয় অনিবার্য। অনিবার্য পরাজয় বিনা লড়াইয়ে মেনে নেয়া উচিত। আর খান বংশের লোক এই উচিত কাজ করতে বুক কাঁপার কথা নয়। ব্যস, সে খুন হতে রাজি হয়ে যাবে।
খুব এক্সাইটেড, বুঝতে পারছেন? মানে, জীবনে প্রথম রান্না করেছিতো, এটা বিশাল একটা লাইফ ইভেন্ট। ফেসবুকে এড করে নিবো। ওকে, তাহলে নুডলসটা খেয়ে দেখি। স্বাদ খারাপ হলে কিন্তু সততার সাথে স্বীকার করবো। আমার বাবা বলেছেন, “শোন বাছা, কখনো মিছে গৌরব করো না।” বাবা শিক্ষক মানুষ। তার কথা মেনে চলি। এটা আমার অভ্যাস। যা হোক, বাবার নামে নুডলস মুখে দিলাম…।
উফ! জাস্ট ইয়াম্মি হয়েছে বস, ইয়াম্মি! কী বলবো আমি! মায়ের দোয়া ছাড়া এটা সম্ভব ছিলো না। সব কৃতিত্ব তার। বিশ্বাস করুন, খুশিতে এখন নৃত্য করছি। এবার বিয়েটা করেই ফেলবো। সত্যি। বাসর রাতে বৌকে নুডলস রান্না করে খাওয়াবো। আজ থেকে এটা আমার এইম ইন লাইফ। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আরে ভাই, রেসিপি দেখে রান্না করেছি ঠিক আছে, কিন্তু প্রথমবার একটু এদিক সেদিক হতেই পারতো। হয়নি। কারণ রান্নাটা আমি করেছি। কারণ আমার মায়ের রান্নার হাত দারুন। কারণ মা যে হাত দিয়ে রান্না করেন, আমার মাথায় সে হাত বুলিয়ে দোয়া করেন। সেই দোয়ার বরকতে এমন অসাম টাইপ রান্না হয়েছে। যদিও নিন্দুকেরা বলবে খিদের পেটে চিরতাও মধু মনে হয়, কিন্তু এটা মানবো না। সন্ধ্যার পর থেকে অনেক ধকল গিয়েছে, কুত্তার মত খিদেও পেয়েছে। কিন্তু বস, সামান্য খিদে দিয়ে আমার পারফরম্যান্স ঢাকার সুযোগ দিচ্ছি না। এই নুডলস আমি রান্না করেছি, আমি খেয়ে দেখেছি, অনেক স্বাদ হয়েছে। এই কথার বাইরে একচুলও নড়ছি না। এখন সব নুডলস খাবো, সব। একটুও রাখবো না।
ইস্, জীবনটা যদি নিজের রান্না করা নুডলসের মত হতো! এমন সুস্বাদু। আহা! জিহ্বায় লেগে আছে। বলুন, জিভের ডগায় এমন স্বাদ নিয়ে কিভাবে খুন করতে যাই? খুন করার পর নুডলসের স্বাদ থাকবে না। খুনের স্বাদ লেগে যাবে। খুনের স্বাদ কেমন হয়, জানি না। কখনো খুন করিনি। কিন্তু খুন যে নিজের রান্না করা নুডলসের চেয়ে বেশি স্বাদের হবে না, তা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি। যাক গা। খান মিয়া গোল্লায় যাক গা। বুড়ো এমনিতেই ক’দিন পর মরে যাবে। তাছাড়া মনের মধ্যে এত ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকা সুখের বিষয় নয়। বরং যন্ত্রনার, কষ্টের। খান মিয়া এই কষ্টের জীবন আরো কিছুদিন ভোগ করুক। অথবা না করুক। তার জীবন, তার যন্ত্রনা। আমার কী! আমার শুধু অপেক্ষা। কখন ভোর হবে, কখন বাসার পাশের সুপার শপ খুলবে, কখন নুডলস কিনবো, কখন রান্না করবো, কখন খাবো!
নো প্রতিশোধ, নো রিভেঞ্জ। আজ রাতে খান মিয়ার বাড়িতে কোন খুন হবে না। প্রতিশোধ হবে না। রিভেঞ্জ ইজ নট সুইটার দ্যান সেলফ কুকড নুডলস।
অসাধারণ ! আমি লাস্ট মুহূর্ত পর্যন্ত ধরেই নিয়েছিলাম এটি কোনো থ্রিলার গল্প হবে হয়তো খান সাহেবেকে খুন করে ফেলবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো শেষটা এমন না শেষটার জন্য একটি স্বস্তি পেলাম।
একটা খুন না হওয়ায় বিষণ্ণ অনুভব করছি, এটা কি ঠিক?
বিলকিস না আকলিমা?
আকলিমা হবে ভাই। খুন খারাবির তাপে কখন বিলকিস হয়ে গেছে টের পাইনি।
গল্প সুস্বাদু হয়েছে। স্বভাবসিদ্ধ রাজনৈতিক আর সোনার ছেলেদের প্রতি কটাক্ষ টা ভাল ছিল। খুন করে ফেললে শেষের মজাটা পেতাম না।
ধন্যবাদ, অদিতি।
সুস্বাগত
গল্পে অনেক মিনিং আছে হয়তো। তবে আমি ফেসবুকের ইস্যুগুলোর সাথে মিল পেয়েছি। গল্পের ঘটনার মতোই প্রতিমুহুর্তে ইস্যু চেঞ্জ হচ্ছে, রক্ত গরম হচ্ছে। একটা কিছু করবোই। কিন্তু তারপর কিছুই না করে নুডলসের মতো আমরাও নিজেদের খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ইস্যুগুলো মরে যায়, আমরা নুডলস খাই, চেকিন দিই, সবভুলে থাকার চেষ্টা করি।
এই মিনিংটা খারাপ না, ভালোই।