বগা শিকারীর কিচ্ছা শেষ করে, আইয়ুব উঠে পড়ে। আসর ভেঙ্গে যায়। আইয়ুব বাড়ীর দিকে পা না বাড়িয়ে, পা বাড়ায় বিলের দিকে। বিলে এখন আর বক আসে না। অন্ধকারে হারিয়ে যায় আইয়ুব।
মাছগুলো মরে ভেসে থাকল। গ্রামে রটে গেল, আল্লার গজব। মানুষ-জন ভয় পেতে শুরু করে দিল। দুই চালা খড়ের ঘর, বেড়া প্রায় নেই; এমন একটা ঘরকে মসজিদ বানিয়ে , যিনি ইমাম হয়েছিলেন, ঘোষণা করে দিলেন, পাপ। নামাজ রোজা নাই, আল্লার গজব পড়ব না তো কি রহমত নাজিল অইব? পাপে সব ছারখার অইয়্যা যাইব।
কারও নামোল্লেখ না করে এই ঘোষণা দিলে, তাতে কাজ হয়। মাছের মৃত্যুতে মুহ্যমান মানুষেরা এই মুহুর্তে সব রকম সংঘাত থেকে দূরে থেকে, নিজেদেরকে অহিংস প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে যায়।
বাঁচার জন্য মসজিদে আনাগোনা বেড়ে গেল। অভিযোগ করার জন্য এর চেয়ে উত্তম আশ্রয় তাদের জানা নেই, এবং তারা খুব নিরীহ ভঙ্গিতেই প্রার্থনার ফাঁকে ফাঁকে আকাশে দুই হাত উত্তোলন করে , অভিযোগ করে; তাদের বাঁচাবার কেউ নেই। মাছগুলোকেও বাঁচাবার কেউ নেই। মাছগুলো মরে গেলে, মানুষেরা কেমন করে বাঁচবে; এই বিচারের ভার আল্লার উপর ছেড়ে দিয়ে তারা স্বস্তি পায়। তাদের বিশ্বাস, অচিরে খাল, বিল ও ধান ক্ষেত আবার মাছে মাছে ভরে যাবে। কেউ কেউ মনে মনে সিন্নি মানৎ করে। ইমাম সাব খুশি হন। ইমান আমান ফিরে আসায় তার মনে হয়, মাছের মড়ক থেকে গ্রামবাসী অচিরে রক্ষা পাবে।
উজান থেকে মাছের ঝাঁক নেমে না এলেও, গ্রামে এনজিওরা এগিয়ে এসেছিল অনেক আগেই। তাদের তৎপরতা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী। মানুষকে বাঁচাবার মন্ত্র নিয়েই তারা মাঠে নেমেছে। বীজ, সার, কীট নাশক; কী নেই তাদের তালিকায়? আপাতত ঋণ শোধ করতে হবে না। ধান গোলায় উঠার পর দিয়ে দিলেই হবে। মহাজনের চেয়ে অনেক ভাল।
নামাজের পর ইমাম সাব জানালেন, তার নব আবিস্কারের কথা। মাছ মরে গেলেও, এই এনজিওরা এসেছে সার কীট-নাশক নিয়ে, এ-ও আল্লার রহমত। আল্লা এক দিক দিয়ে নিয়ে গেলেও, আরেক দিক দিয়ে দেয়। কথায় বলে, মুখ দিয়াছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি।
এত অল্পতে, এই বিপুল অর্জন, মানুষ ভাবে; আল্লার কুদরতের আর কোন শেষ নেই। কি সীমাহীন তার দয়া! মাছগুলো সব মরে গেলেও; শেষ পর্যন্ত দয়ালু হিসাবে আল্লার এই যে অবস্থান, তা ইমাম সাবের নিরলস ইবাদত-বন্দেগির ফসল। ইমাম সাবের প্রতি ভক্তিতে সবাই নতজানু হয়ে পড়ে। সালাম দিতে গিয়েও তাদের হাত কেঁপে উঠে।
ছারখার হয়ে যাবার ভয়ে মানুষ গান বাজনা শোনা বন্ধ করে দিল। শীতের মৌসুমে গানের দল বেঁধেছিল আইয়ুব। গান শোনার জন্য কোন পয়সা দিতে হয় না। লোকজন গান শুনলেই সে খুশি হয়ে যেত। একা একা গান শুনে আরাম নেই। তাই লোকজন নিয়ে, দল বেঁধে গান শোনা। খালেক মুন্সির ছেলে, জামালের গলাটা খুব ভাল । বাবা-র ভয়ে প্রকাশ্যে গাইতে পারত না । লুকিয়ে গাইত। একবার ধরা পড়ে গেল। খালেক মুন্সি তাকে চিল্লায় পাঠাল, চল্লিশ দিনের খোরাকি দিয়ে। বাবা-র দেয়া টাকা নিয়ে উঠেছিল পাশের গ্রামের এক বন্ধুর বাড়ী। সেখান থেকেই গানের দলের জন্য সমুদয় অর্থ ব্যয় করে দিয়েছিল। লোকজন কানাঘুঁষো করে, কিন্তু বলতে সাহস করে না, রামদা আর সেনদা’র ভয়ে। প্রায় তিন হাত লম্বা দা’এর কোপ ঘাড়ে পড়লে একেবারে, এক দৌড়ে আল্লার দরগায় হাজির।
প্রেম করে, প্রেমিক অথবা প্রেমিকা চায় মিলিত হতে। ব্যতিক্রম শুধু আল্লা প্রেমের বেলায়। আল্লা প্রেমে মশগুল বান্দারা কিন্তু মরতে চায় না, জানে; মরে গেলেই আল্লার কাছে চলে যাবে, তবুও এই অনিহা যে কেন হয়, কেউ বলতে চায় না। পাছে ইমান-আমান নিয়ে লোকজন সন্দেহ করে বসে, এই ভয়ে। আইয়ুব মাঝে মধ্যে খুব মারফতি কথা বলে। একবার রোজার দিনে, প্রকাশ্যে ধূমপান করছিল। প্রকাশ্যে অনেকে খেত না লোক-লজ্জার ভয়ে। আবার খেউ খেলে, এ নিয়েও কেউ কিছু বলত না। রেজু-র বাপ, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করে, একটা ষ্টেনগান নিয়ে ফিরে এসেছিল । ষ্টেনগান জমা দিয়ে দিলেও তার একটা প্রভাব ছিল। লোকজন তাকে ভয় বা সমীহ করত। কার বাপের সাধ্যি আইয়ুবকে জিজ্ঞেস করে, রোজা রাহস নাই? কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারদের পাচক রেজুর বাপ বলে ফেলেছিল, রোজা রাহস না, বালা কতা, কিন্তু তাই বইল্যা রাস্তায় বইয়া বিড়ি খাইতে অইব?
আমি বিড়ি খাই না, বাতাস খাই, ধোয়া খাই।
এরই মধ্যে খবর এল, ধলি বিলের উত্তর পাড়ে, অনেক পাখী মরে পড়ে আছে। এই মৃত্যুর জন্য আইয়ুবকে দায়ী করা যেত। কেননা সে প্রকাশ্যে ধূমপান করেছে। আর ঠিক এ কারণে সম্ভবতঃ আল্লা রেগে গিয়ে, পাখীগুলোকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু কেউ আইয়ুবের দিকে আঙ্গুল তুলতে সাহস পাচ্ছিল না ।
এই তো কয়েক দিন আগে, দক্ষিণ পাড়ার কার সাথে যেন তার কথা কাটাকাটি হয়েছিল । আর তাতেই গ্রামের লোকজন দেখল,তার ডান কাঁধে রামদা আর বাম কাঁধে সেনদা। আসন্ন লড়াইয়ের উত্তেজনায় মানুষজনের ঘুম চলে গিয়েছিল। আইয়ুবের রণ-মূর্তি দেখবে বলে, অনেকে অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছিল। তার জন্য, ঐ মুহুর্তে গ্রামে অদ্ভুত এক ঐক্য গড়ে উঠেছিল । প্রায় সবাই তার জন্য দোয়া-দরুদ পড়েছিল, যেন যুদ্ধে তার জয় হয়। পুরো গ্রামটাই তার পেছনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আইয়ুব একা একাই একশ’ হয়ে মহড়া দিয়েছিল।। তার মহড়ায় মানুষ মুগ্ধ, এতটাই মুগ্ধ, তারা বেড়াহীন মসজিদে যেতে ভুলে গিয়েছিল।
রেজুর বাপের সাথে, মহরমের মাসে লড়াই এখনও মানুষ ভুলে যায়নি। দুই সিংহ যেন। লাঠি ছেড়ে রামদা নিয়ে যখন দুই জন মুখোমুখি, চারদিকে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস সেদিন কেউ মরেনি।
তো প্রকাশ্যের ধূমপান করার জন্য, এই যে পাখীগুলো মরে গেল, তার জন্যও তাকে দায়ী করা গেল না। ইমাম সাবও সেদিকে পা না বাড়িয়ে, বাড়ালেন সাধারণ মানুষের ইমাম আকিদার দিকে। তারা কতটা ইমানদার, এই নিয়ে একাই একাই নামাজ শেষে অনেকক্ষণ বকে গেলেন। সবাই অপরাধীর মত শুনে গেল। কেউ কেউ আবার ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল। এরই মধ্যে যারা কেঁচো দিয়ে মাছ ধরতো, তারা যেন হঠাৎ করেই জানল, কেঁচোগুলো উধাও। কিন্তু কেঁচোর এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় কেউ কোন মন্তব্য করল না। কেউ একজন কথায় কথায় প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে, ইমাম সাব বলে দিয়েছিল, কেঁচোর মত একটা প্রাণী নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার কিছু নেই। আর হায়াত মওত তো মানুষের হাতে নয়; আল্লার হাতে। কে কখন কোথায় মরবে, সব যখন আল্লার হাতে , তখন তার লীলা নিয়ে প্রশ্ন করার মানে একটাই – পাপ।
কীটনাশক আর সারের ব্যবসা বেড়ে গেল। বাড়তে বাড়তে মাটি মরে গিয়ে, নদীর প্রাণ মরে গিয়ে, খাল-বিলের জল-পানি মরে গেলেও, বেঁচে থাকল মানুষ। সবই তার কুদরত বলে ইমাম সাব রায় দিয়ে দেন এবং এ নিয়ে প্রশ্ন করে পাপ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিতেও ভুল হলো না।
গানের দল বন্ধ। একটা নাটকের মহড়া চলছিল, তাও বন্ধ। ইমাম সাব নামাজ শেষে ষ্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, গ্রামে অনাচার হলে, আল্লার গজব ঠেকানো তার পক্ষে সম্ভব হবে না। আগে অনাচার বন্ধ করতে হবে। আল্লা যা চায় না, তা করা যাবে না। আল্লার বিরুদ্ধে গেলেই গজব নেমে আসবে। তার পরপরই তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন, ইউরোপ আমেরিকায় মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছে। এমন কি নীল আর্মষ্ট্রং চাঁদে গিয়ে, আজান শুনে; পৃথিবীতে ফিরে এসে; মুসলমান হয়ে গেছে। তাদের উন্নতি হবে না তো কি আপনাদের উন্নতি হবে? আপনারা সারা রাত জেগে গান বাজনা করবেন, আর আপনাগো উপর আল্লার রহমত নাজিল অইব? অইব না। চাইরদিকে যা দেখতাছেন, তা কেবল শুরু। এর শেষ কোথায়, এক মাত্রই আল্লাই জানে?
আইয়ুবকে খুন করা দরকার । কারও কারও এরকম মনে হলেও, কেউ তার সামনে দাঁড়াতে সাহস করে না। জামাল চলে গেছে ভিন গাঁয়ে ।
ঘোর বর্ষা । কিন্তু মাছের দেখা নেই। উজান থেকে পানি আসে, মাছ আসে না। শুধু ভাতে যে পেট ভরে না, তা যেন এই প্রথম জানল গ্রামবাসী। কিন্তু এখন তাদের আর কিছু করার নেই।
তারা অপেক্ষা করছে, আল্লার ডাইরেক্ট হস্তক্ষেপের জন্য। আর সেই জন্য আগামী শুক্রবার মাছের জন্য আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ মোনাজাতের । এই ঘোষণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আগেই, গ্রামে প্রচার হয়ে গেল, এনজিওর পক্ষ থেকে পুকুরে মাছ চাষ করার জন্য ঋণ দেয়া হবে।
আরও খবর এল, আইয়ুব তার বউকে পাঠাতে চেয়েছিল তার বাপের বাড়ী, ধান আনার জন্য। বউ রাজী হয়নি। সারাদিন চুপচাপ থাকলেও, সন্ধ্যার পর, বউকে নিয়ে পশ্চিমে রওনা দিলে, তা রেজুর বাপের চোখে পড়ে যায়। আর সে কারণে বেঁচে যায় তার বউ।
আইয়ুবের রামদা, কুদাল আর গামছা এখন মুক্তিযোদ্ধা রেজুর বাপের দখলে।
ভালো লিখেছেন । এইধরনের লেখা আরও দেওয়া উচিত। যান্ত্রিকতার জীবনে একটু অন্য কিছু পেলে ভালো লাগে
অায়ুব চাচা অামাদের প্রতিবেশি ছিল। অামরা তখন ছোট । রোজার দিন যদি অায়ুব চাচাকে জিজ্ঞেস করতাম চাচা তুমি রোজা রাখ অথচ সারাদিন বি়ড়ি টান, জবাবে বলতো তোর চাচী ভাত দেয় না, আর বিড়ি খাইলে রোজা ভাংগে কেডা কইছে, এইযে নাক মুখ দেয়া বাতাস পেড নিতাছস ছারতাছস এইসম রোজা ভাংগে না?
যতক্ষণ না শিক্ষার ও চিন্তা শক্তির উন্নতি ঘটবে, ততদিন ইমাম-মোল্লাদের যুগের অবসান ঘটবে না। স্বপন মাঝি ভাইকে ধন্যবাদ। ঘড়ির কাঁটাকে আর একটু ঘুরিয়ে দিন, সূর্যের আলোটা সোজা সুজি প্রুক।
উৎসাহিত করার জন্য ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা।
আলি আসমান ভাই , আপনার সাথে আমি একমত ।কিন্তু প্রশ্ন হল কিভাবে তা সম্ভব ? আমরা তো অজ্ঞাতা চক্রে ঘুরছি ।
অসাধারণ….
অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকুন, আনন্দে থাকুন ।
স্বপন দাদা, লাল সালু অনেকদিন আগেই পড়েছি । সেই কতদিন আগের সমাজ এখন বিবর্তিত হয়ে গেছে ।তবুও ধর্ম ধারীরা আরও আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠছে দিন দিন । আপনার লেখাটি দারুণ ভাবে নাড়া দিল ।তবে আইয়ুবের পরবর্তী অবস্থা জানতে ইচ্ছা করছে খুব ।
আগে ছিল পীর, মাজার কেন্দ্রিক ব্যবসা । সেগুলোর উপর এখন হামলা চলছে। বেড়ে গেছে মসজিদ-মাদ্রাসা কেন্দ্রিক বাণিজ্য। আপনার ভাল লেগেছে জেনে, অনুপ্রাবণিত। আইয়ুবেরা হেরে যাচ্ছে, সামনে কী হবে এখনও বলা যাচ্ছে না।