আধুনিক বিজ্ঞানে বস্তুর গতির রহস্য বুঝতে গেলেই বলের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। আর দু এক ধাপ এগোলে আবার শক্তির কথাও উঠে যায়। সেই আলোচনা আজকালকার ছাত্ররা স্কুল পর্যায়েই এত সহজে শিখে ফেলে যে তাদের কখনও একবারও মনেই হয় না, এর মধ্যে কোনো রকম জটিলতা আছে বা এক কালে ছিল। কিন্তু আজ থেকে মাত্র দু চার হাজার বছর আগেকার কথা স্মরণ করুন। সেই ইতিহাসের গুহায় ঢুকলে দেখতে পাবেন, তখন অবধি মানুষ জানতই না, বস্তু যে চলে তা কিসের জোরে। তার নিয়ম কী, তার ভিত্তি কী। বল ও শক্তি — এই দুটো ধারণাই যে আদিম মানুষের ম্যাজিক সংস্কৃতির আঁতুরঘরে জন্ম নিয়েছিল তা অনেক সময়ই আমাদের খেয়াল থাকে না। বিশেষ করে, শক্তির ধারণা নানা রকম ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও বোধের মধ্যে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আজ অবধিও। একেবারে বিশ শতকে পা দিয়ে চিন্তার জগতে এই সমস্ত আদিম ধর্মীয় এবং/অথবা জাদু-বিশ্বাসের প্রভাব ও প্রকোপ থেকে ধীরে ধীরে মানুষ বিজ্ঞানের ধারণাগুলিকে মুক্ত করে নিতে পেরেছে।

অথচ, চারদিকে চোখ-কান পাতলেই দেখা এবং শোনা যাবে, যারা একদিন বিজ্ঞানে এই আদিম ধারণাগুলিকে দান করেছিল, বিজ্ঞান এগুলিকে পরিশুদ্ধ করে নেবার পর তাদেরই একালের উত্তরপুরুষদের একদল আজ আবার এগুলো ফেরত নিতে চাইছে। তারা এও দাবি জানাচ্ছে, বিজ্ঞান থেকেই তারা নাকি এদের পেতে পারে।
সেই দাবির যাথার্থ্য বিচারই আপাতত এই নিবন্ধের আলোচ্য।

[১] বল ও শক্তি

বল এবং শক্তি আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের দুটি অত্যন্ত পরিচিত এবং প্রয়োজনীয় সংজ্ঞা। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বলবিদ্যার ক্ষেত্রে এদের বাদ দিয়ে কোনো আলোচনা এমনকি শুরু পর্যন্ত করা যায় না। ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখলে জানা যায়, অনেক প্রাচীন কাল থেকেই এদের নিয়ে মানুষকে মাথা ঘামাতে হয়েছে। যদিও আদিতে এই দুটি ভৌত ধারণা বা সংজ্ঞার মধ্যে খুব সুনির্দিষ্টভাবে পার্থক্য করা যায়নি বা করা সম্ভব হয়নি বলেই মনে হয়। অথচ আজ থেকে অন্তত আট-দশ হাজার বছর আগে, নবপলীয় যুগের সূচনাকাল থেকেই, মানুষ শুধু যে গতিশীল বস্তুকে অবলোকন করে আসছে তা-ই নয়, নিজেরাও কিছু না কিছু বস্তুকে সচল করে তুলে নানা রকম কাজ হাসিল করে যাচ্ছে। কুকুর দিয়ে স্লেজ গাড়ি চালাচ্ছে। গরু মোষ গাধা উট খচ্চর হাতি এবং ঘোড়াকে দিয়ে মাল পরিবহন করাচ্ছে, আবার চাকাওয়ালা গাড়িও চালাচ্ছে। নদীতে বা সমুদ্রে নৌকা বাইছে।

স্বভাবতই, একটা জিনিস সেই কালের মানুষরাও লক্ষ না করে পারেনি। কোনো কিছুকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যেতে হলে তাকে ঠেলতে হয়। ধাক্কা দিতে হয়। টানাটানি করতে হয়। হাল্কা জিনিস হলে কম ঠেলায় কাজ হয়। ভারি বস্তুকে সরাতে গেলে অনেক বেশি জোরে ঠেলা ধাক্কা দিতে হয়। গরু বা মোষ যত পরিমাণ মাল বহন করতে পারে, কুকুর তা পারে না। ইত্যাদি। এর থেকেই তারা সেই আদ্যিকালে বলের ধারণা করেছিল। বল এবং শক্তি প্রয়োগ — একই অর্থে তারা ভেবেছিল এবং কাজে প্রয়োগ করেছিল। কাজের সামর্থ্য, কব্জির জোর, জিনিস বইবার ক্ষমতা, পেশীর ক্ষমতা — সব কিছুরই একই মানে। যা দিয়ে কোনো কিছুর উপর জোর খাটানো যায়, যে কোনো ভারি জিনিসকে নড়ানো যায়, নাড়ানো যায়, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো যায় — তাই হচ্ছে বল কিংবা শক্তি।

সেকালে মানুষ সহজে নিজের আচরণের সাথে প্রকৃতির খুব একটা পার্থক্য করতে পারত না। হাতি শুঁড় দিয়ে মোটা মোটা গাছের ডাল ভেঙে দিচ্ছে। কী জোর, বাপ রে! আমার থেকে ও অনেক শক্তিশালী! পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ছে, সামনে যা কিছু পড়ছে ভেঙে-চুরে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এরও বল আছে, এও শক্তি প্রয়োগ করছে। সেই ভারি পাথরটিও একটা শক্তির আধার। কিংবা যে পাহাড় তাকে নামিয়ে দিয়েছে সেও এক বিশাল শক্তির অধিষ্ঠাতৃ পুরুষ। কালক্রমে সেই হাতি, সেই পাহাড় হয়ে উঠল এক একজন দেবতা। তাদের যে শক্তি তা অদৃশ্য দৈব শক্তি। শক্তিটা দেখা যায় না। মানুষের শক্তি দেখা যায় না, হাতির শক্তিও দেখা যায় না, পাহাড়ের শক্তিও দেখা যায় না। কিন্তু শক্তির প্রকাশ সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে। যার বা যাদের ক্ষেত্রে শক্তির এই প্রকাশ মানুষের চাইতে অনেক বেশি বলে দেখা যাচ্ছে তারাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠল দেবতা। তাদের শক্তি মানেই দৈব ব্যাপার।

তাহলে এই দৈব ব্যাপারের মধ্যে দুটো উপাদান আছে। অদৃশ্য এবং অধিক শক্তির প্রকাশ।

না, ভুল হল।

আরও একটা ঘটনা এর মধ্যে ছিল। এবং সেটাই আসল ব্যাপার। এই শক্তির ক্রিয়া বা প্রকাশ আচমকা ঘটছে। আকস্মিকভাবে। কখন ঘটবে আগে থেকে কেউ বুঝতে পারে না। কুকুর বা বেড়াল যে দুনিয়ার কোথাও ভালো করে দেবতা হতে পারল না, কিন্তু তার থেকে অনেক দুর্বল অনেক নিরীহ প্রাণী হয়েও সাপ বহু দেশেই মানুষের দেবতা হয়ে বসল, তার কারণ এই আকস্মিকতা। অভাবিত আবির্ভাব। সাপের ক্ষেত্রে আরও একটা মজার ঘটনা ঘটে গেল। সে আবার এল মাথায় এক মণি নিয়ে। যা কুকুরের নেই। বেড়ালের নেই। বেশিরভাগ দেবতা যারা হল তাদের নেই। যে সময়কার কথা হচ্ছে, যখন এই সব দেবতাদের জন্ম এবং প্রোমোশন হচ্ছে, তখন মানুষের হাতে নিজস্ব আলোর উৎস নেই বললেই চলে। দিনে সূর্য আর রাতে মাঝে মাঝে চাঁদ। চাঁদ না থাকলে রাতে একেবারে নিকষ কালো অন্ধকার। একটু হয়ত তারাদের বিচ্ছুরিত আলো। সেই আলোয় সাপের মাথায় আঁশের উপরে হাল্কা প্রতিফলনের ফলে চকচক করে ওঠে। বক্রতল বলে সবটা থেকে নয়, একটা মধ্যবর্তী কোনো ছোট জায়গা থেকে। বিশেষ করে সে যদি ফণা তোলা সাপ হয় — গোখরো, কেউটে, শঙ্খচূড়, প্রমুখ — তাহলে ঠিক তার মাথার মাঝখান থেকে চকচকে আলোটা দেখা যাবে। সুতরাং মণি তো বটেই। সবাই সেটা দেখতে পায়। আর তাদের কী ক্ষমতা। একটা ছোবল দিল, যাকে দিল প্রায়শই তার ভবলীলা সাঙ্গ। অতএব সেও দেবতা হয়ে গেল। ওই অদৃশ্য শক্তি আর তার আকস্মিক প্রকাশের ফলে।

সাধে কি আর আমরা আজও আকস্মিক বোঝাতে গিয়ে দৈবাৎ কথাটা ব্যবহার করি?

এখানে আর একটা জিনিসও মাথায় রাখতে হবে। বলের প্রকাশ যেখানে আকস্মিকভাবে ঘটছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেখানে মানুষের বিপদ ঘটছে, ক্ষতি হচ্ছে কিছু না কিছু। মানুষ নিজে যেখানে পশুর বল ব্যবহার করছে, সেখানে সচরাচর এই সমস্যা নেই। সেখানে তা তার কাজেই লেগে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতি হোক আর কোনো বন্য প্রাণী হোক, উপরে বর্ণিত যে কোনো রকম আকস্মিক বলের ঘটনা মানেই হল মানুষের কোনো না কোনো ক্ষতি। বেশি বা কম, যেমনই হোক। এই ক্ষতি যে ঘটাচ্ছে তাকে খুশি করে বা ভয় দেখিয়ে — যেভাবেই হোক — বশ মানাতে হবে। শান্ত করতে হবে। যাতে সে আর ক্ষতি না করে, আরও বড় ক্ষতি না করে। মানুষের মতোই তো সব। মানুষের মতো করেই তাদের সামলানোর প্রয়াস।

আবার তার চরিত্রটাও বুঝতে হবে। হ্যাঁ, তখনকার মানুষেরাও জানতে চেয়েছিল, বুঝতে চেয়েছিল। বুঝে তবেই তাকে আর একটু ভালোভাবে সামলানো যাবে। সেই চেষ্টাও মানুষ করেছিল। কেন না সে নিজেও এই রকম অতিরিক্ত ও অপরিমিত শক্তির অধিকারী হতে চেয়েছিল। ভেবেছিল, হাতি যা পারে, পাহাড় যা পারে, একটা মানুষও তা করতে পারবে। সবাই না পারলেও অন্তত কিছু মানুষ পারবে। শুধু হাতি বা পাহাড়ের কাছ থেকে তাদের বলটা আদায় করার কায়দা কৌশল আয়ত্ত করতে হবে।

[২] যাদুবিদ্যা ও মন্ত্র-শক্তি

সেই চেষ্টারই অন্যতম ফসল যাদু বিদ্যা ও মন্ত্র-শক্তির ধারণা।

মানুষের রাগ বা ক্ষোভ হলে তাকে খাবার দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায়, শান্ত করা যায়। হাতি বা ঘোড়াকে খাদ্য দিলে তারা মানুষের অনেক কাজই মুখ বুজে করে দেয়। গোলমাল করে না। মানুষেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে। ক্রুদ্ধ বা বিক্ষুব্ধ মানুষকে শান্ত করার জন্য মিস্টি করে কথা বলে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ হাতি বা ঘোড়ার সঙ্গেও কথা বলে, ডাক দেয়, হাঁক দেয়। পিঠে মাথায় লেজে শুঁড়ে হাত বোলায় আর কথা বলে। আবোলতাবোল বকে। মানবশিশুদের শান্ত করা, কান্না থামানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোর জন্যও মানুষ কত আগডুম-বাগডুম বকে। এই সবেই খানিকটা কাজও যে হয় তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এ হচ্ছে এক অর্থে কথার শক্তি। বাক্যশক্তি। সুরেলা ছন্দোবদ্ধ শব্দের শক্তি। এই রকম কথাই কোনো মানব গোষ্ঠীর বিশেষ প্রয়োজনে যখন কোনো বড় শক্তিকে শান্ত করা বা বাগে আনার জন্য বিশেষ কায়দায় সুর করে আবৃত্তি ও পুনরাবৃত্তি করা হতে থাকে, তা হয়ে ওঠে মন্ত্র। তা যে কাজ করে তার কারণ তাতেও আছে শক্তি। এইভাবে বাক্যশক্তি এক সময় হয়ে ওঠে মন্ত্রশক্তি।

অর্থাৎ, ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া যাক। শিশুকে ঘুম পাড়ানোটা মন্ত্র নয়। ওটা শিশু ভোলানো ছড়া। সারা পৃথিবী জুড়েই এরকম অসংখ্য ছড়া ছড়িয়ে আছে। সেগুলোর কোনো অর্থ বিশেষ তেমন কিছু নেই।

“ছেলে ঘুমাল পাড়া জুড়াল বর্গি এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে?” —

এরকম পর পর চরণের মধ্যে কোনো অর্থগত পারম্পর্য নেই। ধ্বনি-ছন্দ বা শ্রুতিমাধুর্য থাকলেও বিরাট কোনো কাব্যগুণ হয়ত তাদের নেই। কিন্তু তবুও জনপ্রিয়। হাজার হাজার বছর ধরে লোকেরা বলে আসছে। শুনে শুনে মুখস্থ রেখেছে। প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে চালু রয়ে গেছে। তথাপি তা মন্ত্র হয়নি। ছড়াই থেকেছে। গরু বা ঘোড়াকে জাবনা খাওয়ানোর সময় বা তাদের নিয়ে পথ চলার সময় বকবক করাটাও কোনো মন্ত্র নয়। বেড়াল বা কুকুরের সঙ্গে গল্প করার মধ্যেও কোনো মন্ত্রের ব্যাপার নেই। কিন্তু ধস যে নামায়, পাথর যে গড়িয়ে ফেলে দেয়, সেই অশান্ত পাহাড়কে খুশি করার উদ্দেশ্যে, কিংবা, পায়ের তলায় মাটি টলিয়ে দেওয়া, ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা ভূমিকম্পমান পৃথিবীকে রাগ নিবারণ করতে বলার জন্য উচ্চারিত যে ধ্বনি-আবৃত্তি — তা হচ্ছে মন্ত্র। যে নদী ফুলে ফেঁপে উঠে বন্যা ঘটায়, ব্যাপক প্রাণ-হানি এবং সম্পদ হানির কারণ হয়ে ওঠে, তাকে খুশী করতে যে বাক্যবিস্তার — তাই হয়ে ওঠে মন্ত্র। তার কোনো অর্থ বা স্পষ্টতার দরকার নেই। কেউ তা জানতে চাইবেও না।

প্রাচীন কালের মানুষের অনেক কিছু আচার বিচারের পেছনে পাওয়া যাবে এই রকম ভাবে প্রাকৃতিক নানা বিরূপ শক্তিকে খুশি করার চেষ্টা আর তার সাথে সংযুক্ত নানা মন্ত্রপাঠ। নৃতত্ত্ববিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, লোকসংস্কৃতিগবেষক ও প্রাচীন ইতিহাসবিশেষজ্ঞ পণ্ডিতরা এই জাতীয় অনেক রকম আচার বিচার প্রথা প্রকরণ এই সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, তা আর কিছুই নয়, এক ধরনের ম্যাজিক বা যাদুবিদ্যা। আধুনিক অর্থে হাতসাফাইয়ের বা মঞ্চ-সাজানো যাদু নয়, জীবনযুদ্ধের সাংস্কৃতিক আঙ্গিক রূপে যাদু। ঈপ্সিত ফললাভের উদ্দেশ্যে, মানুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান এবং সম্ভাব্য ক্ষতিকারক প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে বশ করা, বাগে আনা, কাজে লাগানো, খুশি রাখা, ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখা — ইত্যাদির উদ্দেশ্যে এই সমস্ত ক্রিয়ানুষ্ঠান এবং বাক্যবিস্তার। এই দুইয়ে মিলিয়ে হচ্ছে যাদুমন্ত্র।

এই ম্যাজিক সংস্কৃতি মানব সমাজে সব চাইতে বেশি সময় ধরে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে টিঁকে রয়েছে। পৃথিবীতে বর্তমান হোমো স্যাপিয়েন্স-এর আগমনকালের সময় থেকেই বলা যেতে পারে। অন্তত পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে। আধুনিক উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সমাজও এর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। এর উৎপত্তি ধর্মের আবির্ভাবেরও আগে। ধর্মের আবির্ভাবের সময়ে প্রায় সমস্ত ধর্মই একে বিরোধিতা করেছে। বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্ত ধর্মই এই সংস্কৃতির অধিকাংশ উপাদানগুলিকে গ্রহণ ও আত্মসাৎ করে নিয়েছে, নিজ নিজ ধর্মীয় প্রথা প্রকরণের অঙ্গীভূত করে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে ধর্মোত্তর বা ধর্মনিস্পৃহ গণতান্ত্রিক সমাজে। ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষেরা এগুলিকেই আজ বলেন সংস্কার বা ঐতিহ্য বা পরম্পরা। আর যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা এগুলিকেই বলেন আচার-বিচার-কুসংস্কার।

বেশ কয়েকটি প্রশ্ন এখানে উঠে আসবেই।

(ক) এই সংস্কার বা কুসংস্কারগুলি এতদিন ধরে মানুষের মনে টিঁকে রইল কী করে? (খ) ধর্ম প্রথমে এদের বিরোধিতা করেছিল কেন? (গ) তারপরে আবার ধর্ম এগুলোকে মেনে নিল কেন? (ঘ) আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভর সমাজেই বা এগুলির বেঁচে থাকার কারণ কী?

টিঁকে থাকার প্রশ্নটাই সবচাইতে জরুরি। ঘুরে ঘুরে আসে। আমাদের এই আলোচনায়ও দুবার উঠে এল। এক এবং চার নম্বরে। বহু মানুষ আছেন যাঁরা এখনও এই টিঁকে থাকার ঘটনাকেই এই কুসংস্কারগুলির সপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি বা যথার্থতা বলে মনে করেন। সমাজে নিতান্ত বিনা কারণে কি আর এগুলি টিঁকে আছে? কোনো লাভ যদি না-ই হবে মানুষ যাবে কেন ওঝা গুণিনের কাছে? হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ শুধু ঠকে এল আবার মেনেও এল? তা হয় নাকি?

তবে শুরুতেই বলে রাখি, এই প্রশ্ন নিয়ে আজকের দিনে আলোচনা করায় প্রচুর অসুবিধা আছে। আমাদের আজকালকার যে আধুনিক মন তাই দিয়ে আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগেকার মানুষের মনের হদিশ নিতে গেলে ভুল হয়ে যাবে। আজ একজন বিশ্বাসীও যতটা প্রশ্ন করতে চান, যুক্তি খোঁজেন, যাথার্থ্য বুঝতে চেষ্টা করেন, চার বা পাঁচ হাজার বছর আগের একজন যুক্তিবাদীও ততটা সংশয়প্রবণ হতেন না। হওয়ার কথাই ছিল না। হওয়া সম্ভবও ছিল না। জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথেই মানুষের প্রশ্নশীলতা বা যুক্তিপরায়ণতা বেড়েছে। জিগীষা আর জিজ্ঞাসা সময়ের সমান্তরালে এক সাথে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে।

আসল কথা, সাফল্য।

ইংরেজি প্রবচনে আছে, সাফল্যের চেয়ে বড় সফল আর কিছু হয় না। মন্ত্রতন্ত্রও যদি সফল হয় কোনো ক্ষেত্রে সে মানুষের মনে দাগ কেটে ফেলবে। নিশ্চয়ই উপরে কথিত যাদুবিদ্যা কোনো না কোনো ক্ষেত্রে সফল হত। হয়ত বেশ কিছু ক্ষেত্রেই হত। ধরুন, একজন ওঝা সাপে কাটা রোগীকে বাঁচানোর জন্য সাপের বিষ নামানোর মন্ত্র পড়ছে। যাঁরা আজকের দিনে এই ধরনের ঘটনা নিয়ে কাজ করেন তাঁরা জানেন, সাপ কামড়ালেই মানুষের মৃত্যু হয় না। তিনটি শর্ত পূরণ করে কামড়াতে হয়। এক, সাপটিকে বিষধর হতে হবে। দুই, সাপটিকে ঠিক মতো দাঁত ফোটাতে হবে। তিন, বিষ থলিতে পর্যাপ্ত বিষ থাকতে হবে। প্রথম প্রশ্নে এখন আমরা জানি, পৃথিবীতে বিষধর সাপের তুলনায় নির্বিষ সাপের সংখ্যা অনেক বেশি। এই কথা দুচার হাজার বছর আগে মানুষ যে ভালো করে জানত না, তা তো বেহুলা-লখিন্দরের পুরা-কাহিনি থেকেই আমরা বুঝতে পারি। সেদিন রাতে কালনাগিনী কামড়েছিল বলেই না বেহুলা বৈধব্যের হাত থেকে সেবার বেঁচে গিয়েছিলেন। কালকেউটে ওই ছোবলটি দিলে কী হত ভাবুন দেখি একবার . . . ! তারা তখন সমস্ত সাপকেই বিষযুক্ত বলে ধরে নিত। ফলে, এখন নিশ্চয়ই বুঝি, পারিসংখ্যানিক বিচারে এমনিতেই সাপে কামড়ালেও বেঁচে যাওয়ার সম্ভাব্যতা যথেষ্ট বেশি। দ্বিতীয়ত, চলাফেরার কারণে বহু সময়ই সাপের দাঁত সোজাসুজি রোগীর গায়ে বসে না, ফলে বিষ শরীরে যায় কম। তৃতীয়ত, সাপটি যদি কিছুক্ষণ আগে অন্য কোনো প্রাণীকে কামড়ে এসে থাকে, তাহলে তার বিষ থলিতে বিষ থাকবে কম। ঠিক মতো কামড়ালেও রোগী মরবে না।

অতএব সাপে কাটা যে রোগীকে গুণিনের কাছে আনা হল, উপরোক্ত তিনটি শর্তই এক যোগে পূরণ না হয়ে থাকলে সে এমনিতেই মরবে না। সেটা তো যারা তাকে নিয়ে এসেছে, বা যার কাছে নিয়ে এসেছে, তারা কেউই সেদিন জানে না। যাকে সাপে কামড়েছে, সেও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে আছে। অথচ তারা দেখছে, সাপে কেটেছে, আর ওঝা মন্ত্র ঝেড়ে ঝেড়ে তাকে বাঁচিয়ে তুলছে। ওঝা এবং মন্ত্র — দুটোরই জয়জয়কার হয়ে যাবে। গ্রামে গ্রামান্তরে প্রচার হয়ে যাবে। ওঝা তো নয়, সাপের একেবারে সাক্ষাত যম! আর মন্ত্রের কী জোর! মা মনসাকেও একেবারে নাচিয়ে ছেড়ে দেয়!
এই শেষ কথাটা পাঠককে লক্ষ করতে বলছি। দুইয়ের মধ্যে আবার মন্ত্রের জোরটাই আসল। গুণিন যদি ঠিক মতো মন্ত্র আয়ত্ত করতে না পারে, এবং/অথবা, তার মনে যদি কোনো পাপ, অশুচিতা, লোভ, ক্ষমতা জাহিরতা, ইত্যাদি থেকে থাকে তাহলে কাজ হবে না। অর্থাৎ, বিপরীতক্রমে, যদি মন্ত্রে কোনো কাজ না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, গুণিনেরই দোষ। মন্ত্রশক্তির গুণ তো আর কদাচ নষ্ট হয় না। প্রাচীনকালে এই যুক্তিটা যে সহজেই মানুষের মনে গেঁথে যাবে তা নিশ্চয়ই আজ কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।

তাই এটাও মনে রাখতে হবে, সেই ওঝা-গুনিনরা কেউ ভণ্ড ছিল না। আমজনতা এবং বিশেষজ্ঞ গুনিন—সংশ্লিষ্ট সমস্যার ব্যাপারে উভয়েই ছিল সমান রকম অজ্ঞ।

আর একটা উদাহরণ দিই। ধরুন গ্রীষ্মের গরমে যখন মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত সেই সময়ে বৃষ্টির জন্য যজ্ঞ করা হল। (ভারতের সাপেক্ষে) পবন বরুণ এবং অন্য সমস্ত বিভাগীয় দেবতাদের কাছে জবরদস্ত দরবার করা হল ‘বৃষ্টি দাও’ ‘বৃষ্টি দাও’ বলে। ঋগ-বেদ থেকে নানা অধ্যায় ঘাঁটাঘাঁটি করে উপযুক্ত মন্ত্রও সংশ্লেষণ করা হল এর জন্য। এই যজ্ঞের সাফল্যের সম্ভাবনাটা একবার ভাবুন। তখন পরিবেশ দুষণ বিশ্ব উষ্ণায়ন আজকের মাত্রায় উপস্থিত ছিল না। গ্রীষ্মকালের শেষে বর্ষাকাল আপনিই রুটিন মেনে মোটামুটি চলে আসত। সেই রকম সময়ে সেই বৃষ্টি যজ্ঞের সাফল্যের তো ষোল আনা সম্ভাবনা। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি যে ওঝা গুণিন পুরোহিত যজ্ঞ করছে তারাও জানে না যে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকৃতির নিয়মেই বর্ষা এসে যাবে। ফলে গরমে ঝলসে যেতে যেতে যখন বর্ষা নামল, সকলে ধরেই নেবে, যজ্ঞ সফল। মন্ত্রশক্তির ক্ষমতা প্রমাণিত। আবার এখানেও যদি কোনো কারণে বৃষ্টি না হয়, বর্ষা আসতে দেরি হয়, বেশিরভাগ লোক ধরে নেবে, যজ্ঞের ঋত্বিক পুরোহিত আচার্য প্রমুখর কেউ না কেউ বা একাধিক ব্যক্তি কিছু পাপ-টাপ করেছিল বলেই মন্ত্রের কাজ বিফল হল।

এই রকম আরও বহু উদাহরণ ধরে ধরে আলোচনা করে দেখানো যায়, প্রাকৃতিক নিয়মেই যা ঘটবারই কথা এবং যা প্রায় সময়ই ঘটে যেত, সেই সব ঘটনাই সেকালে ওঝা-গুণিনদের আধিভৌতিক ক্ষমতা এবং তাদের উচ্চারিত মন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তির পরিচয় বলে গণ্য হত।

অন্যদিকে এও সকলেই জানেন, শুধু সেদিনকার কেন আজও অধিকাংশ মানুষ এই সব মন্ত্রতন্ত্র তুক্‌তাক ভোজবাজি ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাফল্য ও ব্যর্থতার আপেক্ষিক পারিসংখ্যানিক বিচার করে না। আধুনিক বিজ্ঞানের এই শিক্ষা এখনও বিজ্ঞানীদেরই সকলে তাঁদের বিশেষ নৈপুণ্যের বাইরে খুব একটা প্রয়োগ করেন না এবং নানা ব্যাপারে বহু যা-তা জিনিস বিশ্বাস করে বসেন। যেমন করে অনেকে আজকাল জ্যোতিষবিদ্যা কিংবা হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে দু-চারটে ঘটনা মিলে যাওয়ার বা সেরে যাওয়ার উদাহরণ দিয়ে তার বৈজ্ঞানিকতার সমর্থনে বলে থাকেন আর কী। সুতরাং সেকালেও লোকে যে দু একটা সাফল্য দেখলেই বাকি সমস্ত ব্যর্থতার ঘটনা ভুলে যাবে বা অগ্রাহ্য করবে — এ আর বেশি কথা কী? বিশেষ করে যেখানে ব্যর্থতার জন্য ব্যক্তিবিশেষের চরিত্র দোষকে দায়ী করার সহজ ফরমুলার ব্যবহার তখন পুরো দস্তুর বর্তমান।

এইভাবেই ইতিহাসে একদিন মন্ত্রশক্তি এক আধিভৌতিক শক্তি হিসাবে মানুষের কাছে সম্মানের জায়গা পেয়ে গেল।

[৩] যাদুবিদ্যা ও ধর্ম

পৃথিবীর সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই প্রথম যুগে এই ম্যাজিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু কেন? আসুন, এবার আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখি।

সমাজ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে দেখা যাবে, ধর্মের উদ্ভবের সময়কালের সাথে এই যাদুবিদ্যার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের পার্থক্য দিয়েই সেই উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, ম্যাজিক সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারের সময় হচ্ছে প্রস্তর যুগের সংগ্রহ ও শিকার ভিত্তিক যাযাবর আদিম সাম্যবাদী জ্ঞাতিগোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ সংগঠন। আর ধর্মের উদ্ভব ঘটে সেই সমাজের ক্রমবিকাশের একটা পর্যায়ে ধাতুযুগের বিকাশের এক উন্নত পর্যায়ে — প্রথমে তাম্রযুগ ও অবশেষে লৌহযুগে এসে — স্থায়ী কৃষি, নগর সভ্যতা তথা শ্রেণিবিভক্ত ও রাজনৈতিক সমাজকাঠামোর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। [এই বিষয়ে খুব বেশি আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। আমি আমার ধর্ম বিষয়ক একটি বইতে তা খানিক বিস্তারিতভাবে চর্চা করেছি।]

আদিম সাম্যবাদী সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, সেখানে কেউ কারোর প্রভু ছিল না। অভাব দুর্দশার সাম্য, আবার কাজ ভাগাভাগি করে দায়িত্ব বহনের সাম্য। সেই কালের মানুষ-জনদের প্রধান সমস্যা ছিল সকলে মিলে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহ করা, বেঁচে থাকার রসদ যোগাড় করা। সে গরু ঘোড়া কুকুরকে দিয়ে নানান কাজ করায়, গাছ পাথর নদী হ্রদকে দিয়েও কাজ করাতে চায়, চেষ্টা করে। কাজের সময় সে কুকুর বা ঘোড়াকে যেমন হাঁক দেয়, গাল পাড়ে, আদরও করে, খেতেও দেয়, হুকুম শোনায়, গাছ পাথর নদী বা হ্রদকেও সে একইভাবে বোঝানোর খুশি করার বা দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতে থাকে। (আজও ভারতে বহু লোক গঙ্গা বা কাবেরী নদীর উপর দিয়ে ট্রেনে করে যাওয়ার সময় পয়সা ফেলে তাকে খুশি করার চেষ্টা করে। ছোটখাটো নদীগুলির অবশ্য এই সৌভাগ্য হয় না।) দলবদ্ধভাবে শিকারে যাওয়ার আগে সে গুহার ভেতরে বাইসনের ছবি এঁকে শিকারের যে অভিনয় করত, যা ছিল তখনকার সময়ে গা গরম করা, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনঃসংযোগ রক্ষা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক ধরনের অসচেতন অনুশীলন; তার মধ্য দিয়ে সে প্রকৃতির কাছ থেকে তার দাবি আদায়ের কথাই ভাবত। এর ফলে তার যে যাদুবিদ্যা, তা ছিল চাহিদা জ্ঞাপন অনুরোধ এবং হুকুমের এক গড়। তার মধ্যে প্রার্থনা নেই, দয়া ভিক্ষা নেই, সমর্পণ নেই। ভারতীয় দর্শনে মীমাংসকরা বলে গেছেন, মানুষের করা যজ্ঞ নাকি দেবতাদের চাইতেও শক্তিশালী। একবার কোনো যজ্ঞ সুষ্ঠভাবে করলে দেবতাকে তার ফল দিতেই হবে।

শ্রেণি বিভক্ত সমাজের বৈশিষ্ট্য কিন্তু তা নয়। সেখানে মুষ্টিমেয় একদলের হাতে সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত, অন্যরা শুধু কাজের লোক, তা সে কেউ দাস হিসাবে আর অন্য কেউ হয়ত তথাকথিত স্বাধীনভাবে। শোষক আর শোষিত, শাসক আর শাসিত, মালিক আর গোলাম। এর ফলে সেই সমাজে উপরের দিকে দু-চারজন হুকুমদার আছে, প্রভু আছে। বাকিরা তার নিচে অধীনস্থ, কৃপাপ্রার্থী, হুকুমের দাস। সমাজের শাসককে দেখেই মানুষের মাথায় প্রকৃতিরও শাসকের ধারণা জন্ম নিল। রাজা, বড় রাজা, আরও শক্তিশালী রাজা, . . ., সুতরাং রাজাদেরও রাজা, দুনিয়ারও রাজা, নিশ্চয়ই কেউ আছেন। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, এইভাবেই একদিন মানুষের মনে ঈশ্বরের ধারণা জন্ম নিয়েছিল। রাজাকে কি কোনো সাধারণ প্রজা গিয়ে হুকুম দিতে পারে? তেমনই ঈশ্বরকেও আর মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতার অনুসরণে অনুরোধ জানাতে, দাবি জানাতে, হুকুম দিতে, হাঁকডাক করতে পারে না। ঈশ্বরের সঙ্গে বোঝাপড়ার উপায় হল কৃপা প্রার্থনা, মঙ্গল-ভিক্ষা, আত্মসমর্পণ, আশীর্বাদ কামনা, . . .।

আর একটা বড় সমস্যাও ছিল। ম্যাজিকের যুগে অসংখ্য প্রাকৃতিক শক্তি, ফলে দেবতাও অনেক। পরিদৃশ্যমান বস্তু থেকে দৈব শক্তির কল্পনা, নদী দেবতা, পাহাড় দেবতা, বট গাছ দেবতা, ইত্যাদি। আবার কাজের কর্তৃত্ব বহনকারী দৈব শক্তি হিসাবে প্রেমের দেবতা, বৃষ্টির দেবতা, শস্যের দেবতা, যুদ্ধের দেবতা, . . .। “এই সব দেবতারা কয়েক হাজার বছর আগেকার জীব।” [বিবেকানন্দ] তাদের স্বভাব চরিত্র আচার আচরণ কমবেশি মানুষেরই মতো। তাদের মধ্যে উদারতা, কর্মপটুত্ব, যুদ্ধানুরাগ, ভোজনরসিকতা, রাগ, হিংসা, লোভ, যৌনতা, ঘুষপ্রিয়তা, . . ., কী নেই?

স্বভাবতই, যাদুবিদ্যার মন্ত্রতন্ত্র দিয়ে, তার ঠাকুর-দেবতাদের দিয়ে কি এই প্রার্থনার কাজ চলতে পারত? না, পারত না। এই জন্য দুনিয়ার সব দেশেই ধর্ম যখন এল, সে এল একেশ্বর উপাসনার কর্মসূচি নিয়ে। গ্রিস দেশের ভাববাদী দার্শনিক প্লাতো ধ্রুপদী মহাকাব্যকার হোমারকে প্রচুর সমালোচনা করলেন দেবতাদের মানুষ করে তোলার জন্য, তাদের মধ্যে দোকানদারি স্বভাব দেখানোর জন্য। মোহাম্মদ বললেন, লা ইলাহ ইল আল্লাহ . . . । এক ঈশ্বর ছাড়া আর আমাদের কোনো উপাস্য থাকবে না। ইহুদিদের ইয়াহ্‌বে, খ্রিস্টানদের জিহোবা (পরে গড), ইসলামের আল্লাহ (আল ইলাহ্‌ থেকে), ইত্যাদি। বিবেকানন্দ আক্ষেপ করে বললেন, ঋগ-বেদে বড্ড খাই-খাই। কেবল পেট পুরে খাওয়ার দিকে নজর। উপনিষদগুলিতেও অনেক কাঁটাঝোপের জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে হয়ত দু একটা গোলাপের দেখা মেলে। গীতাতেই প্রথম পরিপূর্ণ ভক্তি নিয়ে একজন ভগবানের আবির্ভাব। অন্য সব উপাস্যদের সম্ভব হলে বাতিল করে, না পারলে অন্তত বা খাটো করে। ছোট ছোট অল্প ক্ষমতার অধিকারী আঞ্চলিক প্রভাব সৃষ্টিকারী অনেক দেবতার শক্তির যোগফল নিয়ে আবির্ভূত হলেন এই একমাত্র ঈশ্বর। তিনি সর্বশক্তিমান, কেন না, তাঁর প্রভাবাধীন সমাজের অন্য সব কজন দেবতার সমস্ত বিভাগীয় শক্তিই তিনি হরণ ও ধারণ করেছেন। এইভাবে উপাস্যর চরিত্র যখন বদলে গেল, তার সাথে উপাসনার বাক্যজালও ধীরে ধীরে পালটে ফেলতে হল।

কিন্তু — হ্যাঁ, অনেকেই গম্ভীর আলোচনার মাঝখানে এরকম হঠাৎ করে ‘কিন্তু’ নামক অব্যয়টির আগমন পছন্দ করেন না, আমি জানি। জেনেও উপায় নেই বলেই বলছি — কিন্তু, ধর্মকেও শেষ পর্যন্ত যাদুবিদ্যার অনেক কিছুই মেনে এবং মানিয়ে নিতে হয়েছিল। নিতে হল কারণ, প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে চলে আসা এবং ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক প্রথা-প্রকরণগুলিকে এত সহজে সাধারণ মানুষের মন থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। আধুনিক বিজ্ঞানের শক্তি ও বুদ্ধিতে বলীয়ান হয়েও মাত্র আড়াই কি তিন হাজার বছরের ধর্মীয় বিশ্বাসকে মানুষের মন থেকে নড়াতে গিয়েই তো আমরা টের পাচ্ছি, কাজটা কত কঠিন। স্বভাবতই জ্ঞানের দিক থেকে সেই তুলনায় অনেক দুর্বল ধর্মের পক্ষে সেদিন ম্যাজিক সংস্কৃতির অধিষ্ঠানকে নড়ানো আরও অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। ফলে ধর্মপ্রবর্তকরা এবং তাঁদের প্রথম প্রজন্মের প্রচারকরা শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে আপসের পথ খুঁজতে চাইলেন।

আপস করা সম্ভব হল দুটো কারণে।

প্রথমত, ম্যাজিক এবং ধর্ম — দুই জায়গাতেই স্রেফ বিশ্বাসের একটা বড় ভূমিকা ছিল। অর্থাৎ, বিচারবুদ্ধির ফসলে দ্বিমত থাকলেও প্রয়োগ কৌশলে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। বৃষ্টির দেবতাকে যজ্ঞ করে জল ঢালতে বাধ্য করলে সে বৃষ্টি দেবেএর মধ্যে যে ধরনের বিশ্বাস নিহিত রয়েছে, ভগবানের উদ্দেশে প্রার্থনা করলে তিনিও ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে বারিধারা নামিয়ে দেবেনএর মধ্যেও সেই একই ধরনের বিশ্বাস ঢুকে বসে আছে। বরং বলা ভালো, আগের বিশ্বাসের প্রকরণটা মজুত ছিল বলেই পরের বিশ্বাসটাও সহজেই মানুষের মনে জায়গা করে নেবার জমি খুঁজে পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, দুই ক্ষেত্রেই সেই শক্তির ধারণা একটা বড় জায়গা নিয়ে কাজ করছিল। বটগাছের গুঁড়ির শক্তি, পাথরের শক্তি, পাহাড় বা নদীর শক্তি, আবার ভগবানেরও শক্তি। আগেরগুলো অদৃশ্য হলেও কিন্তু মানুষের নাগালের মধ্যে রয়েছে বলেই মনে করা হত। ভগবানের শক্তি শুধু অদৃশ্যই নয়, মানুষের নাগালেরও বাইরে। কিন্তু শক্তি তো বটেই। আর এটা তো স্বাভাবিক, রাজার শক্তিই যেখানে এতকালের দেখা শোনা মানুষের শক্তির চেয়ে অনেক বেশি, অনেক কিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সেখানে দুনিয়ার শাহানশা ভগবানের শক্তি তো আরও বিশাল হবেই। ফলে সেই শক্তির প্রচার একটু একটু করে মানুষের মনে দাগ কাটতে সক্ষম হল।

এই দুই পথ ধরেই আপসরফা হয়ে গেল।

একটি উদাহরণ দিই। “ওম এ ক্লীং হ্লীং শ্রীং হসৌ শ্রীং হ্লীং ক্লীং এং জূং ক্লীং সং লং শ্রীং রঃ অং আং ইং ঈং উং ঊং ঋং ঋং লং লৃং এং ঐং ওং ঔং অং অঃ উং কং খং গং ঘং ডং ঊং চং ছং জং ঝং ত্রং ঊং টং ঠং ডং ঢং ণং ঊং তং থং দং ধং নং ঊং পং ফং বং ভং মং ঊং য়ং রং বং লং ঊং শং ষং হং ক্ষং স্বাহাঃ” — এটি হচ্ছে মহাকালী সাধনার উগ্র মন্ত্র। ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, এর মধ্যে কোনো অর্থপূর্ণ বক্তব্য নেই। আরও ভালোভাবে খেয়াল করলে বরং একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠবে, এই মন্ত্রটিতে মূলত সংস্কৃত বর্ণমালাকেই পর পর অনুস্বার ও বিরতি সহযোগে ঘন্টাধ্বনির মতো করে বলে যাওয়া হয়েছে। এর থেকে একটা কথা অনুমান করা সম্ভব: এই বর্ণমালা যখন বৈদিক জনজাতির লোকেরা তাদের মৌখিক (বৈদিক) ভাষার ভেতর থেকে অণু-অণু বিশ্লেষণ করে আয়ত্ত করেছিল (আজ থেকে কম-বেশি আড়াই হাজার বছর আগে), তা ছিল তাদের এক অসাধারণ কীর্তি-অর্জন। আর তাই তারা এর মধ্যে এক বিরাট শক্তির সম্ভাবনা দেখেছিল হয়ত। কিন্তু বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে এই যাদুমন্ত্রটিতে লক্ষ লক্ষ ধর্মীয় লোকেরা বিশ্বাস করে এসেছে; তারা আন্তরিকভাবেই ভেবেছে, এই মন্ত্র ভক্তি ভরে উচ্চারণ করে গেলেই মহাকালী সন্তুষ্ট হবে; আর তখন ঈপ্সিত ফল লাভ হবেই।

এখানে আর একটি মন্ত্রও পাঠ করা যাক। সকলেই জানেন, মাটির মূর্তি বানিয়ে পুজো করার আগে সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়, অর্থাৎ, উদ্দিষ্ট দেবতাকে আবাহন করে এসে সেই মূর্তিতে বসাতে হয়। তার মন্ত্রটি হল: “ওঁ আং হ্রীং ক্রোং যং রঙ লং বং শং ষং সং হৌং সঃ অমুকদেবতায়াঃ প্রাণা হই প্রাণা। ওঁ আং হ্রীং ক্রোং ওঁ আং হ্রীং ক্রোং যং রঙ লং বং শং ষং সং হৌং হং সঃ অমুকদেবতাঃ জীবঃ ইহ স্থিতঃ। ওঁ আং হ্রীং ক্রোং যং রঙ লং বং শংষং সং হৌং হং সঃ অমুকদেবতায়াঃ সর্ব্বেন্দ্রিয়াণি। ওঁ আং হ্রীং ক্রোং যং রঙ লং বং শং ষং সং হৌং হং সঃ অমুকদেবতায়াঃ বাঙ্মনশ্চক্ষুস্ত্বক্ শ্রোত্রুঘ্রাণপ্রাণা ইহাগত্য সুখং চিরং তিষ্ঠন্তু স্বাহা। …” এটিও যে প্রাচীন কালের মানুষের ছন্দোবদ্ধ শব্দের শক্তিতে বিশ্বাসেরই পুনরুৎপাদন — তা নিশ্চয়ই কাউকে বুঝিয়ে বলে দিতে হবে না।

সমস্ত ধর্মীয় সংস্কৃতির কঠোর একেশ্বরবাদের মধ্যেও এই জাতীয় আপসের নানা রকম ছাপ আজ পর্যন্ত থেকে গেছে। রোমের ভ্যাটিক্যানে, মক্কার কাবায়, জর্ডন নদীর পবিত্র জলে, আরব দেশে জমজমের পানিতে, পরী-দেবদূত-ফরিস্তায়, শয়তান-ইবলিশ-ড্র্যাকুলা-জিন-দুষ্টশক্তি-ভূত — আরও কত কিছুতে! আর হিন্দুদের (তেত্রিশ কোটি নয়) মাত্র তেত্রিশ জন দেবতার মধ্যে এই ছাপ বড্ড বেশি স্পষ্ট বলে কখনও আচার্য শঙ্কর, কখনও নানকদেব, কখনও বা রামমোহন এদের মিলিয়ে দিয়ে একজন-মাত্র ভগবানের ধারণা তৈরি করতে খুবই আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। লাভ হয়নি। শঙ্করের একমেবাদ্বিতীয়ম ব্রহ্ম এক-ঈশ্বরের নানা রকম ধারণার চমৎকার একটি গ.সা.গু. হলেও তিনি নিজে শৈব ছিলেন বলে শেষ পর্যন্ত শিবঠাকুরের প্রাধান্যই কিছু দিনের জন্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। যে কোনো ম্যাজিক-বস্তুর সঙ্গে ঈশ্বর সন্ধি করলেই পেছনে শিবঠাকুরকে পাওয়া যাবে। বটেশ্বর, মহেশ্বর, যোগেশ্বর, ঘাটেশ্বর, বালেশ্বর, ইত্যাদি।

শেষ পর্যন্ত গুরু নানক আর মহাত্মা রামমোহনের প্রচেষ্টায় হিন্দুদের একেশ্বরবাদে আর উত্তরণ ঘটেনি, পরিবর্তে একটা করে নতুন ধর্ম — শিখ ধর্ম এবং ব্রাহ্ম ধর্ম — জন্ম নিয়েছে। তার পরে রামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দকে এসে সেই ম্যাজিক সংস্কৃতির কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। নতুন করে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে, ব্রহ্মও আছে, কালীও আছে। যে যেমন বোঝে তার তেমন উপাস্য। যত মত তত পথ। আসলে সমস্ত মত ও সমস্ত পথ। বক্তৃতায় “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” বল; সব কিছুতে ব্রহ্মও মানো। আবার মা কালীকে পাঁঠা বলি-ও দাও এবং একবার একটু মন্তর পড়ে মূর্তির কাছে উচ্ছুগ্‌গো করে নিয়ে রান্না করে খেয়েও নাও। নিশ্চিন্ত থাক; ব্রহ্মই ব্রহ্মকে খাবে। কোথাও কিচ্ছু উনিশ-বিশ হবে না। এ ভারি সুবিধার কথা!

খ্রিস্টধর্মের তো প্রায় শুরুতেই এক থেকে তিন হয়ে গেল — ভগবান, তাঁর পুত্র যিশু ও পবিত্র আত্মা। অল্প দিনের মধ্যেই মা মেরিও এসে গির্জায় গির্জায় উঁচু বেদীর উপরে জায়গা করে নিলেন। বেচারি পিতৃদেব, যোশেফ — তাঁরই আর কিছু প্রোমোশন হল না! প্রাচীন মাতৃকেন্দ্রিক পরিবারতন্ত্রের জের কিনা কে জানে!! তারপর একে একে অনেক সন্ত। অগাস্তিন, আনসেল্ম, অ্যাকুইনাস, প্রমুখ। সকলেই পূজনীয়।

অন্য দিকে অমন যে কঠোর একেশ্বরবাদী ইসলাম, যে তার ঈশ্বর, তাঁর প্রতিনিধি নবী, জগতের গাছপালা, পশুপাখিকারোর ছবি আঁকতে দিতে চায়নি, পছন্দ করেনি, পাছে মূর্তি পূজার প্রবণতা আবার সমাজে ফিরে এসে পড়ে, তার ভক্তরাও বড় বড় পীর বা গাজীর সমাধি-মাজারে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ধুপধুনো জ্বালিয়ে ফুল বেল(?)পাতা সমেত পুজো দিয়ে আসে। গাছে ঢিল বেঁধে রুমাল ঝুলিয়ে কত কী মানত করে রাখে। আরও কত কী! আর পাথর যুগের ম্যাজিকের কী অপার মহিমা! হিন্দুরাও অনেকে সেই সব দরগা-মাজারে যায় যার যার মনস্কামনা পূরণের বিশ্বাস নিয়ে।

[৪] আধ্যাত্মিক শক্তি

কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যেও একটা নতুন ধারণা সমাজ মননে স্থান করে নিল। আধ্যাত্মিক শক্তির ধারণা। যাদুবিদ্যার মধ্যে যে শক্তির কল্পিত ধারণা নিহিত ছিল তা ছিল আসলে বস্তুরই ক্রিয়াশীলতার প্রকাশ। তার মধ্যে অতি-বস্তু ও অপ্রাকৃতিক কোনো ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যের ধারণা ছিল না। যেমন মানুষের শক্তি, ঘোড়ার শক্তি, তেমনই নদীর শক্তি, হাওয়ার শক্তি। পরিমাণগত পার্থক্য থাকলেও গুণগত পার্থক্য ছিল না বললেই চলে। যাদুবিদ্যার ধারণার মধ্যে বস্তু ও ঘটনা পরম্পরার মধ্যে এক একটা কারণ-কার্য সম্বন্ধ ছিল। এখন আমরা বুঝি, সেই কারণ-কার্য সংক্রান্ত অধিকাংশ ধারণাই ছিল ভুল। তবুও যে কোনো ঘটনার পেছনে বস্তুগত কারণ খোঁজার ঝোঁক বা প্রচেষ্টা ছিল।

কিন্তু ঐশ্বরিক শক্তির ক্ষেত্রে একথা আর বলা যায় না। তা সম্পূর্ণতই বস্তুজগত-ঊর্ধ্ব অতিপ্রাকৃতিক ও অলৌকিক শক্তি। তার আর বস্তুগত কার্য-কারণ পরম্পরা নেই। ঈশ্বর যা চান তাই ঘটে। পাখিদের তিনি আকাশে উড়বার ব্যবস্থা করে দেন। আবার মানুষ খাবে বলে মুরগিদের তিনি উড়তে দেন না, ভূমিতেই চরতে বাধ্য করেন। এই ঈশ্বর চাইলে মরুভূমিতে নদী বসিয়ে দিতে পারেন। তিনি ইচ্ছা করলে সমুদ্র দুভাগ করে মাঝখান দিয়ে করিডর বানিয়ে দিতেও পারেন (টেন কম্যান্ডমেন্ট্‌স সিনেমায় তার ছবিও তুলে দেখানো হয়েছে)। আবার জাগতিক লীলা-বাসনা না জাগলে, তেমন ইচ্ছা হলে, তিনি কিছুই না করে চুপচাপ বসেও থাকতে পারেন। এখন, যেহেতু ঈশ্বর অনেক দূরের শক্তি উৎস, তাই মানুষের কাছে এর একটা আপাত দৃশ্যময়তা (visualization)-র প্রয়োজন দেখা দিল।

ধীরে ধীরে বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে নানা রকম গল্পের সমাবেশ ঘটল এই ঐশ্বরিক অলৌকিক ক্ষমতার দৃশ্যায়নের জন্য। এমন এক একজন সাধুর আবির্ভাব হয় যিনি হাত দিলেই কুষ্ঠ রোগ সেরে যায়, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়, শুকনো কুয়োয় জল ভরে ওঠে, আরও কত কী। এরই নাম আধ্যাত্মিক শক্তি। অন্তরাত্মার শক্তি। সকলের হয় না, কারোর কারোর হয়। কিন্তু মুশকিল হল, সে তো কেউই আবার নিজের চোখে দেখতে পায় না, প্রত্যেকেই অন্য কেউ দেখেছে বলে নিজের কানে শুনতে পায় শুধু। প্রত্যক্ষ শ্রোতা অনেক থাকলেও প্রত্যক্ষ দর্শক কেউই নেই। সেদিক থেকে এই সবের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এক যুক্তি উঠে আসে জগতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সেই কালের আদি প্রয়াসের মধ্যে।

হ্যাঁ, গ্রিক দার্শনিক আরিস্ততলই প্রথম ভাবতে শুরু করলেন বল ও গতির রহস্য নিয়ে। বললেন, কোনো বস্তু চলমান হয় বলের প্রভাবে। পাথরটা মাঠে পড়ে আছে। নড়ছে না চড়ছে না। তুমি ঠেলা দাও, অমনি নড়ে উঠবে। হাতে হাতে প্রমাণ যে বল প্রয়োগেই বস্তু গতিশীল হয়ে ওঠে। এই প্রথম বিজ্ঞানের যুক্তির একটা প্রাথমিক কাঠামো নিয়ে বল গতি ও শক্তি দৃশ্যমান হয়ে উঠল আম আদমির কাছে। আর সেখান থেকেই আরিস্ততল এক বিরাট সিদ্ধান্তের কথা শোনালেন। পৃথিবীর চারদিকে সূর্য চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহগুলি কিংবা নক্ষত্রগুলি ঘুরছে কীভাবে? চলছে কীভাবে? একজন রাম ঠেলা দিয়ে যাচ্ছেন। দিয়েই যাচ্ছেন। ভগবান। তিনিই এই জগত সংসারের অধিচালক (prime mover)। তাঁর ধাক্কাতেই সব কিছু চলমান। আরিস্ততলের ব্যাখ্যায় ভগবানের ক্ষমতা, ঐশ্বরিক শক্তি, সমস্তই মানুষের দুই চর্মচক্ষে একেবারে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে গেল। চোখে লেগেও রইল। প্রতিদিন প্রতি রাতে। প্রায় দু হাজার বছর ধরে। একেবারে সেই গ্যালিলেওর কল্প-জাহাজ ১৬৩২ সালে শান্ত সমুদ্রে পাল তুলে ভাসতে শুরু না করা পর্যন্ত। তখন অবশ্য সমবেগে চলমান বস্তুর গতির জন্য অন্তত আর কোনো অধিচালকের দরকারই রইল না। নিউটন বোধ হয় ভগবানের এই অবমর্যাদা সহ্য করতে পারেননি। তিনি এসে আবার অনেক রকম মাথা খাটিয়ে ভগবানকে একবার মাত্র ধাক্কা দেবার একটা বন্দোবস্ত করে দেন। চতুর্দিক ব্যাপ্ত আপেক্ষিক গতি ও স্থিতি ভরা এই জগতে কোনো এক আদি মাহেন্দ্রক্ষণে তথাকথিত পরম স্থিতি থেকে সমস্ত জগত সংসারকে চলমান করে তোলার জন্য এক দুর্দান্ত পয়লা গুঁতো (first impulse) দেবার অধিকারটুকুই মহামহিম ঈশ্বরের জন্য তিনি বরাদ্দ করতে পারলেন।

যাই হোক, তার আগে অবধি ঈশ্বরর অসীম ক্ষমতা নিয়ে মানুষের কোনোই সংশয় ছিল না।

এই ঐশ্বরিক শক্তির টুকরো-টাকরা ভগ্নাংশও যাঁর মধ্যে বর্তায় তিনিও এক দৈবী আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠেন। তিনি মাঝে মধ্যে ঈশ্বরের বাণী কিংবা স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ শুনতে পান। তিনি অনেক বেশি দেখতে পান, ত্রিকালদর্শী হিসাবে সমস্ত অতীত সমগ্র ভবিষ্যত তাঁর কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তিনি অনেক অসম্ভব কাজ করতে পারেন। পায়ে হেঁটে নদী পার হতে পারেন। হাওয়ায় ভেসে থাকতে পারেন। না খেয়ে দিনের পর দিন বেঁচে থাকেন। জীবনের ওপারে সমাধিস্থ হয়ে থাকেন, আবার কিছু সময় পরে এই নশ্বর পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এরকম বহু গল্প তৈরি হতে থাকে দেশে দেশে। নিজের চোখে প্রত্যক্ষ না করেও লোকে বিশ্বাস করে। ম্যাজিক যুগের সংস্কৃতির নানা রকম বিশ্বাস ধর্মীয় পরিস্রাবনের মধ্য দিয়ে আজ অবধি যতটা টিঁকে আছে তার জোরেই মানুষ এই সব কাহিনিই সত্য বলে ধরে নেয়। তার ফলে অনেকে না হলেও কেউ কেউ সত্যিই চেষ্টা করে এই ক্ষমতা কিছুটা হলেও অর্জন করার।

এই শক্তির ধারণাই এবার চালান হতে থাকে জীবনের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। লোহা থেকে সোনা তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয়। পরশপাথর খুঁজতে থাকে তারা। বয়স ধরে রাখার চেষ্টা চলতে থাকে। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে ঠেকানোর ভাবনা আসে। আত্মা ও জন্মান্তরবাদ অনুযায়ী নতুন করে তো আর কেউ জন্মায় না। আজ যে মরে গেল তার আত্মাই আগামী দিনে আর একজনের শরীরে ভর করে এই দুনিয়ায় ফিরে আসে। তাহলে . . . তাহলে . . . আমার শরীর থেকে যে বা যারা আগামী দিনে জন্ম নিত সে বা তারা যদি আদৌ না জন্মাতে পারে, তাদের আত্মাকে আমার কাছেই পাকাপাকিভাবে ধরে রেখে আমি কি অমর হতে পারি না? ব্রহ্মচর্য, ইন্দ্রিয়সংযম, বীর্যধারণ, তন্ত্রসাধনা, বামাচার — কত ভাবেই না মানুষ চেয়েছে চিরকাল বেঁচে থাকতে। যৌবন ধরে রাখতে, জরা এবং মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখতে।

এই বিশ্বাসের জোরেই কেউ কেউ দাবি করেন, তিনি মৃত বক্তির আত্মাকে নামিয়ে আনতে পারেন। প্ল্যাঞ্চেট-এর আসর বসে দেশে দেশে। আলফ্রেড ওয়ালেস-এর মতো নামকরা বিজ্ঞানীও তাতে যোগ দেন, প্রতারিত হন, তবুও বিশ্বাস করেন। ইউরি গেলারের মতো কেউ আবার দাবি করে বসেন, তিনি দূর থেকে শুধু ইচ্ছা শক্তির জোরে লোহার চামচ বাঁকিয়ে দিতে পারেন। তাপ, আলো, বিদ্যুৎ, চুম্বক, যান্ত্রিক শক্তি, শব্দ, তার সাথে ইচ্ছাশক্তিও যদি পদার্থবিজ্ঞানের সিলেবাসে রাখা যেত, কী মজাই না হত!

স্বামী বিবেকানন্দের কথাই ধরা যাক। তিনি বলছেন, জিতেন্দ্রিয় পুরুষের নাকি অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। একবার পড়লে বা জানলে তিনি নাকি কিছুই আর কখনও ভোলেন না। নিজের উপরেও তিনি এই শক্তির দাবি আরোপ করেছেন। মহেন্দ্রনাথ দত্ত (নরেনের মেজ ভাই) লিখে গেছেন লন্ডনে স্বামীজির এক বক্তৃতার কথা। সেখানে বিবেকানন্দ নাকি বলেছেন: “কিছুকাল ধরে জপধ্যান করলে শরীরের পরমাণু পরিবর্তিত হতে শুরু হয়, তারপর পুরনো পরমাণু পরিবর্তিত হয়ে নতুন পরমাণুর সৃষ্টি হয়, দেহটি যেন সামান্যভাবে বদলে যায়। সাধারণ লোকের দেহ ও যোগীর দেহ ভিন্ন উপাদানে গঠিত। প্রবৃত্তি থেকেই পরমাণুর সৃষ্টি ও স্পন্দন। মনই শরীরের সৃষ্টি করে, যোগীর গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল, কণ্ঠস্বর স্নিগ্ধ ও মধুর, এবং দৃষ্টি স্নেহপূর্ণ ও আকর্ষণীশক্তি সংযুক্ত এবং তাঁর মূর্তি শান্ত ও সৌম্য। তারপর যোগী যখন উচ্চ অবস্থায় ওঠেন, তাঁর দেহ থেকে একটা আকর্ষণী শক্তি বা আভা বের হয়।” পাঠকদের আমি স্বামীজির এই কথাগুলি বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করতে বলছি না। শুধু লক্ষ করতে বলছি, ম্যাজিক যুগের ধ্যান-ধারণাগুলি কীভাবে ঊনবিংশ শতাব্দের শেষভাগেও একজন ব্রহ্মবাদীর মনের পরমাণুগুলিকে দখল করে নিতে পারে।

সুতরাং তাঁর তুলনায় একটু প্রাচীনতর, আধুনিক বিজ্ঞানের জগতেও এই শক্তি ঢুকে পড়ে অতি সহজেই। সেই সুপ্রাচীন যাদুবিদ্যার কারণ-কার্য সম্পর্ক খোঁজার ঐতিহ্য ও পদ্ধতি মেনেই। চুম্বক কীভাবে লোহাকে আকর্ষণ করে? চুম্বক থেকে এক অদৃশ্য তরল নিঃসৃত হয়। তার শক্তিই চুম্বকের আকর্ষণ বল। একইভাবে বিদ্যুতের জন্য এল এক বৈদ্যুতিক তরল। সমসাময়িক কালে দহনের জন্য কল্পিত হল ফ্লোজিস্টন নামক এক অদৃশ্য দাহ্য পদার্থ, যে দহনের বাহক এবং কারক। তাপের জন্য ভাবা হল ক্যালরিক নামক একটি অগোচর তরলের নাম। এইভাবে জৈব পদার্থের জন্য ধরা হল এক অদৃশ্য প্রাণ-শক্তিকে। আর মনের জন্য আত্মা তো বহুকাল আগে থেকে ছিলই। যাদুবিদ্যার মতোই এই ভুল ধারণাগুলিও কিন্তু মানুষকে কিছু কিছু জিনিস সামান্য হলেও বুঝতে বা ধরতে সাহায্য করে। চুম্বকের অন্তরাত্মার শক্তি তাকে শক্ত করে উত্তর-দক্ষিণে আটকে রাখে — এই ব্যাখ্যায় ভুল থাকলেও আপনাকে মাঝ-সমুদ্রে দিক নির্ণয়ে সাহায্য করে বইকি! ঋণাত্মক তড়িৎকে ধনাত্মক ধরে নিয়েই বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিশ্বব্যাপী বিশাল আয়োজন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয়নি।

তবে এও ঠিক, কিছু দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেবার পর আবার এই ভুল যাদুবিদ্যাই বিজ্ঞানের এগনোর পথ রোধ করে দাঁড়াতে থাকে। তখন বিজ্ঞানকে শেষ পর্যন্ত যাদুবিদ্যার গণ্ডি থেকে বেরতেই হয়। বিজ্ঞানীরা তার রাস্তা খুঁজতে থাকেন।

[৫] বিজ্ঞানের মুক্তি

বিংশ শতাব্দে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে অবশেষে বিজ্ঞানের মুক্তি ঘটল। কিন্তু তার জন্য শেষ পর্যন্ত এই সমস্ত অ-বস্তু শক্তির ধারণাকে একে একে হঠিয়ে দিতে হল। এবার সেই প্রসঙ্গ আমরা সংক্ষেপে সেরে নেব।

লোহা চুম্বক হয়, কিন্তু সোনা রুপো তামা পেতল — এরা চুম্বক-ধর্ম পায় না। চৌম্বক শক্তির আধিভৌতিক ক্ষমতায় সন্দেহ দেখা দেয় এর থেকেই। নিউটন বল থেকে শক্তিকে আলাদা করে দিলেন। আঠেরো শতকের শেষে ল্যাভোয়াশিয় এসে অক্সিজেনের সাহায্যে দহনের যে ব্যাখ্যা দিলেন তাতে ফ্লোজিস্টন বেচারার আর কোনো কাজই রইল না। ফরাসি বিপ্লবে ভুলবশত তাঁর শিরচ্ছেদ হতে না হতেই পিয়র সিমোঁ দ্য লাপ্লাস গ্রহ-নক্ষত্রের গতি ব্যাখ্যায় নিউটনের পয়লা গুঁতো-র ধারণাকেও হঠিয়ে দিলেন। ভগবানের আর এই ব্যাপারেও কিছুই করার রইল না। নক্ষত্রবিদ্যার উপর রচিত এক বিশালকায় গ্রন্থে তিনি কোথাও ঈশ্বরের নাম পর্যন্ত নেননি। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে নেপোলিয়ঁ কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হয়ে জানতে চাইলেন, “কী ব্যাপার বিজ্ঞানী? সেই মহামহিমের নাম পর্যন্ত নাওনি কেন?” লাপ্লাস তাতে যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা চিরকালের জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাসে ভগবানের এক কড়া অ্যান্টিবায়োটিক হয়ে রইল: “আজ্ঞে হুজুর, গ্রহ নক্ষত্রের গতি বুঝতে বা বোঝাতে গিয়ে আমার কখনই এই ভদ্রলোকের সাহায্যের দরকার হয়নি! কী আর করা যাবে বলুন!!”

তার কিছু কাল পরেই তাপের তরলকেও বিদায় নিতে হয়েছে। কেন না, বিজ্ঞানী রামফোর্ড লোহার রডকে লোহার করাত দিয়ে কাটতে গিয়ে দেখলেন, দুটোই গরম হয়ে উঠছে। তাহলে তাপের তরল কার থেকে কার দিকে যাচ্ছে? অতএব অন্য ব্যাখ্যা খুঁজতেই হল। বৈদ্যুতিক তরল থেকে বেরনোর জন্য অবশ্য ফ্যারাডের পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আর ততদিনে বিজ্ঞানী হ্বোলারের পরীক্ষায় অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থ তৈরি হওয়ায় প্রাণশক্তিবাদেরও বিদায় বার্তা এসে গেল। এর পর যে আত্মা দিয়ে মনের সমস্ত ব্যাপারের ব্যাখ্যা খোঁজার দিন শেষ হয়ে আসবে, এ আর বেশি কথা কী? ভূতের ভর, সমাধি, দুষ্টশক্তির খেলা — সব একে একে প্রশ্নের সামনে পড়তে লাগল। মন চিন্তা ও ভাষার শারীরিক অবকাঠামোর অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেল। সেই সব ইতিহাসও কলম্বাসের সমুদ্র অভিযানের থেকে খুব একটা কম রোমাঞ্চকর নয়।

তাহলে আজ আবার একদল মানুষ বিজ্ঞান থেকেই আধ্যাত্মিক শক্তির খবর নিচ্ছেন বা পাচ্ছেন কীভাবে? বিজ্ঞান তো সেই সব ধ্যান-বিন্দুর প্রায় সবগুলোকেই তার খেলার মাঠ থেকে একে একে বের করে দিয়েছে। এইখানেই আমরা উপরে উল্লিখিত সেই চার নম্বর প্রশ্নটির উত্তর দিতে বাধ্য হয়ে পড়ি।

সত্যিই কিন্তু ধারণাগুলো বিজ্ঞানে আজ আর নেই। অন্তত প্রামান্য বইপত্রে বা গবেষণা পত্রে নেই। বিজ্ঞানে এগুলি যে একটা একটা করে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অপ্রমাণিত হতে হতে শেষে বর্জিত হয়েছে, তা নয়। অপ্রয়োজনীয় বিধায় বা অসুবিধাজনক লাগায় বিজ্ঞানীদের এগুলো স্রেফ বাদ দিয়ে আসতে হয়েছে। প্রয়োজন পড়লে বা কিছু সুবিধা পেলে এবং অন্য আরও ভালো বিকল্প হাতের কাছে না থাকলে বিজ্ঞানীরাও যে অনেক সময় কিছু কিছু ভুতুড়ে ধারণাকে প্রশ্রয় দেন না এমনটা নয়। যেমন, ইথারের ধারণা। কিংবা, নিউটনীয় মহাকর্ষ-বলের ধারণা, যা যে কোনো দূরত্বে অসীম বেগে ধেয়ে যেতে পারে। এগুলো তখন তত্ত্বকল্প (hypothesis) হিসাবে থেকে যায়। বাড়ি তৈরির সময় দেওয়ালে ফাঁক রেখে ভারা বেঁধে ইট গাঁথার মতো। সমস্ত কাজ হয়ে গেলে একে একে ফাঁকগুলো মিস্ত্রিরাই বুজিয়ে দেন। বিজ্ঞানীদেরও কাজকারবার অনেকটা সেই রকম। ম্যাক্সওয়েল হয়ে আইনস্টাইন পর্যন্ত এসে যখন আলোর তরঙ্গ গতি বোঝার এবং বোঝানোর জন্য ইথার ধারণার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল, তাকে ছেড়ে দেওয়া হল। ওদিকে, জটিল জটিল সব অঙ্ক কষে আইনস্টাইন নিউটনের মহাকর্ষ বলের প্রায়-আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকেও বিজ্ঞানের আঙ্গিনা থেকে একদম ছাঁটাই করে দিলেন। বিকল্প ব্যাখ্যার হাতিয়ার তিনি পেয়ে গেলেন। আমার মতোই যাঁরা অঙ্ক ভালো জানেন না, তাঁদের জন্য সূর্য এখনও পৃথিবীকে টানছে। কিন্তু যাঁরা অঙ্কটা জানেন বা বোঝেন তাঁরা জানেন, এর মধ্যে টানাটানির কোনো ব্যাপারই নেই। সূর্য এবং পৃথিবী যে যার খেয়ালে আছে। তবে এদের যেখানে অবস্থান সেই মহাকাশের চতুর্মাত্রিক জ্যামিতিটা এমন যে সেখানে সূর্যের মতো একটা মহাভারি বস্তুর সামনে পৃথিবীর মতো চুনোপুঁটি এসে পড়লে বেশ কিছু দিন (তা ধরুন, কয়েক কোটি কোটি বছর) ঘুরপাক খাবেই।

আসল কথা হল, বিজ্ঞানে না থাকলেও সমাজে এই সব আধিভৌতিক আধ্যাত্মিক শক্তির ধারণাগুলি রয়ে গেছে। যেমন, জ্যোতিষ শাস্ত্র। সেখানে গ্রহের শক্তি আর পাথরের শক্তির যে ব্যাখ্যান শোনা যায়, তার মধ্যে সেই প্রাচীন মাজিক বিশ্বাসের ছাপ বেশ স্পষ্ট। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানে যে আর সেই সব ধারণার কোনো অবশেষ মাত্রও নেই, তা তো বহু লোকই জানে না। একে তো সকলের মধ্যে শিক্ষা তথা বিজ্ঞান শিক্ষা সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। ফলে ভুল ধারণাগুলির জন্য উর্বর জমি এমনিতেই বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে তৈরি হয়ে আছে। তার উপর সমাজে অন্যায় বৈষম্য শোষণ জুলুম থেকে যাওয়ায় এবং তার হাত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে না পাওয়ায় মানুষ সব সময়ই শর্টকাট খোঁজে। চাকরি না পেলে বা মেয়ের বিয়ে দিতে না পারলে যেমন লোকে জ্যোতিষীর কাছে যায়, আর্থসামাজিক দুঃশাসনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও মানুষ বড় কোনো শক্তির দ্বারস্থ হতে থাকে। সোচ্চারে না হলেও নীরবে, মনের কোনায়। বিজ্ঞানীরাও এই সমাজেই বড় হয়ে ওঠেন। খুব সচেতনভাবে মনের ক্যানভাসে এই সব অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যুক্তিতে শান না দিলে এবং/অথবা সামাজিক ন্যায় ও সাম্যের দাবিতে চলমান সংগ্রামের কোনো না কোনো মঞ্চে যুক্ত হয়ে না থাকলে এই জাতীয় বিভ্রান্তির হাত থেকে কারোরই রেহাই নেই।

শুধু এটুকুই নয়।

সমাজের কায়েমি স্বার্থ, যাদের হাতে সমস্ত প্রতিপত্তি, সমস্ত গণমাধ্যম, সমস্ত প্রকাশনা — তারা কেবল সেই সব চিন্তারই প্রচার প্রসার চায় যার মধ্যে ভূত প্রেত দত্যি দানো আত্মা পরমাত্মা জিন পরী দেবদূত ভগবান — সবাই না হলেও কেউ না কেউ আছে বিভিন্ন মাত্রায়। একেবারে কেউ না থাকলে অন্তত বৈজ্ঞানিক যুক্তিশীলতায় ধন্দ জাগানোর মতো মালমশলা আছে। পক্ষান্তরে যুক্তির পক্ষে, বিজ্ঞানের সঠিক জ্ঞানের পক্ষে কেউ লিখলেও সহজে তাকে ওরা জায়গা ছাড়তে চায় না। যে বিজ্ঞানী বিজ্ঞান থেকে ভগবানের হাত পায়ের ছাপ দেখাতে পারেন তাঁর বেশ প্রচার হয়, বই প্রকাশিত হয়, সেই সব বই প্রচুর বিক্রি হয়। মনি ভৌমিক যে বেশ কিছুকাল যাবত বিজ্ঞান আর অধ্যাত্মবাদের খিচুরি তৈরি করে পরিবেশন করে যাচ্ছেন, অসংখ্য লোক জানে। কিন্তু রিচার্ড ডকিন্স যে ঈশ্বর-বিভ্রান্তি নিয়ে একখানা চমৎকার বই লিখেছেন তা আর কটা লোক জানে? এইভাবে, যিনি বিজ্ঞানের সঠিক তথ্য তুলে ধরেন, বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তিকে ধরে রাখতে চান, তাঁর বই সহজে বেরয় না, প্রকাশক পাওয়া যায় না। আর যে দুচারখানা এরকম বই বেরয় তার আবার তেমন প্রচার হয় না। এই সব নানা কারণে ম্যাজিক সংস্কৃতির উপাদানগুলি আজও সমাজ মননে খুব দৃঢ়মূল হয়ে টিঁকে আছে। আর, বিজ্ঞানের ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক ভাষ্য দিতে গিয়ে কেউ যদি তাঁর বইতে বল, শক্তি, ভরবেগ, আকর্ষণ, পরমাণু, ইলেকট্রন, সূক্ষ্মকণা, ক্ষেত্র, পৃষ্ঠটান, ইত্যাদি শব্দগুলি ব্যবহার করেন [যা অনেকেই করেও থাকেন], সাধারণ মানুষ ধরেই নেন — এই সব বুঝি খোদ বিজ্ঞানেরই অন্দরমহলের কথা। লেখক বোধ হয় বিজ্ঞান থেকেই এই সব ধ্যান-ধারণা একেবারে টাটকা ছেঁকে তুলে এনেছেন। বিজ্ঞানের বল, শক্তি, ক্ষেত্র, কণা, ইত্যাদি সংজ্ঞাগুলি যে অনেক দিন আগেই প্রাচীন যাদুবিদ্যার আনুষঙ্গিক ছাল বাকল ছাড়িয়ে পুরোপুরি আলাদা হয়ে গেছে, সেই খবর তাঁরা অনেকেই রাখেন না। সুতরাং . . .

কিন্তু মনোযোগ সহকারে বিজ্ঞানের প্রামাণ্য বইপত্র পড়লে দেখা যাবে: অধ্যাত্মবাদের পক্ষ থেকে কিছু চাইলেও বিজ্ঞানের তরফে হাত তুলে দিয়ে “ক্ষমা করবেন” বলা ছাড়া ভদ্রতা রক্ষা করার আর কোনো উপায় নেই। যা নেই তা সে দেবে কোত্থেকে?


সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামীজির বাণী ও রচনা, ২য় খণ্ড; ৩য় খণ্ড; ৫ম খণ্ড।
মহেন্দ্রনাথ দত্ত, লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, ১৯৫৫।
অশোক মুখোপাধ্যায়, প্রসঙ্গ ধর্ম: উদ্ভব ও বিবর্তন; ১৯৯২।
James Frazer, Golden Bough; 12 Vols.; 1906-15.
Edward Clodd, Animism: the seed of religion; 1905.
Robert R. Marett, The Threshold of Religion. 1909
George Galloway, Studies in the Philosophy of Religion; 1904.
Joseph Campbell, The Masks of God, 4 Vols. 1962-68.
Plato, Republic
Jane Harrison, Ancient Arts and Rituals, 1913
Richard Dawkins, The God Delusion, 2006.

পুনশ্চ: এই লেখাটিতে ব্যবহৃত শাস্ত্রীয় মন্ত্রগুলি মৃত্যুর (৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪) মাত্র দু মাস আগে, হাসপাতালে যাতায়াতের মাঝের অবকাশে, আমাকে সংগ্রহ করে দিয়েছিল খড়্গপুর শহরের ডি. জগন্নাথ কিট্টু। আমাকে ও বলেছিল, “উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবে অশোকদা; না হলে কেউ ধরতে পারবে না আপনার কথা। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমিই জোগাড় করে দিচ্ছি।” এখন সে আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহণের সীমানা পেরিয়ে অনেক দূরে। তথাপি স্বীকৃতিটুকু দিয়ে রাখা উচিত বলে মনে হল।