0১. মোদী ক্ষমতায় আসার পর ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা আবার মাথা চাঙ্গা দিয়ে উঠেছে। ‘রামরাজ্যে’র স্বপ্নদ্রষ্টারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে দাঙা-হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছে। ইসলামিক মৌলবাদের যন্ত্রণায় হিন্দু মৌলবাদরা অনেক দিন আলোচনায় আসার সুযোগ পায় নি। তবে মোদী ক্ষমতায় এসে তাদের সেই সুযোগটা করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে হিন্দু মৌলবাদীরা পাঁচজন লেখককে হত্যা করেছে। লেখকদের অপরাধ ছিল, তাঁরা গীতা, মূর্তি পূজা বিরোধী ও সমালোচনা করতো। সহজ বাংলায় বললে ধর্মানুভূতিতে আঘাত বা ব্লাসফেমি’র অভিযোগে তাদের হত্যা করা হয়। প্রথমে “রামরাজ্য” কী এবং রামরাজ্য গুরুত্বপূর্ণ হল তা সম্পর্কে কিছু বলে দরকার।
রাজা দশরথ অযোধ্যা নামক ছোট ও নগণ্য এক রাজ্যের রাজা ছিলেন। পরবর্তীতে ভরতের রাজত্বের শেষে রাম সেই রাজ্যে রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এতো ছোট কেন এখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তার উত্তর হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের “রামায়ণঃ খোলা চোখে” বইতে আছে। এছাড়া রামায়ণে রামের চরিত্র বোঝার জন্যে চমৎকার একটি বই। প্রথমে রামায়ণ পরবর্তীতে এই বইটি পড়ার পর সম্ভবত কেউ আর রামের মতন স্বামী প্রত্যাশী হবেন না। প্রাচীনকালে আর্যরা কৃষি বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। কৃষি কাজের জন্যে জমির দরকার ছিল, ফলে বন উজাড় করা নিয়ে স্থায়ী অনার্যদের সাথে আর্যদের বিরোধ তৈরি হয়। আর্যরা অনার্যদের অসম্মানসূচক শব্দে ভূষিত করতেন! তাই তো রামায়ণে বানর, হনুমানের মতন উপাধিপ্রাপ্ত চরিত্রগুলো মানুষের মতন কথাবার্তা ও বীর ছিলেন। আর্যপুত্র রামও কৃষি কাজ জানতেন, তাই তো রামায়ণে আছে শাপগ্রস্তা অহল্যা পাষাণী হয়ে পড়েছিল। রামের পদস্পর্শে অহল্যা প্রাণ পেলেন। অহল্যা কথাটির অর্থ হল যেখানে হল চলে না। অর্থাৎ পতিত জমি।
হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলছেন, “রামরাজ্য” কথাটি রামের সমসাময়িক কালেও ততটা প্রাধান্য পায়নি। এমনকি মহাভারতের যুগেও এর কোন প্রাধান্য ছিল না। মহাভারতে “রামোপাখ্যান” আছে কিন্তু “রামরাজ্যের“ কোন উল্লেখ নেই। রামরাজ্যের কথা প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে গুপ্তযুগ থেকে এবং এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। গুপ্তযুগে “রামরাজ্য” কথাটি প্রচারে বিশেষ কারণ ছিল। গুপ্তযুগ ছিল হিন্দুধর্মের পুনরভ্যুত্থানের যুগ। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের তীব্র বিরোধ তখনও শেষ হয়ে যায়নি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক ছিলেন বৌদ্ধ। হিন্দুদের এমন কোন রাজা ছিলেন না। যিনি অশোকের সমপক্ষ হতে পারেন বা তাঁর ধারে কাছেও পৌঁছুতে পারেন। ধর্মরাজ্যের নায়ক মহাভারতের যুধিষ্ঠির দ্যূতাসক্ত ও অন্যান্য বহু দোষযুক্ত। রাজা হিসেবেও তিনি উল্লেখযোগ্য কোন র্কীতি স্থাপন করতে পারেননি। সুতরাং হিন্দু ধর্মের পুনরভ্যুত্থানের যুগে অশোকের সমকক্ষ আদর্শ রাজা হিসেবে রামচন্দ্রকে বেছে নেওয়া ছাড়া হিন্দুদের গত্যন্তর ছিল না। এই নির্বাচনে অশোক ও রাজচন্দ্রের জীবনের একটি সাদৃশ্য বিশেষ সহায়ক ছিল। অশোক কলিঙ্গ দেশ জয় করেছিলেন অস্ত্রের সাহায্যে এবং সিংহল (লঙ্কা) বিজয় করেন মিত্রতার মাধ্যমে। বিপরীতভাবে, রামচন্দ্র কিষ্কিন্ধ্যা জয় করেন মিত্রতার মাধ্যমে এবং লঙ্কা অস্ত্রের সাহায্যে। আর এভাবেই রাজরাজ্য নামক একটা স্বপ্নরাজ্যের গোড়াপত্তন হয়।
ধর্মীয় রাজনীতি মূল দর্শন-ই হল ফ্যাসিবাদ। তবে আধুনিক ফ্যাসিবাদের শব্দের উৎপত্তি ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের হাত ধরে। ফ্যাসিবাদ মনস্তত্ত্বের লক্ষণগুলো হল- নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা, নিজেদের অতীত ইতিহাসের যুগে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা, ভিন্ন গোত্রের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা, নিজেকে ছাড়া সবাইকে সন্দেহ করা। হিটলার, মুসোলিনিরা ইতিহাসের যতোই ঘৃণ্য স্থানে অবস্থান করুক না কেন ধর্মীয় নেতাদের কাছে তারা পূজনীয়। কারণ ফ্যাসিবাদীরা তো ফ্যাসিবাদের রাজাদের সেবক হবেন ঈশ্বরের এটাই তো নিয়ম!
০২. বাংলাদেশে অনেকের কাছে হিটলার একজন আইকন। ব্যাটার মোরদ আছে কারণ সে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে দাস বানিয়েছে, হত্যা করেছে। তেমনি ভারতের ধর্মীয় নেতাদের কাছেও হিটলার সমানভাবে পূজনীয় কারণ; হিটলার আর্য মতবাদ দিয়েছেন, রক্তের বিশুদ্ধতা শিখিয়েছেন, অন্যদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন। বাংলাদেশ, ভারতের মৌলবাদী নেতাদের মতন পাকিস্তানের মৌদুদীও হিটলারের ভক্ত। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ভারতের সাম্প্রদায়িক দল ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’ সংক্ষেপে আরএসএস। ভারতে সাম্প্রদায়িক দল আরএসএস এর কথা বলা আগে আরএসএস ও সেই দলের নেতাদের ইতিহাস একটু জেনে নিই।
১৯২৫ সালে ভারতে কেশব বলিরাম হেডওয়ার (Keshav Baliram Hedgewar) দলটি গঠন করেন। তিনি মারাঠি ছিলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সময় তিনি যোগ দেন ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে একটি দলে। অনুশীলন সমিতি গঠন করেছিলেন সতীশচন্দ্র বসু। অনুশীলন নামটি গৃহীত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস থেকে। বঙ্কিমন্দ্র শিক্ষিত হয়েও কট্টর হিন্দু ছিলেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহেরও বিপক্ষে ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দমঠ’ বইতে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার কথা বলেন। বলিরাম হেডওয়ার বঙ্কিমদন্দ্রের হিন্দু রাষ্ট্রের কথা মাথায় রেখে মহারাষ্ট্রে নাগপুর শহরে গড়ে তোলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। সেখান থেকে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। পরবর্তীতে এই দলের নেতৃত্ব আসেন মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার (Madhav Sadashiv Golwalkar)। গোলওয়ালকার শুধু আরএসএস এর নেতাই নন তিনি আর এস এসের গুরুজী। গোলওয়ালকার ছিলেন হিটলারের অনুরাগী। ইহুদি নিধনের জন্য তিনি হিটলারের অনুরাগী হোন নাই তিনি অনুরাগী হয়েছেন হিটলারের আর্যবাদের ধারণার কারণে। তাই পরবর্তীতে গোলওয়ালকার বলেন হিন্দুরা হলো আর্য। আর তাই হিন্দুরা হোল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। তাদের আছে বিশ্বকে শাসন করার অধিকার এ হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ১৯৪০ এর দশকের পরিণত আদর্শ।
তবে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির স্রষ্টা বিনায়ক দামোদর সাভারকার। ১৯২৩ সালে তিনিই প্রথম ‘হিন্দুত্ব’ প্রবন্ধের ভাববস্তু হিসেবে এই শব্দটি উদ্ভাবন করেন। অনেকে এখনও এটিকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে একাসনে বসালেও, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী রামতীর্থরা কিন্তু কোনও দিন হিন্দুত্ব শব্দটি ব্যবহার করেন নি। হিন্দুত্ব প্রকৃতপক্ষেই একটি রাজনৈতিক দর্শন যেমন আমাদের উপমহাদেশে আছে- মুসলমানিত্ব। মূলত ধর্মের সঙ্গে এর সরাসরি কোনও যোগ নেই। মজার বিষয় হল, এই ‘হিন্দুত্ব’ ধারনার প্রবক্তা সাভারকার নিজেই ছিলেন নাস্তিক। ধর্ম বা দর্শন চর্চার জন্য তাঁর একবিন্দুও সময় ছিল না।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আলোচনা— প্যালেস্টাইনের পার্টিশন প্রস্তাব গৃহীত। সেদিন সদ্য-স্বাধীন ভারত-ই ছিল আরব দেশগুলির বাইরে একমাত্র দেশ, যারা ১৯৪৭সালে প্যালেস্টাইন ভাগের বিরোধিতা করেছিল। ১৯৪৭সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্যালেস্টাইনের পার্টিশনের বিরুদ্ধে সগর্বে ভোট দেয় ভারত। আর সেদিন ভারতের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি দ্ব্যর্থ-হীন ভাষায় ইহুদীদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, তিনি বিনায়ক দামোদর সাভারকার। সাভারক ইহুদিদের ভালোবাসতো বিষয়টি তা নয় বরং আরব মানেই তার কাছে ধারনা ছিল মুসলিম। এমনকি প্যালেস্টাইনে যে খ্রিস্টানও আছে সেটি তার বিবেচনার বিষয় ছিল না। আরব মানেই মুসলিম এই ছিল তার ধারণা।
০৩. রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের লক্ষ্য হলো,দক্ষিণ এশিয়াকে একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ পরিণত করা। সংগঠনটি কতোটা উগ্র ও ফ্যাসিবাদ লালন করে তা গান্ধী হত্যার মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণ হয়। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লির এক প্রার্থনা সভায় নাথুরাম বিনায়ক গডসে নামের একজন আরএসএস সমর্থক মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীকে (মহাত্মা গান্ধী) গুলি করে হত্যা করে। সেসময় গান্ধী দিল্লি এবং অন্যান্য জায়গার হিন্দু ও মুসলমানের দাঙ্গা বন্ধের জন্য প্রার্থনা করছিলেন । গডসে হাতেনাতে ধরা পড়ে। গডসেকে বিচার করে প্রাণদণ্ড প্রদান করা হয়। আরএসএসকে ঘোষণা করা হয় বেআইনি দল হিসেবে। হিটলার ভক্ত গোলওয়ালকার বলেন, আরএসএস আর কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত থাকবে না। তার কার্যকলাপ সীমিত থাকবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে। পরবর্তীতে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। আরএসএস মুসোলিনির কিংবা হিটলারের ফ্যাসিস্ট দলের মতন খুবই শক্তিশালী সংগঠন। ১৯৬২ সালে চিন-ভারতের যুদ্ধের সময় সীমান্তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারতের যুদ্ধে দিল্লীর রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণয়ে সহযোগিতা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা অবস্থান করে নেয় এই দলটি। ভারতজুড়ে ৬০ হাজারের উপর আরএসএস এর শাখা রয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজশাহীতে এক সময় আরএসএস যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। পাকিস্তান হওয়ার পরও ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে আরএসএসের শাখা ছিল। আরএসএসের ছেলেরা ব্যায়াম চর্চা ও প্যারেড করত পদ্মা নদীর ধারে একটা দোতলা পোড়ো বাড়িতে। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন পদ্মা পার হলেই কিন্তু ভারত।
০৪. শুরুতেই বলেছিলাম ফ্যাসিবাদ কায়েম করার জন্য ফ্যাসিস্টরা অতীতে ফিরে যেতে চায়। যেমনটি যেতে চায় ভারতের আরএসএস। সংগঠনটি ‘রামরাজ্যের’ কথা বলে। ভারতের উত্তর প্রদেশের, ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলের উপর অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ হল- বাবরি মসজিদ। রামরাজ্য গড়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। হিটলার যেমন ইহুদিদের বেছে নিয়েছিল ঠিক তেমনি হিন্দুত্ববাদীরা বেছে নিয়েছে মুসলিমদের। তাই হিন্দুত্ববাদীদের নায়ক হয় তারা, যারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয় বরং যুদ্ধ কিংবা সংগ্রাম করেছিল মুসলিমদের বিরুদ্ধে কিংবা মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে। ক্ষুদিরাম কিংবা সূর্যসেন, ভগৎ সিং তাদের হিরো নয় তাদের হিরো কিংবা নায়ক হলেন- রানা প্রতাপ, গুরু গোবিন্দ, শিবাজী প্রমুখ। ইসলামিক মৌলবাদ কিংবা হিন্দুত্ববাদের নেতারা বিদেশী কিংবা পশ্চিমী শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ঘৃণার চোখে দেখলেও হিটলার মুসোলিনি’র আদর্শকে গ্রহণ করতে তাদের একটুও বিলম্ব হয় না। গোলওয়ালকায় পশ্চিমা সংস্কৃতি ঘৃণা করে রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখলেও মুসোলিনি ও হিটলার থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন- দুনিয়ার এই সমস্ত চালাক জাতিগুলোর (ইতালি, জার্মানি) কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভারতবর্ষে যে সকল অহিন্দু মানুষ থাকবে তাদের অবশ্যই হিন্দু কৃষ্টি এবং ভাষা গ্রহণ করতে হবে। অবশ্যই হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে হবে। হিন্দু জাতি’র আদর্শ মহিমান্বিত করা ছাড়া অন্য কোন ধারণাকে তাদের মানা চলবে না। এখানে থাকতে হলে তাদের কোন কিছু দাবী-দাওয়া ছাড়াই থাকতে হবে। গোলওয়ালকার কিংবা আরএসএস-এর ভারতে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিমদের যেভাবে ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ হিসেবে দেখতে চাইছে, ঠিক সেভাবেই আরব ও প্যালেস্টাইনদের দেখে থাকে ইজরায়েল। ইজরায়েলের মূল ভূখণ্ড এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে বসবাসকারী প্যালেস্টাইনদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ বলেই গণ্য করেন জায়নবাদীরা।
সাভারকার, গোলওয়ালকার থেকে মোদীর মতন ফ্যাসিস্টরা হিটলারকে এবং একই সাথে ইহুদিবাদকে সমর্থন করেন। এর একটাই কারণ তারা একই চরিত্রের ফ্যাসিস্ট। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদি তার জীবনীতে হিটলারকে তিনি প্রেরণা মনে করেন। বর্তমানে ভারত-ইসরাইলের সম্পর্কে নেই ফ্যাসিবাদের সুতোয় বাঁধা। গান্ধী প্যালেস্টাইনের মানুষের পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডের পক্ষে সওয়াল করেছেন, তেমনই নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে বরাবর প্যালেস্টাইনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভারতের বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এতোটুকু হলফ করে বলা যায় যে কয়েক বছরের মধ্যে মোদী ইসরাইল সফরে যাবেন। ১৯৯২ সালে ভারতে ইসরাইলের পূর্ণ দূতাবাস খোলার পর এই প্রথম মোদী সরকারের কারণে ভারতের সাথে ইসরাইল রাষ্ট্রের সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হয়।
হিটলারের জমানায় হিটলার ঘোষণা করলেন যে জার্মানরা যেহেতু বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী সেহেতু যুদ্ধে আহত কোন সৈনিক যেন ইহুদিদের রক্ত না নেয়। কারণ এতে রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হবে। এর জন্য জার্মানে রক্তের বিশুদ্ধ রক্ষার আইন জারি হয়। এই একই ধ্যান-ধারণা পাই আরএসএস এর মধ্যে। তারাও হিন্দু রক্তের বিশুদ্ধতার জিকির করছে। আর এই বিশুদ্ধতা নষ্ট করার দোষ চাপাচ্ছে মুসলিমদের উপর ঠিক যেমনটি হিটলার ইহুদিদের উপর চাপিয়েছেন। ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য যে করেই হোক অন্যগোত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরী। এর জন্য ধর্মের ব্যবহার করা হয়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ধর্মেই ফ্যাসিবাদের শিকড়। হিটলার ইহুদী বিদ্বেষ তৈরি করার জন্য প্রচার করতে থাকেন যে, ইহুদিরা ঈশ্বরপুত্র জিশু’কে মেরেছে সুতরাং এই খেসারত বর্তমান প্রজন্মকে দিতে হবে, এবং দিতে হয়েছিল। হিটলার বলেন- আজ আমি যা করছি (ইহুদি নিধন) সেটা সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছানুসারেই করছি। ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আমি ঈশ্বরের সৃষ্টিকেই রক্ষা করছি। ভারতের উগ্রবাদী দলগুলো তাদের গুরু হিটলারের পথই অনুসরণ করছে। তারা তাদের বিভিন্ন পুস্তকে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের ফলে রক্তের বিশুদ্ধতা হারানো, ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংস হওয়া, মুসলিম শাসকদের অত্যাচারের কথা বর্ণনা করে মুসলিম বিদ্বেষ চাঙ্গা করার চেষ্টায় আছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ফ্যাসিস্টরা হিটলার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার আরেকটি কারণ জানা যায় উপমহাদেশের আরেক ফ্যাসিস্ট ও জঙ্গি সংগঠন জামাতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর বক্তব্যে। তিনি বলেন- “আপনারা কি জানেন কেন তারা (হিটলার,মুসোলিনি) সফল হয়েছিল? দু-টো দেশেই, দু’টো ক্ষেত্রেই একই ধরণের দুটো কারণ আছে। এক. বিশ্বাস। দুই. আমির বা নেতাদের বিনা শর্তে মানা এবং তার কথাকেই চরম আদেশ বলে গ্রহণ করা।’’ তবে ধর্মীয় কিতাব কিংবা নেতাদের ফ্যাসিস্ট ধারণাটি তারা মূলত পেয়েছে ঈশ্বরের কাছ থেকে। ঈশ্বর অমান্যকারী’কে, দ্বি-মতকারীকে পছন্দ করেন না। তা সে তাঁর যতো প্রিয় হোক না কেন। আমরা সকলেই জানি ঈশ্বরের কথা অমান্য করায় ফেরেশতাকে স্বর্গ থেকে বিতারিত করা হয়েছিল। এটাই ঈশ্বরের ফ্যাসিস্ট চরিত্র!
০৫. ইতোমধ্যে ভারতীয় কট্টর ধর্মীয় নেতারা স্পষ্টভাষায় মুসলিমদের বলে দিচ্ছেন যে, ভারতের থাকতে হলে গরু’র মাংস খাওয়া ছাড়তে হবে। অথবা থাকতে হবে প্রজার ন্যায় তাদের দয়ার উপর। এর অর্থ হল; ভারতে মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ছাড়া অন্য কিছু তারা মনে করে না। ইতোমধ্যে ধর্মান্তরিত-করণের মতন ঘটনা ভারতে ঘটে গেছে। আরএসএস ধর্মান্তরিত-করণে কর্মসূচী’র নাম দিয়েছে- ‘পুরখো কে ঘর ওয়াপসি!’ মুসলিম-খ্রিস্টানদের ‘ঘরে ফেরার কর্মসূচি’ ফ্যাসিবাদের সেই রক্তের বিশুদ্ধতা, জাতির বিশুদ্ধতার ধারণা থেকেই ‘শুদ্ধিকরণ’ নামক বেআইনি কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় ‘ধর্মাচরণ, ধর্মীয় বিশ্বাস বেছে নেওয়া ও অনুসরণের অবাধ অধিকার এবং ধর্মীয় প্রচারের স্বাধীনতা’ স্বীকৃত হয়েছে। বলপূর্বক ধর্মান্তরের কোনো ঘটনা ঘটলে তা ইতোমধ্যেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩(এ) উপধারায় আনার সংস্থান রয়েছে। এই উপধারা অনুযায়ী ধর্মের নামে বলপ্রয়োগ করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, একশ বিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষে এক আরএসএস হয় তো পুরো ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে সক্ষম হবে না। তাদের স্মরণ রাখা উচিত মুলোলিনি’র পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র চার লাখ। রোমের সড়ক ধরে তারা যখন অভিযান শুরু করে, তারা ছিল মাত্র তিন লাখ। এই তিন লাখ লোকই মাত্র কয়েক মাসে সাড়ে চার কোটি (তৎকালীন জনসংখ্যা) লোককে পদানত করে ফেলে। তাই আরএসএস এর কার্যক্রম দেখে এতোটুকু হলফ করে বলা যায় যে, শুধু ভারত বর্ষে নয় এই ফ্যাসিবাদ আচরণ ও ধ্যান-ধারণার কারণে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও হিংস্র হয়ে উঠবে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আরও হুমকির মধ্যে পতিত হবে। আরএসএস নতুন কোন মত বা দল নয় বরং হিটলারের নাৎসি বাহিনী’র ভারতীয় সংস্করণ মাত্র!
তথ্য-সহায়তায়-
হিন্দুত্বের ইজরায়েল দর্শন- শান্তনু দে
মেইন ক্যাম্প- আডলফ হিটলার
মনু মহম্মদ হিটলার- আজিজুল হক
রামায়ণঃ খোলা চোখে – হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ইতিহাস-এবনে গোলাম সামাদ
@ যুক্তিবাদী
‘মুসলমান ভোট খুব ইম্পর্টান্ট ” – (হিন্দু ভোট ইম্পর্টান্ট নয়। কারণ হিন্দু ভোট বোধহয় polarised নয়।) তা হলে বোঝাই যাচ্ছে হিন্দু ভোট polarisation এর জমি তৈরী আছে।
“ আমার মনে হয় কেবল একটা মিরাকেলই এখন ভারতকে বাঁচাতে পারে |”
– যুক্তি বাদী লোক মিরাকেল বিশ্বাস করে না। বলতে পারেন অজানা কোনো ঘটনা ভারত কে ফ্যাসিবাদ থেকে বাচাতে পারে। আসুন যুক্তির উপর দাড়িয়ে অনুমান করি কি সেই ঘটনা হতে পারে।
আমার মনে হয় কেবল একটা মিরাকেলই এখন ভারতকে বাঁচাতে পারে |
সময়োপযোগী লেখা। ভারতে ফ্যাসিবাদী উত্থান হবে কিনা সেটা সময়ই বলবে। তবে তেমন একটা আশংকা সৃষ্টি হয়েছে সে কথা রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখের্জির মুখেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ভারতে ফ্যাসিবাদী উত্থানের পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো সেটাই মুখ্য। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও ভারতের সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতা ধরে রাখতে মৌলবাদের সাথে আপোষ করেছে। বলা বাহুল্য সেটা মুসলমান মৌলবাদ (BJP বাদে ) এমন কি তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরাও হিন্দুমুলোবাদের উত্থানের ব্যাপারে যতটা সোচ্চার মুসলমান মৌলবাদের ব্যাপারে ততটাই নিশ্চুপ। সম্প্রতি তসলিমা টাইমস অফ ইন্ডিয়া তে সে কথা মুক্ত কন্ঠে প্রকাশ করে দিয়েছে। হিন্দু মৌলবাদ নানা সময় (গ্রাহাম স্টেইনস , মকবুল ফিদা হুসেন ইত্যাদি ) ছোবল মারলেও সেটা বেশি ছড়াতে পারত না যদি ইসলামী মৌলবাদের ছোবলকে মুক্ত কন্ঠে নিন্দা করা যেত। কিন্তু মিডিয়া থেকে আরম্ভ করে রাজনৈতিক দল, এমনকি শিল্পী, সাহিত্যিক সবাই মুসলমান মৌলবাদের সম্পর্কে মৌনতাকে শ্রেয় মনে করেছে। তার বড় প্রমান তসলিমার উপর যখন আক্রমন নেমে আসলো তখন কেউ তার পাশে থাকে নি। আর একটা কথা বলতেই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়তে এই দেশে মুসলমানরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। (এক জন সংসদ পার্লিয়ামেন্তে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন উঠে চলে গেল এই বলে যে সে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করবে না) আশ্চর্য ! পাকিস্থান, বাংলাদেশে কি জাতীয় সঙ্গীত নেই ? অথচ এই ব্যাপারে ওই সংসদকে কেউ নিন্দা করলো না ) হা হুতাশ না করে কারণ খুঁজে তার প্রতিকার করাই জরুরি।
আসলে সমস্যাটা হচ্ছে ভারতে লোকে বড় বেশি ধার্মিক | ধর্মের কিছু বুঝুক না বুঝুক সেই বিষয়ে তার কিছু নিজস্ব মত আছে আর যদি কেউ সেই মতকে চ্যালেঞ্জ করে তখনই সে হয়ে যায় ঘৃণার পত্র | সে ভোট পায় না | সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলি নিশ্চুপ | বুদ্ধিজীবিরা রাজনৈতিক দলের ভাড়াটে কলমচি মাত্র | তাই তারাও চুপ |
মুসলিম ভোট খুবই ইম্পর্টান্ট | তাই মুসলমানের বেলায় সবাই চুপ |
আর এস এস একটা স্ববিরোধী প্রতিষ্ঠান | একই সঙ্গে এরা হিটলারকে পুজো করে আবার ইহুদীদেরও পুজো করে | হিটলার ইহুদিদের শত্রু ছিল , কিন্তু আর এস এস হিটলারের পুজারী আর ইহুদিদের বন্ধু : এটা বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার |
আর এস এসের হিটলার প্রীতির কথা ইসরাইলকে জানিয়ে যদি ইহুদিদের আর এস এস থেকে আলাদা করা যায় , তাহলে সেটা একটা বড় জিত হবে |
লেখাতেই উল্লেখ করেছি, ইহুদীদের মারার জন্য তারা হিটলারকে পছন্দ করে না। তারা হিটলারকে পছন্দ করে হিটলারের আর্যমতবাদের জন্য।
সুব্রত
এই লেখাটার জন্য বেশ কিছু ইসলামোফোবিয়াতে ভোগা লোকজনের চক্ষুশুল হবেন আপনি 🙁 , বাংলা ভাষায় বিশেষ করে অনলাইনে ইসলামোফোবিয়াতে ভোগা লোকজনের বেশিরভাগই আরএসএস অথবা ইসকন এর সদস্য, নাস্তিক ওয়েবসাইট বা তসলিমা নাসরিনের স্ট্যাটাসগুলোতে মন্তব্যকারীদের ব্যাকগ্রাউন্ড একটু ঘাটলেই এদের চরিত্র বেরিয়ে আসে।