আমার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু ইদানীং আমাকে খুব বিনীতভাবে অনুরোধ করছে-আমি যাতে ব্লগে লেখালেখি বন্ধ করি। আমি বুঝি তাদের এ উৎকণ্ঠার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। ধর্মীয় জঙ্গীবাদীরা ইদানীং একে একে তালিকা করে ব্লগারদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করছে।
বিগত ২৬ ফে্ব্রুয়ারী,২০১৫, ঢাকার বই মেলা দেখতে আসা মুক্তমনা ওয়েব-সাইটের প্রতিষ্ঠাতা, বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে বই মেলা প্রাঙ্গণে কুপিয়ে হত্যা করেছে জঙ্গীরা। তার স্ত্রী ও সহলেখিকা বন্যা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছে।
সুদীর্ঘ মাসাধিক কাল অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রশাসন খুনীদের ধরতে পারে নি। অথচ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের এক মাসের মধ্য আবারো একই কায়দায় খুন করা হয়েছে এক তরুণ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। এবার গুটিকয়েক মানুষের সাহসী ভূমিকার কারণে দুই জন খুনী হাতেনাতে ধরা পড়েছে । অতি সম্প্রতি একই কায়দায় খুন করা হয়েছে-তাও চাপাতি দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে-আরেক তরুন ব্লগার ও মুক্তমনার অন্যতম লেখক অনন্ত বিজয় দাশকে। পরবর্তী ক্রমিক কে? খুনীরা তো তালিকা করে এক এক জনকে খুন করে যাচ্ছে ।
খুন হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে-আমি তখন ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম-অভিজিৎ এর সাথে ফেইস বুকে বার্তা বিনিময় করি। সে বার্তায় আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম-কিছু দিন থেকে বাংলাদেশে মুক্তমনা ওয়েব-সাইটটি ব্লকড পাওয়া যাচ্ছে। এটা কি কোন টেকনিক্যাল সমস্যা, নাকি সরকার ব্লক করে দিয়েছে। অভিজিৎ তাৎক্ষণিক আমার বার্তার জবাবে লিখেন-সরকার বন্ধ করতে পারে, আপনি প্রক্সি সার্ভারে চেষ্টা করুন, দেখা যাক কি করা যায়।আমি তখনো জানতাম না, অভিজিৎ সস্ত্রীক ঢাকায়। কয়েক ঘন্টা পর আমার ছোট ভাই নাছির আলম আমাকে ফোন করল আবুধাবির রুয়াইস থেকে। সে আমাকে জানাল-অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছে।
আমি বিস্ময়ের সাথে তাকে বললাম-অভিজিৎ তো আমেরিকায়। সে বলল-বই মেলার জন্য তিনি ঢাকা গেছেন। কিছুক্ষণ পূর্বে তাকে বই মেলা প্রাঙ্গনে খুন করা হয়েছে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে। তার বউ বন্যাও মারাত্মক ভাবে আহত। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার মোবাইলে বার্তা আসল-ব্লগার অভিজিৎ রায় ইজ হ্যাকড টু ডেথ। স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার বারংবার কেন জানি মনে হচ্ছিল-অভিজিৎ যেন আত্মহত্যা করল-কেন সে সুদূর আমেরিকা থেকে এদেশে আসল-যে দেশে কিছু ধর্মোম্মাদ বর্বর খুনী চক্র একে একে আলোকিত মানুষদের খুঁজে খুঁজে খুন করছে? মুক্তমনার চলমান যে আন্দোলন, তাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অভিজিতের খুব প্রয়োজন ছিল। অভিজিতের মত লেখককে হারানোর এ শূণ্যতা যে পূরণ হবার নয়। মুক্তমনার আন্দোলন যে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল।
মুক্তমনা ওয়েব সাইটে আমিও একজন তালিকাভূক্ত লেখক-এ ওয়েব সাইট এ আমারও একটি ব্যক্তিগত ব্লগ আছে । সে ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধ সংকলিত করে ২০০৭ ইং সালে আমি-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ-শীর্ষক একটি প্রবন্ধ সংকলনও প্রকাশ করেছি। নিজস্ব ব্লগে লেখার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল- এখানে যখন তখন লেখা যায় এবং লেখা মুদ্রণ করার কোন ঝামেলা নেই। তাই যখনি কোন চিন্তার উদ্রেক হয়, নিজস্ব মত প্রকাশের তাগিদ অনুভব করি, তখনি আমি ব্লগে লিখি। খুব বেশী লোক যে এ লেখা পড়ে, তা কিন্তু নয়। সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৭০০ লোক আমার কোন কোন লেখা পড়েছে। কেহ কেহ আবার মন্তব্যও করেছে। কারো কারো মন্তব্যে পুনরায় লেখার অনুপ্রেরণা পাই, আবার কারো মন্তব্যে নতুন করে ভাবার তাগিদ অনুভব করি।
আমার ব্লগে আমি কী নিয়ে লিখি?
আমি একাত্তুরের একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। আমি আমার মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন নিয়ে লিখি। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে লিখি। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা নিয়ে লিখি। আমার সব লেখার একটি লক্ষ্য থাকে-আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণ ও দুর্নীতি মুক্ত সেক্যুলার বাংলাদেশ চাই। আমি দেশের আম জনগণের আর্থ-সামাজিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি চাই। এ চাওয়ার অধিকার আমার জন্মগত। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমার এ চাওয়ার সাথে একমত পোষণ না করার অধিকারও যে কারো আছে। আমি তাকে চাপাতি দিয়ে কোপানো দূরের কথা-তার নাকে কোন দিন একটি ঘুষি মারতেও প্রস্তুত নই।
ধর্ম সম্পর্কে আমার অভিমত অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আমি মনে করি-ধর্মের মূল ভিত্তি বিশ্বাস এবং একমাত্র বিশ্বাস। মানুষের এ বিশ্বাস যুগে যুগে পরিবর্তন ও পরিমার্জন হয়েছে।হতে বাধ্য। কারণ প্রত্যেকটি ধর্ম বিশ্বাস একটি বিশেষ কালের সৃষ্টি। কাল প্রবাহমান। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের জীবন পাল্টায়-জীবনাচরণ ও জীবনের চাহিদা পাল্টায় । তাই সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে । দুনিয়াতে আজ ছোট বড় মিলিয়ে ধর্মের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশী। আবার কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না এমন লোকে সংখ্যা আজ বিশ্বে ধর্ম বিশ্বাসীদের তুলনায় তৃতীয় স্থানে। সকল ধর্মের বিশ্বাস যদি একই রকম হত, তাহলে এতগুলো ধর্মের জন্ম হত না। মজার ব্যাপার হল এই যে, এতগুলো ধর্ম বিশ্বাস-তারা আবার একটি আরেকটিকে নাকচ করে দেয়। তাই বিশ্বে বিরাজমান ধর্মগুলোর কোন ধর্মই তার শ্রেষ্টত্বের দাবী পরিহার করে নি। প্রত্যেক ধর্মই দাবী করে-সে ধর্মই একমাত্র সহী এবং শ্রেষ্ট ধর্ম, আর বাকীগুলো বাতিল।
যেহেতু এ দ্বন্দ্ব কেবল বিশ্বাসের, সেহেতু যার যার বিশ্বাস নিয়ে সে সে থাকুক, এ সহজ নীতিটি মানলেই বিশ্বের মানবগোষ্ঠী পরম শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। ধর্মের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল-প্রায় প্রত্যেক ধর্মই কেবল পরকালে বিশ্বাস করে না, অধিকন্তু পরলৌকিক মুক্তি বা মোক্ষ লাভই ধর্মের মুল লক্ষ্য বলে দাবী করে।
তাহলে বহু ধর্মে বিভক্ত মানুষের এ বিশ্ব সমাজে-যার যার ধর্ম তার তার-এ অবস্থান নিয়ে শান্তিপুর্ণ ভাবে বসবাস করতে হলে, আমাদের সামনে একটি মাত্র উপায় আছে-তাহল ইহজাগতিক বিষয়ে বিশেষ কোন ধর্মের অনুশাসন চাপিয়ে না দেওয়া। তাতে ধর্মও বাঁচে, ধার্মিকও বাঁচে।
পক্ষান্তরে আমরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোন ধর্মীয় অনুশাসনকে ইহজাগতিক জীবনে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করি, অর্থাৎ ধর্মীয় আইন-কানুনকে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করি, তাহলে যেখানে যে ধর্মানুসারী সংখ্যাগরিষ্ঠ-সেখানে সে ধর্মকেও সে অধিকার দিতে হবে। ফলত: সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সকল ধর্মের অনুসারীরা কম বেশী ভিন্ন ধর্মের অনুশাসন ধারা নিগৃহীত হবে। এ অতি সহজ বিষয়টা আমরা কেন বুঝব না।
ধর্মের ব্যাপারে আমার আরো একটি উপলব্ধি আছে। আমি মনে করি-আগুনের ধর্ম যেমন জ্বলা, পানির ধর্ম যেমন সিক্ত করা, তরবারির ধর্ম যেমন কাটা, মানুষের ধর্মও তেমনি মনুষ্যত্ব । এর চেয়ে বড় কোন ধর্ম হতে পারে না। বিশ্বে যুগে যুগে মানুষের জন্য ধর্ম এসেছে, কিন্তু ধর্মের জন্য মানুষ আসে নি। অর্থ্যাৎ আগে মানুষ ও মনুষ্যত্ব, পরে ধর্ম। আমরা যদি এমন একটি বিশ্বের কল্পনা করি, যেখানে কোন মানুষ নেই, সেখানে ধর্ম কোথায় থাকবে? মানুষইতো ধর্মকে(উপসনা ধর্ম) ধারণ করে। অবশ্য অনেক ধর্মবেত্তাদের বলতে শুনি-ধর্মের জন্য নাকি মানুষের আগমন । অতিসাধারণ যুক্তিতেও এ ধারণা ঠিকবে না।
ব্লগে যারা লিখেন-তারা সবাই নাস্তিক-এ ধারণাটি সর্বৈব মিথ্যা। ব্লগে বিভিন্ন ব্যক্তি ধর্ম প্রচারও করে থাকেন কিংবা ধর্মের কোন মাহাত্ম্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন। আবার ধর্মের নামে প্রচলিত নানা লোকজ কুসংস্কার বা অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তিবাদীরাও লিখে থাকেন। কারো লেখা আমার পছন্দ না হলে, আমি না পড়তে পারি, কিংবা তার লেখার সমালোচনায় পাল্টা লেখা লিখতে পারি, তার লেখার উপরও ভিন্ন মত পোষণ করে মন্তব্য করতে পারি। কিন্তু তার সাথে একমত হতে না পারলে তাকে খতল করে ফেলব-এ ভাবনা যাদের মাথায় আসে, তারা বস্তুত: বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বৈ কিছ্ইু নহে। তারা অজ্ঞ, মুর্খ, বর্বর অন্ধকারের জীব । তাদের ঘৃণা নয়, কেবল করুণা করা চলে।
এ কথা আজ বলা বাহুল্য যে, বিজ্ঞান বা যুক্তির বিকাশ কোন বিজ্ঞানী কিংবা যুক্তিবাদীকে হত্যা করে থামানো যাবে না। গ্যালিলি গ্যালিলিও কে নিপীড়ন করে, জিয়ার্দানো ব্রুনোকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেও মধ্যযুগীয় ধর্ম যাজকেরা সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনকে থামাতে পারে নি। পৃথিবী গোলাকার, তা সূর্যের চারিদিকে ঘৃরে বলেই দিন রাত্রি হয়। প্রতিদিন সূর্য অস্থমিত হয়ে কর্দমাক্ত ডোবায় ডুবে যায়-সে কথা আজ আর কেউ বিশ্বাস করবে না-গণ্ডমুর্খ ছাড়া। তাতে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলেও করার কিছু থাকে না। সমকালীন শ্রেষ্ট বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ঈশ্বর এবং বেহেস্ত-দোজকের অস্তিত্ব নিয়ে নেতিবাচক গ্রন্থ লিখেছেন। এসবকে তিনি কল্পকাহিনী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাকে কিন্তু এখনো কেউ মৃত্যু হুমকী দেয় নি। কিংবা তার বক্তব্যের কারণে বৃটেনে বা বিশ্বের কোন জায়গায় ধর্ম চর্চা বন্ধ হয়ে যায় নি।
আমাকে যারা ব্লগে লিখতে বারণ করছে, তাদের সাথে সর্বশেষ যোগ হয়েছে আমার প্রিয় তনয়া তন্বি। আমি জানি, তারা সবাই মুক্তবুদ্ধির মানুষ। কিন্তু তারা কেউ চায় না, আমিও অজ্ঞাত কারো চাপাতির কোপে কোন এক ফুটপাতে তাৎক্ষণিক মুণ্ডহীন নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ি । তাদের এ প্রত্যাশায় ভালবাসার যে আকুতি প্রতিভাত, তাতে আমি সত্যই অনুপ্রাণিত-তাদের প্রতি আমার অফুরন্ত ভালবাসা এবং তাদের প্রতি আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ।
সম্ভবত: উক্তিটি রবীন্দ্রনাথের- A slave is he, who can not speak his thought. মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে এর চেয়ে মোক্ষম উক্তি আর কি হতে পারে ? আমি যা ভাবব কিংবা চিন্তা করব, তা আমি বলতে পারবনা, এ যে এক প্রকার দাসত্ব।
রবীন্দ্রনাথ আরো একটি দারুণ কথা বলেছিলেন- I love God because he has given me freedom to deny him. কবি গুরুর এ উক্তির মধ্যে কেবল নাস্তিক হওয়ার স্বাধীনতার প্রতি ইঙ্গিত নেই, বরং ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার মাহাত্ম্য ও এখানে বিধৃত।
যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, তারা সকলে বিশ্বাস করতে বাধ্য যে-আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি করার ব্যাপারে তার ক্ষমতা অসীম। তিনি হও বললে, হয়ে যায় (কুন ফাইয় কুন) । তাহলে আমাদের মানতে হবে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে দুনিয়ার তাবৎ মানুষকে মুসলিম করে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিংবা যে কোন সময় মুসলিম ধর্মে সকলকে দীক্ষিত করে ফেলতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তাহলে আল্লাহ যা করেন নি, তার উম্মাদ কতিপয় বান্দারা কেন তা করতে চাচ্ছেন । কেন দুনিয়ার তাবৎ মানুষ আমার ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে? কেন ধর্ম কায়েম করা কিংবা ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য আমরা বিধর্মী বা ভিন্ন মতের মানুষদের হত্যা করব ? আল্লাহের দুনিয়ায় আল্লাহের শাসন কায়েম করব, এ দাবীটার মধ্যে আল্লহকে বরং খাটো করা হয়। কারণ এ দাবীর মধ্যে এ কথাটি সুপ্ত আছে যে, আল্লাহকে কেউ তার শাসন চ্যূত করেছে কিংবা আল্লাহের দুনিয়ায় শাসন কায়েম করার ক্ষমতা আল্লাহের নেই। কোন ধার্মিক মুসলিম এ কথা মানবে না।
হ্যাঁ বন্ধুরা, আমি জীবনবাদী মানুষ। তাই আমিও দীর্ঘদিন বাঁচতে চাই। কিন্তু এটাও আমার স্মরণ আছে যে, আমার এ জীবন একটি বর্ধিত জীবন (extended life)। একাত্তুরের রণাঙ্গনে বহুবার মরতে মরতে বেঁচে গেছি। শহীদ না হয়ে বেঁচে যে আছি- এটাই বরং মিরাক্যাল। একটি সুপ্ত স্বপ্ন বক্ষে ধারণ করে আমি মাত্র চৌদ্দ বৎসর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমার সে স্বপ্ন এখনো পূরণ হয় নি। বরং স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমি বহু ভেবেছি-আমি আমার চেতনা, বিশ্বাস বা আদর্শ বিসর্জন দিতে পারি না-জীবন রক্ষার আদিম তাগিদেও। আমি যা সত্য মনে করি, তা অকপটে বলে যেতে চাই, লিখে যেতে চাই-তাতে যদি যায় প্রাণ-যাক না। জ্ঞানের কথা অজ্ঞদের, সত্য কথা মিথ্যাবাদীদের, ন্যায় বিচারের কথা অন্যায়কারীদের অনুভূতিতে আঘাতত হানবেই। তাই বলেকি সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকব?
তবে যারা আমার চিন্তার সাথে একমত নয়, যারা আমার আদর্শে বিশ্বাস করে না, যারা বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোঁড়ামী নিয়ে থাকতে চায় এবং মুক্তমনাদের গালাগালি করে, ঘৃণা করে, হত্যার জন্য তালিকাভূক্ত করে, আমি পূর্বেই বলেছি-তাদের কাউকে চাপাতির কোপ দূরের কথা, একটি ঘুঁষি মারার ইচ্ছাও আমার নেই। আমার এ লড়াই মনসতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-আদর্শিক। সে লড়াইয়ে আমি অক্লান্ত নিরাপোষ-কারণ কবি গুরুরর্ ভাষায়-সত্য যে কঠিন, সে কঠিনেরে ভালবাসিলাম।
আমি যা সত্য মনে করি, তা অকপটে বলে যেতে চাই, লিখে যেতে চাই-তাতে যদি যায় প্রাণ-যাক না। জ্ঞানের কথা অজ্ঞদের, সত্য কথা মিথ্যাবাদীদের, ন্যায় বিচারের কথা অন্যায়কারীদের অনুভূতিতে আঘাতত হানবেই। তাই বলেকি সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকব?
আপনাকে স্যালুট । লেখাটি পড়ে অনেক অনেক ভালো লাগলো ।
আপনাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আপনাকে কুর্নিশ।
বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই। এই যে ওরা চাপাতির আঘাতে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলছে – তাদের বিপরীতে শুধু কলম চালিয়ে কি আমরা জিততে পারবো? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আরো কত প্রাণের বিনিময়ে? বা আরো কত বছর অপেক্ষার পর? আর উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে একজন মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টিতে মুক্তমনাদের কী করা উচিত?
কলম চলুক।
প্রিয় প্রদীব দেব, আপনার মন্তব্য ও প্রশ্রের জন্য ধন্যবাদ। আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে হলে বড় একটি নিবন্ধ লিখতে হবে, যা এ মন্তব্যে কলামে সম্ভব নয়।
তবে আমাদের এ উক্তিটি ভুলে গেলে চলবে না যে-Pen is mightier than the sword. আজ যারা কলমের জবাবে চাপাতি নিয়ে ঘুরছে মুক্তমনাদের খুন করার জন্য তারা বস্তুত ভীষণ অজ্ঞ, মুর্খ। কিছু ধর্মীয় খেতাব পড়া ও তাদের হুজুরদের বয়ান শোনা ছাড়া তাদের আর কোন শিক্ষা নেই। তাদের মগজ ধোলাই এমন ভাবে করা হয়েছে যে, তারা মনে করে তারা ছাড়া দুনিয়াতে আর সবাই ভুল পথে আছে। তবে তাদের বা তাদের গুরুদের একটি ধারণা ঠিক যে-মুক্তচিন্তার প্রসার তাদের অন্ধ বিশ্বাসের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা। তাই তারা মরিয়া হয়ে ওঠেছে। তারা বুঝতে পারছেনা-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ অবজেকটিবলি তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি মূলে আঘাত হানবে। এখন তারা যে যুদ্ধটা শুরু করেছে- তাতো গুপ্ত হত্যা, তার বিরুদ্ধে মুক্তমনা লোকদের কি পাল্টা চাপাতি বা অন্য অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করা সম্ভব? তবে, হ্যা, তাদের দমন ও নির্মূল করতে পারে রাষ্ট্র- যদি চায়। কিন্তু সেখানেও তো প্রশ্ন আছে। রাষ্ট্র সেটা চায়, নাকি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। এমতাবস্থায় একটি সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করা ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, একজন দুইজন করে ব্লগারদের খুন করে যেমন মুক্তচিন্তার প্রসার বন্ধ করা যাবে না, ঠিক তেমনি কয়েকজন জঙ্গীদের ধরে জেলে পুরে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের উত্থান ঠেকানো যাবে না। এ প্রসঙ্গে মুক্তমনায় প্রকাশিত আমার একটি লেখা-“জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে যুগপৎ লড়াই অপরিহার্য” পড়ার জন্য অনুরোধ রইল। লেখক তালিকা থেকে আমার ব্রগে গেলে তা পাওয়া যাবে। আমি লিংক দিতে জানি না। না হলে এখানে লিংক দিয়ে দিতাম।
ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর বলে স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস লিখে যান।
ধন্যবাদ গীতাদি, অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য। হ্যা, লিখতে লিখতে হঠাৎ কেন জানি মনে হয়, এসব লেখা কি আজকের প্রজন্মকে আকৃষ্ট করছে, নাকি তাদের বিরক্তির কারণ হচ্ছে? তাই মাঝে মাঝে থেমে যেতে ইচ্ছা করে। তা ছাড়া অভিজিৎ হত্যাকান্ডের সপ্তাহ দই পূর্ব থেকে বাংলাদেশে র্মুক্তমনা খোলা যাচ্ছিল না-যা নিয়ে অভিজিতের সাথে আমার শেষ বার্তা বিনিময়-তাও তার হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে এবং অভিজিৎ মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত একই অবস্থা বিরাজমান ছিল বলে আমি অভিজিতের মৃত্যু নিয়ে কেবল ফেস বুকে আমার প্রতিক্রিয়া জানিয়ছিলাম। আমার এ লেখাটিও ফেইস বুকে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া। আমার এখনো আক্ষেপ হয়-কেন যে অভিজিৎ এদেশে আসল? আমি এখনো ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছিনা। মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের জন্য যে কোন মূল্যে তার বেঁচে থাকা দরকার ছিল।
চমৎকার লিখা , যুগে যুগে মুক্তমনাদের কলমই ছিলো একমাত্র অস্র যত ক্ষুদ্রই হোক এর চেয়ে শক্তিশালি অস্র কোথাও নেই ।
তাই কলম ছেড়ে চাপাতি হাতে নেওয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা কারণ মুক্তচিন্তার মানুষরা কাপুরুষ নয় । মৌবাদীদের পরাজয় এখানেই, তারা নিরস্র একজন মানুষকে চার পাঁচ জনে মিলেও সামনে থেকে আক্রম্নন করার সাহস পায় না। অতএব হে রণাঙ্গনের সৈনিক , মৃত্যু কে আমরাও ভয় করিনা ,ওরা কতজনকে মারবে ।
আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো ।
১। শিখদের মত বা আরবদের মত কোমরের খাপে সবসময় তলোয়ার রাখলে কেমন হয়? মরতে মরতে একটারেও হলেও মারি? পেছন দিক থেকে এসে মুখোশ পরে সরাসরি মাথায় চাপাতির আঘাত এর বিপরীতে আর কিইবা করার আছে?
২। [email protected] এ মোবাইল নাম্বার দিয়েন।
৩। আজ দেখলাম, অনন্ত বিজয় সুইডেনের ভিসা পায়নি কিন্তু তাহের হত্যার আসামি সালেহীন সুইডেনের নাগরিকত্ব পেয়েছে!
৪। ধারনা করা হচ্ছে রাজীব হত্যার আসামী আজাদ অস্ট্রেলিয়ায়।
৫। পুলিশ ধরবে না জানি, তবুও যদি কোনদিন ধরে আসামীদের বিচারের আওতায় আনা হয়, তাহলে সঠিক ন্যায় বিচার হচ্ছে না বলে আসামীদের পক্ষে বিবৃতি দিবে বা ফোন দিবে আমেরিকা, ইঊরোপীয় ইউনিয়ন।
৬। অনন্ত হত্যার পর প্রথম যে দেশটি নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল সে দেশটি হল- যুক্তরাজ্য । ১৯৭১ সালে যেসব খুনীরা তালিকা ধরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, যুদ্ধাপরাধের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছিল তারা কিন্তু থাকে যুক্তরাজ্যে। তারা প্রিন্স চার্লসের বিশেষ বন্ধু।
৭। আচ্ছা জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অনন্ত হত্যায় কি কিছু বলেছে?
৮। আগেও একবার বলেছি এখনও আবার বলছি অভিজিত হত্যার পর মুক্তমনা জার্মানীর ববস পুরস্কার পেয়েছে। এখন অনন্তও পাবে। মনে হয় প্রথম পুরস্কারটি দেবে সুইডেন।
পুরস্কার দেখার জন্যে আর কেউ বেঁচে হয়তো থাকবে না। কী আসে যায় সুইডেন দেয় না ইউকে
মুক্তিযোদ্ধা ব্লগারকে আমার ও স্যেলুট।কলম অবশ্যই চলবে, অনুরোধ একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন, আমরা তো আর যানি না, রাজিব, অভিজিৎ দা, বাবু, অনন্ত এর পর এবার কে?
ধন্যবাদ। হ্যাঁ আমাদের অবশ্যিই সর্তক হতে হবে। অভিজিতকে নিয়ে এখানেই আমার কষ্ট। সে কেন সর্তক হল না। লড়াইয়ে জিতার জন্যতো আমাদের বাঁচতে হবে। আমরা সংশপ্তক হতে চাইনা, আমাদের গাযী হতে হবে।
একজন অভিজিৎ কে হারিয়ে আমরা কত যে পিছনে চলে গেলাম সেইটা যদি দাদা একটু বুজতে পারতেন………………………………আজ আমাদের আর হাহাকার করতে হতো না। যাই হোক ভাল থাকবেন।
ইতিহাসে দেখা গেছে ,যখনই মানুষ ধার্মিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক বা অন্য কোন ক্ষেত্রে স্পষ্ট কথা বলেছে,সন্দেহের নিরসন করেছে বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে তখনই তার বিরুদ্ধে পাপশক্তি ষড়যন্ত্র করেছে,বিষপ্রযোগ করেছে , অপপ্রচার করেছে,ক্ষেপে মরিযা হযে উঠেছে,ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে , নিষ্ঠুরভাবে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে,
কিন্তু সেই আঘাতই আবার প্রত্যাঘাত হয়ে
তারই কাছে ফিরে গেছে । নিজের
আঘাতের প্রত্যাঘাতেই পাপশক্তি বিনষ্ট হয়েছে ।
তোমরা জেনে রেখো, ইতিহাসের অমোঘ বিধানে পাপশক্তিকে বিদ্ধস্ত হতেই হবে ।
শ্রী শ্রী আনন্দমূ্র্ত্তি
মুক্তিযোদ্ধা ব্লগারকে স্যেলুট। কলম চলবে।
মাভৈ: এগিয়ে চল।