কবি জীবনানন্দ দাশের পদবীর হচ্ছে দাশ, দাস নয়। তাঁর পদবীর বানানে শ হয়, স নয়। যাঁরা জীবনানন্দের মহা ভক্ত তাঁদের সাধারণত এই বিষয়টাতে খুব একটা ভুল হয় না। তবে, অন্যদের যে ভুল হয় না, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। জীবনানন্দ দাশের পদবীর বানানে এখন তেমন একটা ভুল না হলেও, তাঁর জীবিত থাকার সময়ে অনেকেই তাঁর পদবীর বানান লিখতে গিয়ে ভুল করতেন। জীবনানন্দ নিজেও তাঁর পদবীর বানান নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর ছিলেন। শুধু জীবনানন্দ কেনো, প্রায় সব মানুষই তার নামের বানান নিয়ে স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। কেউ শ এর বদলে স লিখলে, জীবনানন্দ খুবই বিরক্ত হতেন, চটে যেতেন, মনে কষ্ট পেতেন। কবি কিরণশংকর সেনগুপ্ত বলেছেন, “জীবনানন্দের নাম লিখতে গিয়ে কেউ তাঁর পদবীটা দাশ না লিখে দাস লিখলে, তিনি বিরক্ত হতেন। একদিন তিনি এ প্রসঙ্গত আমাকে বললেন, – দেখুন না সাহিত্যিকদের অনেকেই আমার নামটা ঠিক করে লিখতে পারেন না। পদবীর বানানটায় তাঁরা প্রায়ই ভুল করেন।”
অথচ মজার বিষয় কি জানেন? জীবনানন্দের পদবী আসলে দাসই। তিনি কলেজ জীবন পর্যন্ত দাসই ছিলেন। এমনকি তাঁর এম এ-র সার্টিফিকেটেও পদবী হিসাবে দাস লেখা আছে। তাঁর মা কুসুমকুমারী দেবীও কবিতা লিখতেন। ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় তাঁর যে সব কবিতা প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোতে নাম লেখা আছে কুসুমকুমারী দাস। ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় জীবনানন্দেরও কবিতা ছাপা হয়েছে। সেখানেও তাঁর নাম লেখা আছে জীবনানন্দ দাস।
প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি দাস থেকে দাশ হলেন কবে?
এখানেও প্যাঁচ আছে। তিনি দাস থেকে আসলে দাশ হননি। বরং হয়েছিলেন দাশগুপ্ত। কলেজ জীবনের শেষ দিকে তিনি যে সমস্ত লেখা পাঠাতেন, সেখানে তিনি নাম লিখতেন জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। শুধু লেখাতেই নয়, নিজের নাম হিসাবেও তিনি জীবনানন্দ দাশগুপ্তই বলতেন। জীবনানন্দের বিয়ে হয় বাংলা ১৩৩৭ সালে। বিয়ের আগে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি তাঁর ভাবি স্ত্রী লাবণ্যকে। সেখানেও তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশগুপ্ত হিসাবে। লাবণ্য দেবী তাঁর মানুষ জীবনানন্দ প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
জ্যাঠামশায় আমাকে বললেন – এই যে মা এসো আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। দিল্লী থেকে এসেছেন।
এখন তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ালো, এই দাশগুপ্ত আবার এলো কোথা থেকে?
আসলে জীবনানন্দ দাশদের মূল পদবী ছিলো দাসগুপ্ত। সেখান থেকেই এই দাশপগুপ্ত এসেছে। এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ বলেন,
আমার ঠাকুরদা ব্রাহ্ম হয়ে জাতিভেদ মানতেন না বলে নিজের পদবী থেকে বৈদ্যত্বসুচক গুপ্তটা বাদ দিয়েছিলেন। দাদাও অনেকটা ঐ একই যুক্তিতে আবার এক সময় আমাদের পদবির সঙ্গে গুপ্তটা বসিয়েছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন – আগে আমরা বৈদ্যই থাকি, আর যাই থাকি, এখন তো আর আমরা জাতিভেদ মানি না। অতএব শুধু শুধু মূল পদবীটাকে বদলেই বা লাভ কি? এই বলে তিনি ঠাকুরদার আমলের ত্যাগ করা গুপ্তটাকে আবার পদবীর শেষে বসিয়েছিলেন। তবে দাদা ওই সময় দাসগুপ্ত না লিখে দাশগুপ্ত লিখতেন। এর কারণ, আমার মনে আছে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ একবার বৈদ্যজাতির লোকদের বলেছিলেন – বৈদ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁদের পদবী দাস অথবা দাসগুপ্ত তাঁরা দাস, দাসগুপ্তের বদলে দাশ, দাশগুপ্ত লিখলেই ভাল হয়। দেশবন্ধু নিজেই বৈদ্য ছিলেন বলে নিজেও নাম লিখতেন – চিত্তরঞ্জন দাশ।
তো বোঝা গেলো তিনি কীভাবে দাস থেকে দাশপগুপ্ত হলেন। এইবার শেষ প্রশ্ন, দাশগুপ্ত থেকে আবার গুপ্ত ছুটে গেলো কখন?
১৩৩৪ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয়। এতে তাঁর নাম ছিলো জীবনানন্দ দাশ। দাশগুপ্তের বদলে দাশকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন কীর্তিমান হবার জন্যে।
তিনি দাশ হলেও দাসের হাত থেকে মুক্তি পেতে তাঁর অনেক সময় লেগেছে। তিনি দাশ লিখলেও প্রেসের কম্পোজিটার, প্রুফ রিডার বা সম্পাদক প্রায় সময়ই দাশ কেটে দাস বানিয়ে দিতেন। ১৩৩৮ সালে পরিচয় পত্রিকায় তাঁর ক্যাম্পে নামের কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। সেখানে তাঁর নাম লেখা হয়েছিলো জীবনানন্দ দাস।
এখন অবশ্য ভদ্রলোককে আর এই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। বিখ্যাত হলে এই এক সুবিধা আছে। রেহমান, রাহমান, দাশ যাই লেখেন না কেনো, তাই সই হয়ে যায়।
নামের পদবী দাস এর অর্থ কৃতদাস এমনই শুনেছি বহুদিন থেকে, কিন্তু সেখানে শ দিলেই কি বৈদ্য যারা তাদেরকে বোঝায় কিনা সে বিষয়টি পরিস্কার বুঝলাম না।
নামের পদবীতে যে ‘দাস’। তার অর্থ ছোট বেলা থেকে শুনে এসেছি কৃতদাস। তবে ঈশ্বরের কৃতদাস।
ভালো লাগলো ।
এফিডেবিট করার একটা চিন্তা মাথায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে বেশ কয়েকমা্স থেকেই। এখন ভাবছি এক “স” কে “শ” বানাতে যদি এতো হ্যাঁপা হয় তাহলে তিন শব্দের নাম আমূল পরিবর্তন করতে হলে কী হবে!
নিজের নামের প্রতি সকলেরই আসক্তি থাকে। পছন্দ মতো করে নিলে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়।
পদবির ‘দাস’ অর্থে ক্রীতদাস/চাকর/অধীন বোঝান হয় না। ‘দাস’ হিন্দু কায়স্থ সম্প্রদায়ের পদবি। কিন্তু জীবনানন্দ ছিলেন বৈদ্য গোত্রের। বৈদ্য গোত্রে পদবি হিশেবে ‘দাশ’ লেখা হয়।
@মাজ্হার,
বৈদ্য গোত্রে পদবী হিসাবে দাশ লেখা কবে থেকে শুরু হয়?
@ফরিদ আহমেদ,
কবে থেকে লেখা শুরু হয়, তা জানি না। তবে ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে’ দাশ শব্দের অর্থে লেখা আছে এটা। আর ক্লিন্টন বি সিলির ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ বইয়ে ‘জীবনানন্দের বনলতা সেন’ আর্টিকেলে লেখা আছে তিনি বৈদ্য গোত্রের।
@মাজ্হার,
জীবনানন্দ দাশ যে বৈদ্য গোত্রের সেটা আমি জানি। এই লেখাতেও সেটা বলা আছে। আমার প্রশ্নটা সেটা না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে, বৈদ্য হলেই দাশ লেখে কি না? বৈদ্য হলেই যে দাশ লেখে না, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে জীবনানন্দ দাশ এবং তার পরিবারই। তার মা দাস পদবী ব্যবহার করতেন, জীবনানন্দ দাশও দাস হিসাবেই এম এ পাস করেছেন। তিন দাশ হয়েছেন আরো পরে, বই ছাপানোর সময়ে। কাজেই, বৈদ্য হলেই দাশ লিখবে, এই যুক্তিটা ধোপে টেকে না।
পদবীর ‘দাস’ মানে কি কৃতদাস বা ভৃত্ত?