পাল্টায় মন, পাল্টায় বিশ্বাস

শ্লোগান পাল্টে হয়ে যায় ফিসফাস

ফিসফাসটাও পাল্টে যেতে পারে

হঠাৎ কারও প্রচণ্ড চিৎকারে।

 

হন্যে হাওয়া নিয়ত পাল্টে দিচ্ছে

এমন কি সব পাল্টে দেবার ইচ্ছে।

জানলার কাঁচে বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে

হন্যে হাওয়া পাল্টে দেবার ইচ্ছে। …

-কবীর সুমন

suman

বাংলা ব্লগে ‘ছাগু’ নামে একটি টার্ম আছে। যে আন্তর্জালজগতে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিদের সাফাই গায়, রাজাকারদের দোষ-স্খলন করার জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে ব্লগে বা ফেসবুকে পোস্ট দেয়, তাকেই চলতি ভাষায় ব্লগে ‘ছাগু’ বলা হয়। যারা অভিজ্ঞ ব্লগার তারা নাকি ছাগু দেখলেই চিহ্নিত করতে পারেন। তাদের সেই পরীক্ষণের নাম ‘কাঁঠাল পাতা টেস্ট’ বা সংক্ষেপে ‘কেপি টেস্ট’। ধরা যাক এমন একজনের স্ট্যাটাস আপনাকে পড়তে দেয়া হল যেখানে লেখা আছে –

প্রথম পয়েন্ট অনুযায়ী পুলিশের সহায়তায় জামাত ই ইসলাম বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামাতি রাজাকারদের পক্ষে বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে জনসভা করে। একেবারে মিথ্যা কথা। আপনাকে চ্যালেঞ্জ করলাম- আপনি এটা প্রমান করে দেখান। জামাত ই ইসলামকে বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে কোনও জনসভা করতে দেওয়া হয় নি। পশ্চিম বাংলার প্রথম সারির ১১টি মুসলিম সংগঠন একটি জনসভা করেছিল। ১১টি সংগঠনের মধ্যে জামাত ইসলামী হিন্দের নামটাই ছিল না। সেই জনসভা বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে করা হয়নি। মমতা দেবীর প্রশাসনের ১০ গাড়ী র্যানফ অনেক আগেই তাদের আটকে দেয়। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামাতি রাজাকারদের পক্ষে ১১টি সংগঠন সেই জনসভা করেনি। তারা সেই জনসভা করেছিল বাংলাদেশে ইসলাম অবমাননাকারী কুলাঙ্গার ব্লগারদের বিরুদ্ধে। যে কুলাঙ্গাররা দিনের পর দিন আল্লাহ, ইসলাম, মোহাম্মদ (সঃ), কুরাণ এবং হাদিসকে অকথ্য অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে চলছিল।

দ্বিতীয় পয়েন্ট অনুযায়ী ময়দানে জামাত ই ইসলাম যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামাতি সাঈদী-নিজামীর মত রাজাকারদের পক্ষে পুলিশের সহায়তায় জনসভা করেছিল। আপনার একথাটিও সর্বৈব মিথ্যা। আপনি যে জনসভাটির কথা বলতে চেয়েছেন সেটিতেও জামাত ই ইসলাম হিন্দ নামটি ছিল না। সেই জনসভা ময়দানে নয়, শহীদ মিনার ময়দানে হয়েছিল। পশ্চিম বাংলার প্রথম সারির ১৫ টি মুসলিম সংগঠন এই জনসভা করেছিল। এই অধিকাংশ সংগঠনই নীতিগতভাবে জামাত ই ইসলাম হিন্দ বিরোধী। সেখানে তাদের জনসভা করা হয়েছিল বাংলাদেশের বহুল বিতর্কিত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল কৃত সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে, রায় পরবর্তিতে একসপ্তাহের মধ্যে পুলিশের গুলিতে ২০০ জনের মৃত্যু এবং মানবধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশে ইসলাম অবমাননাকারী কুলাঙ্গার ব্লগারদের বিরুদ্ধে। এই জনসভা বাংলাদেশ জামাত ই ইসলামের নায়েব সাঈদীর পক্ষে নয়, বরং ইসলামিক স্কলার- এশিয়া মহাদেশের অন্যতম সেরা তাফসীরে কুরান আল্লামা দিলোয়ার হোসেন সাঈদীর পক্ষে সমাবেশ হয়েছিল। এই সমাবেশের জন্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সমস্ত অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। …”

আপনি কী ভাববেন? ‘কেপি টেস্ট’ না করেও আপনি বুঝবেন ব্যাটা এক রাম ছাগু। আপনি সোজা ট্র্যাশে চালান করে এক নম্বর পচা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন। কিন্তু যদি দেখেন কোন এক বিখ্যাত ‘সেলেব্রিটি’ সে ম্যাসেজটাকে আয়েশ করে মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের ওয়ালে সযত্নে শেয়ার করেছে, তখন?

ঠিক এই কাজটিই করেছেন বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী কবীর সুমন। উনি এক অখ্যাত ‘ছাগু’র স্ট্যাটাস ওয়ালে পোস্ট করে ছাগুটিকে লাইম লাইটে নিয়ে এসেছেন। যে শিল্পী দু’দিন আগেই শাহবাগ নিয়ে গান বেধেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন, আজ তিনিই এমন পোস্ট শেয়ার করেছেন যেখানে মুক্তচিন্তার ব্লগারদের ‘কুলাঙ্গার ব্লগার’ বলা হয়েছে আর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাইদীর (যিনি হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা সহ বহু অপরাধে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত) আগে বসেছে ‘ইসলামিক স্কলার- এশিয়া মহাদেশের অন্যতম সেরা তাফসীরে কুরান’ টাইপের আদেখালামো বিশেষণ!

কেন করলেন এ কাজটি সুমন?

কারণ সম্প্রতি তার দেউলিয়াপনা প্রকাশ করে দিয়েছেন পরিচয় পাত্র নামের এক লেখক একটি সাইটে। পত্রলেখক সেই চিঠিতে সুমনের ‘মুসলমান’ কার্ড খেলা, পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৌলবাদীদের ইন্ধন যোগানো সহ অনেক অভিযোগই করেছেন (চিঠিটি আছে এখানে)।  পাঠকদের পরিচয় পাত্রের চিঠিটি প্রথমে পড়ে নিতে অনুরোধ করছি। এই পত্রাঘাতের  পর থেকেই মনে হচ্ছে সুমনের ‘মগজে কারফিউ’!

এই চিঠির জবাব দিতে গিয়ে সুমন বিগত কয়েকদিন ধরে যা করলেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। প্রথমেই ‘আমি’ ‘আমি’ আমি’ করে দেড় বিঘত লম্বা চওড়া এক ফিরিস্তি দিলেন, বাংলা গানের উন্নয়নে তার কী বিশাল ভূমিকা (যেন এটাতে কেউ সন্দেহ করেছে, কিংবা এটা যেন প্রাসঙ্গিক)। সেখানে থামলেও না হয় চলতো, তিনি পত্রলেখককে ঠারেঠোরে ‘নিম্নবর্ণ মাহিষ্য’ বলে আখ্যায়িত করলেন, এমনকি  ছেলেটা ‘বাবার পয়সায় অস্ট্রেলিয়া পড়তে গেছে’, কিংবা এও ইঙ্গিত করলেন ‘দেশে থাকলে গামছা বেচেও রোজগার করতে পারত না’ জাতীয় মন্তব্যও এসেছে সুমন এবং তার স্তাবকদের কাছ থেকে। অথচ এই সুমনই না তার গানে গানে আমাদের শিখিয়েছিলেন –

বিরোধীকে বলতে দাও…

বিরোধীকে বলতে দাও…

বিরোধীকে বলতে দাও…

তোমার ভুলের ফর্দ দিক।

বিরোধীকে বাঁচতে দাও…

বিরোধীকে বাঁচতে দাও…

বিরোধীর দৃষ্টি দিয়েও সবাই নিজের হিসেব নিক।

যুক্তিকে বাঁচতে দাও…

যুক্তিকে বাঁচতে দাও…

যুক্তির স্বচ্ছ আলোয় শানিয়ে নিচ্ছি আমার চোখ।

বিরোধীর যুক্তিটাও বন্ধুরা আমল দাও,

বিরোধীর স্বাধীনতাটাই স্বাধীনতা সাব্যস্ত হোক।

এই কি তার নমুনা?

যে ভদ্রলোকের স্ট্যাটাসটি দর্পভবে সুমন তার নিজের সমর্থনে তাঁর ওয়ালে শেয়ার করেছেন, সেখানে আরো লেখা ছিল –

‘খাগড়াগড় কান্ড নিয়ে বঙ্গ রাজনীতি তোলপাড়। প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার খবরের বহর দেখে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে- বাংলা বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে। বোমা বানাতে গিয়ে দুজন নিহত। এক শাকিল গাজী এবং অন্যজন স্বপন মন্ডল ওরফে শোভন মন্ডল। ইতিমধ্যেই গোয়েন্দা সুত্র উল্লেখে মিডিয়া মারফৎ আমরা শাকিলের জীবন বৃত্তান্ত জেনেছি। অজ্ঞাত কারণে জানতে পারিনি- স্বপন মন্ডল ওরফে শোভন মন্ডলের কুণ্ডলী। পত্রপত্রিকার খবরা খবর এবং টিভিতে বিদগ্ধজনদের আলোচনায় মৃত দুজনের মধ্যে শাকিল বহু চর্চিত হলেও ব্রাত্য থেকে গেছেন স্বপন মন্ডল ওরফে শোভন মন্ডল। ঘুণাক্ষরেও তার নামটি উচ্চারিত হয় না।…’

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে ‘স্বপন মণ্ডল’কে  সুমন এবং সুমনের দোসর ‘ইসকাপনের টেক্কা’ ভেবেছিলেন, দু’দিন পর তার পরিচয় বের হয়ে গিয়েছে মিডিয়ায়। নিহত স্বপন মণ্ডল আসলে বীরভূমের কীর্ণাহারের কাফেরপুর গ্রামের আব্দুল করিম (সুবহান আসলে করিম-ই, দেহ দেখে অজ্ঞান বাবা, আনন্দবাজার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪)। আমি জানি, সন্ত্রাসীর কোন দেশ নেই, নেই কোন ধর্ম। কিন্তু সত্য যখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার, তখন অহরহ  মুসলিম ট্রাম্প-কার্ড ব্যবহার আর স্বপন মণ্ডলের পরিচয় নিয়ে ঘোট পাকানোর খেলা থামিয়ে সুমন কি আজ বাস্তব সত্যটা মেনে নেবেন – ‘চোখ থেকে খুলে ফেলে চশমা, আর মন থেকে মুছে ফেলে চালশে’?

নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন ফেসবুকে সম্প্রতি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সুমনকে নিয়ে।  সেখানে সুমনের জার্মান স্ত্রী মারিয়ার উপর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের উল্লেখ তো ছিলোই পাশাপাশি কলকাতায় থাকাকালীন সময়গুলোতে উনি সুমনের যে পরিচয় পেয়েছেন তা মোটেই সুখকর ছিল না। ‘মতামত’ নামের একটি অনুষ্ঠান করতেন সুমন।  সে অনুষ্ঠানে ‘তার পয়গম্বর’কে নিয়ে তসলিমা দ্বিখণ্ডিত উপন্যাসে কি লিখেছেন তা নিয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের রীতিমত উস্কে দেন সুমন। তসলিমা লিখেছেন, ‘টিভিতে আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি খুলে পয়গম্বর মুহম্মদকে অসম্মান করে কোথায় কী লিখেছি তা শুধু পড়েই শোনাননি, দেখিয়েওছেনও। …কোনও জঙ্গি মুসলমান সে রাতে আমাকে খুন করতে পারতো। নির্ঘাত পারতো।  আমি থাকতাম মুসলিম অধ্যুষিত পার্ক সার্কাসের কাছেই রওডন স্ট্রিটে। সে রাতে ভয়ে আমার গা কেঁপেছে। সে রাতেই আমি প্রথম জানালা দরজাগুলো ভালো করে লাগানো হয়েছে কিনা পরখ করে শুয়েছি … সুমন বলেছেন আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের জারি করা ফতোয়াকে তিনি সমর্থন করেন। এমনিতে নব্য-মুসলিমদের সম্পর্কে বলাই হয় যে তারা মৌলবাদীদের চেয়েও দু’কাঠি বেশি মৌলবাদী।’

তসলিমার স্ট্যাটাসটি প্রকাশের পর এক পাঠক আমাকে মন্তব্যে জানিয়েছেন ব্যাপারটা নাকি সত্য নয়। সুমন নাকি  নাকি বইটা থেকে সেভাবে কিছু কোট করেননি। করলে দাঙ্গা লেগে যেতে পারত। হতে পারে;  আমি মতামত অনুষ্ঠান দেখিনি। তাই তসলিমার অভিযোগ সত্য না মিথ্যা তা যাচাই করার উপায় নেই আমার। তবে দাঙ্গা লাগার ভয়ে যদি সত্যই সুমন তসলিমার বই সবাইকে না দেখিয়ে থাকেন, সেখানে কি আছে তা না বলে থাকেন, এবং এ সংক্রান্ত দাবীটি যদি সত্য হয়, তার কখনোই সেগুলো উদ্ধৃত করার কথা ছিল না।এমনকি এখনও। কিন্তু এ ব্যাপারটি যে সত্য নয়, তা আমি নিজেই জানি। পরিচয় পাত্রকে এক হাত নিয়ে তিনি ফেসবুকে লেখার প্রথমেই তসলিমার উদ্ধৃতি একেবারে লাইন পৃষ্ঠা সহ কোট করে একদম মাথার উপরে টাঙ্গিয়ে রেখেছিলেন। অনেকটা ধার্মিকেরা যেমন ‘বিসমিল্লাহ’ বলে লেখা শুরু করে কিংবা আওয়ামিলীগাররা যেমন ‘জয় বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু’ বলে সাওয়াল জবাব দেন সেরকমের।  মতামত অনুষ্ঠান যেহেতু আমি দেখিনি, তা দিয়ে আমি সুমনকে ‘জাজ’ করছি না, কিন্তু যা দেখেছি তা অস্বীকার করি কি করে? সুমন তো সত্যই এমন এক স্ট্যাটাস শেয়ার করেছেন যেখানে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাইদীকে ‘শ্রেষ্ঠ ইসলামী স্কলার কুরানে তফসির’ টাইপের আদেখলামো আছে, আর প্রগতিশীল ব্লগারদের ‘কুলাঙ্গার ব্লগার’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর পরিচয় পাত্রেরর চিঠির উত্তর দিতে তার বিশেষণগুলো (‘নিম্নবর্ণ মাহিষ্য’ ইত্যাদি) এগুলো অনেকেই দেখেছেন, এবং বহু জায়গায় এ নিয়ে কথাও হচ্ছে।

তবে, মতামত অনুষ্ঠানে ঠিক কি হয়েছিল তা আমি নিশ্চিত করে না জানলেও তসলিমা তার  স্ট্যাটাসে কিছু কথা  উল্লেখ করেছেন যা আমার কাছে একেবারে মিথ্যে মনে হয়নি। যেমন, তসলিমা তাঁর স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘সুমনের গানের কথাগুলো খুব ভালো। সেসব কথা বাংলার লক্ষ মানুষ বিশ্বাস করলেও সুমন বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না’। কথাগুলোতে আংশিক হলেও সত্যতা আছে বইকি। যে সুমন তার গানের বাণীতে বলেন –

‘আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্র বধূ

আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু,

আমি চাই বিজেপি নেতার সালমা খাতুন পুত্র বধূ

আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু’।

অথচ সবাই তো দেখেছে – তিনি তার বাস্তব জীবনে সাবিনাকে বিয়ের সময় তার নিজের গানের বানী বেমালুম ভুলে গিয়ে একেবারে  ‘কবীর সুমন’ বনে যান।  ধর্ম পরিবর্তন করেই বিয়ে করেন সাবিনা ইয়াসমিনকে। শুধু তাই নয়, তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেন, সারা বিশ্বে মুসলিমদের উপর যে নিপীড়ন হচ্ছে তার প্রতিবাদে নাকি তিনি মুসলমান হয়েছিলেন।  তিনি মুসলমান  হওয়ায় বিশ্বজুড়ে ‘মুসলিমদের উপর নিপীড়ন’ কতটুকু বন্ধ হয়েছে জানি না,  তবে কেউ কেউ সন্দেহ করেন তার এই মুসলিম বনে যাওয়ার পেছনে আসলে আছে গ্রেফতার এড়ানো এবং হয়তো ‘পলিগ্যামি চর্চার’ সুপ্ত বাসনা, যেটি বিপ্লব বলেছেন এভাবে –

suman_maria_sabina_biplabpal

তবে সুমন কখন কাকে কেন বিয়ে করেছেন, তা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে দিয়ে তাকে বিচার না করে বরং তার সৃষ্টির দিকেই বরং নজর দেয়া যাক। যে সুমন একসময় গান বাঁধতেন এই লিরিকে – ‘পাকস্থলিতে ইসলাম নেই নেইকো হিন্দুয়ানি; তাতে যাহা জল তাহা পানি’ আজ সেই সুমন গান লেখেন –  ‘জেহাদ ডাকছি, অজয়, শোনো’  কিংবা বলেন –

ওরা – গাল দেয় আমি কলমা পড়েছি ব’লে

মুসলিম-বিদ্বেষের তোলে নিশান

জন্মের ঘৃণা লুকনো অস্ত্র খোলে

আমি গর্বিত বাঙালি মুসলমান।

সুমনের এই বিবর্তন নিঃসন্দেহে লক্ষণীয়।

কোথায় যেন পড়েছিলাম ব্রাহ্মণ যখন মুসলমান হয়, গরু খাওয়ায় নাকি সবাইকে টেক্কা দেয়। পাকিস্তানী খ্রিস্টান ক্রিকেটার ইউসুফ ইউহানা মুসলিম হবার পর নাকি এক ওয়াক্ত নামাজ বেশি পড়তেন। সুমনেরও মনে হয় একই ধরণের সিন্ড্রোম কাজ করছে। ধর্মান্তরিত হবার পর (সেটা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নাই, ইনফ্যাক্ট সুমন –সাবিনা পরিণয়ে আবদ্ধ হবার পর আমি খুশি হয়েছিলাম সবচেয়ে বেশি সেটা আমার স্ট্যাটাসেই বলেছিলাম) থেকেই দেখছি ক্রমশ ফরহাদ মাজহারীয় জমজমের পানিতে ক্রমশ মাথা ধুয়ে ফেলছেন তিনি- মুসলিম মানেই এখন তার কাছে ‘নির্যাতিত নিপীড়িত’ জাতির প্রতিনিধি – সেটা রাজিয়া বিবি হোক, বিন লাদেন হোক, ঔরঙ্গজেব হোক, বাদশাহ আকবর হোক, কিংবা হোক না সৌদি কিং আব্দুল্লাহ। মুসলমান যেহেতু, নিশ্চয় পশ্চিমা ইয়াহুদি-নাসারাদের অত্যাচারের শিকার তারা। তাই বর্ধমানে বোমা বানানোয় অভিযুক্ত জিহাদিনী রাজিয়া তার কাছে বিপ্লবী। ফরহাদ মজহারও একসময় লাদেনকে বিপ্লবী বলতেন, জেএমবির সন্ত্রাসীদের বানিয়েছিলেন ‘মুক্তিযোদ্ধা’। সেই মুক্তিযোদ্ধারা নাকি তাদের মত করে ‘সমাজটাকে বদলাতে চায়’।  ছাগতত্ত্ব আর বামতত্ত্বের খিচুড়ি রাঁধলে যা হয় আর কি – ‘সাম্যবাদের ডাক ঘুমে জাগরণে’! ব্লগার চরম উদাস সঠিক কথাই বলেছেন তার ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করতে গিয়ে একটি স্ট্যাটাসে – রামছাগল আর বামছাগলের মাঝে পার্থক্য কেবল তলে একটা ফুটার!

সুমন আমার খুব প্রিয় শিল্পী। যারা আমার লেখা নিয়মিত পড়েন তারা জানেন – আমার বহু লেখার শিরোনামই করা হয়েছে সুমনের গানের কলি ধার করে। সুমনের গানের সাথে আমার পরিচয় বহুদিনের। সত্যি বলতে কি – সুমনের গানের অধিকাংশ মুগ্ধ শ্রোতাদের চেয়ে ঢের বেশিদিন ধরে সুমনের গানের সাথে পরিচয় আমার। সেই আশির দশকের শেষ দিকে  “অন্য কথা, অন্য গান” শিরোনামের যে ক্যাসেটটি কিংবা ‘তোমাকে চাই’ নামের বিখ্যাত অ্যালবামটি নব্বইয়ের দশকে সুমনের পরিচিতি এনে দিয়েছিল সর্বত্র তার অনেক আগে থেকেই আমার কাছে একটা রেকর্ড ছিল সুমনের গানের। কারো বাসার জলসায় রেকর্ড করা কিছু গানের সংকলন। তাতে ছিল ‘রাষ্ট্র মানেই কাঁটাতারে ঘেরা সীমান্ত’ , ‘চোট্ট দেশ ঘিরে বেড়া দেয়া হবে, বাংলাদেশ ঘিরে বেড়া দেয়া হবে’ , ‘গণহত্যার নাম ভূপাল’ এর মতো গান। আমি নিশ্চিত, এখনো অনেকেই এই গানগুলোর সাথে পরিচিত নন, কারণ সুমন বিখ্যাত হবার পরে এর অনেকগুলো নতুন করে আর প্রকাশিত হয়নি।  এখানে একথাগুলো হয়তো বলার দরকার ছিল না, কেবল বললাম একারণেই যে সুমনের গানের সাথে সংশ্রব আর পরিচয়ের আবেগটা একেবারে ফেলনা নয় আমার জীবনে। সুমন আসলেই আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ‘তোমাকে ভাবাবোই ভাবাবো’র শিল্পী সত্যই আমাকে ভাবিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন,  কখনোবা নিঃসীম আঁধারে পথ খুঁজে পেতেও সহায়তা করেছেন তিনি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর যা আমি সবচেয়ে বেশি শুনেছি তা হল এই ‘সুমনের জীবনমুখী গান’।  আমার মনে আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের বদান্যতায় যখন সুমন প্রথম বাংলাদেশে এলেন কী বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে তার কনসার্ট শুনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ এতদিন পরে মনে হচ্ছে ‘আলু ব্যাচা, ছোলা ব্যাচা, কিংবা বাখরখানি ব্যাচার’ মতো সুমনও কেবল জীবনমুখী গান বেঁচে খান। ওটাই তার পেশা। রাস্তার পাশের ময়রা যেমন জিলিপিটা খুব ভাল বানায়, সুমনও তার বানী দিয়ে, ছন্দোবদ্ধ কথা দিয়ে, হৃদয় নিংড়ানো সুর দিয়ে আর পাশাপাশি তার সাংস্কৃতিক গভীরতা  আর কপটতা মাখিয়ে জিলিপির মতোই গান পাকান খুব ভাল। শেষ বিচারে তিনি একজন গান ব্যাচা ময়রাই। গুরুচণ্ডালীতে  সন্দীপন দাসগুপ্ত এই সত্য কথাগুলো কি অবলীলায় বলেছেন –

“দোষ কবীর সুমন নয়, আমাদের প্রত্যাশার। মুক্তচিন্তার কথা গানে সুন্দরভাবে বললে আমরা ভাবি- এনার ব্যবহারিক চিন্তাও বোধহয় এতটাই সুন্দর। এটা ভুল প্রত্যাশা – কারণ চিন্তা থেকে গান হয় না – ওটা হয় পরিশ্রম আর চর্চা থেকে, ঠিক যেভাবে একটা জার্মান গাড়ি, ইতালীয় বেহালা, বা মেচেদার চপ তৈরি হয়।

এটা ঠিক যে এতটা আমিও প্রত্যাশা করি নি – ছাগু পোষ্টের প্রশংসা তো তুচ্ছ ব্যাপার, সামগ্রিকভাবে যুক্তির অভাব, মাত্রাতিরিক্ত অযৌক্তিক অভিযোগ, গালিগালাজ, বিরুদ্ধমতের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা – এসব চলতে চলতে শেষে পরিচয়বাবুকে PA করতে গিয়ে গোটা একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন সেটা নন্দীগ্রাম পরবর্তী সময়ে CPM-র অর্কুট ক্যাডারকুলের লেভেলের। “বিরোধীকে বলতে দাও” -এর জন্মদাতার কাছে এটা পেয়ে খারাপ লেগেছে যাদের – তারা মনে রাখুন, সৃষ্টি সৃষ্টির জায়গায়, আর মানুষটা মানুষের। কবি মিথ্যুক, কবিতাও মিথ্যে। গায়কের মূল্য যদি তার যুক্তিতে বা সত্যনিষ্ঠায় থাকত, তবে তিনি বৈজ্ঞানিক হতেন। এতে দু:খ পাওয়া বোকামো। সত্যেরে লও সহজে”।

আরমান রশীদ আমার স্ট্যাটাসটি শেয়ার সময় লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ থেকে ভূপেন-সুমন হয়ে আবার যেন রবীন্দ্রনাথেই হবে শেষ আশ্রয়স্থল’। আমিও তাঁকে উদ্ধৃত করে ইতি টানি –

সত্য যে কঠিন সে কঠিনেরে ভালবাসিলাম, সে কখনো করেনা বঞ্চনা!