অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজির অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম প্রতিদিন সন্ধ্যার আগ দিয়ে হাঁটতে বের হন। শেখেরটেক আটে তাঁর ফ্লাট বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে তিনি আশেপাশের এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে কি যেন খোঁজেন! তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে যশোরের ভাটপাড়ায়। পড়াশুনা করেছেন যশোর, রাজশাহী ও ঢাকাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ করে ইংল্যান্ডেও গিয়েছিলেন কয়েকবছরের জন্যে। বাপের যে অল্পবিস্তর জমিজমা ছিল সব বিক্রি করে পাড়ি জমালেন। বাড়ির লোকজন কি খাবে এসব ভাবনা ফেলে তিনি শেক্সপিয়ার, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস– এঁরা কি খেতেন তার নমুনা দেখতে চলে গেলেন ইংল্যান্ডে। ডিগ্রি বাহানা ছিল মাত্র। ইচ্ছে ছিল, ইংরেজিটা ঠিকমতো রপ্ত করতে পারলে কবি হয়ে পশ্চিমেই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু তিন বছর কাটতে না কাটতে আবার চলেও এলেন। বললেন, সবকিছুই আছে ওখানে, তবুও কি যেন নেই! আর এখানে কিছুই নেই, আবার কি যেন আছে!
সামন অব দ্য সোয়েল– নাড়ির টান বড় টান, বুঝলে হে– তাঁর ঐ কথা শুনে অধ্যাপক বন্ধু আফসার বলেছিলেন। তিনি উত্তরে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, যার নাড়িই নেই, তার আবার নাড়ির টান! সব বোগাস। আসলে মিডলক্লাস কমপ্লেক্স।
ইংল্যান্ড থেকে একধরনের বনেদি ঠাঁট তিনি নিয়ে এসেছিলেন, যা এতটা বছরেও ফেলতে পারেননি। তোমাকে দেখলে মনে হয়, তুমি হচ্ছ কি যে পারফেক্ট কলোনিয়াল প্রোডাক্ট! আফসার এই সেদিনও বললেন। রেজাউল শুধু তাঁর সহজাত হাসিটা মেলে ধরেছেন। তাঁর হাসিটাও একধরনের রহস্যের মোড়কে মোড়ানো। যারা চেনেন না, তারা বাজি রেখে বলবেন, লোকটির হাসি সন্দেহজনক! আর যারা চেনেন তারা জানেন, অধ্যাপক রেজাউল করিম আপাদমস্তক একজন ভাল মানুষ। শুরুর জীবনে কবি হবেন বলে ইংরেজি সাহিত্যের প্রেমে পড়েন। আস্তে আস্তে ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতিও আপন করার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। কবি হওয়াও হল না তাঁর। যে কয়েকটি কবিতা লিখলেন, নিজেরই পছন্দ হল না। যেদিন চূড়ান্তভাবে বুজলেন কবি হওয়া তাঁর হচ্ছে না, সেদিন থেকেই এভাবে পথে পথে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন! যারা রীতিমত পেছনে লেগে তাঁর হাঁটার রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালিয়েছেন তারাও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে বলেছেন–পাগল নাকি!
আজ অধ্যাপক রেজাউল বের হয়েছেন গেটসবি ক্যাপ, বাদামি রঙের একটা টি-শার্ট আর সেমিবেগি জিনস ও কেডস পরে। শেখেরটেক থেকে হাঁটতে হাঁটতে মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে হয়ে ইকবাল রোডে প্রিপারেটরি স্কুল মাঠসংলগ্ন একটি চায়ের দোকানের সামনে বসেছেন। আশেপাশে আরও কিছু মানুষজন আছে, বেশিরভাগই কলেজপড়–য়া ছাত্র। আগেরদিন শেষ হওয়া বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ম্যাচ নিয়ে আলোচনা চলছে। খানিক বাদে আলোচনা রাগিনী এমএমএস টুয়ের দিকে মোড় মারে। রেজাউল মিনিট দশেক জিরিয়ে নিয়ে চা অর্ডার দিলেন, চায়ের সঙ্গে টাও–সিগারেট ও বিস্কিট। দোকানের ছোকড়াটা বিস্কিটের পিরিচটা হাতে ধরিয়ে দিতেই কয়েকগজ দূরে বসে থাকা কুকুরটা উঠে এলো। কুকুর দেখলেই একধরনের না পাওয়ার অতৃপ্তি রেজাউলের ভেতর কাজ করে। ছাত্রাবস্থা থেকেই শখ ছিল বিলেতি কুকুরের। ইংল্যান্ডে গিয়ে সেই শখ প্যাশন এন্ড ডিজায়ারে পরিণত হয়েছে। ফেরত আসবার সময় ভেবেছিলেন, কিছু ইংরেজি বই আর একটা কুকুর নেবেন সঙ্গে। বই সম্ভব না হলেও কুকুর তিনি নেবেনই। শেষপর্যন্ত কয়েকটা বই হয়েছে, কুকুরটা আর হয়নি। ঢাকায় এসেও বহুবার কাঁটাবনের অ্যানিমেল শপগুলোতে গেছেন– দেখে, দাম জিজ্ঞেস করে– চলেও এসেছেন। একটা কুকুর কেনার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিল। যথেষ্ঠই ছিল। আজীবন ব্যাচেলর, কাজেই বাসাতেও বাগড়া দেবার মতো কেউ ছিল না। কিন্তু কেন কিনলেন না সেটাও তাঁর চরিত্রের অনাবিষ্কৃত রহস্যগুলোর মধ্যে পড়ে। তবে দেশি কুকুর দেখে তাঁর ভেতর কোনো অনভূতি কাজ করে না। তিনি যে দেশি কুকুর খুব ঘৃণা করেন তাও না। হি জাস্ট ডাজেন্ট কেয়ার অ্যাবাউট ইট। আজ এই দেশি কুকুরটা দেখে তাঁর ভারী ভালো লাগলো। তাঁর গায়ের টি-শার্টের মতোই গাঢ় বাদামী রঙ, কেমন ঢিলেঢালা শরীর। বেওয়ারিশ হলেও বোঝা যায়, মানুষের ভালোবাসা সে পেয়েছে। এবং তার ভেতর কেমন একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ব্যাপার আছে। রেজাউল সাহেব বিস্কিটটা না খেয়ে কুকুরটাকে দেখিয়ে মাটিতে রাখলেন। কুকুরটা কয়েকবার শুঁকে মুখে ওঠালো না। দোকানের ছেলেটি উঁচু গলায় বলল– মাটিতে পড়া জিনিস খায় না স্যার। হাতে ধরে দিলে খায়। বিষয়টি রেজাউলের ভারি ভাল লাগলো। আবার সন্দেহও হল। এদেশের মানুষ যেখানে ডাস্টবিনের নোংরাও চেটেপুটে খায় তখন একটা রাস্তার কুকুর এতটা সভ্য হয় কিভাবে! তিনি আরও একটা বিস্কিট আনতে বললেন। ছেলেটি নিয়ে এল, আগের মতোই পিরিচে করে। রেজাউল সাহেব পিরিচ থেকে খালি বিস্কিটটা উঠিয়ে নিলেন। কুকুরটি লেজ নাড়তে নাড়তে যতটা সম্ভব কাছে এলো। একেবারে মুখে তুলে অচেনা একটা কুকুরকে খাওয়ানোর রিস্ক তিনি নিলেন না। বলা তো যায় না, তার ওপর আবার দেশী কুকুর! তিনি উপরে তুলে বিস্কিটটা ছেড়ে দিলেন। কুকুরটি ইঞ্চি আটেক লাফিয়ে লুফে নিলো।
বাহ! বেশ বোঝে তো। রেজাউল বললেন। আরও ক’টি বিস্কিট আনো।
স্যার, ওর কেক বেশি পছন্দ। কেক আনি? ছেলেটি পিরিচ হাতে বলল।
আচ্ছা আনো। রেজাউলের মনে হল, আজ বহুবছর পর তাঁর কুকুরের শখ খানিকটা পূরণ হচ্ছে। তিনি কয়েকশ’ কুকুর খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের ব্রিড নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছেন, দামও জেনেছেন। কিন্তু এভাবে কোনো কুকুরকে তিনি মুখে তুলে খাওয়াননি। আজ একটি বিস্কিট ও দুটি কেক টুকরো টুকরো করে নিজে হাতে খাওয়ালেন। তৃতীয় কেকটাও শেষের দিকে। এমন সময় একটি প্রাইভেট পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। গতি পায়ে হাঁটার মতো। কুকুরটি সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে গাড়িটার দিকে ছুটে গেল। রেজাউল কুকুরের এঁটো কেক হাতে ধরে কেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন।
এই হচ্ছে দেশি কুকুরের স্বভাব, বুজলে? পাশেই আড্ডা দিতে থাকা স্কুলপড়–য়া ছেলেদের লক্ষ করে বললেন তিনি। এদের ভেতর ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। গাড়ি দেখেই আরও ভালো কিছু পাবার আশায় ছুটে গেল। গ্রিড, গ্রিড টু এক্সপেক্ট মোর! এ জাতিকে এটাই ধ্বংস করলো। কুকুর হবে হাচিকোর মতো! হাচির নাম শুনেছ? ছেলেগুলো একটু দ্বিধায় পড়ে গেল– হাচি বলতে তারা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার হাচিকে বোঝে। তাই মুরুব্বি কি বলে শোনার আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো– কই নাতো আঙ্কেল!
শোনো তবে। আকিতা ব্রিডের ছোট্টো হাচিকে জাপানের এক রেল স্টেশনে খুঁজে পায় একজন। ভদ্রলোকের দেখে মায়া হয়। হাচিকে কোলে তুলে তার অনারের জন্য অপেক্ষা করে। ওদেশে তো আর এমন বেওয়ারিশ কুকুর হয় না। সবার কেউ না কেউ মালিক থাকে। টাইম পাসেস বাই বাট নোবডি কামস টু ক্লেইম। শেষপর্যন্ত ভদ্রলোক স্টেশন মাস্টারকে নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে হাচিকে বাসায় নিয়ে আসে। স্ত্রীকে বাসায় ম্যানেজ করে এই বলে, ফোন পেলেই আসল মালিককে ফেরত দেবে। ফোন আর আসে না। ভদ্রলোকই হাছির মনিব বনে যান। ইনফ্যাক্ট, সেটাই তিনি চাচ্ছিলেন। হি ওয়াজ ইন লাভ উইথ হিম! হাচি বড় হয়ে ওঠে। প্রতিদিন স্টেশন পর্যন্ত মনিবকে ছেড়ে আসে, আবার বিকালে ফিরতি ট্রেন এলে তাকে আনতে ছুটে যায়। একদিন বিকালের ট্রেনে মনিব আর ফেরে না। হাচি স্টেশনে অপেক্ষা করে করে ফিরে আসে। পরদিন আবারও যায়। এভাবে প্রতিদিনই। সে তো আর জানে না যে মনিব ঐদিন স্ট্রোক করে অফিসে মারা গেছে!
আঙ্কেল, তারপর? ছেলেগুলোর পাশাপাশি কয়েকজন রিকশাওয়ালাও দাঁড়িয়ে গেছে।
তারপর আর কি! হাচি পাগলের মতো স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকে। দীর্ঘ দশ বছর স্টেশনে অপেক্ষা করে বৃদ্ধ হয়ে ওখানেই মারা যায়। ওর মৃত্যুদিনটিকে জাপানে ডগস ডে হিসেবে পালন করা হয়।
পিরিচ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছোকড়াটার চোখে জল টলমল করছে। অন্যরাও কেমন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তারপর সাইবেরিয়ার স্লেড ডগ বাল্টোর কথা শোনোনি? সে কিভাবে স্টেশন থেকে প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ডিপথেরিয়া এন্টিটক্সিন টেনে এনে মৃতপ্রায় শিশুদের রক্ষা করেছিল! এই হল কুকুর– এনাদার নেম অব ট্রাস্টওয়র্দি– বুঝলে? এমনই বিশ্বস্ত হয় ওরা। কিন্তু আমাদের কুকুরগুলোর দিকে তাকাও। কেমন লোভী আর ছ্যাঁচড়া স্বভাবের! দ্যাটস হোয়াই পিপল স্ল্যাং অন ডগ সো ওফেন ইন দিস কান্ট্রি!
যাই বলেন স্যার, আমাদের এই কুকুরটা কিন্তু অনেক ভালো। কুকুরটি ততক্ষণে এই আলোচনার একেবারে মাঝখানে এসে বসেছে। তাকে দেখিয়েই পিরিচ হাতে চা বিক্রেতা ছোকড়া বলল,
‘হ্যাঁ। নমুনা তো দেখলামই! আমি কেক কিনে খাওয়াচ্ছিলাম, ব্যাটা দামি গাড়ি দেখে আরও ভাল কিছু পাবার আশায় ছুট মারলো। এই তোমার ভাল কুকুরের কাণ্ডজ্ঞান?’
গাড়ির পেছনে তেড়ে যাওয়ার একটা কারণ আছে। ঐ দিনের পর থেকেই ও এদিক দি যত গাড়ি যায় সবগুলার পেছন তেড়ে যায়। খাবার জন্যি না, প্রতিশোধ নিতি।
মানে? ঠিক বুঝলাম না তোর কথা! রেজাউল সাহের একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
জ্বি স্যার, ও আর ওর সাথের এক কুকুর ছিল। ওরা এ পাড়াতিই মানুষ। একসাথে খাতুক, ঘুমাতুক, খেলা করতুক। কয়েকবার বাচ্চাও দিছে। কিন্ত দু’বছর আগে এখানে রাস্তার মদ্যিখানে একটা প্রাইভেট গাড়ি এসে ওর সাথীকে চাপা দি মেরে ফেলে। তারপর থেকেই ও এখান থেকি নড়ে না। কোনো গাড়ি গেলেই তেড়ে যায়।
অধ্যাপক রেজাউল কি বলবেন ভেবে পান না। কুকুরটার চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে তাঁর মায়া হয়। লজ্জাও পান ওকে কেন্দ্র করেই এতক্ষণ ধরে এত আবোল-তাবোল বকার কারণে। ঐ ছোকড়া আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে ফিরে যায়। রেজাউল স্যার কুকুরটার চোখে আরও একবার চোখ রাখেন; অস্পষ্ট স্বরে নিজেকে নিজে সরি বলে উঠে পড়েন।
দোকানে বিল দিতে গেলে চা ছাড়া আর কিছুরই বিল নেয় না চা বিক্রেতা লিকলিকে গড়নের ছেলেটা। বলে, আপনি তো কিছুই খাননি, সব তো আমাদের কুকুরটাই খেয়েছে। বিল লাগবে না স্যার।
রেজাউল আর কথা বাড়ান না। ফেরত পাওয়া টাকাটা আলদা করে ধরে পা বাড়ান। এই প্রথম তাঁর মনে হয়, বিদেশের মতো এই দেশটাও তাঁর অচেনায় রয়ে গেল।
ভাল লাগল।
হলিউড সিনেমা, Hachi: A Dog’s Tale দেখেছিলাম। আবাক করে দিয়েছিল। httpv://www.youtube.com/watch?v=rUNQjYe870A