[ এই লেখাটি কয়েকটিপর্ব আকারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকবে। মূল লেখকঃ “রফিকুর রহমান লজু” ( শিক্ষক, কলামিস্ট, সংস্কৃতিসেবী)। বাংলা-ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোকপাত করাই আমার মূল লক্ষ্য। আত্মপ্রচার মোটেই কাম্য নয় আমার। শুধু ইতিহাসের এই অংশবিশেষ সম্পর্কে সবাইকে জানানোই আমার উদ্দেশ্য। তাই লেখক কর্তৃক প্রকাশিত একটি বার্ষিকী ( জালালাবাদ বার্ষিকী ) থেকে এই প্রবন্ধটুকু সংগ্রহ করা হল ]
আমাদের মহান একুশের মতো বরাক উপত্যকার বাঙ্গালিদেরও একটি মহান দিবস আছে। সেটি ঊনিশে। বাংলাদেশের যেমন মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, বরাক উপত্যকার তেমনিই উনিশে মে। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ঠিক তেমনই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যকার শিলচর শহরে রক্ত-গঙ্গা প্রবাহিত হয়েছিল। সেদিন বিনা উষ্কানিতে বেপরোয়া-বেধড়ক গুলিতে শিলচর শহরে ১১টি তরুণপ্রান ঝরে পড়েছিল। প্রতিবছর উনিশে মে বরাক উপত্যকার জনগন গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় এই ১১জন অকুতোভয় বীরের আত্মোৎসর্হকে স্মরন করেন।
ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ জেলা ও কাছাড় জেলা নিয়ে যে ভূ-ভাগ গঠিত, সেটাই বরাক উপত্যকা নামে পরিচিত। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ব্রম্মপুত্র উপত্যকা ও পার্বত্য এলাকার কিছু অঞ্চল নিয়ে পৃথক একটি প্রদেশ-আসাম প্রদেশ গঠন করে। শ্রীহট্র বা সিলেট ও কাছাড় জেলাকে নবগঠিত আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আসাম প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সিলেট ও কাছাড় জেলার ভাষাসহ নানা ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। সম্ভবত এ কারনেই ব্রিটিশ রাজশক্তি সিলেট ও কাছাড় জেলাকে নিয়ে সুরমা ভ্যালি ডিভিশন নামে একটি আলাদা প্রশাসনিক ইউনিট গঠন করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রদ্বয়ের অভ্যুদয় ঘটলে সিলেট জেলার সাড়ে তিন থানা বাদে বাকি অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিলেট জেলা থেকে কেটে নেওয়া হয় সাড়ে তিন থানা বাদে বাকি অংশ, যা নিয়ে করিমগঞ্জ মহকুমা গঠিত হয়। পরে করিমগঞ্জ মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে সম্পুর্ণ কাছাড় জেলা রয়ে যায় ভারতের অংশে। এভাবে মূল সিলেট জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন সাড়ে তিন থানা যা নিয়ে করিমগঞ্জ জেলা গঠিত হয়। এবং সম্পুর্ণ কাছাড় জেলা নিয়ে ভারতের যে ভূ-খন্ড গঠিত হয়, তারই নাম বরাক উপত্যকা। অর্থাৎ, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ভারতের আসাম রাজ্যের অধীন কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ জেলা বরাক উপত্যকার অন্তর্ভুক্ত। সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিমন্ডলে বরাক উপত্যকার অপর নাম ‘বরাক উপত্যকা : বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় ভুবন’ ।
বরাক উপত্যকায় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বসবাস রয়েছে। এদের মধ্যে বাংলাভাষী জনসংখ্যার আধিক্য বেশি। ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত আসামের আদমশুমারি অনুসারে বরাক উপত্যকার ভাষাভিত্তিক জনসংখ্যা নিম্নরূপঃ
১. বাংলা ভাষীঃ ১৩,৩২,২০০ জন
২. হিন্দি ভাষীঃ ১,৯৩,২০০ জন
৩. মেইতেই মণিপুরিঃ ৬৮৪০০ জন
৪. বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিঃ ৩৩,০০০ জন
৫. ডিমাছাঃ ৯,২০০ জন
৬. অসমীয়াঃ ৬,৮০০ জন
বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার উপর প্রথম আঘাত আসে স্বাধীন ভারতে ১৯৬০ সালে। এ সময় অসমীয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা করার দাবি ওঠে। ২৪ অক্টোবর আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল গৃহীত হয়। এবং বিভিন্ন ভাষাভাষির জনসংখ্যার মধ্যে সর্বনিম্ন সংখ্যার ভাষা অসমীয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এর ফলে বরাক উপত্যকায় সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বরাক উপত্যকার উপর অন্যায়ভাবে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এবং বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যকার সর্বত্র সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়।
১৯মে’র চারদিন আগে ১৫ মে থেকেই শিলচর শহরে সরকারি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী তৎপর ওঠে। প্রতিদিন তারা শহরে রোডমার্চ করছিল। ১৯ মে’র সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সমর্থন ১৮ মে সন্ধ্যায় এক বিরাট গণ-মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে। সরকারের বিশেষ করে রেল চলাচল অব্যাহত ও আন্দোলনমুক্ত রাখতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের ঘোষনা দেয়। সত্যাগ্রহীরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করেছিল। সত্যাগ্রহীরা প্রস্তুতি নেয় ১৮ মে রাত ১২ টার পর রেল স্টেশন দখল করে নিতে। সে অনুযায়ী সত্যাগ্রহী- বাহিনী রাতে রেল স্টেশনে পৌঁছে ঠিকই, কিন্তু পুর্ব-পরিকুল্পনা অনুযায়ী স্টেশন দখলে নিতে পারেনি। তবে পূর্বেই আসাম পুলিশ, সিআরপি , পিএসসি এবং আসাম রাইফেলসের জোয়ানরা স্টেশনের চতুর্দিক কর্ডন করে নেয়। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মহিলা সত্যাগ্রহীরা সরকারি বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এক অভিনব পন্থায় অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে মহিলা সত্যাগ্রহীদের কয়েকজন সাহসী মেয়ে অতর্কিতে সরকারি বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনার আকষ্মিকতায় হতচকিত সরকারি বাহিনীর লোকেরা সড়ে পড়লে সত্যাগ্রহীরা দলে দলে স্টেশনে চত্বরে ঢুকে পড়ে। অন্যদিকে ভোর হবার আগেই হাজার হাজার সত্যাগ্রহী পূর্ব-পরিকল্পনা মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের সামনে দৃঢ় অবস্থান নেয়। আরও হাজার হাজার সত্যাগ্রহী প্রস্তুত থাকে নেতৃত্বের নির্দেশ পালন করে করার জন্য। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পুরুষ-মহিলা সবাই আন্দোলনের সমর্থনে, বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায়। সত্যাগ্রহীরা নিরস্ত্র, অহিংস। তবুও পুলিশি লাঠিচার্জ হয়েছে তাদের ওপরে। কাঁদানো গ্যাস শেল নিক্ষেপ হয়েছে তাদের ওপর। সত্যাগ্রহীদের কেউ কেউ পুলিশের শেলই তুলে নিয়ে পালটা ছুড়ে মেরেছে পুলিশের দিকে। তবুও স্টেশন থেকে সত্যাগ্রহীদের সরানো যায়নি।
[ চলবে]
একটা প্রাসঙ্গিক ছবি।
[img]http://3.bp.blogspot.com/-8lP9yStb6OQ/Uix73efF4DI/AAAAAAAAACg/v_AJAJ-jZFA/s640/1240139_410471165730972_1975735552_n.jpg[/img]
১৯শেমে’র শহীদদের নিয়ে ২০শে মে শোকমিছিল
@অজয় রাউত, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে । 🙂
বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের নিয়েও লেখা হয়েছে আগে, তবু গৌরবগাঁথাগুলো লিখে যেতেই হবে, বিশেষত নতুন প্রজন্মের জন্য!
@কাজি মামুন, হ্যা আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে আমরা তরুন প্রজন্ম অনেকেই এখনো জানিনা। তাই মূল লেখা থেকে হুবহু তুলে ধরার কাজটাই আমি হাতে নিয়েছি।
বাংলাই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যে ভাষার জন্য ঐ ভাষাভাষী লোকেরা নিজের মুল্যবান জীবন অকাতরে বলিদান করেছিল। তাও একবার নয়, দু-দু’বার। কিন্তু আমরা একটা সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল, আরেকটা থেকে যায় বিস্মৃতির অতলে,অজানার গহীন সমুদ্রে। একটাকে নামমাত্র বৈশ্বিক মর্যাদা এনে দিতে পারলেও, অন্যটির ক্ষেত্রে সমগ্র বাঙ্গালীর প্রাণেই ছড়িয়ে দিতে পারিনি। তাই আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ যেটির ন্যুনতম বৈশ্বিক স্বীকৃতি এসেছে সেটিকে সারা বিশ্বের সর্বজনীন একটা দিবসে উন্নীত করা, সকল জাতির মানুষকে এই দিবস পালনে উৎসাহিত করা, আর যেটি অজানার সমুদ্রে লুক্কায়িত আছে সেটিকে জানার ভুবনে প্রকাশিত করা। আর আমি মনে করে এরকম লেখাগুলো এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে।
(Y)
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম। পরের পর্বের অপেক্ষায়…