httpv://www.youtube.com/watch?v=ENrTi2V2WwM

চেতনা। স্বপ্ন। ভালোবাসা।
দুর্বার সাহসিকতা। অসীম ত্যাগ। মহিমান্বিত দেশপ্রেম।
ইতিহাসের বৃষ্টিতে স্নান। ইতিহাসের প্রেক্ষণবিন্দুতে বাস। ইতিহাস হয়ে ওঠা।
তারপর.. ..
নির্জন।
নিঃসঙ্গ।
বিভীষিকা।
বাঙালির বুকের কাছে রিকোয়েলেস রাইফেল। ব্যালটের পায়রায় স্বাধীনতার হৃদপিণ্ড। বুলেটের কর্কশ চিৎকারে হৃদয়ের রক্তাক্ত ক্ষত। পঁচিশে মার্চ। উনিশ শো একাত্তর।

বাঙালি- মহাকাব্যের উপমার মতো উদ্বেল একটি শব্দ; বাঙলাদেশ- অসীম নীলিমার মতোই সুন্দর আর পবিত্র।
পাকিস্তান- শোষকের প্রতিভূ, শুয়োরের বাচ্চা চিনে নেবার ব্যাকরণ; চাঁন তারা মার্কা বেঈমান একটি পতাকা মহাকালের বুকে থুথু’র মতোন।

পঁচিশ, ছাব্বিশ, সাতাশ, আটাশ.. ..মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন.. ..অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর- দীর্ঘ নয় মাস; জানোয়ারের বুলেটের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে মানুষের প্রতিরোধ; ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা, নারকীয় নারী-নির্যাতন, শরণার্থীদের অবর্ণনীয় কষ্ট, উদ্বাস্তু মনের তীব্র যাতনা, বুদ্ধিজীবী হত্যা- এসব কিছু ঠেলে উঠে আসে ‘মুক্তিযুদ্ধ’- দৃপ্ত-বলিষ্ঠ অথচ প্রগাঢ় মায়াময় মুক্তিযুদ্ধ জেগে ওঠে নতুন ভোরের সূর্যের মতো। সাড়ে সাতকোটি বাঙালি হয়ে ওঠে একটি নিটোল কবিতা। একজন মুক্তিযোদ্ধার চোখের গহীনে তাকালে দেখা যায় বাঙলাদেশ, হাজার মুক্তিযোদ্ধার চোখের ফ্রেমে সে-ই একই দৃশ্যপট। লিয়ার লেভিনের ক্যামেরা জুম আউট হতে থাকে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মিলিত মানচিত্র- বাঙলাদেশ। হৃদয়ের অভিধানে বাঙলাদেশের আরেকটি নাম লেখা হয়ে যায়। দোলনচাঁপার গন্ধ বুকে নিয়ে পাঠ করলে দেখা যায়, সে নামটি ‘বঙ্গবন্ধু’।

পনেরোই আগস্ট, উনিশ শো পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কেবল এখানেই বক্তব্য শেষ হয় না- আরও কিছু থেকে যায়; কেননা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরই সঙবিধান থেকে মুছে ফেলা হয় ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র মতো দুটো অনস্বীকার্য বিষয় এবঙ সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয় মৌলভীতন্ত্র। অসাম্প্রদায়িক বাঙলাদেশের যে অবিনাশী চেতনাকে বুকে ধারণ করে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো, স্বাধীনতা নিয়ে এসেছিলো প্রাণময়ী ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের জন্যে; সেখানে সামরিক উর্দির রজঃস্রাবে লেখা হয়েছে- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তাই পনেরোই আগস্ট বাঙালি কেবল বঙ্গবন্ধুকেই হারায়নি, হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বাঙলাদেশটাকেও।

এই লেখাটি ধারাবাহিক- কেননা, এর মধ্য দিয়ে তুলে আনার ইচ্ছে আছে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর থেকে বাহাত্তর সালের দশই জানুয়ারিতে তাঁর দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত কয়েকটি ঘটনাবলী। আন্তর্জাতিক নানা রাজনৈতিক জটিলতার আবর্তে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবঙ তার সাথেই বঙ্গবন্ধুর মু্ক্তির প্রশ্নটি আবর্তিত হয়েছে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটি চেতনা, একটি প্রতীক, আকাশের মতোন সামিয়ানা। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী কেবল নির্মম গণহত্যাই চালায়নি, তারা গ্রেফতার করেছিলো বঙ্গবন্ধুকে এবঙ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো শকুনের দেশে- করাচীতে। একটি সবুজ প্যাডে কাঠপেন্সিল দিয়ে অপারেশন সার্চ লাইটের বিভৎস পরিকল্পনা করে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা (১) ও রাও ফরমান আলী। বিশ মার্চ, উনিশ শো একাত্তরের বিকেলে সিদ্ধান্ত হয় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনারত অবস্থাতেই গ্রেফতার করা হবে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে। তবে এ বিষয়টি জানোয়ার ইয়াহিয়া মেনে নেয়নি। তার বক্তব্য ছিলো-

আওয়ামী নেতাদের এভাবে গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়া হবে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক (২)

তবে পঁচিশে মার্চ রাতে সামরিক আদেশেই স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের এক প্ল্যাটুন কমান্ড নিয়ে বত্রিশ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো। তাঁকে কীভাবে গ্রেফতার করা হলো তা পাকিস্তানি বাহিনীর ওয়্যারলেস মেসেজ হতে জানা যায়।

From 99: Subsequently these were repeated to you starting from Commando Unit headed by Col Sayeeduddin. When they caged the main bird Sheikh Mujib and subsequently the two telephone exchanges, the P.S. at Rahman, People’s Daily, the Reserve Line, then the action that is still continuing in the area of University plus the houses in Gulshan, correction, houses in Dhanmandi, the occupants of which were not traceable. Over.. ..To 99: 16 has very little resistance in which they killed 4 and wounded about 10 after that they were fully in control House raid (Mujib’s Residence). As regards 41 their operation regarding. (৩)

বঙ্গবন্ধুকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো। চারদিকে তখন বিভৎস গণহত্যা চলছে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর পাকিস্তানি বর্বর সরকার বিভিন্ন সঙবাদমাধ্যমে যে সব বিবৃতি দিয়েছে, তা সাপ-লুডু খেলারই নামান্তর। নিচে তার একটি নমুনা উল্লেখ করা হলো-

প্রশ্ন: শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ্য দেশ কিভাবে বিচ্ছিন্ন হতে পারে? প্রেসিডেন্ট নিজেই মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে প্রাইম মিনিস্টার পদে আসীন হওয়ার জন্যে আহবান জানিয়েছেন। তাহলে তাকে কেমন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে হঠাৎ চিহ্নিত করা হলো?
উত্তর: প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। কিন্তু একটি গোষ্ঠী এজন্য চেষ্টা করতে পারে। অখণ্ড পাকিস্তানের অধিনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসনের ম্যান্ডেট লাভ করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পাকিস্তানে তাঁর ভূমিকা রাখতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে যেতেও অপারগতা প্রকাশ করেন।.. ..শেখ মুজিবুর রহমান ২৭ তারিখে হরতাল আহবান করেন এবং জনগণকে অধিকার আদায়ের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন “This will be the last time”

প্রশ্ন: শেখ মুজিবের বিচার হবে কি সামরিক শাসনের অধীনে না সাধারণ ফৌজাদারি আইনে?
উত্তর: দেশে এখনও সামরিক শাসন বলবৎ।

প্রশ্ন: তিনি কোথায় এবং তাঁর ভাগ্যলিখন কি হতে পারে?
উত্তর: তাঁর অধিকাংশ লোকজনই কলকাতায় ভাল সময় অতিবাহিত করছে। পৃথিবীর অন্য সব এলাকার লোকজনদের মত তারা ভাল-মন্দ মিলিয়েই আছে। তিনি অন্যান্য অপরাধিদের মতই দোষী। (৪)

httpv://www.youtube.com/watch?v=ehATucv_dPs&feature=related

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি নিজেই পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত সাঙবাদিক ডেভিট ফ্রস্টকে (জন্ম: ৭ এপ্রিল, ১৯৩৯) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-

.. ..আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিলো। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। প্রথমে ওরা ভেবেছিলো, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপোসের আলোচনা করছিলো, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে ‘বেরুব, না বেরুব না’ নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানী বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। এক হত্যাযজ্ঞ ওরা সমাপ্ত করবে। আমি স্থির করলাম, আমি মরি তাও ভালো, তবুও আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।.. .. যে মানুষ মরতে রাজী, তাঁকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস। (৫)

httpv://www.youtube.com/watch?v=PKuKApv69_M

httpv://www.youtube.com/watch?v=hXZahA8D7JE&feature=related

বত্রিশ নম্বরে এসে স্ট্যানগানের ব্রাশ ফায়ারের মাধ্যমে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী তাদের উপস্থিতি সঙবাদ ঘোষণা করলো এবঙ চিৎকার করে বঙ্গবন্ধুকে বেরিয়ে আসার আহবান জানালো। কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। তারপর দুপদাপ শব্দ তুলে হুড়োহুড়ি করে বারান্দায় উঠলো তারা। এরপর দোতলায়। গ্রেফতার করা হলো বঙ্গবন্ধুকে- বাঙলাদেশের আকাশকে। রাতের জন্যে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো আদমজী স্কুলে। পরের দিন তাঁকে ফ্লাগ স্টাফ হাউসে সরিয়ে নেয়া হলো। সেখান থেকে তিনদিন পর তাঁকে করাচীতে নিয়ে যাওয়া হলো। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বিষয়টি যখন আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হলো তখন ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফরের একটি বিবৃতি থেকে জানা যায়-

.. ..আমি বন্ধু মেজর বিল্লালের কাছে জানতে চাইলাম কেনো সে উত্তেজনার মুহূর্তে মুজিবকে শেষ করে দিলো না। সে বললো- মুজিবকে জীবন্ত গ্রেফতারের জন্য জেনারেল মিঠ্ঠা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন। (৬)

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পাঁচ মাস পরে ধানমণ্ডির বাড়ি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্বন্ধে একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়। সেখানে লেখা হয়-

ঢাকার বিলাসবহুল ধানমণ্ডি এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে বিবর্ণ হলুদ রঙের তিনতলা বাড়িটা। শোনা যায় বর্সার রাতে এ বাড়িতে ভূতেরা আনাগোনা করে। বেশিরভাগ জানালার কাঁচ ভাঙা, প্রায় প্রত্যেকটা দেয়ালে গুলির চিহ্ন। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে বেড়ে ওঠা আইভি লতায় ঢেকে গেছে ইটের দেওয়াল। পুরোনো গাছগুলোর ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে দেওয়ালে লেখা শ্লোগানটি চোখে পড়ে- জয় বাংলা।

আওয়ামী লীগের কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি এটি। ধূমকেতুর মতো যিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছেন। তার আকস্মিক অস্বীকৃতি এবং সেনাবাহিনীর হাতে তার গ্রেফতারে লাখ লাখ দেশবাসীর স্বপ্নে মিশে গেছে দুঃস্বপ্ন। গত এক বছর ধরে মুজিবের জ্বালাময়ী ভাষণে দেশের মানুষের রক্তে জেগে উঠতো প্রবল উন্মাদনা। বাড়িটির মাঝামাঝি একটি ঘরে থাকতেন মুজিব। সেখানে এখনও একগাদা না খোলা চিঠি পড়ে আছে। বিয়ের আমন্ত্রণ, বিভিন্ন বিষয়ে অনুরোধ, উপরোধ দুর্বোধ্য বাংলা ভাষায় (আমাদের কাছে) পাতার পর পাতা লেখা।

তাঁর টেবিলের উপর পড়ে আছে স্যার আইভর জেনিংসের ‘কনস্টিটিউশনাল প্রবলেমস অব পাকিস্তান’ (৭)। জুবেরি নামের কোনো এক শিক্ষক তাঁর ছাত্র মুজিবকে উপহার দিয়েছেন বইটি। ভেতরের পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে- রাজনীতি ক্ষমতার পথে ধাবিত করে, কিন্তু জ্ঞানও শক্তি। প্রত্যেকবার জেলে বসে বইটি পড়েছেন তিনি। কিন্তু এবারে আর বইটি সঙ্গে নিতে পারেননি। (৮)

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর কী ঘটেছিলো- তা নিয়ে আমির তাহেরির আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘মুখবন্ধ: চুপচাপ’ শিরোনামে। সেখানে উল্লেখ করা হয়।

গ্রেফতারের পর কারও সঙ্গে কথা বলেননি তিনি। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটায় নেওয়ার উদ্দেশে করাচী বিমান বন্দরে তাঁকে অন্য বিমানে তোলা হয়। ভি.আই.পি লাউঞ্জে নেবার পর দুজন পুলিশকে তাঁর পেছনে দাঁড় করিয়ে ছবি নেওয়া হয়।

মুজিব এখন কোথায়, কীভাবে আছেন এ সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে স্থানান্তর করা হয় তাঁকে। গত কয়েক সপ্তাহ (জুলাই-আগস্ট মাস) ধরে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে অনবরত লিখে যেতে দেখা যায় তাঁকে। তিনি কি লিখেছিলেন- তা অবশ্য কেউ জানে না।

পাকিস্তান সরকার নানাভাবে এই গুজবটি ছড়ানোর চেষ্টা করছে যে- মুজিবের মানসিক বৈকল্য দেখা দিয়েছে এবং দিনের কয়েকঘণ্টা প্রলাপ বকছেন। তবে প্রতিবেদন লেখার আগে আমি প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছি যে- এটা সেনাবাহিনীর ছড়ানো গুজব। আওয়ামী লীগ প্রধান মোটামুটি ভালোই আছেন।.. ..আইনজীবী ও সামরিক প্রধানদের একটি দল তাঁর বিরুদ্ধে মামলার শুনানি তৈরি করছে। গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর বিচার শুরু হবে। সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু। (৯)

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও বন্দী অবস্থায় করাচী নিয়ে যাবার প্রসঙ্গে এস. এ. করিম উল্লেখ করেন-

একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে- ২৬ মার্চে বন্দী মুজিবকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত গ্রেফতারের সঙবাদ বা সঙবাদচিত্রটি গোপন রাখা হয়েছিলো কেনো? সার্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে- পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে কমান্ডো স্টাইলে গ্রেফতারের পর অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় ছিলো যাতে সঙবাদটি প্রকাশিত না হয় কারণ ঢাকায় তার অবস্থান বা বিমানপথে করাচী নেবার পথে যেনো ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তান বিমানকে ইন্টারসেপ্ট করে ভারতের দিকে নিয়ে যেতে না পারে। যে কারণে তাঁর গ্রেফতারের ঘোষণা বিলম্বিত হয়। (১০)

করাচী পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর বর্তমানে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ কারাগারে নেয়া হয়। তাঁকে একটি অতি ক্ষুদ্র সেলে রাখা হয়- যেখান থেকে লোহার শিক দ্বারা বেষ্টিত ছোট্ট ফাঁকা জায়গা থেকে এই বিশ্বজগৎ প্রায় আবছা। প্রচণ্ড গরম অথচ কোনো বৈদ্যুতিক পাখা ছিলো না- পরবর্তী সময়ে একটি পুরোনো বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো হলো- যা মূলত ঘরের গরমকে আরও ছড়িয়ে দেবার জন্যই। এছাড়াও আরও নানা রকমের অত্যাচার ছিলো সেখানে। বঙ্গবন্ধু এসব তোয়াক্কা করেননি, তবে বেদনাবোধ করেছেন বাঙলাদেশের জন্য- যে বাঙলাদেশটি তখন জন্ম নেবার জন্যে লড়ছে।

এস. এ. করিম আরও লিখেছেন-

শেখ মুজিবের তাঁর নিজের ললাট লিখন নিয়ে মায়া ছিলো না। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে তিনি লক্ষ্য করেছেন, কীভাবে পাকিস্তানি সৈন্য লুটপাট ও অগ্নিসঙযোগ করেছিলো এবঙ নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিলো। এদের হাত থেকে বাঁচার কোনো আশা তিনি করেননি। ইয়াহিয়ার ইচ্ছা ছিলো বিচারের মাধ্যমে তাঁকে হত্যা করা। মার্শাল ল কোর্টে নেয়ার সময় মুজিব যেনো সুস্থ থাকে এ বিষয়টি তার মনে ছিলো। যে কারণে মুজিবকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়নি। কিছুদিন একজন বাঙালি বাবুর্চিকে লায়ালপুরে ভাড়া করা হয়েছিলো তাঁর বাঙালি রান্নার জন্য। কেননা ইতোমধ্যেই তাঁর শরীর ভেঙে যাচ্ছিলো। তাঁর পাইপে তাঁর পছন্দের তামাক সরবরাহ করা হয়। তাঁকে দেখার জন্য একজন ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। লন্ডনের ফিনানশিয়াল টাইমস পত্রিকার সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া বলে যে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, খুব শীঘ্রই তাঁর বিচার কাজ শুরু করবে। ১৯ জুলাই, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া আরও বলে- তাঁর বিচার হবে সিক্রেট মিলিটারী ট্রাইবুন্যালে। যদিও সে ঘোষণা করে বলেনি, তাঁর বিরুদ্ধে কী ধরণের কয়টি চার্জ গঠন করা হবে। কিন্তু এ কথা সে বলে যে- এই চার্জশীটে মৃত্যুদণ্ডের কয়েকটি ধারা থাকবে। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হবে এবঙ মুজিব একজন মাত্র পাকিস্তানি আইনজীবীর সহায়তা নিতে পারবেন। (১১)

এ থেকে পরিস্কার হয় যে- বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে জানোয়ার ইয়াহিয়া আগরতলা মামলার মতো কোনো জটিলতায় পা ফেলতে চায়নি। আগরতলা মামলায় ইঙরেজ আইনজীবী নিয়োগ ও প্রকাশ্য বিচার করায় সাক্ষীগণের জেরায় সমস্ত মামলা লেজে গোবরে হয়ে গিয়েছিলো। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে তাদের চিন্তা ছিলো যে, এটি হবে সিক্রেট ট্রায়াল এবঙ কোনো সঙবাদ বাইরে আসতে পারে বা কোনো সাঙবাদিক বা পর্যবেক্ষক সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবে না। জানোয়ার ইয়াহিয়া মনে করতো ট্রাইবুন্যালে বিচারের রায় পাকিস্তানিদের সন্তুষ্টি দেবে এবঙ তাঁর বিরুদ্ধে যে ধরণের গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ গঠন করা হয়েছে তার যথাযথ বিচার বঙ্গবন্ধু পাবেন।

কারাগারের কাছেই একটি লাল ভবনে ট্রায়ালের জন্য ১৯ আগস্ট শেখ মুজিবকে স্পেশাল মিলিটারী ট্রাইবুন্যালের নিকট হাজির করা হয়। প্রিজাইডিঙ বিচারপতি ছিলো একজন ব্রিগেডিয়ার। কোর্টের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে দুজন ছিলো সামরিক অফিসার, একজন নেভাল অফিসার এবঙ পাঞ্জাব থেকে আগত একজন জেলা জজ। যখন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ডিফেন্স কাউন্সিল সিলেক্ট করার জন্য বলা হয় তখন তিনি ড. কামাল হোসেনকে আইনজীবী হিশেবে নিয়োগের কথা বলেন। তাঁকে বলা হলো- এটা সম্ভব নয়। তখন বঙ্গবন্ধু এ. কে. ব্রোহিকে আইনজীবী হিশেবে গ্রহণ করেন। ছাব্বিশে মার্চ জানোয়ার ইয়াহিয়া খানের প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রম, অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ বলে অভিযোগ উল্লিখিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ট্রায়ালে অঙশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবঙ ব্রোহিকে বিদায় করে দেন। কিন্তু বোর্ডের অনুরোধে ব্রোহি রাষ্ট্রপক্ষ হতে প্রতিনিধিত্ব করে। বঙ্গবন্ধুর বুঝতে সমস্যা হয়নি- এটা বিচারের নামে প্রহসন চলছে। সাজানো মৃত্যুদণ্ড। তিনি ছিলেন নির্বিকার। একের পর এক সাক্ষী আসছে, পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে ধ্বঙসের জন্য বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করে সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রসিকিউশন ১০৬ জনের সাক্ষ্য তালিকা ট্রাইবুন্যালে পেশ করে, কিন্তু তার অর্ধেককেও বোর্ডের সামনে উপস্থিত করা হয়নি। যারা কেবলমাত্র সামরিক অফিসে বা পুলিশের কাছে জবানবন্দী দিয়েছিলো, তাদেরই হাজির করা হয়েছে। ব্রোহি কোর্টের নিকট আবেদন করেন যারা ক্র্যাক ডাউনের পূর্বে ঢাকায় আলোচনায় অঙশগ্রহণ করেছিলো যেমন- কর্নেলিয়াস, পীরজাদা, এম. এম. আহমদ তাদের হাজির করা হোক। ব্রোহি তাদের জেরা করার আবেদন জানায়- কিন্তু কোর্ট তার আবেদন নাকচ করে দেয়।

এভাবেই একটি প্রহসনমূলক বিচার চলতে থাকে পাকিস্তানে; আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় সে-ই মানুষটিকে, যিনি বাঙালির জন্যে ছিলেন এক অগ্নিপক্ষ মুক্তি পাখি, যিনি গান শুনিয়েছিলেন স্বাধীনতার; আর তখনই পুড়ছে বাঙলাদেশ, গণহত্যা-নারী নির্যাতন-বিপর্যস্ততার সমস্ত মাপকাঠিতে তিলে তিলে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধ করছে বাঙলাদেশ। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জানোয়ার ইয়াহিয়া কর্তৃক পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর এই সাজানো বিচারের নানা প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো। কিন্তু সে বিষয়গুলো আগামী পর্বে নয়; বরঙ আগামী পর্বে আলোচনা করা হবে- স্বয়ঙ পাকিস্তান সরকার কতো রকমের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছিলো বিষয়টি সম্বন্ধে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে নানা রকমের মিথ্যাচারের মাধ্যমে একটি ছলনার প্রলেপ জড়াতে চেয়েছিলো বর্বর পাকিস্তানি গোষ্ঠী- তারই একটি বিবরণ তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে আগামী পর্বে।

পঁচিশে মার্চ, উনিশ শো একাত্তর থেকে যে দীর্ঘ সময়টি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, সে সময় তিনি এক মুহূর্তের জন্যে স্বদেশভূমিকে ভোলেননি, বরঙ বুকের কাছে আঁকড়ে ধরেছেন নিজের দেশ, পতাকা আর বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত চেতনাকে। মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে যে দেশের মানুষকে তিনি ভোলেননি, যে দেশকে তিনি ভুলেননি- সেই স্বদেশভূমিতেই পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট তিনি বুকের রক্তে পলিমাটি সিক্ত করেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যদি মহাকাব্য হয়, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সেই মহাকাব্যের ট্র্যাজিডি।

ট্র্যাজিডির সে-ই শোকটুকু এখনো বয়ে বেড়াই উষ্ণতার বিবর্ণ গোলার্ধে।

তথ্যসূত্র

১। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা (১৯২২-১৯৯৯) ছিলো অপারেশন সার্চ লাইটের অন্যতম পরিকল্পনাকারী। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে ঢাকা জিওসি’র অফিসে বসে সে এই নৃশঙস পরিকল্পনাটি করে আর তা অনুমোদন করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও জেনারেল আব্দুল হামিদ খান। মেজর জেনারেল খাদিমের উপর অর্পিত হয়েছিলো সমগ্র প্রদেশের প্রতিরোধকে নির্মূল করে তা কব্জা করার দায়িত্ব। পঁচিশে মার্চে বাঙালি নিধনযজ্ঞে তার ছিলো অগ্রণী ভূমিকা। সম্প্রতি A stranger in my own country. East Pakistan, 1969–1971 শিরোনামে তার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মূল বই ১১১ পাতার দাম ৬৯৫ পাকিস্তানি টাকা। এর বিজ্ঞাপনের জন্যে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে এইটা প্রমাণের যে- সে ছিলো বাঙালির প্রতি সমব্যথী। কিন্তু ইতিহাস ঠিক উল্টো সাক্ষ্য দেয়। ১৯৬৯ সালে খাদিমকে মেজর জেনারেল পদে প্রমোশন দিয়ে ১০৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়। এর সদর ছিলো যশোর। একই সঙ্গে সে খুলনা ডিভিশনের উপ-সামরিক আইন প্রশাসকও নিযুক্ত হয়। যশোরে এসে সে কী দেখলো? তার একটি বর্ণনা তার গ্রন্থে রয়েছে-

পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে এর দীর্ঘ সীমানা এবঙ সীমান্তে পারাপার প্রায় খোলাখুলি হচ্ছে। খুলনা থেকে কোলকাতা চল্লিশ মাইল দূরে, এখানে বিশ ভাগ হিন্দু। এবঙ অনুপ্রবেশ অপ-তৎপরতা, ধ্বংসাত্মক কাজে এটি আদর্শ পরিবেশের সৃষ্টি করেছিলো শত্রু ভারতের জন্য। খুলনায় শ্রমিকদের বেশ বড়োসড়ো সমাবেশ ছিলো যারা অসন্তোষে টগবগ করে ফুটছিলো (কেনো ফুটছিলো তার কিন্তু কোনো উল্লেখ নেই)। সঙখ্যালঘু হিন্দু, আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট এবঙ আওয়ামী লীগের মিলিট্যান্টদের টাকা দিয়ে হিন্দু ভারত অপতৎপরতা চালাতে পারতো। কারণ, সীমান্তের ওপার থেকে তারা সব রকম সাহায্য পেতো।

প্রথম ছয় পাতার মধ্যেই খাদিম হিন্দু এবঙ আওয়ামী লীগারদের নিয়ে এসেছে তার পূর্বসূরিদের মতো।

২। নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, ভাষান্তর: মাসুদুল হক, পৃষ্ঠা: ৭৫
৩। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৭৮
৪। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৬৫, ৩৬৬, ৩৭৫। সূত্র: পাকিস্তান সরকারের প্রচার পুস্তিকা।
৫। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু’র সাক্ষাৎকার। ১৮ জানুয়ারি, ১৯৭২।
৬। বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত। পৃষ্ঠা: ২৩৪
৭। মূল বইটির নাম Constitutional Problems in Pakistan, লেখক স্যার আইভর জেনিঙস (১৬ মে, ১৯০৩-১৯ ডিসেম্বর, ১৯৬৫)। লেখক ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অক্টোবর, ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে উদ্ভূত সাঙবিধানিক জটিলতার প্রেক্ষিতে গ্রন্থটি লিখিত। মূল প্রতিবেদনে গ্রন্থটির নাম ভুলভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো।
৮। আমির তাহেরির প্রতিবেদন। সূত্র: কাইহান ইন্টারন্যাশনাল, ২৭ জুলাই, ১৯৭১ [ভাষান্তর: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ]
৯। আমির তাহেরির প্রতিবেদন। সূত্র: কাইহান ইন্টারন্যাশনাল, ১ আগস্ট, ১৯৭১ [ভাষান্তর: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ]
১০। SHEIKH MUJIB TRIUPH AND TRAGEDY, S. A. Karim, page: 224
১১। SHEIKH MUJIB TRIUPH AND TRAGEDY, S. A. Karim, page: 227

৩১ শ্রাবণ, ১৪১৯