httpv://www.youtube.com/watch?v=ENrTi2V2WwM
চেতনা। স্বপ্ন। ভালোবাসা।
দুর্বার সাহসিকতা। অসীম ত্যাগ। মহিমান্বিত দেশপ্রেম।
ইতিহাসের বৃষ্টিতে স্নান। ইতিহাসের প্রেক্ষণবিন্দুতে বাস। ইতিহাস হয়ে ওঠা।
তারপর.. ..
নির্জন।
নিঃসঙ্গ।
বিভীষিকা।
বাঙালির বুকের কাছে রিকোয়েলেস রাইফেল। ব্যালটের পায়রায় স্বাধীনতার হৃদপিণ্ড। বুলেটের কর্কশ চিৎকারে হৃদয়ের রক্তাক্ত ক্ষত। পঁচিশে মার্চ। উনিশ শো একাত্তর।
বাঙালি- মহাকাব্যের উপমার মতো উদ্বেল একটি শব্দ; বাঙলাদেশ- অসীম নীলিমার মতোই সুন্দর আর পবিত্র।
পাকিস্তান- শোষকের প্রতিভূ, শুয়োরের বাচ্চা চিনে নেবার ব্যাকরণ; চাঁন তারা মার্কা বেঈমান একটি পতাকা মহাকালের বুকে থুথু’র মতোন।
পঁচিশ, ছাব্বিশ, সাতাশ, আটাশ.. ..মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন.. ..অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর- দীর্ঘ নয় মাস; জানোয়ারের বুলেটের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে মানুষের প্রতিরোধ; ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা, নারকীয় নারী-নির্যাতন, শরণার্থীদের অবর্ণনীয় কষ্ট, উদ্বাস্তু মনের তীব্র যাতনা, বুদ্ধিজীবী হত্যা- এসব কিছু ঠেলে উঠে আসে ‘মুক্তিযুদ্ধ’- দৃপ্ত-বলিষ্ঠ অথচ প্রগাঢ় মায়াময় মুক্তিযুদ্ধ জেগে ওঠে নতুন ভোরের সূর্যের মতো। সাড়ে সাতকোটি বাঙালি হয়ে ওঠে একটি নিটোল কবিতা। একজন মুক্তিযোদ্ধার চোখের গহীনে তাকালে দেখা যায় বাঙলাদেশ, হাজার মুক্তিযোদ্ধার চোখের ফ্রেমে সে-ই একই দৃশ্যপট। লিয়ার লেভিনের ক্যামেরা জুম আউট হতে থাকে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মিলিত মানচিত্র- বাঙলাদেশ। হৃদয়ের অভিধানে বাঙলাদেশের আরেকটি নাম লেখা হয়ে যায়। দোলনচাঁপার গন্ধ বুকে নিয়ে পাঠ করলে দেখা যায়, সে নামটি ‘বঙ্গবন্ধু’।
পনেরোই আগস্ট, উনিশ শো পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কেবল এখানেই বক্তব্য শেষ হয় না- আরও কিছু থেকে যায়; কেননা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরই সঙবিধান থেকে মুছে ফেলা হয় ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র মতো দুটো অনস্বীকার্য বিষয় এবঙ সেখানে প্রতিস্থাপন করা হয় মৌলভীতন্ত্র। অসাম্প্রদায়িক বাঙলাদেশের যে অবিনাশী চেতনাকে বুকে ধারণ করে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো, স্বাধীনতা নিয়ে এসেছিলো প্রাণময়ী ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের জন্যে; সেখানে সামরিক উর্দির রজঃস্রাবে লেখা হয়েছে- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তাই পনেরোই আগস্ট বাঙালি কেবল বঙ্গবন্ধুকেই হারায়নি, হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বাঙলাদেশটাকেও।
এই লেখাটি ধারাবাহিক- কেননা, এর মধ্য দিয়ে তুলে আনার ইচ্ছে আছে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর থেকে বাহাত্তর সালের দশই জানুয়ারিতে তাঁর দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত কয়েকটি ঘটনাবলী। আন্তর্জাতিক নানা রাজনৈতিক জটিলতার আবর্তে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবঙ তার সাথেই বঙ্গবন্ধুর মু্ক্তির প্রশ্নটি আবর্তিত হয়েছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটি চেতনা, একটি প্রতীক, আকাশের মতোন সামিয়ানা। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী কেবল নির্মম গণহত্যাই চালায়নি, তারা গ্রেফতার করেছিলো বঙ্গবন্ধুকে এবঙ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো শকুনের দেশে- করাচীতে। একটি সবুজ প্যাডে কাঠপেন্সিল দিয়ে অপারেশন সার্চ লাইটের বিভৎস পরিকল্পনা করে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা (১) ও রাও ফরমান আলী। বিশ মার্চ, উনিশ শো একাত্তরের বিকেলে সিদ্ধান্ত হয় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনারত অবস্থাতেই গ্রেফতার করা হবে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে। তবে এ বিষয়টি জানোয়ার ইয়াহিয়া মেনে নেয়নি। তার বক্তব্য ছিলো-
আওয়ামী নেতাদের এভাবে গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়া হবে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক (২)
তবে পঁচিশে মার্চ রাতে সামরিক আদেশেই স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের এক প্ল্যাটুন কমান্ড নিয়ে বত্রিশ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো। তাঁকে কীভাবে গ্রেফতার করা হলো তা পাকিস্তানি বাহিনীর ওয়্যারলেস মেসেজ হতে জানা যায়।
From 99: Subsequently these were repeated to you starting from Commando Unit headed by Col Sayeeduddin. When they caged the main bird Sheikh Mujib and subsequently the two telephone exchanges, the P.S. at Rahman, People’s Daily, the Reserve Line, then the action that is still continuing in the area of University plus the houses in Gulshan, correction, houses in Dhanmandi, the occupants of which were not traceable. Over.. ..To 99: 16 has very little resistance in which they killed 4 and wounded about 10 after that they were fully in control House raid (Mujib’s Residence). As regards 41 their operation regarding. (৩)
বঙ্গবন্ধুকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো। চারদিকে তখন বিভৎস গণহত্যা চলছে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর পাকিস্তানি বর্বর সরকার বিভিন্ন সঙবাদমাধ্যমে যে সব বিবৃতি দিয়েছে, তা সাপ-লুডু খেলারই নামান্তর। নিচে তার একটি নমুনা উল্লেখ করা হলো-
প্রশ্ন: শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ্য দেশ কিভাবে বিচ্ছিন্ন হতে পারে? প্রেসিডেন্ট নিজেই মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে প্রাইম মিনিস্টার পদে আসীন হওয়ার জন্যে আহবান জানিয়েছেন। তাহলে তাকে কেমন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে হঠাৎ চিহ্নিত করা হলো?
উত্তর: প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। কিন্তু একটি গোষ্ঠী এজন্য চেষ্টা করতে পারে। অখণ্ড পাকিস্তানের অধিনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসনের ম্যান্ডেট লাভ করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পাকিস্তানে তাঁর ভূমিকা রাখতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে যেতেও অপারগতা প্রকাশ করেন।.. ..শেখ মুজিবুর রহমান ২৭ তারিখে হরতাল আহবান করেন এবং জনগণকে অধিকার আদায়ের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন “This will be the last time”প্রশ্ন: শেখ মুজিবের বিচার হবে কি সামরিক শাসনের অধীনে না সাধারণ ফৌজাদারি আইনে?
উত্তর: দেশে এখনও সামরিক শাসন বলবৎ।প্রশ্ন: তিনি কোথায় এবং তাঁর ভাগ্যলিখন কি হতে পারে?
উত্তর: তাঁর অধিকাংশ লোকজনই কলকাতায় ভাল সময় অতিবাহিত করছে। পৃথিবীর অন্য সব এলাকার লোকজনদের মত তারা ভাল-মন্দ মিলিয়েই আছে। তিনি অন্যান্য অপরাধিদের মতই দোষী। (৪)
httpv://www.youtube.com/watch?v=ehATucv_dPs&feature=related
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি নিজেই পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত সাঙবাদিক ডেভিট ফ্রস্টকে (জন্ম: ৭ এপ্রিল, ১৯৩৯) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-
.. ..আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিলো। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। প্রথমে ওরা ভেবেছিলো, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপোসের আলোচনা করছিলো, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে ‘বেরুব, না বেরুব না’ নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানী বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। এক হত্যাযজ্ঞ ওরা সমাপ্ত করবে। আমি স্থির করলাম, আমি মরি তাও ভালো, তবুও আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।.. .. যে মানুষ মরতে রাজী, তাঁকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস। (৫)
httpv://www.youtube.com/watch?v=PKuKApv69_M
httpv://www.youtube.com/watch?v=hXZahA8D7JE&feature=related
বত্রিশ নম্বরে এসে স্ট্যানগানের ব্রাশ ফায়ারের মাধ্যমে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী তাদের উপস্থিতি সঙবাদ ঘোষণা করলো এবঙ চিৎকার করে বঙ্গবন্ধুকে বেরিয়ে আসার আহবান জানালো। কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। তারপর দুপদাপ শব্দ তুলে হুড়োহুড়ি করে বারান্দায় উঠলো তারা। এরপর দোতলায়। গ্রেফতার করা হলো বঙ্গবন্ধুকে- বাঙলাদেশের আকাশকে। রাতের জন্যে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো আদমজী স্কুলে। পরের দিন তাঁকে ফ্লাগ স্টাফ হাউসে সরিয়ে নেয়া হলো। সেখান থেকে তিনদিন পর তাঁকে করাচীতে নিয়ে যাওয়া হলো। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বিষয়টি যখন আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হলো তখন ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফরের একটি বিবৃতি থেকে জানা যায়-
.. ..আমি বন্ধু মেজর বিল্লালের কাছে জানতে চাইলাম কেনো সে উত্তেজনার মুহূর্তে মুজিবকে শেষ করে দিলো না। সে বললো- মুজিবকে জীবন্ত গ্রেফতারের জন্য জেনারেল মিঠ্ঠা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন। (৬)
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পাঁচ মাস পরে ধানমণ্ডির বাড়ি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্বন্ধে একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়। সেখানে লেখা হয়-
ঢাকার বিলাসবহুল ধানমণ্ডি এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে বিবর্ণ হলুদ রঙের তিনতলা বাড়িটা। শোনা যায় বর্সার রাতে এ বাড়িতে ভূতেরা আনাগোনা করে। বেশিরভাগ জানালার কাঁচ ভাঙা, প্রায় প্রত্যেকটা দেয়ালে গুলির চিহ্ন। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে বেড়ে ওঠা আইভি লতায় ঢেকে গেছে ইটের দেওয়াল। পুরোনো গাছগুলোর ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে দেওয়ালে লেখা শ্লোগানটি চোখে পড়ে- জয় বাংলা।
আওয়ামী লীগের কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি এটি। ধূমকেতুর মতো যিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছেন। তার আকস্মিক অস্বীকৃতি এবং সেনাবাহিনীর হাতে তার গ্রেফতারে লাখ লাখ দেশবাসীর স্বপ্নে মিশে গেছে দুঃস্বপ্ন। গত এক বছর ধরে মুজিবের জ্বালাময়ী ভাষণে দেশের মানুষের রক্তে জেগে উঠতো প্রবল উন্মাদনা। বাড়িটির মাঝামাঝি একটি ঘরে থাকতেন মুজিব। সেখানে এখনও একগাদা না খোলা চিঠি পড়ে আছে। বিয়ের আমন্ত্রণ, বিভিন্ন বিষয়ে অনুরোধ, উপরোধ দুর্বোধ্য বাংলা ভাষায় (আমাদের কাছে) পাতার পর পাতা লেখা।
তাঁর টেবিলের উপর পড়ে আছে স্যার আইভর জেনিংসের ‘কনস্টিটিউশনাল প্রবলেমস অব পাকিস্তান’ (৭)। জুবেরি নামের কোনো এক শিক্ষক তাঁর ছাত্র মুজিবকে উপহার দিয়েছেন বইটি। ভেতরের পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে- রাজনীতি ক্ষমতার পথে ধাবিত করে, কিন্তু জ্ঞানও শক্তি। প্রত্যেকবার জেলে বসে বইটি পড়েছেন তিনি। কিন্তু এবারে আর বইটি সঙ্গে নিতে পারেননি। (৮)
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর কী ঘটেছিলো- তা নিয়ে আমির তাহেরির আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘মুখবন্ধ: চুপচাপ’ শিরোনামে। সেখানে উল্লেখ করা হয়।
গ্রেফতারের পর কারও সঙ্গে কথা বলেননি তিনি। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটায় নেওয়ার উদ্দেশে করাচী বিমান বন্দরে তাঁকে অন্য বিমানে তোলা হয়। ভি.আই.পি লাউঞ্জে নেবার পর দুজন পুলিশকে তাঁর পেছনে দাঁড় করিয়ে ছবি নেওয়া হয়।
মুজিব এখন কোথায়, কীভাবে আছেন এ সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে স্থানান্তর করা হয় তাঁকে। গত কয়েক সপ্তাহ (জুলাই-আগস্ট মাস) ধরে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে অনবরত লিখে যেতে দেখা যায় তাঁকে। তিনি কি লিখেছিলেন- তা অবশ্য কেউ জানে না।
পাকিস্তান সরকার নানাভাবে এই গুজবটি ছড়ানোর চেষ্টা করছে যে- মুজিবের মানসিক বৈকল্য দেখা দিয়েছে এবং দিনের কয়েকঘণ্টা প্রলাপ বকছেন। তবে প্রতিবেদন লেখার আগে আমি প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে খবর নিয়ে জেনেছি যে- এটা সেনাবাহিনীর ছড়ানো গুজব। আওয়ামী লীগ প্রধান মোটামুটি ভালোই আছেন।.. ..আইনজীবী ও সামরিক প্রধানদের একটি দল তাঁর বিরুদ্ধে মামলার শুনানি তৈরি করছে। গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর বিচার শুরু হবে। সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু। (৯)
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও বন্দী অবস্থায় করাচী নিয়ে যাবার প্রসঙ্গে এস. এ. করিম উল্লেখ করেন-
একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে- ২৬ মার্চে বন্দী মুজিবকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত গ্রেফতারের সঙবাদ বা সঙবাদচিত্রটি গোপন রাখা হয়েছিলো কেনো? সার্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে- পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে কমান্ডো স্টাইলে গ্রেফতারের পর অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় ছিলো যাতে সঙবাদটি প্রকাশিত না হয় কারণ ঢাকায় তার অবস্থান বা বিমানপথে করাচী নেবার পথে যেনো ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তান বিমানকে ইন্টারসেপ্ট করে ভারতের দিকে নিয়ে যেতে না পারে। যে কারণে তাঁর গ্রেফতারের ঘোষণা বিলম্বিত হয়। (১০)
করাচী পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর বর্তমানে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ কারাগারে নেয়া হয়। তাঁকে একটি অতি ক্ষুদ্র সেলে রাখা হয়- যেখান থেকে লোহার শিক দ্বারা বেষ্টিত ছোট্ট ফাঁকা জায়গা থেকে এই বিশ্বজগৎ প্রায় আবছা। প্রচণ্ড গরম অথচ কোনো বৈদ্যুতিক পাখা ছিলো না- পরবর্তী সময়ে একটি পুরোনো বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো হলো- যা মূলত ঘরের গরমকে আরও ছড়িয়ে দেবার জন্যই। এছাড়াও আরও নানা রকমের অত্যাচার ছিলো সেখানে। বঙ্গবন্ধু এসব তোয়াক্কা করেননি, তবে বেদনাবোধ করেছেন বাঙলাদেশের জন্য- যে বাঙলাদেশটি তখন জন্ম নেবার জন্যে লড়ছে।
এস. এ. করিম আরও লিখেছেন-
শেখ মুজিবের তাঁর নিজের ললাট লিখন নিয়ে মায়া ছিলো না। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে তিনি লক্ষ্য করেছেন, কীভাবে পাকিস্তানি সৈন্য লুটপাট ও অগ্নিসঙযোগ করেছিলো এবঙ নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিলো। এদের হাত থেকে বাঁচার কোনো আশা তিনি করেননি। ইয়াহিয়ার ইচ্ছা ছিলো বিচারের মাধ্যমে তাঁকে হত্যা করা। মার্শাল ল কোর্টে নেয়ার সময় মুজিব যেনো সুস্থ থাকে এ বিষয়টি তার মনে ছিলো। যে কারণে মুজিবকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়নি। কিছুদিন একজন বাঙালি বাবুর্চিকে লায়ালপুরে ভাড়া করা হয়েছিলো তাঁর বাঙালি রান্নার জন্য। কেননা ইতোমধ্যেই তাঁর শরীর ভেঙে যাচ্ছিলো। তাঁর পাইপে তাঁর পছন্দের তামাক সরবরাহ করা হয়। তাঁকে দেখার জন্য একজন ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। লন্ডনের ফিনানশিয়াল টাইমস পত্রিকার সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া বলে যে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, খুব শীঘ্রই তাঁর বিচার কাজ শুরু করবে। ১৯ জুলাই, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া আরও বলে- তাঁর বিচার হবে সিক্রেট মিলিটারী ট্রাইবুন্যালে। যদিও সে ঘোষণা করে বলেনি, তাঁর বিরুদ্ধে কী ধরণের কয়টি চার্জ গঠন করা হবে। কিন্তু এ কথা সে বলে যে- এই চার্জশীটে মৃত্যুদণ্ডের কয়েকটি ধারা থাকবে। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হবে এবঙ মুজিব একজন মাত্র পাকিস্তানি আইনজীবীর সহায়তা নিতে পারবেন। (১১)
এ থেকে পরিস্কার হয় যে- বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে জানোয়ার ইয়াহিয়া আগরতলা মামলার মতো কোনো জটিলতায় পা ফেলতে চায়নি। আগরতলা মামলায় ইঙরেজ আইনজীবী নিয়োগ ও প্রকাশ্য বিচার করায় সাক্ষীগণের জেরায় সমস্ত মামলা লেজে গোবরে হয়ে গিয়েছিলো। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে তাদের চিন্তা ছিলো যে, এটি হবে সিক্রেট ট্রায়াল এবঙ কোনো সঙবাদ বাইরে আসতে পারে বা কোনো সাঙবাদিক বা পর্যবেক্ষক সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবে না। জানোয়ার ইয়াহিয়া মনে করতো ট্রাইবুন্যালে বিচারের রায় পাকিস্তানিদের সন্তুষ্টি দেবে এবঙ তাঁর বিরুদ্ধে যে ধরণের গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ গঠন করা হয়েছে তার যথাযথ বিচার বঙ্গবন্ধু পাবেন।
কারাগারের কাছেই একটি লাল ভবনে ট্রায়ালের জন্য ১৯ আগস্ট শেখ মুজিবকে স্পেশাল মিলিটারী ট্রাইবুন্যালের নিকট হাজির করা হয়। প্রিজাইডিঙ বিচারপতি ছিলো একজন ব্রিগেডিয়ার। কোর্টের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে দুজন ছিলো সামরিক অফিসার, একজন নেভাল অফিসার এবঙ পাঞ্জাব থেকে আগত একজন জেলা জজ। যখন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ডিফেন্স কাউন্সিল সিলেক্ট করার জন্য বলা হয় তখন তিনি ড. কামাল হোসেনকে আইনজীবী হিশেবে নিয়োগের কথা বলেন। তাঁকে বলা হলো- এটা সম্ভব নয়। তখন বঙ্গবন্ধু এ. কে. ব্রোহিকে আইনজীবী হিশেবে গ্রহণ করেন। ছাব্বিশে মার্চ জানোয়ার ইয়াহিয়া খানের প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রম, অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ বলে অভিযোগ উল্লিখিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ট্রায়ালে অঙশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবঙ ব্রোহিকে বিদায় করে দেন। কিন্তু বোর্ডের অনুরোধে ব্রোহি রাষ্ট্রপক্ষ হতে প্রতিনিধিত্ব করে। বঙ্গবন্ধুর বুঝতে সমস্যা হয়নি- এটা বিচারের নামে প্রহসন চলছে। সাজানো মৃত্যুদণ্ড। তিনি ছিলেন নির্বিকার। একের পর এক সাক্ষী আসছে, পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে ধ্বঙসের জন্য বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করে সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রসিকিউশন ১০৬ জনের সাক্ষ্য তালিকা ট্রাইবুন্যালে পেশ করে, কিন্তু তার অর্ধেককেও বোর্ডের সামনে উপস্থিত করা হয়নি। যারা কেবলমাত্র সামরিক অফিসে বা পুলিশের কাছে জবানবন্দী দিয়েছিলো, তাদেরই হাজির করা হয়েছে। ব্রোহি কোর্টের নিকট আবেদন করেন যারা ক্র্যাক ডাউনের পূর্বে ঢাকায় আলোচনায় অঙশগ্রহণ করেছিলো যেমন- কর্নেলিয়াস, পীরজাদা, এম. এম. আহমদ তাদের হাজির করা হোক। ব্রোহি তাদের জেরা করার আবেদন জানায়- কিন্তু কোর্ট তার আবেদন নাকচ করে দেয়।
এভাবেই একটি প্রহসনমূলক বিচার চলতে থাকে পাকিস্তানে; আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় সে-ই মানুষটিকে, যিনি বাঙালির জন্যে ছিলেন এক অগ্নিপক্ষ মুক্তি পাখি, যিনি গান শুনিয়েছিলেন স্বাধীনতার; আর তখনই পুড়ছে বাঙলাদেশ, গণহত্যা-নারী নির্যাতন-বিপর্যস্ততার সমস্ত মাপকাঠিতে তিলে তিলে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধ করছে বাঙলাদেশ। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জানোয়ার ইয়াহিয়া কর্তৃক পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর এই সাজানো বিচারের নানা প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো। কিন্তু সে বিষয়গুলো আগামী পর্বে নয়; বরঙ আগামী পর্বে আলোচনা করা হবে- স্বয়ঙ পাকিস্তান সরকার কতো রকমের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছিলো বিষয়টি সম্বন্ধে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে নানা রকমের মিথ্যাচারের মাধ্যমে একটি ছলনার প্রলেপ জড়াতে চেয়েছিলো বর্বর পাকিস্তানি গোষ্ঠী- তারই একটি বিবরণ তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে আগামী পর্বে।
পঁচিশে মার্চ, উনিশ শো একাত্তর থেকে যে দীর্ঘ সময়টি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, সে সময় তিনি এক মুহূর্তের জন্যে স্বদেশভূমিকে ভোলেননি, বরঙ বুকের কাছে আঁকড়ে ধরেছেন নিজের দেশ, পতাকা আর বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত চেতনাকে। মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে যে দেশের মানুষকে তিনি ভোলেননি, যে দেশকে তিনি ভুলেননি- সেই স্বদেশভূমিতেই পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট তিনি বুকের রক্তে পলিমাটি সিক্ত করেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যদি মহাকাব্য হয়, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সেই মহাকাব্যের ট্র্যাজিডি।
ট্র্যাজিডির সে-ই শোকটুকু এখনো বয়ে বেড়াই উষ্ণতার বিবর্ণ গোলার্ধে।
তথ্যসূত্র
১। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা (১৯২২-১৯৯৯) ছিলো অপারেশন সার্চ লাইটের অন্যতম পরিকল্পনাকারী। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে ঢাকা জিওসি’র অফিসে বসে সে এই নৃশঙস পরিকল্পনাটি করে আর তা অনুমোদন করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও জেনারেল আব্দুল হামিদ খান। মেজর জেনারেল খাদিমের উপর অর্পিত হয়েছিলো সমগ্র প্রদেশের প্রতিরোধকে নির্মূল করে তা কব্জা করার দায়িত্ব। পঁচিশে মার্চে বাঙালি নিধনযজ্ঞে তার ছিলো অগ্রণী ভূমিকা। সম্প্রতি A stranger in my own country. East Pakistan, 1969–1971 শিরোনামে তার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মূল বই ১১১ পাতার দাম ৬৯৫ পাকিস্তানি টাকা। এর বিজ্ঞাপনের জন্যে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে এইটা প্রমাণের যে- সে ছিলো বাঙালির প্রতি সমব্যথী। কিন্তু ইতিহাস ঠিক উল্টো সাক্ষ্য দেয়। ১৯৬৯ সালে খাদিমকে মেজর জেনারেল পদে প্রমোশন দিয়ে ১০৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়। এর সদর ছিলো যশোর। একই সঙ্গে সে খুলনা ডিভিশনের উপ-সামরিক আইন প্রশাসকও নিযুক্ত হয়। যশোরে এসে সে কী দেখলো? তার একটি বর্ণনা তার গ্রন্থে রয়েছে-
পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে এর দীর্ঘ সীমানা এবঙ সীমান্তে পারাপার প্রায় খোলাখুলি হচ্ছে। খুলনা থেকে কোলকাতা চল্লিশ মাইল দূরে, এখানে বিশ ভাগ হিন্দু। এবঙ অনুপ্রবেশ অপ-তৎপরতা, ধ্বংসাত্মক কাজে এটি আদর্শ পরিবেশের সৃষ্টি করেছিলো শত্রু ভারতের জন্য। খুলনায় শ্রমিকদের বেশ বড়োসড়ো সমাবেশ ছিলো যারা অসন্তোষে টগবগ করে ফুটছিলো (কেনো ফুটছিলো তার কিন্তু কোনো উল্লেখ নেই)। সঙখ্যালঘু হিন্দু, আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট এবঙ আওয়ামী লীগের মিলিট্যান্টদের টাকা দিয়ে হিন্দু ভারত অপতৎপরতা চালাতে পারতো। কারণ, সীমান্তের ওপার থেকে তারা সব রকম সাহায্য পেতো।
প্রথম ছয় পাতার মধ্যেই খাদিম হিন্দু এবঙ আওয়ামী লীগারদের নিয়ে এসেছে তার পূর্বসূরিদের মতো।
২। নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, ভাষান্তর: মাসুদুল হক, পৃষ্ঠা: ৭৫
৩। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৭৮
৪। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৬৫, ৩৬৬, ৩৭৫। সূত্র: পাকিস্তান সরকারের প্রচার পুস্তিকা।
৫। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু’র সাক্ষাৎকার। ১৮ জানুয়ারি, ১৯৭২।
৬। বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত। পৃষ্ঠা: ২৩৪
৭। মূল বইটির নাম Constitutional Problems in Pakistan, লেখক স্যার আইভর জেনিঙস (১৬ মে, ১৯০৩-১৯ ডিসেম্বর, ১৯৬৫)। লেখক ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অক্টোবর, ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে উদ্ভূত সাঙবিধানিক জটিলতার প্রেক্ষিতে গ্রন্থটি লিখিত। মূল প্রতিবেদনে গ্রন্থটির নাম ভুলভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো।
৮। আমির তাহেরির প্রতিবেদন। সূত্র: কাইহান ইন্টারন্যাশনাল, ২৭ জুলাই, ১৯৭১ [ভাষান্তর: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ]
৯। আমির তাহেরির প্রতিবেদন। সূত্র: কাইহান ইন্টারন্যাশনাল, ১ আগস্ট, ১৯৭১ [ভাষান্তর: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ]
১০। SHEIKH MUJIB TRIUPH AND TRAGEDY, S. A. Karim, page: 224
১১। SHEIKH MUJIB TRIUPH AND TRAGEDY, S. A. Karim, page: 227
৩১ শ্রাবণ, ১৪১৯
একটা ব্যাপক লেখা। তার চাইতেও ব্যাপক কমেন্ট সেকশনের আলোচনা। রেফারেন্স হিসেবে রেখে দেবার মতন কাজ।
শনিবারে চিঠি @
তোমার লিখা প্রতিটা শব্দ , প্রতিটা বা্ক্যের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ভাই –
@মিরা, অনেক অনেক ধন্যবাদ মিরা আপু। কৃতজ্ঞতা রইলো লেখাটা পড়ার জন্যে।
অনেক ইতিহাসসমৃদ্ধ একটি লেখা। সিরিজটিতে চোখ রাখছি। আশা করি খুব শীঘ্রই তৃষ্ণা মেটাবেন।
শনিবারের চিঠি আপনাকে অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্যে। অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে। পরের পর্বগুলোর অপেক্ষায় থাকলাম। আপনার সিরিজটি কি ধারাবাহিকভাবেই চলবে না কি মাঝখানে অন্য কোন লেখাও আসবে?
শচিঃ আবারো একটা দারুন লিখা!
হ্যাটস অফ টু ইউ! (Y) (Y) (Y)
@আলিয়া, অনেক কৃতজ্ঞতা আপু। ধন্যবাদ রইলো পোস্টটি পড়ার জন্যে।
অসাধারন তথ্য সমৃদ্ধ শনিবারের লেখা বরবরই আমার অনেক প্রিয়। আজকের লেখাটিও তেমনি একটি লেখা। জানা তথ্যের ভিন্ন রকম উপস্থাপনা।
@পাভেল চৌধুরী, লেখাটি পড়ার জন্যে অনেক কৃতজ্ঞতা পাভেল ভাই। অনেক ধন্যবাদ আপনার জন্যে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ, সম্পূর্ণ অনুপ্রেরণা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রহনসমূলক বিচার আর তাঁর মুক্তির বিষয়টি। পরের পর্বগুলোতে নিশ্চয়ই আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসবে; প্রত্যাশায় রইলাম।
@মাটির মানুষ, অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানবেন।
শনিবারের চিঠি: লেখা সম্বন্ধে কিছুই বলার নেই, অসাধারণ একটি লেখনী। আপনার লেখার বৈশিষ্ট্যই হল তথ্যের সাথে আবেগের একটি শুদ্ধ সমন্বয়। পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর ক্যামেরা ট্রায়াল নিয়ে পশ্চিমাবিশ্বের মতামত কেমন ছিল? আমি যতদূর জানি, জাতিসংঘসহ অন্যান্য পশ্চিমা সংগঠনগুলো এই বিচারের বিষয়ে বেশ নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছিল। বিষয়টি সম্বন্ধে বিস্তারিত জানালে খুশি হব।
লেখার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। (Y)
@অজন্তা,
আমার পরের পর্বগুলোর মাঝে এই কথাগুলো উঠে আসবে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শনি, সত্যিই অনেক সুন্দর আর গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের কারাগারের দিনগুলি সম্বন্ধে ওবায়েদুল কাদের সাহেবের একটি লেখা পড়েছিলাম, ‘পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধ’ শিরোনামে। অনেক সুন্দর কতগুলো বিষয় তুলে এনেছেন- বিশেষ করে পঁচিশে মার্চ রাত ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিকৃত মনস্তত্ত্বের বিচারে বাঙালি হত্যাকাণ্ড ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বিষয়। অনেক অজানা তথ্য জানলাম, ভবিষ্যতের পর্বগুলোর অপেক্ষায় আমিও রইলাম।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের ইতিহাস নিয়ে আপনার কাছ থেকে একটি ধারাবাহিক লেখা প্রত্যাশা করি।
@বিভা, মূল বইটা মনে হয় রবার্ট পেইনের। ওবায়েদুল কাদের অনুবাদ করেছেন। আপনার আগ্রহের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানবেন।
@বিভা,
শনিবারের চিঠিকে আদর করে শনি সম্ভাষণ!! :lotpot:
@বিপ্লব দা,
আপনিও তো কম না :-Y , জানেন না-
:lotpot:
আপনার লেখা আমি সব সময় বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ি। পাঠক টেনে ধরে রাখার ক্ষমতা আপনার লেখনীর রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের বন্দী জীবন নিয়ে তেমন কোনো ধারাবাহিক লেখা পড়া হয়নি। আপনার ধারাবাহিকটি তাই অনেক আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। পরের পবূগুলোর অপেক্ষায় রইলাম।
@মোমতাজ, পরের পর্বগুলো তৈরি করছি। আপনার পাঠ ও আগ্রহের জন্যে অনেক কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ জানবেন। (F)
ভাই নতুন অনেক তথ্য জানতে পারলাম………।। (Y)
(Y) :-X
@NETWORK, লেখাটি পড়ার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানবেন।
পাক কারাগারে বংগবন্ধুর গোপন বিচারে সরকার নিযুক্ত আইনজীবি ব্রোহিও আসলে সামরিক জান্তার প্ল্যান মতই খেলেছিল। বন্দী বংগবন্ধুর বিচার নিয়ে আমার লেখায় কিছুটা এসেছিল।
@আদিল মাহমুদ ভাই, অনেক ধন্যবাদ লিঙ্কটার জন্য। আমার পরের লেখাগুলোর ক্ষেত্রে এই লিঙ্কটা সত্যিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবঙ প্রয়োজনীয়। কৃতজ্ঞতা জানবেন আদিল ভাই।
মাফ করবেন। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হয়েছিল, এটি ইতিহাসেরই চরম সত্য, কিন্তু একমাত্র সত্য নয়। তাই বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে ভাব-বুদ্বুদে অমন গদগদ হওয়ার কারণ দেখি না। বরং নির্মহভাবেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বটির মূল্যায়ন হওয়া জরুরি।
বরং মুক্তিযুদ্ধটি ছিলো জনযুদ্ধ এবং এতে ছাত্র-জনতা, বামপন্থী দল, এমন কি চরমপন্থী সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির অবদান যথেষ্টই ছিলো, যদিও মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে, তারা খুব সচেতনভাবে বঙ্গবন্ধু বা শহীদ জিয়ার একচ্ছত্র অবদানকে ইতিহাসে ও পাঠ্যপুস্তকে প্রতিষ্ঠায় খুবই তৎপর । [লিংক]
[img]http://blog.mukto-mona.com/wp-content/uploads/2010/05/purba-bangla-sromik-andolon_march02-1971.jpg[/img]
ড. আহমদ শরীফ তার দিনপঞ্জীতে যেমন বলেন:
[লিংক]
এদেশে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠা, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, দেশ চালানোর অযোগ্যতা ও অরাজকতার কারণে মুজিব সরকারের পতন প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস রচনায় শুধু শেখ মুজিব, চার জাতীয় নেতা বা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারই শুধু যথেষ্ট নয়, শহীদ দেশ প্রেমিক বিপ্লবী সিরাজ সিকদার, কর্নেল তাহের, আলফ্রেড সরেন, পিরেন স্নাল, চলেশ রিছিলসহ সব রাজনৈতিক হত্যার বিচার হওয়া জরুরি।
[img]http://2.bp.blogspot.com/-83QTjms_uaA/Ti_2so3yp2I/AAAAAAAAAYU/DzYJej2m-Gs/s1600/Kamrul%2BHasan-793917.jpg[/img]
[১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, ছাপচিত্র, কামরুল হাসান]
প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তার ‘বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ’ বইয়ের শেষ বাক্যে যেমন বলেন:
[লিংক]
তবে সবার আগে চাই ‘৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, এর আবশ্যিকতা সব প্রশ্নের উর্দ্ধে।
ধারাবাহিকটিতে চোখ রাখছি। পরের পর্বের অপেক্ষায়। চলুক। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
আপনি আহমদ শরীফকে উদ্ধৃত করে আপনার মনের কথাগুলো ব্যক্ত করেছেন। আহমদ শরীফের কথাকে মূল্যায়ন করার ধৃষ্ঠতা আমার নেই, তবু কিছু প্রশ্ন করাই যেতে পারে, আশা করি প্রশ্নগুলোর জবাব মিলবে আপনার কাছে।
শেখ মুজিবের মধ্যে নেতৃত্বগুণের অভাব? কথাটা শোনাল অনেকটা এমন, ‘শেক্সপিয়ারের মধ্যে কাব্যগুনের অভাব বা নিউটনের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব’। অবশ্য নেতৃত্বগুণ বলতে যদি দেশ পরিচালনা বুঝানো না হয়ে থাকে, কারণ শেখ মুজিবকে অনেক সমালোচকই দক্ষ প্রশাসক বলেন না। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, নেতৃত্বগুণ ছাড়াই একটা ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুললেন? যারা প্রায় আড়াই দশক আগে পাকিস্তান চেয়েছিল ধর্মের প্রতি মোহের কারণে, তারা হঠাৎ কোন মন্ত্রবলে স্বাধিকার, স্বাধীনতা এ শব্দগুলো বুঝতে শিখে গেল?
হ্যা, এ কথাটা মুজিব সমালোচকদের কণ্ঠে আগেই শুনেছি। তবে ছোট থেকেই যে প্রশ্নটা আমাকে আমোদিত করে, তা হলো, মুজিব ভারতের না পাকিস্তানের? একদল বলে, মুজিব ভারতের হাতে দেশ তুলে দিতে চেয়েছিলেন, আরেক দল বলে, মুজিবের পাকি প্রেম এতই বেশি ছিল যে, তার নেতা-কর্মিদের প্রবল চাপ থাকলেও উনি পাকিস্তান ভাংতে চাননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চাননি।
মুজিবের ঘনিষ্ঠজনরা বলেন, সবসময় উনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলাকালে পাকিস্তান যেমন প্রস্তুতি নিচ্ছিল অপারেশন সার্চলাইটের, বাংলাদেশও প্রস্তুত হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য। মুজিব ভারতের সাথেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভাব্য সহযোগিতার উপায় নিয়ে। কিন্তু এটা ছিল শুধুই সহযোগিতা, কোন দাসখত নয়, মুক্তিযুদ্ধোত্বর মুজিবের কর্মকান্ডই প্রমাণ। আসলে মুজিব ইন্ডিয়া বা পাকি পন্থি কোনটাই ছিলেন, উনি ছিলেন একজন বাংলাদেশ পন্থি। জাতীয়তাবাদ উনার জীবন ও কাজের প্রতিটি বিন্দুতে মিশে আছে।
কোন কিছুই পুরোপুরি পরিকল্পিত থাকে না, আবার সব ভাল কিছুর পেছনেই পরিকল্পনা কিছু থাকতেই হয়। এটা তো সত্যি বাংলাদেশের মানুষ ১৯৪৭ এর আগে পাকিস্তান চেয়েছে, তা চেয়েছে তাদের তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে। কিন্তু তাদের ভুল ভাংতে দেরী হয় না। ৫২, ৬৬, ৬৯ এর ধাপ পেরিয়ে এসেছে ৭১। এখন যদি বলা হয়, রফিক-বরকত-জব্বারের তেমন ব্যক্তিগত অবদান ছিল না, তাৎক্ষনিক ঘটনার প্রেক্ষিতে তারা ইতিহাসের নায়ক হয়ে উঠেছে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে? অথবা গান্ধীর ব্যাপারেও কি একই কথা বলা যায় না?
যার ‘পতন প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল’, তাকে এমন সপরিবারে হত্যা করতে হল কেন, বলুনতো? জনগণের ক্ষোভের আগুন তাকে সরিয়ে দিতে পারল না? সিরাজ শিকদারের ভাবশিষ্যরা কোন ভূমিকা রাখতে পারল না? অবশ্য আপনি যদি তার হত্যাকাণ্ডকে তার পতন হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চান এবং তার অনিবার্যতা ঘোষণা করতে চান, সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই।
ফ্যাসিবাদী রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ – এগুলো সত্য, তবে আপনি যে মুজিবকে এগুলোর সোল এজেন্সি দিতে চাইছেন, তা সত্য নয়। নিচের উদ্ধৃতি লক্ষ্য করুন:
মোদ্দা কথা হল, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে অনেক অব্যবস্থা-অসাম্য-বিশৃঙ্খলা ছিল, তবে সেউ ব্যর্থতা সমগ্র জাতির ব্যর্থতা, মুজিবের একক ঘাড়ে সেই পুরো বোঝা চাপিয়ে ঘোরতর অন্যায় হবে।
@কাজি মামুন,
বলেন কী? পাকিস্তানিরা যখন চলে যায় তখন এ দেশে রেখে গিয়েছিল গোয়াল ভরা গরু, মাঠ ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, যাকে এক কথায় বলা যায়- ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা—। আর সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল, ঝড়-খরা, বন্যা সহ সকল প্রাকৃতিক উপদ্রব। শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ সকল ধন-সম্পদ লুটে-পুটে খেয়ে সাবাড় করে দেশে দূর্ভিক্ষ ডেকে এনেছিল। এ জন্যেই ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়-
১০ জানুয়ারি ৭১ পুষ্প মালাটা মুজিবের গলায় পরায়ে এদেশের মানুষ মারাত্বক ভুল করেছিল, পরানো উচিৎ ছিল সিরাজ সিকদার ও তার বোন শামিম শিকদারের গলায়। আহা, আজ আমরা সুখের সাগরে ভেসে বেড়াতাম।
@আকাশ মালিক,
সংশোধন- ১০ জানুয়ারি ৭২
@কাজি মামুন,
ভাল ভাল তথ্য দিয়েছেন, ‘৭৪ এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমি একটু যোগ করি; আশা করি কিছু মনে করবেন না। এই দূর্ভিক্ষ আমেরিকার ষড়ন্ত্রে সৃষ্ট, আওয়ামী কুশাসনের ফল, প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফল এসব নিয়ে এক এক জনার এক এক তত্ত্ব আছে।
আমি যতটা বুঝি তাতে এতে আমেরিকার ভূমিকা পরোক্ষভাবে থাকলেও সেখানে বেশ কিছু কথা আছে যা জানা দরকার। অনেকেই মনে করেন যে আমেরিকা বংগবন্ধু সরকারকে উতখাতের পদক্ষেপ হিসেবে সেই দূর্ভিক্ষ লাগিয়েছিল, ব্যাপারটা তেমন নয়। ফ্যাক্ট হল বিশ্বব্যাপি খাদ্যমূল্য ‘৫৬-৭২ সাল পর্যন্ত অনেকটা স্থির ছিল। নানান কারনে ‘৭২ সাল থেকেই বেড়ে যায়। আমেরিকাও পিএল-৪৮০ এর আওতায় গরীব দেশগুলিতে খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়, সে কমানোর কুফল শুধু বাংলাদেশেই নয়, সাহায্য গ্রহনকারী প্রায় সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। বাংলাদেশ কিউবায় পাট রপ্তানীর কারনে হয়ত ভুগেছিল তা হতে পারে, তবে সে সময় আমেরিকা যে শুধু বাংলাদেশেই খাদ্য সরবরাহ বাতিল করেছিল তা নয়, তাদের এমনকি নিজেদেরও রিজার্ভে টান পড়েছিল। সে সময় দুটি চালান তারা বাতিল করেছিল তবে জাহাজ দেশের দোরগোড়ায় আসার পর নাটকীয়ভাবে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিনা তা জানি না। তেমন সম্ভাবনা কম কারন আমেরিকার নিজের রিজার্ভ খাদ্য সংকট বাংলাদেশের কাছে নুতন খবর ছিল না। সে সময় তাদের মূল খাদ্য সহায়তা পেয়েছিল কেবল ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া। ‘৭৩/৭৪ সালে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার খাদ্য সাহায্য ‘৬৫ এর তূলনায় ২০% এরও নীচে নেমেছিল। ‘৭২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ছিল টন প্রতি ৭৭ ডলার, ‘৭৪ এ ছিল ২৭২ ডলার। বাংলাদেশের মত গরীব দেশ ও সে সময় খাদ্য সরবরাহের জন্য চরম ভাবে নির্ভর বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতিতে আলাদিনের চেরাগ ছাড়া রেহাই পাবার কোন রাস্তা ছিল না। এ ছাড়াও গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত বিশ্বব্যাপী জ্বালানী তেলের মূল্যও হু হু করে বেড়ে যায়। ‘৭২ সালে ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১.৭২ ডলার, ৭৪ সালে তা হয় ১৬ ডলার। জ্বালানী সংকটের কারনে দেখা দেয় জাহাজ সংকট। এ কারন এমনকি ‘৭৩ সালে আমেরিকা থেকে বাংলাদেশের আগের কেনা ২৮০,০০০ টন গমের মাত্র ১৯,০০০ টন পৌছে। দুর্ভিক্ষ আসলে ‘৭৩ সালেই হত, সরকার কানাডা অষ্ট্রেলিয়ার সহায়তায় সে যাত্রা এড়াতে সমর্থ হয়।
অমর্ত্য সেনের স্ত্রী আরেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এমা রথচাইল্ডের এ নিয়ে ভাল গবেষনা আছে।
বিশ্বব্যাপী সংকটের কবল থেকে সে সময়ের বাংলাদেশের মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নও রেহাই পায়নি, বাংলাদেশ তাদের থেকেও সে সময় সহায়তা চেয়ে বিফল হয়েছিল।
‘৭৪ এর বন্যা খরা পরিস্থিতি আরো খারাপ করলেও মূল কারন ছিল না। একই কথা খাটে দলীয় মদদে চাঁদাবাজী, মজুরদারি,চোরাচালান এসবের ক্ষেত্রেও। এসব এ দেশে পরবর্তিকালেও সব আমলেই দেখা গেছে, তবে মূল কারন এসব নয়। তবে মুল কারন না হলেও জনগন অন্তত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া বংগবন্ধুর কাছ থেকে এমন আশা করেনি, তাই বাস্তব ভিত্তিক আরো বড় কারন গুলি থেকে এটাই বড় করে লেগেছে। সমালোচকরাও সুযোগের ব্যাবহার করেছে। আজকের দিনে বন্যা/খরা, চোরাচালানী/মজুদদারি এসব হলেও ‘৭৪ এর মত দূর্ভিক্ষ হবার সম্ভাবনা কম কারন এখন আর বাংলাদেশ সে সময়ের মত খাদ্যের জন্য ব্যাপকভাবে পরনির্ভরশীল নয়।
আসলে বংগবন্ধু আমলের সমালোচনার বেশীরভাগই এই নীতিতেই ডালপালা মেলেছে। সরকারের ভুল পদক্ষেপ ছিল, দলীয় পরিচয়ে সন্ত্রাসীদের অবাধ দাপটে জনগন বিরক্তও ছিল। বংগবন্ধু এদের বিরুদ্ধে তেমন কঠোর ব্যাবস্থা নিতে পেরেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয় না। একে ভিত্তি করে গুজবের অপর ভিত্তি করে বহু বেহুদা দুর্নামও বংগবন্ধুর কপালে জুটেছে, যা পরবর্তিকালে খুনীদের কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। বংগবন্ধু আমলের দূঃশাসনের কথা জাফর ইকবালের মত বংগবন্ধু ভক্তরও একাধিক লেখায় আছে, হুমায়ুন আজাদের লেখায় আছে। উল্টদিকে বংগবন্ধু ভক্তরাও কিছুতেই সে আমলের কোন দোষ ত্রুটি স্বীকার করবেন না, সবই ষড়যন্ত্র/অপপ্রচার বলে চালিয়ে দিতে চান। সে আমলে বংগবন্ধু বা তার সরকারের যেসব সমালোচনা হয় সেগুলি আসলে বলতে গেলে আমাদের জাতীয় চরিত্রের অন্তর্গত, পরবর্তিকালের সব সরকারের আমলেই একই ছবিই দেখা গেছে।
@আদিল মাহমুদ ভাই,
আমিও সেই কথাই বলি। প্রতিটি যুদ্ধোত্তর দেশেই একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থাকে- যা ওই মুহূর্তে একেবারেই মৌলিক একটি বাস্তবতা। তাছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনা বলতে অনেকগুলো ফ্যাক্টর চলে আসে- সবগুলোই করতে হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুকে এবঙ তাঁর মন্ত্রীসভাকে। অতএব এখন বিষয়টি যতোটা সহজ বলে মনে হয়, তখন ততোটা ছিলো না। আপনি অনেক বড়ো এবঙ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক নিয়ে এসেছেন- রেফারেন্সসহ। অনেক ধন্যবাদ আদিল ভাই।
বঙ্গবন্ধুর চারপাশে কতো মিথ্যা-মানব থাকতো তার সবচেয়ে বড়ো নিদর্শন হলো মুশতাক। ১৯৭৫ এর পর দেখা গেলো মুশতাকের মন্ত্রীসভায় যারা যোগ দিলো এদের সবাই বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার (উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ছাড়া) লোক। অতএব বঙ্গবন্ধু যেমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেননি, এরাও হঠকারিতা করে গিয়েছিলো- অনায়াসে।
@শনিবারের চিঠি,
‘৭৪ এর দূর্ভিক্ষ বংগবন্ধুর শাসনামলের অন্যতম সমালোচনার বস্তু,একে কেন্দ্র করে লিজেন্ডারি চিলমারির বাসন্তি নাটকও হয়েছে। মুশকিল হল এই ‘৭৪ এর দূর্ভিক্ষের আসল কারন কি এর কোন বস্তনিষ্ঠ আলোচনা বংগবন্ধু সমালোচক বা ভক্ত কোন পক্ষই করে না। সে সময়ের বাস্তবতার ভিত্তিতে সে দূর্ভিক্ষ এড়ানোর কোন উপায়ই ছিল না। আড়তদার, চোরাচালানী, মজুদদার এরা কোন আমলে দেশে ছিল না? দূঃখজনকভাবে সরকারী দলের ছত্রছায়ার এদের বড় এক অংশ সব আমলেই থাকে। শুধু এদের কারনে ‘৭৪ এর দূর্ভিক্ষ হয়নি। যারা তেমন দাবী করেন তারা গতবাধা দাবীর সমর্থনে কিছু গানিতিক হিসেব নিকেশ দেখালে বুঝতে সুবিধে হয়। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির হিসেব সে তূলনায় অনেক বেশী যুক্তি সংগত।
-মোশতাক বড় প্রমান ঠিক। তবে জনসাধারন সরকারের ওপর বিরক্ত মোশতাকের কারনে হয়নি। বংগবন্ধুর এক প্রিয় শিষ্য গাজী গোলাম মোস্তফার দূর্নীতি ও ছেলেদের সন্ত্রাসের কাহিনী সে যুগে এই আমলের জয়নাল হাজারি কিংবা দেলোয়ার পুত্র পবন ডব্লুদের মত সর্বজন বিদিত ছিল। বংগবন্ধুর প্রিয় ভাগ্নে শেখ মনিও আতংকের বস্তু হিসেবে সর্বত্র কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। জনগন এসব ভাল চোখে দেখেনি। এখন বংগবন্ধু ভক্তরা ‘আমার কম্বল কই গাজী’ এসব চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারবেন, সবই রাজাকাদের ষড়যন্ত্র বলে সহজেই উড়িয়ে দিতে পারবেন তবে সে সময় লোকের মুখে মুখে এসব সব প্রচলিত ছিল। গাজি পরিবারের সামান্য নমুনা এই স্মৃতিচারনে পাবেন।
বংগবন্ধু দূঃখজনকভাবে এসব রাহুর কবল থেকে মুক্ত হতে পারেননি, তিনি তার আশেপাশের লোকজন সম্পর্কে বেশ উদাসীন ভূমিকা দেখাতেন।
@আদিল মাহমুদ ভাই,
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায় সে সময়ের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। আপনার দেয়া Emma Rothschild এর লেখা Food Politics টা-ও পড়ছি। কিন্তু মুশকিল হলো- ওই সময়ের সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধীয় প্যারামিটারগুলো আমার অতো জানা নাই, কেননা আমি অর্থনীতির উপরে অতো দখলদার নই। তবে এই বিষয়টি নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই কাজ করা দরকার, কেননা- এর দৌড়টা আসলে বহুদূর।
এখানে বঙ্গবন্ধুর মনস্তত্ব আলোচনার একটি সুযোগ থাকে। বস্তুত কিছু মানুষ থাকেন- একই রকম; আমি জানি না- বঙ্গবন্ধু কি গোড়া থেকেই কাছের মানুষদের বিষয়ে উদাসীন ছিলেন, না কি একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তিনি সেই উদাসীনতা প্রাপ্তি হলেন? তাঁর আত্মজীবনী পড়লে বোঝা যায়- হৃদয়ের একটি গভীর প্রভাব তাঁর প্রতিটি কাজের উপরই ছিলো। এটা কিন্তু তেমন দোষেরও নয়। আরেকটি বিষয় আমার কাছে মনে হয়- ওই মুহূর্তে নানা রকম ষড়যন্ত্রে উনার কি বিশ্বাস করার মতো লোকই কমে গিয়েছিলো না? আদিল ভাই- আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর ভেতরে শেষ দিকে একটি গভীর নিঃসঙ্গতা বিরাজ করেছিলো। বস্তুত তিনি ছিলেনও নিঃসঙ্গ, তবে বোধ করি তিনি সেটি বুঝতে পারেননি।
@শনিবারের চিঠি,
‘৭৪ এর প্রেক্ষাপট বুঝতে খুব বেশী অর্থনীতির জ্ঞান মনে হয় না দরকার। এমা রথচাইল্ডের পেপারে যে তথ্য নেই তা হল স্বাধীনতা পরবর্তি কয়েক বছর বাংলাদেশের খাদ্যের জন্য অতি মাত্রায় পরনির্ভরশীলতা। বাংলাদেশে খাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্নতা কয়েক বছর পরে এসেছিল। বাংলাদেশের ফরেন এইডের ইতিহাস দেখলেও পরিষ্কার দেখা যায় যে সে প্রথম দিকে বিদেশী সাহায্যের বড় অংশ এসেছিল খাদ্য খাতে। তলা বিহীন ঝুড়ি বদনাম সে সময় এ জন্যই জুটেছিল। সময়ের সাথে এই প্রবনতা কমে এসেছে। ‘৭০ দশকের মত বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট ঘটলে তেমন অবস্থায় যা হবার তাই হয়েছে। আজকের দিনে এমন হবার সম্ভাবনা কম কারন খাদ্যের জন্য আর তেমন ভাবে আমরা পরনির্ভরশীল নই, যদি না যদি না নিজেদের উতপাদনও মারাত্মক ভাবে ব্যাহত না হয়। ‘৭৪ এ বাংলাদেশের মত খাদ্য সংকটে ভারত, পাকিস্তানও ভুগেছে। ‘৭২ সালে সোভিয়েত রাশিয়া এমনকি তাদের চিরশত্রু আমেরিকার কাছ থেকে খাদ্য কিনতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশ বাঁচবে কেমন করে? যাদের কাছে খাদ্য রফতানী করার মত উদ্বৃত্ত ছিল তারা রফতানী করেছে খুব বেছে বেছে। জ্বালানী সংকট সমস্যা বাড়িয়েছিল আরো শতগুনে, বাংলাদেশকে মুদ্রাস্ফীতির ফাঁদে ফেলে আর কোন উপায়ই রাখেনি। ‘৭৩ সালেই আসলে দূর্ভিক্ষ হত, কানাডা/অষ্ট্রেলিয়ার সহায়তায় সরকার সে বছর সামাল দেয়। সে সময়ের আলোচনা এখানেও পাবেন।
বংগবন্ধুর যা গুন অর্থাৎ দেশের মানুষের প্রতি অসীম ভালবাসা তাইই পরের দিকে হয়ে যাচ্ছিল তার সরকারের অভিশাপের মত। উনি ব্যাক্তিগত ভাবে চেনা পরিচিত লোকজনের প্রতি সেভাবে কঠোর হতে পারতেন না এমন বেশ কিছু নজির আছে। ওনার কাছে হাজির হয়ে কান্নাকাটি করলেই যা আমি দেখব, আর ভবিষ্যতে এমন করিস না এভাবে লোকের নানান সমস্যা মিটিয়ে দিতেন। এসবের ফলে দলের পরিচয়ে সন্ত্রাস হয়ে যাচ্ছিল নিয়ন্ত্রনের বাইরে। এমন ধরনের অতি উদারতার ফল শুভ হয়নি। সেনাবাহিনী পরিচালিত চোরাচালান সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে গ্রেফতারকৃত দলের বহু নেতা কর্মীকে উচ্চপর্যায়ের দলীয় সুপারিশে ছেড়ে দেবার ফলে সেনাবাহিনীতে শুরু হয় ক্ষোভের, এর সাথে যুক্ত হয় রক্ষী বাহিনীর দাপট। হুমায়ুনের দেওয়ালের আরেক পার্ট যা তার মৃত্যুর পর প্রথম আলো বের করেছে সেখানে টংগীর মোজাম্মেলের তেমন এক উদাহরন আছে, এটা সম্ভবত মাসকারেনহাসের বই থেকে নেওয়া। সেনাবাহিনীতে মুজিব হয়ে পড়েন চরম ভাবে অপ্রিয়। আজকের সেনাবাহিনীর অনেকে রং পাল্টেছেন, শফিউল্লাহকে অনেকে প্রান খুলে গাল দেন ক্যান তিনি হেন করলেন না তেন করলেন না। ফ্যাক্ট হল ১৫ই আগষ্ট ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উতসব উতসব আমেজ বিরাজ করছিল। খুনী মেজরদের যে সময় সব সিনিয়র অফিসার বুকে জড়িয়ে ধরে কংগ্র্যাচুলেট করছিল, শফিউল্লাহ সে সময় কাকে কার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে বলতে পারতেন? এসব আওয়ামী লীগাররা স্বীকার করতে চান না কারন এগুলি বংগবন্ধুর ইমেজের জন্য ক্ষতিকর, তাই সহজ শিকার হল বেচারা শফিউল্লাহ, যিনি ছিলেন একমাত্র সিনিয়র অফিসার যিনি আসলেই সেদিনের ভয়াবহ হত্যাকান্ডে দূঃখিত হয়েছিলেন।
বংগবন্ধুর ব্যাক্তিগত পরিচিতির জন্য কিছু কুখ্যাত দালাল রাজাকার যেমন খাজা খয়েরও আদালতে অপরাধী হয়ে সাজা ভোগ শুরু করার পরেও ছাড়া পায় এমন মনে করার কারন আছে। শের এ বাংলার ছেলেও রাজাকারির দায়ে জেলে ছিলেন, বংগবন্ধু তাতেও দূঃখিত হয়েছিলেন।
আসলে আমাদের সংস্কৃতিটাই এমন যে স্বজনপ্রীতি অনেক সময় রীতিমত অপরাধের পর্যায়ে হলেও আমরা এটাকে সহজভাবে নেই। আপনার মামা মন্ত্রী হলে আপনি আশা করবেন যে অন্য ১০ জন যোগ্য প্রার্থীকে ডিংগিয়ে আপনাকে চাকরি দেওয়া মামার দায়িত্ব, আপনার ভাই সন্ত্রাসের দায়ে পুলিশের হাতে ধরা খেলে মামার দায়িত্ব থানার ফোন করে তাকে ছাড়ানো, মামা সেসব কাজ না করলে আপনিই তাকে গালি দেবেন। সোজা কথায়, নীতিবান আচরন করলে ভিলেনে পরিনত হতে হবে।
হ্যা, বংগবন্ধু শেষ দিকে অনেকটা নিঃসংগই হয়ে গেছিলেন। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আশে পাশে সব চোর বলে নিজের দূঃখ করতেন। সম্ভবত সে চোরের দল এতই বড় ছিল যে তাদের ত্যাগও করতে পারছিলেন না। বাকশাল গঠন করে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নেওয়ার পেছনে মনে হয় তেমন মনোভাব কাজ করেছিল।
পুরষ্কৃত করার এই ধারা আজকের দিনেও চলছে। সব সরকারই দাবী করে যে আগের সরকারের লোকে ভয়াবহ সব দূর্নীতি করেছে, কিন্তু আদালতে চুড়ান্ত বিচারে সাজা হয় কয়জনার? আমি লিখে দিতে পারি যে তারেক কোকোরও কোন শাস্তি এ দেশে হবে না। এদের বিরুদ্ধে মামলাগুলির কি অবস্থা? তাদের কেন সরকার দেশে এনে আদালতে দাঁড় করায় না? গরীব চোর ছ্যাচ্চড় আদালতে শাস্তি পাবে আর শত কোটী চুরি করে বিদেশে পালালে সরকারের আইনের হাত থেমে যাবে? ইউনুসের বিরুদ্ধে সরকারের যত মনোযোগ তারেক কোকোর বিরুদ্ধে তার কতভাগ মনোযোগ আছে? রাজনৈতিকভাবে সরকারের জন্য কে বেশী হুমকির? ১০ বছর পর অন্ধ বিএনপি সমর্থকরা যখন বলবে যে তারেক কোকোর অসীম দেশপ্রেমের কারনে আওয়ামী বাকশালীরা দূর্নীতির অপবাদ দিয়েছিল, শত দূর্নীতির অপবাদ দিলেও কোনটাই আদালতে প্রমান করতে পারেনি তখন আমরা কি জবাব দেব?
বিএনপি সরকার আবারো ক্ষমতায় আসলে আবুল মন্ত্রী, জয়, রেহানা, এমন বহু লোকের বিরুদ্ধেই যথারীতি মামলা হবে। ফলাফলও হবে একই, কারোই কোন সাজা হবে না (আমি বলছি না যে এরা সকলেই আসলেই অপরাধী) গত জোট সরকারের বহু ভয়াবহ গডফাদার দিব্ব্যি বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক বহুল আলোচিত গডফাদার যিনি আমার সম্পর্কে দূলাভাই হন উনি এখন সপরিবারে আমেরিকায় এসেছেন ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে। তার বিরুদ্ধে কিভাবে যাদুমন্ত্রের মত মামলাগুলি গায়েব হয়ে গেল তার রহস্য উনি নিজেই বলেছেন। কাকে কত টাকা দিয়েছেন তার পরিমান নিয়ে হয়ত সংশয় প্রকাশ করা যায়, কিন্তু ফলাফল বিচার করলে অবিশ্বাস করি কিভাবে?
এরশাদ ক্ষমতা নিয়েছিল ততকালীন বিএনপি সরকারের সীমাহীন দূর্নীতির অভিযোগে। যে মওদুদকে জেলে পাঠিয়েছিল সে মাত্র কমাস পরেই হয়ে গেছিল এরশাদের ডান হাত। ‘৯১ সালের খালেদা সরকারের মন্ত্রী সালাম তালুকদার সহ কিছু মন্ত্রী, ছাত্রদলের রাস্তায় ঘোরা কিছু নেতা পাতি নেতাদের বহুতল ভবনের মালিক হওয়া মানুষ চোখের সামনেই দেখছিল। ‘৯৬ এর আওয়ামী সরকার তাদের কয়জনকে শাস্তি দিতে পেরেছিল?
এরশাদ পতনের পর এত ভয়াবহ দুর্নীতিবাজ এরশাদ সরকারের কয় মন্ত্রী আদালতের চুড়ান্ত বিচারে শাস্তি পেয়েছিল? এরশাদের নামমাত্র সাজা হয়েছিল কিছু পাতি মামলায়।
গাজির ঘটনা এই ধারার বাইরে নয়। পরের সরকারগুলি আগের সরকারের দূর্নীতি নিয়ে লাফালাফি করে আইনের শাসন পুণঃপ্রতিষ্ঠা বা দেশপ্রেমের তাড়নায় নয়, নিজের ক্ষমতায় আরোহনের পথ মুক্ত করার জন্য পথের কাঁটা দূর করতে। তলে তলে চলে মোটা অংকের লেনদেন।
@আদিল মাহমুদ ভাই,
গাজী গোলাম মোস্তফার বিষয়ে আরেকটি জিনিশ পেলাম-
আমি পুরো বিষয়টি এখনও পড়ছি, আশা করছি পরিস্কার হলে এ নিয়ে পোস্ট দেয়া যাবে।
@মাটির মানুষ,
হান্নানের কোন বইতে এটি আছে? ঘটনাটি অবশ্যই সত্যি যেটা ডালিমের বয়ানেও আছে। শুধু এই ঘটনার জন্য ১৫ই আগষ্ট ঘটেছিল তা নয়, তবে এই জাতীয় বেশ কিছু ঘটনা সেনাবাহিনীকে করে তুলছিল সামগ্রিকভাবে মুজিব বিদ্বেষী। ১৫ই আগষ্ট খুনীদের বিরুদ্ধে এ কারনেই সেনাবাহিনীর কেঊ ব্যাবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা উলটো মোলাকাত করছিল। হত্যাকারীরাও জানত যে তারা বংগবন্ধু হত্যা করলে ভিলেন নয়, হিরো হিসেবেই অভিনন্দিত হবে, শুধু জানত না যে তাদের গডফাদাররা তাদের কেবলই ব্যাবহার করছে, কাজ হয়ে গেলে তাদেরও ছুড়ে ফেলে দেবে।
@আদিল মাহমুদ ভাই, পনেরোই আগস্ট নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধ কিছুদিন আগে ইতিহাস সমিতির একটি জার্নালে আমি পড়েছি। বই ছিলো না, লেখা ছিলো। ওখানে ভুলে ‘বই’ লিখে ফেলেছি। দুঃখিত।
@মাটির মানুষ,
ওনার বেশ কটি ভাল ভাল বই আছে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে, আমি বর্তমানে তেমন একটা পড়ছি, (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস)। মুক্তিযুদ্ধ পুরো বুঝতে হলে আসলে কিছুটা আগ থেকে জানা দরকার।
@আদিল মাহমুদ ভাই,
আরেকটি বিষয় বলার প্রয়োজন ছিলো। এটা মানা যায়- বঙ্গবন্ধু কোনোভাবেই তাঁর চারপাশের লোকজনকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে পারেনি। কিন্তু এটাও কিন্তু বিবেচ্য, সেইসব লাগামছাড়া লোকদের বঙ্গবন্ধু খুনিরা কিছুই করেনি, উল্টো পুরস্কৃত করেছে। আপনার দেয়া লিঙ্ক থেকেই জানলাম-
অতএব ঘটনা হলো- এরা দুই ঘাটেরই জল খেয়েছে, এবঙ খেয়াল করুণ- এরা কেবল ব্যবহৃত হয়েছে একেকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে।
@আদিল মাহমুদ,
এটা ১০০% আওয়ামী লাইন। দূর্ভিক্ষ এড়ানোর কোন উপায়ই ছিল না বললে মুজিব সরকারকে ১০০% নির্দোষ ঘোষণা দেয়া হয়। এটা কোন পেশাদার নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদের মুখ দিয়ে বলালে গুরুত্ব দেয়া যেত। বরং যত লেখা দেখা যায় নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদের মত এটাই যে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ মানব সৃষ্ট ছিল এবং এড়ান সম্ভব ছিল। কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাক নীচে।
Bnagladesh: A Legacy of Blood: Anthony Mascarenhas থেকেঃ
Dr. K.U.Ahmed of Brunel Univ, UK এর মতে দুর্ভিক্ষের মূল কারণের একটি ছিল ভারতে খাদ্য চোরাচালান : পৃঃ-২৭
দুর্ভিক্ষটি মানুষের সৃষ্ট, আল্লাহর নয়, বলেছিলেন তখনকার Dutch Salvation Army volunteer ত Grace Samson: পৃঃ-৪৪
১৯৭৩ এর শেষ হবার আগে দুই বিলিয়ন ডলার পাম্প করা হয়েছিল বাংলাদেশে। পৃঃ-২৮
Sheikh Mujib – Triumph and Tragedy থেকেঃ
ড: অমর্ত্য সেন আর ড: আনিসুর রহমানের মতে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ মানবসৃষ্ট ছিলঃ পৃঃ-৩৩৫,৩৩৭-৩৩৮
http://mason.gmu.edu/~atabarro/Famine,%20Corruption,%20the%20Media%20and%20Democracy.ppt
অথবা
http://www.docstoc.com/docs/52634126/Famine-Corruption-the-Media-and-Democracy থেকেঃ
(Famine, Corruption, the Media and Democracy )
* Overall, however, the fundamental problem was not a lack of food per-se as food per capita was in fact at an all-time high in 1974.
* Starvation began before the rice that the floods destroyed would have been available for eating. So what was the problem?
“no famine has taken place in the history of the world in a functioning democracy, be it economically rich (as in Western Europe or North America) or relatively poor (as in post independence India, or Botswana or Zimbabwe.”
(Amartya Sen. 2001. Development as Freedom. p.16)
আরেক আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ আখতার হোসেন তাঁর অমর্ত্য সেনের বইএর পর্যালোচনামূলক প্রবন্ধেও একই কথা বলেছেন এবং আরো কিছু মানব সৃষ্ট কারণ উল্লেখ করেছেন। এই সব ক্ষেত্রেই মানব কে? নিশ্চয়ই মুজিব সরকার (শুধু মুজিব একাই নন)। একটা মানব সৃষ্ট মূল কারণ ছিল অতিস্ফীতী। এর জন্য কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে ১২-১৯৭১ থেকে ৪-১৯৭২ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারণ করেছিলেন ভারতের উপদেষ্টারা। এই সব নীতিগুলি অতিস্ফীতী, চোরাচালান, ইত্যাদির জন্য দায়ী ছিল।
@কালযাত্রী,
আপনার দেওয়া রেফারেন্স আপাতত পড়ার সময় নেই, অবশ্যই পড়ে দেখব। তবে আপনি গতবাধা ‘মানব সৃষ্ট’ বলে অপর পক্ষের গবেষনা মূলক প্রবন্ধকে কোন রকম তথ্য মূলক রিফুউটাল না বলে “আওয়ামী” বলে উড়িয়ে দিলে কোন রকম আলোচনা সম্ভব নয়। আমি আলোচনার জন্য খোলা আছি, উপযুক্ত তথ্য প্রমান দিতে পারলে অবশ্যই নিজের ধারনা পরিবর্তন করতে রাজী আছি। আপনি আশা করি নিজে এসব রেফারেন্স ভাল করে পড়েছেন, আপনি সাহায্য করলে আমার সময় বাঁচে, মানবরা ঠিক কে বা কারা, এদের ভূমিকা কতটা?
গতবাধা মানব সৃষ্ট বলতে তেমন কিছু বোঝা যায় না। যেমন মুদ্রাস্ফীতি অবশ্যই মানব সৃষ্ট। নির্দিষ্ট করে না বললে বোঝা যায় না আসলেই কোন মানবের ভূমিকা কতটা। আজকে কিছু মানব ‘৭৩ সালের মত তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৭০% বাজারে তার প্রভাবে দেশে মুদ্রাস্ফীতি হবেই, যেইই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না। এটা অবশ্যই মানব সৃষ্টই বটে। ‘৭৩ সালের ওপেকের অয়েল এমবারগোর ফলে যে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ৩ থেকে ১২ ডলার হয়েছিল তার কোনই ভূমিকা মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য সংকটে থাকতে পারে না? বাংলাদেশের হয়ত সে সময় নিজেদেরই যথেষ্ট তেল সম্পদ ছিল, ওপেক আর আমেরিকার রাজনীতিতে তার কি যায় আসে।
আমি গতবাধা ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ গোছের কিছু বলে দায় সারিনি। কিছু তথ্য উপাত্ত দিয়েছি। আন্তর্জাতিক বাজারের খাদ্য সংকট, আমেরিকার থেকে প্রতিশ্রুত চালান, জ্বালানী সংকটের কারনে পরিবহন সমস্যা (যা মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য দায়ী) এসব আলোচনা করেছি। এসবই আওয়ামী দৃষ্টিভংগীর লোকে তৈরী করে রাখলে আমি আন্তরিক দূঃখিত।
নাকি আপনার মতে সে সময় বিপুল ভাবে খাদ্যের জন্য পরনির্ভরশীল বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ভয়াবহ খাদ্য সংকট কোন ব্যাপারই ছিল না? এর কোনই প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার কথা না? যেখানে সোভিয়েত রাশিয়া আমেরিকার থেকে খাদ্য আমদানীতে বাধ্য হয়েছিল সেখানে বন্যা খরায় আক্রান্ত বাংলাদেশের মোট উৎপাদন কতটা ছিল, চাহিদার তূলনায় তার প্রতূলতা কেমন ছিল? এই দুয়ের হিসেব মিললে অবশ্যই বোঝা যাবে যে নিজেদের উদপাদন যথেষ্ট থাকার পরেও কোন ভাবে দেশ থেকে চোরাচালান হয়ে খাদ্য গায়েব হয়ে গেছিল।
আমার ক্ষুদ্র ভাসা ভাসা জ্ঞান বলে যে যেখানে বাংলাদেশের তখন নিজেদেরই খাওয়াবার মত খাদ্য উতপাদন ছিল না সেখানে শুধু চোরাচালান করে সমস্যা তৈরী হওয়াটা তত্ত্বীয়ভাবে সম্ভব নয়। নিজেদের যথেষ্ট থাকলে তবেই না চোরাচালানের কথা আসবে। দলীয় চোরাচালান অবশ্যই ঘটেছিল, সেটা অস্বীকার করে কে? তবে শুধু সেটা কিভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য সংকট, জ্বালানী সংকট থেকে বড় হয় তার হিসেব অবশ্যই জানা দরকার।
@আদিল মাহমুদ,
“মানব সৃষ্ট” আমার ভাষা না। এটা সব অর্থনীতিবিদেরই ভাষ্য। তার তখনকার মুজিব সরকারের কথাই বুঝিয়েছেন। সবার মতে এটা একটা প্রিভেন্টেব্ল দুর্যোগ ছিল। এটা ঘটতেই হত সেটা নয়, যেটা আপনি বলছেন। তর্কটা আপনার সাথে আমার হবার কথা নয়, কারণ আমরা কেউ অর্থনীতিবিদ নই। আপনার প্রশ্নগুলি (চোরাচালান কেন হল ইত্যাদি) নিশ্চয় তাঁরা বিবেচনায় এনেই তাঁদের রায় দিয়েছেন। কিছু রেফেরেন্স দেই আরও। মূল রেফারেন্স ড: আখতার হোসেনের Professor Amartya Sen And The 1974 Bangladesh Famine – Akhtar Hossain থেকে নেয়া, যাতে আরো অনেক রেফেরেন্স আছে।
M. Ravallion, ‘Markets and Famines’ (1987) এর পৃষ্ঠা ৭৮-৭৯ থেকেঃ
[… the government’s use of military action against hoarders and smugglers in
May 1974 was soon terminated when the army apprehended numerous members
of the Awami League (Maniruzzaman, 1975). By late 1974, many observers, including the Finance Minister, Tajuddin Ahmed, claimed that the famine was as much the result of the government’s activities as of bad weather.]
Maniruzzaman, (1975) -> “Bangladesh in 1974: Economic Crisis and Political Polarization”, Asian Survey,Vol.15, pp.117-128)
এই সেনাবাহিনীর আওয়ামী লীগার চোরাকারবারী/মজুতদার ধরার পরিণতি আন্টনি মাস্কারেনহাসের “Bangladesh: A legacy of blood” এর ৪৭ পৃষ্ঠায়ও উল্লেখ করা আছে। এই অপারেশনের দায়িত্বে ছিলে কর্নেল ফারুক। ফারুক বলেছিলেন যে যখনই কোন চোরাকারবারী বা মজুতদার ধরা হিত দেখা যেত যে তারা আওয়ামী লীগার বা আওয়ামী লিগ সমর্থিত। তিনি মাস্কারেনহাসকে বলেন যে তাকে একটা লিখিত অর্ডার দেয়া ছিল যে কোন আওয়ামী লীগারকে যেন ধরা না হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্য এই দুর্ভিক্ষের জন্য তেমন প্রাসঙ্গিক ছিলনাঃ
M. Ravallion, ‘Markets and Famines’ (1987) এর ৯৫ পৃঃ থেকে :
[Domestic markets in Bangladesh were effectively segmented from world markets during this period. The domestic price instability is not attributable to conditions in foreign markets]
মার্কিন খাদ্য সাহায্য না দেয়া বা বিলম্বে দেয়াও আসল ব্যাপার ছিল না। যেমন ড: আখতার বলেনঃ
“While the American action was deplorable, it is however an exaggeration to claim that the threat to cut off food aid of about 20 thousand tons in September 1974 was the prime cause of famine. This was just one among many other factors that raised food prices by raising price expectations and creating economic uncertainties. As already discussed, the process of famine started when inflation took off in
1972 due to indisciplined monetary and fiscal policy”
চোরাকারবারের মূল কারণ ছিল মুদ্রা পাচার ও মুদ্রা নীতি। খাদ্যের পর্যাপ্ততা /অপর্যাপ্ততা এ ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক ছিল না। যেমন ড: আখতার বলেনঃ
Having faced such practical difficulties in transferring capital, the main option remaining for asset-holders was to smuggle out the taka notes (and precious metals) into India where there were active black markets for those currency notes and precious metals. Private money-changers in India generally converted the taka
notes into the Indian currency with a heavy discount. They, in turn, sold the taka notes to smugglers who purchased those essential products from Bangladesh that had excess demand in India. This was the common mechanism for capital flight from Bangladesh to India, and it satisfied the interests of all parties concerned. This also explains why foodgrains were smuggled out from Bangladesh into India even when the food price differential was not large enough to induce such smuggling during or prior to the famine।
The politics and economics of food and famine in Bangladesh in the early 1970s – with special reference to Amartya Sen’s interpretation of the 1974 famine
– Caf Dowlah
(International Journal of Social Welfare
Volume 15, Issue 4, pages 344–356, October 2006)
বই তে লেখক দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে লিখেছেন “the directing of subsidised food to the politically vocal urban population, an abrupt fall in food aid and political and administrative corruption that encouraged massive hoarding and the smuggling of food grain”
যেখানে সংবিধানে সমাজতন্ত্র একটা মৌলিক স্তম্ভ বলা হয়েছিল, সেখানে গ্রামে অভুক্ত লোকের দিকে খাবার পাঠিয়ে শহরের প্রভাবশালীদের সমর্তনের আশায় শহরেই খাদ্য মজুত রাখা কি ধরণের সমাজতন্ত্র? যেখানে হাজার হাজার মানুষ মা খেয়ে মরছে সেখানে সংবাদপতের শেখ কামালের স্বর্ণমুকুট পরা ছবি কেমন দেখায় ?(হুমায়ুন আজাদের “আমরা কে এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম বইতে এর উল্লেখ আছে, পৃঃ ৫৯)
মোদ্দা কথা অন্য সব ফ্যাক্টর সত্বেও মুজিব সরকারে ব্যর্থতা, দুর্নীতিঅই এই মানব সৃষ্ট দুর্যোগ রোধ না করতে পারার চূড়ান্ত কারণ। এটা প্রিভেন্টেব্ল ছিল। এর দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।
@কালযাত্রী,
আলোচনা বেশ ভাল দিকে এগিয়েছে, আপনাকে ধন্যবাদ যে আপনার খাতিরে আমিও এ বিষয়ে আরো নুতন তথ্য জেনেছি, আমার আগের ধারনার পরিবর্তন অবশ্যই কিছুটা হলেও ঘটেছে, তবে মূল কারন ভারতে খাদ্যদ্রব্য চোরাচালান এই ধারনা বাদ দেবার কারন আরো দৃঢ় হয়েছে।
আপনি দেখি ‘নিরপেক্ষ’ অর্থনীতিবিদদের তালিকায় কর্নেল ফারুককেও যোগ করেছেন, তাকে বেশ বড় রেফারেন্স মানছেন। যাক, তার মোটিভেশন কি সে কথা বাদ দিয়েও মানতে হয় যে তার কথার সত্যতা অবশ্যই কিছুটা আছে তাতে সন্দেহ নেই। আমি নিজেই ততকালীন আওয়ামী লীগ/বংগবন্ধুর সমালোচনা এ কারনে করি। দলীয় পরিচয়ের বদমায়েশদের ব্যাপারে কঠোর ব্যাবস্থা তারা নিতে পারেনি, সেনাবাহিনী অপরাধীদের পাকড়াও করলে দলীয় চাপে তাদের ছেড়ে দিতে বাঁধ্য হত এমন অভিযোগ শুধু ফারুক নয়, আরো অনেকেই করেছেন। কর্নেল ফারুক যেইই হন, তিনি কালেক্টিভ কি ষ্টাডি করেছেন তা আমার জানা নেই।
ভারতের সাথে চোরাচালান সমস্যা ‘৭১ এর পর থেকেই ছিল, এর মাত্রা বরঞ্চ ৭৩/৭৪ এর তূলনায় ৭১/৭২ এর দিকেই বেশী ছিল মনে হয়। তবে খাদ্য সামগ্রীর মূল্য বাংলাদেশের তূলনায় ভারতে সব সময়ই কম। সে খাদ্য সামগ্রী ভারতে পাচার করা কতটা লাভজনক হত এ কথা প্রথমেই মনে আসার কথা। আরো কিছু প্র্যাক্টিকেল কন্সিডারেশন আছে যাতে চোরচালান মূল কারন এমন মনে হওয়ার তেমন কারন দেখি না।
কথা হল চোরাচালান কি মূল কারন? আওয়ামী চোরাচালানীরা কি কেবল ‘৭৪ এর কয় মাসই সক্রিয় ছিল? দূর্ভিক্ষ তো আসলে পুরো ‘৭৪ সাল জুড়েও হয়নি। নাকি বংগবন্ধু সরকার ‘৭৪ এর ক’মাস তাদের বিশেষ কোন ছাড় দিয়েছিল? সময় সীমা শেষ হবার পর চোরাচালানরা ভালমানুষ হয়ে গেছিল? নাকি বংগবন্ধু সরকারই ‘৭৪ এর সেই ভয়াবহ ক’মাসের পর দলীয় চোরাচালানদের কঠোর হাতে দমন করে ফেলেছিল বললে আপনি মেনে নেবেন?
চোরাচালান সম্ভাব্য কারন ছিল কিনা তার তত্ত্বীয় ছাড়াও বাস্তব ভিত্তিক এনালাইসিস আছে। কর্নেল ফারুকের মত নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ হয়ত তাতে একমত হতেন হতেন না জানা কথা। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের গবেষনা থেকে কিছু জেনে নিন। সে সময়ের স্মাগলিং কতটা গুরুত্বপূর্ন কারন হতে পারে তার ধারনা পাওয়া যেতে পারে, এ ষ্টাডি শুধু ঘটার ১০/২০ বছর পর দুনিয়ার অপরপ্রান্তে বসে নামজাদা অর্থনীতিবিদদের তত্ত্বীয় ধারনা নয়, কেম্ব্রীজ ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপকের ষ্টাডি যিনি সরেজমিনে সে সময় পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে গেছিলেন।
10.2 HOW IMPORTANT WAS SMUGGLING?
Was smuggling to India large enough to create such a scarcity? During 1973-74 right up to the famine period, there were widespread rumours and reports in the press of smuggling of foodgrains to India. In response, the government employed the army to guard the borders against smuggling from April 1974 onwards. There was no way one could estimate smuggling of foodgrains from direct observations. From the list of goods confiscated by the army at the borders, it appeared that rice was hardly the most important item, but sixth or seventh in importance. Brian Reddaway of Cambridge University, England, visiting the Bangladesh Institute of Development Studies at that time, was requested to undertake a study of the subject. His study was based on an indirect method of comparison of rice prices in border areas with those in the interior markets that were on the direct trade route to the border areas. Ex hypothesi, in case there was a large scale smuggling, prices Were most likely to be higher in the border areas than in the interior markets that were supplying rice for smuggling. On a study of price behaviour in different markets, he came to the conclusion that smuggling was not significant so as to run into hundreds of thousands of tons Direct comparisons of prices of jute in the border market in Bangladesh with those in a neighboring border market in India- converted at the prevailing black market rates of exchange between the Bangladesh and India currencies- did not indicate high enough profit to justify large-scale smuggling.8 Large scale smuggling would be inconsistent with highly variable smuggling profit margin from month to month. The evidence indicated high variability. This was consistent with the hypothesis of limited smuggling.
ধরে নিলাম যেই এই ধারনাও সঠিক নয়, এখন দেখা যাক যে সে সময়ের বর্ডারে খাদ্যদ্রব্য চোরাচালান হচ্ছিল এমন আলামত কেমন পাওয়া যাচ্ছিল। সে সময় যেমন দলীয় হালুয়া রুটি খাওয়া লোকে মধু লুটছিল তেমনি সেনাবাহিনীর লোকেরাও অবস্থা কিছুটা হলেও অতিরঞ্জন করছিল তারও আলামত আছে। তবে সেজন্য আমি তাদের দোষ দেই না, কষ্ট করে ক্রিমিনাল ধরলে তাদের দলীয় চাপে ছেড়ে দিতে হলে মেজাজ খারাপ হবেই।
……There was some discussion between us as to the evidence the army had about large scale rice smuggling. In the absence of any direct estimate of smuggling. I tried to engage him in a discussion about various indirect indicators that could help to explain or give an idea about the scale of smuggling. For example, I wanted to know how, in his opinion; hundreds of thousands of tons of rice were being smuggled in such a short time (between April-June). This discussion took place at the time of the onset of July-August 1974 floods when prices rose very sharply. If smuggling was the cause for such a spurt in prices, then it had to occur on a very large scale in the months immediately following Aman and Boro harvests. How were such large quantities transported of carried across the borders in such a short period? If rice was to be transported in such large quantities, it could not be done in small lots by individual smugglers. If that was the case, then very large members of people or smugglers were to be seen crossing back and forth the border continuously for a month or so. This was obviously ruled out, since the army had not confirmed a large scale continuous movement of people. Alternatively, rice had to be transported in big trucks and barges and that was possible only through a few points at the border where they could physically pass through. Therefore, if very substantial smuggling did take place, it was unlikely that such a large scale crossborder movements of trucks and barges would not have been detected by the public, the Bangladesh Rifles (BDR) and the army. However, it was the contention of the army that even if they had observed such large scale movements, they could not have seized or taken preventive action since local party workers or leaders were in league with smugglers with the connivance of local officials.9 But then newspapers, which were full of reports and rumours on the food situation, did not report such a very large scale movement of trucks and barges within the span of such a short period
……Estimates of massive smuggling to rice that Zia conveyed appeared improbable, considering the limited time involved and the poor state of roads and transportation systems in the border and adjoining areas in the early days of Bangladesh
তত্ত্বীয়ভাবে ওপারে কম দাম হলে খাদ্য চোরাচালান হতে পারে এমন সম্ভাবনা থাকলেও খাদ্য চোরাচালান যে সে সময় সে মাত্রায় হচ্ছিল না তার আলামত সরাসরিও মনে হয় পাওয়া যায়, যদিও চোরাচালানের কোন ষ্ট্যাটিসটিক্স পাওয়া সম্ভব নয়। ……There was no way one could estimate smuggling of foodgrains from direct observations. From the list of goods confiscated by the army at the borders, it appeared that rice was hardly the most important item, but sixth or seventh in importance.
http://www.scholarsbangladesh.com/nurulislam1.php
আপনার দেওয়া সূত্রগুলি সে সময় সরেজমিনে এমন ধরনের বাস্তব ভিত্তিক ষ্টাডি কতটা করেছে আর বিক্ষিপ্তভাবে সংবাদপত্রের রিপোর্ট, গতবাধা ধারনার ওপর কতটা কাজ করেছে সে প্রশ্ন আসতে পারে।
আপনার দেওয়া আখতার হোসেনের সূত্র থেকে মূল্যবান কথা জেনেছি যে আসলে চোরাচালান নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক মাতামাতি হলেও (আমার কথা) তার থেকেও বড় ভূমিকা রেখেছিল মজুদদাররা, সেটা অবশ্যই একটি বড় কারন হতে পারে। এই মজুদদারদের কিন্তু আখতার সাহেব দলীয় অদলীয় ভাগ করেননি, ‘বোনা ফাইড’ খাদ্য ব্যাবসায়ী হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। আমাদের ব্যাবসায়ীদের স্বভাব চিরকালই তাই, মুনাফার চিহ্ন দেখলে মজুদদারি করে কৃত্রিমভাবে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ায়, এটা আসলে অনেকটা আমাদের সংস্কৃতির অংগ। বিদেশে ক্রিসমাস আসলে জিনিসের দাম কমে, আর আমাদের দেশে রোজা ঈদ আসলে দাম বাড়ে। এর সাথে দলীয়/অদলীয় সম্পর্ক নেই, যদিও এদের নিয়ন্ত্রন করার মত অসম্ভব কাজটা অবশ্যই সরকারের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
আখতার সাহেবের পেপার থেকেঃ
The situation deteriorated further when bona fide rice traders in big cities started the
speculative hoarding of foodgrains in an anticipation of the food crisis. Their expectations of food prices were based primarily on the actual or potential damage that was caused to food crops by floods. As the country had only a limited amount of foreign exchange reserve, rice traders were generally pessimistic about the ability of the government to import foodgrains to the extent necessary to fill in the food gap. Ravallion (1987) has studied the behaviour of rice traders in Dhaka and showed how the price forecasting errors of them led to excessive hoarding.
মজুদদারির ব্যাবসা শুরু হয়েছিল বন্যার ভয়াবহতার কারনে, আর যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সির অভাব যার কারনে সে সময়কার হঠাত বেড়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য কিনতে পারা যাবে না, সর্বোপরি মার্কিন সাহায্য আসবে না এসব আতংকে। সে সময়কার তেল সংকট মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়েছিল তবে সরকারের কিছু অনভিজ্ঞ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তও মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী ছিল। আজকের দিনে তেলের দাম ৪ গুন বাড়লে কেমন ফলাফল দেশে হবে তা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। ঠিক একই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য মূল্য বেড়েছিল আকাশ্চুম্বী হয়ে। ‘৭৪ সালে দাম কতটা বেড়েছিল তা ফিগার ২।২ তে দেখেন। http://www.ifpri.org/sites/default/files/publications/rr165.pdf
অনেকেই দেখি তত্ত্বীয় হিসেব করছেন যে ‘যথেষ্ট’ খাদ্যদ্রব্য দেশে মজুদ ছিল, তাও দূর্ভিক্ষ হয়েছে, কাজেই মানব সৃষ্ট, আপনার মতে যেই মানব সরকার। …মার্কিন সাহায্য বাতিলের গুরুত্ব থাকতে পারে না…
এখানে মনে হয় একটি মোটাদাগের কথা অনেকেই তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না তা হল আমাদের সমাজ ব্যাবস্থার তীব্র শ্রেনীবিভাগ। সে সময়ের দূর্ভিক্ষে মরেছে যথারীতি মরেছে দরিদ্র শ্রেনীর লোকে, কারন তাদের বন্যার কারনে উপার্জন ছিল না (আখতার হোসেনের লেখাতেও আছে)He did not, however, examine in detail the economic events that led to the entitlement failure of
the rural poor, including landless wage labourers, artisans, and transport workers.। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন বলে দাবী করা হয়, তারপরেও বিপুল পরিমান খাদ্যদ্রব্য আমদানী করতে হয়। কেন? দেশের নিজের স্বয়ংসম্পূর্নতা থাকতে ক্যান আমদানী করতে হয়? এর কারন হল সমাজের গরীব শ্রেনীর জন্য স্বয়ংসম্পূর্নতার কাগুজে হিসেবে কিছু যায় আসে না। তাদের নির্ভর করতে হয় সরকারের নানান কর্মসূচী যেমন কাজের বিনিময়ে খাদ্য এসবের জন্য। সে সময় ছিল রেশন ব্যাবস্থা। এই জাতীয় কর্মসূচীর জন্য বিদেশী খাদ্য সাহায্য সব সময়ই প্রয়োযন, আজকের দিনেও প্রয়োযন।
দূর্ভিক্ষ ছিল আসলে কয়েক মাস, এটা দেখা যায় যে এর ভয়াবহতা (পুরো সারতে যদিও পুরো ‘৭৫ সালই লেগেছিল) দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল ‘৭৪ এর বন্যা নেমে যাবার পর পরই, এর মূল কারন বন্যা শেষ, নুতন ধান উঠছিল, সর্বোপরি মার্কিন সেই সাহায্যও দেরীতে হলেও পৌছেছিল। বন্যা সরাসরি ফসল নষ্ট করে ক্ষতি সেভাবে করেনি, তবে উপার্জন ক্ষমতা নষ্ট করে, আতংক ছড়িয়ে মজুদদারিতে উতসাহিত করে ক্ষতি করেছে অনেক বেশী, এটা অনেকে সেভাবে মানতে চান না, কেবল হিসেব দেখান যে বন্যায় ফসলের ক্ষতি ১২% হলেও তা দূর্ভিক্ষ আনতে যথেষ্ট নয়। অযোগ্য দূর্নীতিবাজ সরকার হঠাত শীতকাল মার্কিন সাহায্য আসার পর থেকে ভাল হয়ে গেছিল যদি মানতে না চান আরকি। ‘৭৩ সালে সরকার রাশিয়া থেকে কিভাবে সাহায্য ঘুরিয়ে এনে বিপর্যয় ঠেকিয়েছিল তার ফাউ বিবরন পাবেন নুরল ইসলামের গবেষনায়।
ব্রিটিশ মিডিয়ার ততকালীন সরেসজমিনে প্রতিবেদন দেখেন এইখানে, তারা কাকে দায়ী করছে দেখেন। বেশ আবেগময় এবং হ্রদয়বিদারক প্রতিবেদন।
http://www.genocidebangladesh.org/?p=465
তবে কারন যাইই থাক, নৈতিকভাবে হলেও সেটা ততকালীন সরকারের জন্য অবশ্যই একটি কালো অধ্যায়, কতটা তাদের দূর্বলতা/অযোগ্যতা/দূর্নীতি আর কতটা একযোগে নানান গুরুতর পরিস্থিতির শিকার এ প্রশ্ন বাদ দিলেও।
@কাজি মামুন,
০১. বিতর্কটি সহব্লগার শনিবারের চিঠির কাছ থেকে আশা করেছিলাম; কারণ এর আগের পোস্টগুলোতে মুক্তমনার জন্য মুক্তিযুদ্ধের গবেষণামূলক বিষয়ক পোস্ট দেওয়ার জন্য আমি তাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলাম। বহুদিন ধরেই তার চমৎকার আবেগী লেখনি, অসংখ্য দুর্লভ তথ্য ও বিশ্লেষণের আমি বিশেষ পরিচিত; তবে সর্বাংশে একমত নই। যাক হোক, বিতর্কটিতে আপনি [পরে আকাশ মালিক এবং অন্য সহব্লগাররা] যোগ দেওয়ায় সবিশেষ ধন্যবাদ। শুরুতেই স্পষ্ট আরো জানিয়ে দেই, আপনার বক্তব্যটিকে আমার যথেষ্ট যান্ত্রিক বস্তুবাদে দুষ্ট এবং আপ্তচিন্তার ফল বলে মনে হয়েছে [এবং আকাশ মালিক]।
০২. বিনয়ের সঙ্গে বলি, ভ্রাতা, আপনি দেখছি, আমার বক্তব্য ধরতে বেশ খানিকটা ভুল বুঝেছেন, নয়তো আমার বক্তব্যের মূল কথা তেমন কিছুই বোঝেননি। এটি বোঝার ভুল হতে পারে, আবার বোঝানোর ভুলও হতে পারে। ধরে নিচ্ছি, এটি আমারই ব্যর্থতা। অনুগ্রহ করে উদ্ধৃতি/লিংক [এ বিষয়ে আলাদা পয়েন্টে পরে বলছি] বাদে আমার বক্তব্যগুলো আরেকবার পড়ে দেখবেন কী? উদ্ধৃতি/লিংক-এর বাইরে বিপ্লব রহমান যা বলেছে, তা প্রায় হুবহু এই রকম:
০৩. পাঠক মাত্রই জানেন, কোনো উদ্ধৃত/তথ্যসূত্র/লিংক যখন ব্যবহার করা হয়, তখন তা করা হয় মূল বক্তব্যটিকে প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু কাজী মামুন [এবং আকাশ মালিক, তার সঙ্গে আলাদা বিতর্কের খুব বেশী প্রয়োজন দেখছি না], আপনি আমার মূল বক্তব্যটিকে একেবারেই আমলে না নিয়ে বিপ্লব রহমানকে হাস্যকরভাবে ড. আহমদ শরীফ ঠাউড়ে নিয়ে তার মুখে ড.শরীফ বসিয়ে দিয়ে রীতিমত পুলিশি জেরা শুরু করে দিলেন! মুক্তমনায় এইরকম চূড়ান্ত যান্ত্রিকতা আগে খুব বেশী দেখিনি ভাই!
আপনি জানেন কি না জানি না, জেনে থাকলে আবারো মনে করিয়ে দেই, উদ্ধৃত/তথ্যসূত্র/লিংক-এর ব্যবহারকারীকে সংশ্লিষ্ট উদ্ধৃত/তথ্যসূত্র/লিংক-এর সঙ্গে একদম শতভাগ একমত হতে হবে, এমন কোনো স্বতঃসিদ্ধতা সর্বত্র নেই। তবে অনেকাংশে একমত হওয়াই সমীচিন।
তাই, আপনি যদি বলতেন, আচ্ছা বিপ্লব, আপনার উদ্ধৃত ড. শরীফ অমুক কথাটি কেনো বলেছিলেন বলে আপনি মনে করেন, সেক্ষেত্রে ড.শরীফের সম্ভাব্য ভাবনাটির উদ্দেশ্য বা বিধেয় বা বস্তুনিষ্ঠতা বা ফলাফল ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে, সেটি হবে বিপ্লবের ব্যাখ্যামাত্র এবং তা অবশ্যই ড.শরীফকে কেন্দ্র করে, তবে তা একশত ভাগ ড. শরীফের ভাবনার আলোকে না-ও হতে পারে।
আবার কোনো লেখক যখন নিজের লেখা তথ্যসূত্র/লিংক হিসেবে ব্যবহার করে, তখন ওই তথ্যসূত্র/লিংক-এর সুতো ধরে সেই লেখাটিও পরে নিয়ে লেখকের পুরো মতটিকে বুঝে নিতে হয়। তাই বিপ্লব যখন নিজের বক্তব্যের সমর্থনে সিরাজ সিকদার সর্ম্পকিত লেখা তথ্যসূত্র/লিংক [এবং ইমেজ] হিসেবে ব্যবহার করে সেগুলো ভালো করে পড়েশুনে তবেই তার মতটিকে বোঝা জরুরি। নইলে আপ্ত/অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী হয়ে উঠতে পারে বৈকি। এই যেমন, সহব্লগার আকাশ মালিক বিপ্লবকে লক্ষ্য করে এবং আপনাকে উপলক্ষ্য করে বলেন, “১০ জানুয়ারি ৭১ পুষ্প মালাটা মুজিবের গলায় পরায়ে এদেশের মানুষ মারাত্বক ভুল করেছিল, পরানো উচিৎ ছিল সিরাজ সিকদার ও তার বোন শামিম শিকদারের গলায়। আহা, আজ আমরা সুখের সাগরে ভেসে বেড়াতাম।”
আপনার জন্য আরো সহজ করে বলি, ড. শরীফকে বিপ্লব যখন উদ্ধৃত করে তখন সে বুলি আউড়ায় না, নিজের পাঠ-চিন্তনের সঙ্গে ড.শরীফকে মিলিয়ে নিয়ে বোধটিকে আরো পোক্ত/ঝালাই করে; পাঠকরাও বিপ্লব ও ড.শরীফ দুজনের মতটিকে সমান্তরালভাবে যাচাই করার সুযোগ পান। কিন্তু বিপ্লব মানেই ড. শরীফ নয়। তার নিজস্ব একটি মত আছে –এটিকে মনে রাখার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানাই।
০৪. এ পর্যায়ে সমস্ত উদ্ধৃত/তথ্যসূত্র/লিংক বাদেই আপনার আপত্তি/বিতর্কটি ঠিক কোন কোন বিষয়ে এবং কেনো, তা জানার জন্য বিশেষ আগ্রহ বোধ করছি। কারণ ড. আহমদ শরীফ বা সিরাজ সিকদার সেজে বিপ্লব রহমান তাদের পক্ষে বিতর্ক করতে রাজী নন, এমনকি প্রথমজনকে বিশিষ্ট দেশপ্রেমিক ও বুদ্ধিজীবী এবং শেষোক্তজনকে দেশপ্রেমিক, কিন্তু হঠকারি বিপ্লবী মনে করা বা না করার সঙ্গেও এটি সর্ম্পকিত নয়।
অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা রইলো। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
শনিবারের চিঠি হয়তো সময় করে আসবেন। বিপ্লব দা, আলোচনা চলুক, নির্মোহ, নিরপেক্ষদৃষ্টিকোণ থেকে। য্তক্ষণ পর্যন্ত আমরা তর্কটাকে ব্যক্তি বিদ্বেষ পর্যায়ে না নিচ্ছি, কোন নির্দিষ্ট দল বা মতের অনুগত বা অন্ধ সমর্থক হিসেবে না দেখছি, আলোচনায় যে কোন মানুষ অংশ গ্রহণ করুন, আশাকরি তাতে অসুবিধে হওয়ার কথা না। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব মত-পছন্দ থাকবে সেটাই স্বাভাবাবিক। আহমেদ শরিফ বা হুমায়ুন আজাদ বা রবীন্দ্রনাথের কোন কর্ম, সিদ্ধান্ত মন্তব্যকে ঈশ্বর কর্ম বা তার বাণী বা চিরন্তন সত্য বলে মেনে নেয়ার কোন কারণ নেই। শেখ মুজিবও তেমনি এক রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন, সমালোচনার উর্ধে নন, কোন ফেরেস্তা বা দেবতাও নন। ১০ জানুয়ারি ৭২ থেকে ১৫ আগষ্ট ৭৫ এই সময়ের দেশে বিদ্যমান পরিবেশ, পরিস্থিতি, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার একটা চিত্র শনি ও আপনার আলোচনায় উঠে আসুক সেই আশায় রইলাম।
@বিপ্লব রহমান,
ধন্যবাদ আপনার আলোচনার জন্য। মুক্তমনায় সুস্থ বিতর্কের যে ধারা বহমান, আপনি তাকেই উচ্চকিত করলেন আপনার বিনীত আলোচনার মাধ্যমে।
উপরের ‘যেমন’ শব্দটি এমন ইঙ্গিত দেয় না কি যে, আপনি তেমনটাই মনে করছেন, যেমনটা ড. শরীফ লিখে গেছেন বঙ্গবন্ধু বিষয়ক তার নিজস্ব মূল্যায়নে? যেহেতু ড. শরীফ বেঁচে নেই (বা বেঁচে থাকলেও উনার নাগাল পাওয়া হয়ত আমাদের পক্ষে সম্ভব হত না), তাই তার মন্তব্যের যে দিকগুলো নিয়ে মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, তার জবাব আপনার কাছে আশা করেছিলাম এই ভাবনায় যে, আপনি উনার এই মন্তব্যগুলোর ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবেন (যেহেতু আপনি তাকে অধ্যয়ন ও উদ্ধৃত করেছেন)। আর একটা কথা বলা দরকার, ড. শরীফ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদ হিসেবে আমাদের সবার শ্রদ্ধার পাত্র, তবু তার কোন কোন ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, কারণ মুক্তমনাই শিখিয়েছে, কেউই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়, কেউই পুজনীয় নয়, সে রবীন্দ্রনাথই হোক আর ড. শরীফই হোক।
ড. শরীফের উদ্ধৃতি থেকে প্রশ্নগুলো করার অর্থই হল, এ সম্পর্কে আপনার মত জানতে চাওয়া। ড. শরীফ হয়ে আপনি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন বা দিতে বাধ্য, এমনটা কি কোথাও বলা হয়েছে? যদি তাই বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে দুঃখ প্রকাশ করছি আর সঙ্গে আপনার মত জানতে চাইছি প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে (এটা মেনেই যে, আপনার মত ড. শরীফ থেকে ভিন্ন হতেই পারে)।
পড়াশুনা নেই এবং ‘বিদ্যা অল্প’ বলেই তো প্রশ্ন করেছি। আপনি উত্তর দিয়ে আমাদের অল্পবিদ্যাকে ভয়ংকর হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারেন। 🙂
ড. শরীফের সাথে আপনার মতের সঙ্গতি আছে, এমনটা মনে করা কি এই ইঙ্গিত দেয় যে, আপনার নিজস্ব কোন মত নেই?
আমার মন্তব্যটির শেষে আপনার ‘এদেশে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠা, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ, দেশ চালানোর অযোগ্যতা ও অরাজকতার কারণে মুজিব সরকারের পতন প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো।’ – এই লাইনটি উদ্ধৃত করে কিছু কথা বলা হয়েছিল ও অন্য লেখকদের কিছু উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছিল। সেখানে বিতর্কটি মনে হয় পরিষ্কার হয়েছে। আমাদের অল্প পড়াশুনায় জেনেছি, ফ্যাসিবাদী (মানে, রক্ষিবাহিনী, ইত্যাদি গঠন) রাজনীতির পেছনে সিরাজ শিকদারদের কেমন উস্কানি ছিল, ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের পেছনে কেমনভাবে দায়ী ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, ইত্যাদি, অরাজকতার পেছনে কেমনভাবে দায়ী ছিল পাচারকারী, চোরাকারবারি, মজুদদারেরা, আর দেশ চালানোয় অযোগ্য মুজিব কিভাবে বহিষ্কার করেছিল দলীয় সাংসদ এবং সরকারী কর্মকর্তাদের। আশা করি, এসব তথ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমাদের জানাবেন। কেন এসব প্রেক্ষিত সত্বেও মুজিবের ব্যর্থতাকে আপনার কাছে এত বিশাল মনে হয় যে, মুজিবের পতন (মানে কি সপরিবারে হত্যাকাণ্ড?) অনিবার্য হয়ে যায় আপনার কাছে? দেশের ঐ সময়কার পরিস্থিতিতে মুজিবের পতন কি কি সুবিধা বয়ে আনার কথা ছিল এবং কি কি সুবিধা এনেছিল বাস্তবিক? আর যদি আমার উদ্ধৃত অন্য লেখকদের তথ্যগুলো মিথ্যা হয়, তাহলেও আপনার কাছ থেকে জানার আশা করছি।
যান্ত্রিকতার যুগে ‘অযান্ত্রিক’ হওয়ার সুযোগ কোথায় বলুন, ভাইয়া? 🙂
কিছু নিরীহ প্রশ্নকে আপনার কাছে পুলিশি জেরা মনে হল? যদি সত্যি তাই মনে হয়ে থাকে, আমি লজ্জিত, দুঃখিত আর ক্ষমা-প্রার্থী!
পঁচাত্তরের পরের ২১ বছর বঙ্গবন্ধু (যার নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং যাকে ‘৭২ এর ১০ই জানুয়ারি এদেশের মানুষ গ্রহণ করেছিল) পাঠ্যপুস্তকে বা সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল। এরপর হাসিনার সরকার দু-মেয়াদে বঙ্গবন্ধুর নামটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং ক্ষেত্র-বিশেষে বাড়াবাড়ি করেছে। অন্যদিকে বিএনপি সরকার বঙ্গবন্ধুকে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুধু বিসর্জনই দেয়নি, জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বানিয়ে ফেলেছে। সুতরাং, আপনি যখন বঙ্গবন্ধু আর শহীদ জিয়ার নাম একত্রে উচ্চারণ করেন বা পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাস দখলের দায়ে সমানভাবে অভিযুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু বা সেক্টর কমান্ডার জিয়াকে, তখন কিছুটা দৃষ্টিকটু লাগে বইকি!
বঙ্গবন্ধু বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। তবে উনার ব্যর্থতা আমাদের কাছে জাতীয় ব্যর্থতা বলেই মনে হয়, যেখানে উনার নিজস্ব ব্যর্থতা অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যাই হোক, বঙ্গবন্ধুর নির্মোহ সমালোচনা আবশ্যক। আপনার আলোচনা (আমাদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে) সেই পথ দেখাবে আমাদের, সেই প্রত্যাশা করছি।
@কাজি মামুন,
আপনার প্রতি-মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগলো [এবং আকাশ মালিক]। নীচে অভিজিৎ দা’র প্রতিমন্তব্যেও [ইমেজসহ] নিজস্ব ভাবনার খানিকটা জানান দিয়েছি, সেটিকেও এই চলতি প্রতিমন্তব্যটিতে যোগ করে নিলে হয়তো ভালো হতো, সেটি হয়নি বলে চলতি বিতর্কটির পরিসর খানিকটা ভিন্নরূপ নিচ্ছে বলে টের পাই। …নানান উদ্ধৃতি ও যতিচিহ্নের বাইরে এইবার বোধহয় আপনার কথা থানিকটা বুঝেছি; আবারো স্পষ্ট বলি, যদিও আপনার সরলীকরণের গরলভেল সর্বত্র বিস্তর এবং সঙ্গত কারণেই এর সঙ্গে মতৈক্য খুব সামান্যই। আমার কথিত মুজিবের নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ সর্ম্পকিত মতামত, যা আমার এতোক্ষণের বক্তব্যের টপলাইন, তা অবশ্য ঠিকই ধরতে পেরেছেন, সে জন্য একটি লাল গোলাপ আপনার অবশ্যপ্রাপ্য [সহব্লগার আকাশ মালিকও এখন এই টপলাইনে আছেন, তাকেও সাধুবাদ]। (F)
মুজিবের পতন অনিবার্যতার সঙ্গে সপরিবারে খুনকে সমর্থন বা সিরাজ সিকদারের অভ্যূত্থানের সম্ভাবনার কথা আমি কোথাও ঘুনাক্ষরেও বলিনি, বরং আন্তরিকভাবেই মুজিবসহ জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা বিচারই চেয়েছি [এবং কি আশ্চর্যজনকভাবে আপনি এই গুরুতর বিষয়টিকে আমলেই নেননি], রক্ষী বাহিনীবাদীতাকেই একমাত্র ফ্যাসিবাদী উপদান বলেও মনে করিনি, কারণ এটি মুজিব- ফ্যাসিজম ও ফ্যান্টাসির গেস্টোপা অ্যাকশন মাত্র, কিন্তু আপনার সরলসমীকরণ/আপ্তবিদ্যা আমার মতামতের সারৎসার সে রকমভাবেই উপস্থাপন করে।
মুজিবের সংক্ষিপ্ত বিচার-ব্যাখায় ড. আহমদ শরীফের প্রতি অবশ্যই আমার বেশ খানিকটা পক্ষপাত রয়েছে, সেটি পক্ষপাতই মাত্র, মুজিব প্রেমের ভাব-বুদ্বুদের বাইরে এ সম্পর্কিত আমার নিজস্ব পাঠ-প্রতিক্রিয়াটি ইতিহাস বিশ্লেষনে বিশদে নিম্নরূপ [যে কোনো মতামত সাদরে গ্রহণীয়, পুরো আলাচনাটি চলতি ধারাবাহিকের শেষ পর্বে হলেই হয়তো ভালো হতো, কিন্তু পুরো বক্তব্যটি পরিস্কারভাবে এখনই তা উপস্থাপন করার জোর তাগিদ বোধ করছি]:
প্রথমত, ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ১৯৭১ এর মহান জনযুদ্ধটি মুক্তিযুদ্ধই ছিলো, এটি ছিলো ছাত্র-শিক্ষক-জনতা-সাধারণ মানুষ সকলের মুক্তির সংগ্রাম, মোটেও কেবলমাত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম বা একখণ্ড দেশপ্রাপ্তির লড়াই তো নয়ই [এ কারণেই আদিবাসীরাও বাঙালির পাশাপাশি এতে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেন, স্বাধীন দেশে সব রকমের মুক্তির স্বপ্ন দেখেন তারাও, যদিও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাদের সে স্বপ্ন নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, ‘তোরা সব বাঙালি হইয়া যা’ ], শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার মানুষের স্পিরিটটুকু ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়, বাঙালি ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন প্রায় কিংবদন্তীতুল্য নেতা, বঙ্গবন্ধু [এতে নিজস্বপন্থায় বিপ্লবকাঙ্খায় সরাসরি অংশ নিয়ে অবদান রাখে কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন দল ও উপদল, এমকি সিরাজ সিকদার, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাদের সকলকেই মুজিব-জিয়া স্বৈর শাসনে নির্মমভাবে খুন হতে দেখা যায়, উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রপাগান্ডায় তারা থাকেন উপেক্ষিত এবং ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’], সাতের দশকে অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ এক পর্যায়ে সমর্থক হয়ে পড়ে [স্বাধীনতার পর সেই মোহ চূর্ণ হয় অচিরেই, বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত আর বঙ্গের বন্ধু থাকেননি, নায়ক থেকে খলনায়কে তার উত্তোরণ ঘটে দ্রুত, সহযোগি ভক্তকূল তাকে সামনে রেখে সব রকম দেশবিরোধীতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও লুঠপাটে মত্ত হয়], যদিও মুক্তিযুদ্ধের নিয়ামক এই শক্তিটি এর আগে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় জোর ভূমিকা রেখেছে।
সে সময় একমাত্র বাংলা এবং পাঞ্জাব প্রদেশেই মুসলিম লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জোরেই মুসলিম লীগ পাকিস্তানের সম্বাবনা ভারতবর্ষের বাদবাকি মুসলমানদের দেখাতে সাহস করে। তখন শেখ মুজিবও সেই আন্দোলনেরই বলিষ্ঠকর্মি ছিলেন [এবং মওলানা ভাষানী]। শেখ মুজিব তখন মুসলিম লীগের রক্ষণশীল সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কর্মি ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীদের বিরুদ্ধে ছিলেন আবুল হাশিমের মতো প্রগতিশীল তরুণ নেতা। বাংলার অখণ্ডতা ঠেকাতে আবুল হাশিম-শরত বোস প্রমুখের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৪৭-এর পর আবুল হাশিম রাজনীতিই ছেড়ে দেন। কিন্তু শেখ মুজিব টিকে থাকেন। হাশিমপন্থীরা গোপনে কমিউনিস্টদের সমর্থন দিতে থাকে আওয়ামী লীগের ভেতর। তার বাইরে স্বতন্ত্র ছাত্র-যুব সংগঠনও করতেন তারা, সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও ছিলোন।
দ্বিতীয়ত, পাক উপনিবেশটি ক্রমেই পূর্ব বাংলার হাতে-পায়ে শেকল হয়ে এঁটে বসে। পাকিস্তানে প্রথমত আঘাত হানেন তারাই, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে, এর আগে হাজং বিদ্রোহের সশস্ত্র লড়াইয়ে। ১৯৫২-র পরপরই কমিউনিষ্টরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন পাক শাসনে মুক্তি নেই, নইলে কৃষক-শ্রমিক স্বরাজও সম্ভব নয়, বাংলাকে স্বাধীন না করলে রাষ্ট্র বিপ্লবও সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের অগ্রসর কর্মি — ভাষা মতিন, অলি আহাদদের পরের কার্যক্রম দেখলে সেটা মনে হয়।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন করে বাঙালিদের সব দল এক হয়ে মুসলিম লীগকে শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে দেশ স্বাধীনের শর্ত তৈরী করে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নযাত্রা শুরু এরই আগেই হয়। তখন স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দুটি স্পষ্ট ধারা সমান্তরাল চলতে শুরু করে। একদিকে কমিউনিষ্ট প্রভাবিত ছাত্ররা সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাকে স্বাধীন করতে চান, আরেকদিকে জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি আস্থায় সাংবিধানিক পথে পূর্ণ স্বাত্তশাসনের মাধ্যমে অখণ্ড পাকিস্তানের জায়গায় ফেডারেল পাকিস্তানের স্বপ্ন। শেষোক্ত এই ধারাটিই ২১ দফার প্রবক্তা।
কিন্তু পাক সরকার ২১ দফা মানতে প্রবলভাবে অস্বীকার করে, মাওলানা ভাসানী ১৯৫৬-তে ঘোষণা করেন, এ রকম হলে বাঙালিরা আলাদা রাস্তা ধরবে, এক সঙ্গে থাকবে না। সোহরাওয়ার্দীর প্রধান অনুসারী শেখ মুজিব তার নেতার পথেই থাকেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্র্দী মত দেন, ৯৮ ভাগ স্বাধীনতা তো দেওয়াই হয়েছে।
তৃতীয়ত, আইয়ুব শাহী কমিউনিস্ট কার্যক্রম নিষিদ্ধ করলে তাদের একটি বড় অংশ মওলানা ভাষানীর সমর্থক হয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে থাকেন। কাগমারি সম্মেলনে দলে দলে বিপ্লবী কমিউস্টরা যোগ দেন [‘পাকিস্তান, ওয়ালাইকুম আস সালামালাইকুম’]। আমেরিকার সঙ্গে সামরিক চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়। মুসলিম কাম মার্কিন কাম পাকিস্তানপন্থীদের নেতা থাকেন সোহরাওয়ার্দী ও মুজিব। ভাষানী ন্যাপ গঠন করে পৃথক হন।
আওয়ামী লীগের ভেতরের কমিউনিস্টপন্থীরা তখন মস্কো-চীন দুই গ্রুপে ভাগ হয়। তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় এর আগেই কমিউনিস্টদের অপর অংশটি আওয়ামী লীগে ঢুকেছিলো। মস্কোওয়ালারা চলে যায় মুজিবের সঙ্গে আর চীনারা ভাষানীর সঙ্গে।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়াদী গ্রেফতার হলে ৩১ জানুয়ারি ৪ টি ছাত্র সংগঠন মধুর ক্যান্টিনে যৌথভাবে বসে। সভা থেকে আন্দোলনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। সকল আন্দোলন কর্মসূচিকে সংগঠিতভাবে রূপ দেওয়ার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফোরাম নামে সাধারণ ছাত্রদের একটি মোর্চা গঠন করে। এরই মধ্যে একদল জঙ্গি ছাত্র বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স নামে একটি বাহিনী তৈরি করে। ছাত্ররা তখনই বুঝেছিলো, তাদের লড়তে হবে আইয়ুব শাহীর সেনাদের সঙ্গেই। স্বাধীনতার দুই পথের পার্থক্য তখন আরো স্পষ্ট হয়।
চতুর্থত, উপমহাদেশ ও বিশ্ব রাজনীতিতে ১৯৬৫-৬৬ সালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একমাত্র বাঙালিরাই বীরের মতো লড়ে পাকিস্তানের সন্মান অক্ষুন্ন রাখে। কিন্তু তারা দেখতে পায়, যুদ্ধে পূর্ব বাংলা অরক্ষিত ছিলো। সেটি বাঙালির বৈষম্যকে প্রকট করে। প্রণীত হয় ছয় দফা। যার প্রণোদনা এসেছিলো বামপন্থি শিক্ষক নাজমুল করিমের বই থেকে।
লক্ষনীয়, যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, সে দ্বিজাতিত্ত্বওয়ালারাই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলো, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণ সমান নয়। এ থেকে আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের প্রেরণায় তৈরি করলো বাঙালিদের আরেক দ্বিজাতিত্ত্ব, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এক জাতি নন! সে সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবসহ ৩৪জন সশস্ত্র অভুত্থানের পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেফতার হন, তারা তা অস্বীকার করেন। পূর্ব বাংলা ক্ষুব্ধ থেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল মুজিব জেলে ছিলেন।
অন্যদিকে, ১৯৬৬ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক বিপ্লববের ঢেউ সারা বিশ্বে আছড়ে পড়ে। গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক মাওসেতুং প্রদর্শিত সশস্ত্র বিপ্লবের ঢেউ আলোড়ণ তোলে ভারত ও পূর্ব বাংলায় [ ‘মোর গাঁয়েরও সীমানায়/পাহাড়ের ওপারে/নিথীশ রাত্রির প্রতিধ্বনী শুনি/নতুন দিনের যেনো/পদধ্বনী শুনি’, ভূপেন হাজারিকা]। ভিয়েতনাম ও কিউবার সশস্ত্র গেরিলা বিপ্লবী সংগ্রামও কমিউনিস্টদের উজ্জীবীত করে [‘তোমার নাম, আমার নাম/ভিয়েতনাম! ভিয়েতনাম!’] আরো পরে ভারতের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের নেতা চারু মজুদারের ‘শ্রেণী শত্রু খতমের লাইন’ও এপারের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে প্রভাবিত করে [‘৭০ দশককে মুক্তির দশকে পরিনত করুন’]। এরই পথ ধরে পরে বিপ্লবকাঙ্খি চীনপন্থী কমিউনিস্টরা নিজ নিজ নেতা ও তত্ত্বের সমর্থনে সশস্ত্র হতে শুরু করেন [এবং সিরাজ সিকদার]।
এদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্রের ক্ষোভের পথ ধরে আসে ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থান। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার যুথবদ্ধ যে জঙ্গি আন্দোলন সে সময় হয়, তা-ই রচনা করে ১৯৭১ এর জনযুদ্ধের পটভূমি।
পঞ্চমত, আরো লক্ষ্যনীয়, ১৯৫২ সালের পর তখনও শেখ মুজিব সংগ্রামের কেন্দ্রে ছিলেন না, প্রধান নেতাও ছিলেন না। ভাষানী, তোয়াহা এবং ছাত্রনেতারাই আন্দোলন চালিয়ে যান। তারা সেনা নিবাস ঘেরাও করে শেখ মুজিবকে মুক্ত করেন। কিন্তু শেখ মুজিব আবারো তার অতি চেনা নির্বাচনের পথেই হাঁটলেন। তখন তার জন্য সেটিই ছিলো স্বাভাবিক ও সহজ। কারণ তিনি বিপ্লবী ছিলেন না, ভাষানী মতের তো নয়ই। ১৯৭০ এর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ন্যাপ-ভাষানী এবং প্রায় সকল কমিউনিস্ট পার্টি বর্জন করে। ভাষানীর শ্লোগান ছিলো: ভোটের আগে ভাতা চাই। কমিউনিস্ট শ্লোগান ছিলো: ভোটের বাক্সে লাথি মারো, সমাজতন্ত্র কায়েম করো। বামপন্থীদের একটা বড় অংশ এবং ছাত্ররা মিলে তখনই স্বাধীন পূর্ব বাংলার কর্মসূচি ঘোষণা করে [এবং সিরাজ শিকদার]। তারা বাহিনী গঠনের কাজে মন দেন; মুজিবের প্রস্তুতি ছিলো নির্বাচন কেন্দ্রীক।
ভাসানী ও চীনাপন্থীরাও নির্বাচন বাদ দিয়ে জনযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের জমিন তৈরিতে ব্যস্ত হন। সে সময়, ভাষানী বা মুজিব, কে কার থেকে বেশী জনপ্রিয় তা বোঝা ছিলো মুশকিল। তবে তখন শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে কমিউনিষ্টদের সাংগঠনিকভিত্তি ছিলো দৃঢ়। কোনো জোর প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ভোটে শেখ মুজিব নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন।
নির্বাচনের কয়েকদিন আগেই উপকূলীয় অঞ্চলে বিরাট ঘূর্ণিঝড়ে কয় লাখ মানুষ মারা যায়। ভাসানী সেখানে ত্রাণ দিয়ে এসে পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন, ‘ওরা কেউ আসেনি’ [পাক সরকার]। নির্বাচনোত্তর ক্ষমতা মুজিবের কাছে হস্তান্তর করতে পাক-সরকার কালক্ষেপন করতে থাকে। আসলে তারা সময় নিচ্ছিলো সামরিক প্রস্তুতির। ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ভাষানীর জনসমর্থনও বাড়তে থাকে [‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো’]।
ষষ্ঠত, ১৯৭১ এর ৩ জানুয়ারি, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি আবার রমনা রেসকোর্স ময়দানে গণআবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়। এদিন সেখানে আইনসভার সকল পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যদের সভা ডাকেন শেখ মুজিব। তিনি তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান, তারা আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিনামার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন।
১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি- মার্চের ঘটনাবলি স্বাক্ষ্য দেয়, ফেডারেল পাকিস্তানের সম্ভাবনা বাস্তবে আর সম্ভব নয়। কিন্তু তখনো পাকিস্তানের মধ্যে ছয় দফার বাস্তবায়নের কাঁঠালের আমস্বত্তটি মুজিবের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়নি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাতেই অনঢ় ছিলেন। কারণ কারণ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি ছিলো তার অগাধ আস্থা, নির্বাচনী রায় এবং জনগণের সমর্থনে এরচেয়ে বেশী তার কাছে আশা করাও বাতুলতা [মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন]।
তবে বাস্তবতার কঠিন জমিনে শিগগিরই তিনি নেমে আসেন। ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন, জাতীয় পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হবে ৩ মার্চ, ঢাকায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘোষণা দেন, ছয় দফা জনিত সৃষ্টি জটিলতার অবসান না হলে তার দল জাতীয় পরিষদের সভায় যোগ দেবে না। ২১ ফেব্রুয়ারি মুজিব কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আবারও ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন আদায়ে তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
এ পর্যায়ে পাক চক্রান্ত আরো প্রকাশ্য হয়। ইয়াহিয়া মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে জেনারেলদের বৈঠক করে নিজস্ব কায়দার সঙ্কট সমাধান করতে উদ্যোগ নেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, অধিকার আদায় ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় পুর্ব পাকিস্তান দরকার হলে লড়াই করবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সকল সদস্যের কাছে ঢাকা অধিবেশনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু পরের দিন ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন।
এ হেন খবরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলস্থলে জড়ো হন। তারা সেখানে দাঁড়িয়ে দাবি তোলেন, শেখ মুজিব যেনো এখনই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেন। তারা পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বিক্ষোভ করে।
এদিকে, ছাত্রনেতারা সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। এর নেতা ছিলেন নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব এবং রুহুল কুদ্দুস মাখন [খলিফা চতুষ্টয়]। তারা স্বাধীনতার সংগ্রামে যৌথভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭১ সালের মার্চে এই প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রস্তুতি প্রধান ধারা হয়ে ওঠে [অবশ্যই মুজিবও তার ‘নিয়মতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন’ দাবি থেকে ক্রমেই সরে আসেন, তবে এই মোহভঙ্গ হতে একটি গণহত্যার প্রয়োজন পড়ে এবং আত্নসমর্পন]। এই দাবির শক্তি ও জনসমর্থন সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিকপন্থী তো ছিলোই না, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধই ছিলো এর একমাত্র লক্ষ্য। ২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে ছিলো স্বতষ্ফূর্ত হরতাল। ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকা থেকে অগনিত মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমবেত হন। সেখানে ছাত্র-জনতা জাতীয় স্বাধীনতার ধ্বনী তোলে এবং স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা দৃঢ় সিদ্ধান্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদের ভিপি, ছাত্রলীগ নেতা আসম আব্দুর রব বিপুল করতালি ও গগনবিদারী জয়োধ্বনী ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন [পতাকার নকশাবিদ শিবনারায়ন দাস]।
সপ্তমত, এভাবেই জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন ইত্যাদির পরও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ শেষ হয়ে যায়। দেশ এগিয়ে চলে ইতিহাসের নির্ধারিত পথে– রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামে। পরের ঘটনাবলীও তাই অনিবার্যভাবে সেই সংঘাতের দিকেই ধাবিত হয়। শেষে ২৫ মার্চ রাতে জাতি মুখোমুখি হয় সামরিক জান্তার ভয়াল আক্রমনের [ওই সন্ধ্যাতেও মুজিব গোল টেবিল বৈঠক চালিয়ে গেছেন, সমঝোতার পথ]।
স্পষ্টতই তিনি ভুল পথে হেঁটেছিলেন, ওই সান্ধ্য-বৈঠক সে প্রমানই বহন করেন। মুজিব ব্যাখ্যা মতে, তিনি ভারতের কাছে যেতে চাননি [কিন্তু যেতে কী হয়নি, যেতে কী হতো না?] এবং তিনি লোকক্ষয় এড়াতে বৈঠক অব্যহত রেখেছিলেন [ কিন্তু গণহত্যা কী এড়ানো গেছে? বরং পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে লোকক্ষয় আরো কত হতো, প্রতিরোধ লড়াইটি হতো অনেক জোরদার]।
৭ মার্চ মুজিব গণসমূদ্রে উচ্চারণ করেছিলেন সেই অস্মরণীয় কাব্য ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। কিন্তু লক্ষ্যনীয়, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো/ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ো’ ছাড়া যুদ্ধের জন্য মুজিব অনুসারীদের তখনো কোনো প্রস্তুতিই ছিলো না।
নির্মোহ বিচারে ৭ মার্চের ভাষণের কাব্যময় আবেগকে মুজিব নিজেই ধারণ করেননি [মার্চের আগে তো নয়ই]। ‘যার যা কিছূ আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’ হুংকারের পর দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে তিনি জনতার হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়েছেন! স্বাধীনতা সংগ্রামের এমন নেতার এ হেন নজির বিশ্বজোড়া মেলা দায়ই বটে। বিশ্বের আর কোনো নেতা যুদ্ধ ঘোষণা করে আত্মসমর্পণের জন্য ঘরে বসে থেকেছেন? নাকি তখনো তিনি পাক- প্রধামন্ত্রীত্বের খোয়াবে বিভোর ছিলেন? গুঢ় বাস্তবতা এই যে, মুজিব তখনো মার্কিনের বন্ধু ছিলেন, তাদের কাছেই সমাধান চাইছিলেন [দ্র. সম্প্রতি প্রকাশিত সিআইএ-এর নথি]। মুজিব সারা জীবন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, আলোচনা ও নির্বাচন করে এসে জনযুদ্ধের দাবি মেটাতে না পেরে কারাবরণ করেন। তার অনুসারী আওয়ামী নেতারা জাতিকে অরক্ষিত রেখে যে যেভাবে পারেন ভারতে চলে গেলেন।
মুক্তিকামী জাতি দেশেই থেকে সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সন্তানদের পাঠিয়েছে রণাঙ্গনে। গণহত্যার পর গণহত্যা, ধর্ষনের পর ধর্ষন, জ্বলে-পুড়ে খাঁক হতে হতে পুরো জাতি তার জাতীয় নেতাকে ছাড়াই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে [যদিও লক্ষন রণনীতিতে মুক্তিযুদ্ধটি এবং স্বাধীনতার সংগ্রামটি হয়েছে শেখ মুজিবের নামেই, এর নেতৃত্বে থাকে আওয়ামীলীগ।]
অষ্টমত, [পুনর্বার, অতএব সংক্ষেপে] আমরা যারা প্রজন্ম ৭১, তারা অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই-পত্র পড়ে, চলচ্চিত্র দেখে, স্বাধীন বাংলা বেতারের গান শুনে, জহির রায়হান, তারেক মাসুদ, জাহানারা ইমাম, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তো বটেই..[এমন কি ড. আহমদ শরীফ এবং সিরাজ সিকদার]…ইত্যাদিতে মুক্তিযুদ্ধের সব ঘটনা প্রবাহ বুঝতে চেষ্টা করি। অনুধাবন করার চেষ্টা করি, বাঙালির গৌরবের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসের ঘটনাটিকে অনুধাবনের জন্য এবং যুদ্ধোত্তোর বাংলাদেশ। …এই পঠন-পাঠনটিও অব্যহত থাকে এবং ব্লগ বিতর্ক তো বটেই। এখানে ভাবনা-চিন্তার নির্মান-বিনির্মানটি খুব বেশী জরুরি।
তবে ইতিহাসের ঘটনাবলিকে [ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিব তো বটেই] বোধহয় নির্মোহভাবেই দেখা ভালো। এখানে আবেগতাড়িত হয়ে ভাব-বুদ্বুদে মজে গিয়ে দেবোত্ব আরোপ করার যৌক্তিকতা দেখি না। মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত এই পাঠটিকেই আমি বিশেষ গুরুত্ব দেই; কারণ শেষ পর্যন্ত এটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধই ছিলো, নিছক স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিলো না। এখানেই মুক্তি সংগ্রামের জনযুদ্ধটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
এর সূচনা সাতের দশকে বাম ভাবাদর্শে সশস্ত্র পন্থায় হয়েছিলো, ১৯৭১ এ স্বাধীনতা একটি চূড়ান্তপর্ব মাত্র, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটি শেষ হয়ে যায়নি, এটি অব্যহতভাবে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম ও চেতনাটিকে অব্যহত রাখা জরুরি; যদিও শেখ মুজিব এবং আওয়ামী অনুসারীরা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এটিকে বরাবরই স্বাধীনতার সংগ্রামেই আটকে রাখতে চেয়েছে, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামটিকে তারা শেষ পর্যন্ত [এবং কি নিষ্ঠুরভাবে পরের সব কয়েকটি অধ্যায়ে] জিইয়ে রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। বাকশালী একনায়কতন্ত্র/ফ্যাসিজমের বিষবৃক্ষ মুজিব দর্শনের ঔরসজাত এই সীমাবদ্ধতারই ফল। অবশ্য আটার কলের কাছে আখের রস চেয়ে লাভ কী?
দেখতে পাই, মুক্তিযুদ্ধকে নিজস্বপন্থায় সে সময় যেসব কমিউনিস্ট পার্টি এগিয়ে নিতে চেয়েছিল [অধিকাংশই দক্ষিনপন্থা এবং চরমপন্থার ঝোঁকের কারণে শেষ পর্যন্ত হঠকারিতার চোরাবালিতে আটকে যায়, নকশালী কায়দায় আত্নঘাতিতায় নিক্ষিপ্ত হয়], পুরো সাতের দশক ধরে মওলানা ভাসানী তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়/সমর্থন দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনিও তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন, অতি গুঢ় বাস্তবতা অনুভব করেই [আবার পাইপগান/এতো বেশী গরম হয়ে আসে যে/ক্রমশ এর ব্যবহার কমে আসছে]।
তাই আমাদের দেখার চোখটি যেনো সাদাকালো হয়, পরিশেষে এ আহ্বান পুনঃপুনর্বার।
বিতর্কের জন্য আবারো ধন্যবাদ। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
আপনার সুচিন্তিত মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আমিও আপনার মত কোন রকম পক্ষপাত ছাড়াই একেবারে নির্মোহভাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক, মহানায়ক ও খলনায়কদের বিশ্লেষনে আগ্রহী। এই সংগ্রামের ইতিহাসে শেখ মুজিব অবশ্যই সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভিন্ন মতধারার রাজনীতির ছলনায় শৈশবে তাঁকে খলনায়ক হিসেবে জানলেও সত্য চাপা থাকেনি; তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন স্বমহিমায়। তবে স্তব করতে গিয়ে অনেকে যেভাবে তাঁকে দেবতা বানিয়ে ফেলেন তা প্রায় অন্ধবিশ্বাসেরই নামান্তর। এখন সময় হয়েছে তাঁর কিছু আপাত-পরস্পরবিরোধী কাজের সঠিক বিশ্লেষনের। বিশেষত যে প্রশ্নগুলো আরও অনেকের মত আমাকে ভাবায় তা হল, স্বাধীনতা অর্জনের পদ্ধতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা কি ছিল? তিনি কি সশস্ত্র আন্দোলনের কথা ভেবেছিলেন? তিনি কি ভারতের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য নেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন? ভারতের সাথে কি তাঁর কোন যোগাযোগ হয়েছিল? তিনি নিশ্চয় জানতেন বাইরের সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র লাঠি,বাঁশ নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন করে পাকিস্তানীদের তাড়ানো যাবে না। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তিনিসহ লীগ নেতাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সুনির্দিস্ট কোন পরিকল্পনা ছিল না। এই ধারনা বেগবান হয় যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানীদের হাতে ধরা দিয়েছেন। আরও মনে হয় সত্তরের নির্বাচনের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব পেলে তা হয়তো আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিলম্বিত করতো।
@মনজুর মুরশেদ,
আপনার প্রশ্নগুলি চিন্তা করার মত। আমাদের দেশে আসলে এসব প্রশ্ন নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষনের মত পরিবেশ নেই। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ‘৭৫ এর পর থেকে ইতিহাস বিকৃতির ধারা বার করে জাতিকে সফল ভাবে বিভক্ত করতে পেরেছে। ইতিহাস বিকৃতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে আরেক ধারা জন্ম নিয়েছে যারা আবার বংগবন্ধুকে দেবতা বানিয়ে ফেলতে চান, এরাও আসলে নিজেদের অজান্তে হলেও অপশক্তির চিন্তাধারা দিয়ে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত।
আপনার কিছু প্রশ্নের জবাব নিজের জ্ঞানে এ পর্যন্ত যা বুঝেছি বলার চেষ্টা করি।
– আমার যতটা মনে হয় ‘৭০ এর নির্বাচনের পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষনা ব্যাক-আপ প্ল্যান হিসেবে রেখেছিলেন, তবে পরিস্থিতি ক্রমশ সেদিকেই যাচ্ছে সেটা তিনি ‘৭১ এর মার্চ মাস থেকে বুঝতে পেরেছিলেন। তবে সে দায় তিনি কৌশলগত কারনে নিজে নিতে চাননি, চেয়েছিলেন পাকিস্তানীরাই চাল দিয়ে বিপাকে পড়ুক, তবে পাকিস্তানীদের চালের মাত্রা যে কেমন ভয়াবহ হতে পারে তার ব্যাপকতা নিশ্চিত কেউই বুঝতে পারেননি।
তিনি নিয়মতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহনকে প্রায়োরিটি দিয়েছিলেন আগে। এর প্রমান ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ঘোষনা ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ঘোষনা দিলেও এরপর তিনি ২৫শে মার্চ পর্যন্ত সেই পাকি জান্তার সাথেই আপোষ বৈঠক করেছেন। সবাই জানি যে ভূট্টো, ইয়াহিয়ার সাথে তিনি মধ্য মার্চ থেকে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে গেছিলেন, তবে সে আলোচনায় কি আলোচিত হয়েছিল, কি প্রস্তাবনা হয়েছিল সেসব নিয়ে তেমন লেখালেখি গবেষনা আজ পর্যন্ত দেখিনি। ব্যাপারটি বিস্ময়কর হলেও তবে অবাক হবার মত নয়।
সেই বৈঠকে কিন্তু তিনি বা আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষনা সংক্রান্ত কোন দাবী তুলেছিলেন বলে জানা যায় না। ওনার মূল দাবী ছিল অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, বাংলার স্বাধীনতা দাও এই দাবী ছিল বলে জানা যায় না। যদিও সে সময় তার বাড়ির ছাদে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে, গাড়িতেও বাংলার পতাকা। সে বৈঠকে আমার জানা মতে শেষ সিদ্ধান্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র বজায় রেখে বাংলার সায়ত্বশাসন বাড়ানো, বংগবন্ধু এমনকি রাষ্টের নামের আগে কনফেডারেশন নামটি যুক্ত রাখার প্রস্তাব রাখেন দলের তীব্র জাতীয়তাবাদীদের শান্ত রাখতে, এ প্রস্তাবে পাকিস্তানী জান্তা আপত্তি করে, তাদের দাবী ছিল কনফেডারেশন নয়, ইউনিয়ন নামে থাকবে। এই বিষয়টি ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্তও বিতর্কের বিষয় ছিল, আওয়ামী নেতারা আশা করেছিলেন যে বিরোধ যদি কেবল এই শব্দকেই কেন্দ্র করে চলে তবে সেটা ইয়াহিয়া ও বংগবন্ধু সহজেই মীমাংসা করতে পারবেন। মোদ্দা কথা এ বৈঠকে দুই পক্ষ মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান বজায় রেখেই অচলাবস্থা নিরসনের খসড়া চুক্তি মুসাবিদা করে, সেটা ইয়াহিয়ার চুড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হবার আগ পর্যন্ত। এর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেত্রীবৃন্দ বুঝতে পারেননি যে আসলে পাকিস্তানীদের আপোষের ন্যূনতম মনোভাবও নেই, সবই তারা চুড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্তুতির জন্য সময় ক্ষেপন করে যাচ্ছে মাত্র। বংগবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১০টার সময়েও কামাল হোসেনের কাছে ইয়াহিয়ার সেই কাংখিত ফোন কল এসেছে কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ইয়াহিয়া কেন্দ্রের প্রেসিডেন্ট, পূর্ব ও পশ্চীমের ক্ষমতায় বংগবন্ধু ও ভূট্টো এমন ধরনের রুপরেখাই প্রস্তাবনা অনুযায়ী হবার কথা ছিল। যুক্ত পাকিস্তান বজায় রেখে আপোষ রফার এই প্রস্তাবনা কি পাকিস্তানীদের মত আওয়ামী লীগও ভাওতা হিসেবেই গন্য করছিল কিনা এই প্রশ্নও হতে পারে। আওয়ামী নেতাদের নিজেদের মধ্যকার আলোচনার গতি প্রকৃতি দেখে মনে হয় না এমন কোন সম্ভাবনা বিবেচনা করা যায় কিনা।
ওপরের আলোচনায় মনে হতে পারে যে বংগবন্ধুর আদৌ স্বাধীনতা ঘোষনার কোন নিয়তই ছিল না – এই ধারনাও ঠিক না। আগেই বলেছি যে তার ব্যাক আপ হিসেবে হলেও স্বাধীনতা ঘোষনার পরিকল্পনা ছিল। এই তথ্যের সমর্থনে ততকালীন ইপুয়েটের অধ্যাপক নুরুল উলার কথা বলা যায় যাকে বংগবন্ধু গোপনে ওয়্যারলেস বানিয়ে প্রস্তুত রাখতে বলেছিলেন। এমনকি ২৫শে মার্চ দুপুর থেকে তার নির্দেশে ৩২ নম্বরে আবদুর রাজ্জাক হন্যে হয়ে ফোনে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি বিএ সিদ্দীকিকে খোঁজ করছিলেন (যিনি টিক্কা খানকে প্রথম গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহনে অস্বীকৃতি জানান), কেন এর কারন নিশ্চিত বলা না গেলেও ধারনা করা যায় যে তার মাধ্যমে শপথ গ্রহনই উদ্দেশ্য ছিল (কার বা কিসের তা অবশ্যই আমিও নিশ্চিত নই)। বিচারপতি বিএ সিদ্দীকি সেদিন সম্ভবত রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে পড়ার ভয়েই ইচ্ছেকৃতভাবেই নিজের ফোন তুলছিলেন না। তার এই এড়ানো বংগবন্ধুকে অত্যন্ত আহত করেছিল। ‘৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসার পর এই বিচারপতি তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি দেখাও করেননি। বিচারপতি মহোদয়কে দেখা গেছিল ৩২ নম্বরের গেটের বাইরে অবনত মস্তকে মলিন বদনে অপেক্ষমান।
তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের কোন পরিকল্পনা করেছিলেন কিনা এমন কোন তথ্য নেই। সেটা তার পক্ষে সম্ভবও নয়, কারন তিনি সেনাপতি ছিলেন না, ছিলেন জননেতা। তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে তেমন পরিস্থিতি হলে ওসমানীর কাঁধে বাহিনী পরিচালনার ভার তিনিই নির্ধারন করে গেছিলেন। এমনকি প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী সভাও তারই নির্বাচিত ছিল। তিনি ২৫শে মার্চ ক্র্যাক ডাউনের নিশ্চিত সংবাদ পাবার পর দলীয় সব নেতাকে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে জনগনকে নিয়ে প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তবে ঠিক কিভাবে সেটা করা হবে তেমন পরিষ্কার কোন পরিকল্পনার ছাপ আমি এখন পর্যন্ত দেখিনি। তবে আমি নিজেও ঠিক ভেবে পাই না যে পরিকল্পনা ঠিক কি হতে পারত। দেশের সেনাবাহিনী যদি নিজ দেশের জনতার বিরুদ্ধে কামান বন্দুক ট্যাং বিমান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তবে তাদের প্রতিহত করার কি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা যেতে পারে আমি জানি না।
ভারতের সাথে তেমন কোন পূর্ব যোগাযোগের আলামত কোথাও নেই। তিনি এর আগে একবার ‘৬৪ সালে ভারতে আলোচনার উদ্দেশ্যে গিয়ে খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এটা ঠিক যে তার নির্দেশে তাজউদ্দিন মার্চের প্রথম দিকে ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিলেন পরিস্থিতি বিপদজনক হলে তাদের সহায়তা কতটা পাওয়া যাবে সেটা যাচাই করতে। সে বৈঠক খুব বেশী এগোয়নি, ভারতীয়রা সে আলোচনা খুব সিরিয়াসলি নেয়নি। তারা নানান পর্যায়ে নিজেদের ভেতরেই আলোচনা করা অবস্থায় ঘটনা ঘটে গেছিল। তাজউদ্দিন যখন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতে পৌছান তখনো ভারত সরকারের কাছে পুরো ব্যাপারটাই ছিল শকিং এবং বিভ্রান্তিকর, তারা নিজেরাও তখনো জানে না তাদের কি করা উচিত। ভারতের ইন্ধনে পাকিস্তান ভেংগেছে এমন প্রচারনা আসলে পুরোই ভিত্তিহীন। ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে নিতান্তই মানবিকতার স্বার্থে বাংগলাদেশী শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু বাহিনীকে সামান্য কিছু অস্ত্রপাতি দিয়েছে, তবে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে তাদের আরো বহুদিন লেগেছিল।
আমার মনে হয় যে স্বাধীনতা ঘোষনা যে অবশ্যম্ভাবী সেটা তার মনে ভালই ছিল, তবে তিনি শেষ পর্যন্তই চেষ্টা করেছিলেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের। আর সেটা না হলে স্বাধীনতা ঘোষনার পর ঠিক কিভাবে যুদ্ধ করা হবে এমন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মনে হয় না ছিল বলে। পাক জান্তা যদি সেই মধ্য মার্চের আপোষ রফার প্রস্তাব ২৫ তারিখ মেনে নিত তবে কি বংগবন্ধু সে রাতে স্বাধীনতা ঘোষনা করতেন? প্রশ্নটা হাইপোথিটিক্যাল হলেও আমি অন্তত সেক্ষেত্রে সে রাতে স্বাধীনতা ঘোষনার সম্ভাবনা দেখি না। যে আপোষ প্রস্তাবে তারা নিজেরাই সম্মত হয়েছিলেন তা চুড়ান্তভাবে মানা হলে আর আন্দোলন সংগ্রামের কি থাকে? তবে পাকিস্তান নামের আজগুবি রাষ্ট্রের ভাংগন ছিল নিশ্চিত, সেটা যে ২৪ বছর চলেছিল সেটাই এক বড় বিস্ময়।
বংগবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেননি ঠিক, ওপরে বলা কিছু তথ্যের ভিত্তিতেও তিনি আদৌ স্বাধীনতা কতটা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন আর কতটা পাকিস্তানীদের গোয়ার্তূমির ফলে ঘোষনা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন এমন বিতর্ক তোলাই যায়। তবে এ বিতর্ক এড়িয়ে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বহু আদর্শবাদে বিভক্ত বাংগালী জাতিকে সফলভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মত এক সূতোয় বাঁধার মূল নায়ক তিনি, সেই ঐক্য ছাড়া এক অসম সমীকরনে দানবীয় পাক জান্তার বিরুদ্ধে বাংগালীর বিজয় ছিল অকল্পনীয়। এখানেই তার স্বার্থকতা। সফল রাষ্ট্রনায়ক দুনিয়ায় ভুরি ভুরি আছে। কিন্তু হাজার মাইল দূরের গোপন কারাগারে বসে থেকেও কোটি কোটি লোকের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করার উদ্দীপনা যুগিয়ে এমন অসম্ভব সমীকরন জয় করার মত ব্যাক্তিত্ব বিশ্বের ইতিহাসে মনে হয় না আর আছে বলে। ‘৭৫ এর ট্র্যাজেডিতে দেশের চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়েছে এখানেই, জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়ে গেছে চিরতরে। তিনি হয়তবা অযোগ্য রাষ্ট্রনায়ক হতে পারেন, তবে তিনি ছিলেন ঐক্যবদ্ধ বাংগালী জাতির প্রতীক। এই ক্ষতির কোন সহজ ক্ষতিপূরন নেই। বংগবন্ধুর অন্ধ সমালোচকদের এটা বোঝার মত ঘিলু নেই।
@আদিল মাহমুদ,
আদিল ভাই, আমি ৪ র্থ সংশোধনী (বাকশাল) নিয়ে একটু লিখতে চাই। ইন্টারনেটে অনকে খুজেও সংশোধনীর মূল টেক্সট পেলাম না। অনেক আগে পড়েছিলাম এজন্যে একজ্যাক্ট ডিটেলও খেয়াল নেই। আপনার কাছে যদি কোনো বই বা সফট কপি থাকে তবে আমাকে পাঠানো যাবে কি?
@সফিক,
না ভাই, আমার কাছে সংসদের মূল বিবরনীর কোন সূত্র নেই। কাছাকাছি মূল কথা মনে হয় নীচের সূত্রগুলিতে পাবেন।
http://www.banglapedia.org/httpdocs/HT/C_0336.HTM
http://www.banglapedia.org/httpdocs/HT/B_0207.HTM
আমার দেশ পত্রিকা ইত্তেফাকের ২৬শে জানুয়ারী, ‘৭৫ এর সূত্র উল্লেখ করে মূল ধারা কিছু দিয়েছিল, তবে আমার দেশ পত্রিকার সব খবরই হ্যান্ডেল উইথ এক্ট্রিম কেয়ার।
বাকশাল নিয়ে আমার ব্লগে পিয়াল ভাই এর লেখা আছে, সেটারও সাহায্য নিতে পারেন।
@আদিল মাহমুদ,
অনেক ধন্যবাদ তথ্যসহ আলোচনাটির জন্য। ৭ মার্চ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা অত্যন্ত জরুরী। এতে অনেক ভুল ধারনার অবসান হবে। শুভেচ্ছা।
@মনজুর মুরশেদ,
আপনার বক্তব্যে যে প্রশ্নসমূহ উঠে এসেছে, সে প্রশ্ন আমারও। আলোচনাটি সুসংহত করার জন্য ধন্যবাদ। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
আপনার দীর্ঘ আলোচনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রথমেই বলে নিচ্ছি, এই আলোচনায় আমার ভূমিকাটা কিন্তু শিক্ষার্থীর, অর্থাৎ, কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছি আবারো, আশা করি সেগুলোকে আপনি ইতিবাচক-ভাবেই দেখবেন, বস্তুত প্রশ্ন না থাকলে দুনিয়ায় কোন ক্লাসরুমের প্রয়োজন হতো না।
আর একটা কথা, অভিজিৎ-দার ‘যে যাই বলুক – তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশে আসলে স্বাধীনই হত না। দেশের মানুষ একত্রিত হয়েছিল কেবল মুজিবকে বুকে ধারণ করেই।‘ – এই মন্তব্যে আপনার ‘অবশ্যই’ রায় দেয়ার সাথে উপরের দীর্ঘ মন্তব্যটিকে পরস্পরবিরোধী মনে হয়েছে আমাদের কাছে। সত্যি বলতে কি, আপনি নির্মোহ-ভাবে মুজিবের যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন, তা পাঠ করলে নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি আর নির্মোহ থাকবে না, তাদের পক্ষপাত ঝরে ঝরে পড়বে একটি রাজনৈতিক ধারার প্রতি, তাদের সাদা-কালো চোখে ধরা পড়বে, মুক্তিযুদ্ধের যত সংগ্রাম, যত বীরত্ব-গাঁথা – সব বাংলাদেশের বামধারার কর্মীদের গড়া, মুজিব (ডঃ শরীফের মতানুযায়ী) এক সৌভাগ্যের বরপুত্র ছাড়া কিছু নন, যিনি পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি হয়ে গেছেন। আপনি আমার এই পাঠ প্রতিক্রিয়াকে সরলীকরণ, আপ্তবাক্য বা যান্ত্রিকতার দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেন, কিন্তু কেন আমার এমনটা মনে হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করছি নীচেই।
এ কথাটি আপনি বারবার বলছেন এবং এ নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিমত কারো মধ্যে নেই। হ্যাঁ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধই ছিল, তবে সে জনযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাতেই হয়েছে। এ আমাদের জাতীয় গৌরব যে, আমাদের দেশের চাষা-মুটে-মজুরসহ সর্বশ্রেণীর মানুষ তাদের যার যা আছে তাই দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করেছে এবং তাদের লক্ষ্য ছিল, মুক্তি বা অন্য কথায় শোষনমুক্ত সমাজ, এবং এ মুক্তির স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুই দেখিয়েছেন। সুতরাং, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে (বা মুক্তির যুদ্ধে) বঙ্গবন্ধুর অবদান ও জনযুদ্ধ- এ দুটি মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ কোন ব্যাপার কিন্তু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা বলতে গেলেই যখন ‘জনযুদ্ধ’ কথাটা বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয়, তখন মনে পড়ে যায় আমাদের গ্রামের কট্রর বিএনপি সমর্থক শুক্কুর ব্যাপারীর কথা, ”মুজিব দেশের লাইগা কি করছে, হেই তো পাকিস্তানে জামাই-আদরে আছিল, রক্ত দিয়া দেশ স্বাধীন করছে তো এই দেশের মানুষ”।
মুজিব প্রশাসক হিসাবে অনেক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে জিয়ার সাথে সংযুক্ত করে স্বৈর শাসনের দায়ে অভিযুক্ত করা হবে? আপনি আগেও একসাথে নামদুটি ব্যবহার করে পাঠ্যপুস্তক দখলের দায়ে উভয়কে সমানভাবে অভিযুক্ত করেছেন। মুজিব কি ক্ষমতা দখল করেছিলেন, রবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট দিয়ে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে/অপকর্মকে বৈধতা দিয়েছেন, অথবা হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করেছিলেন?
বুঝলাম না। বিপ্লব তো বিপ্লবই, স্বাধীন দেশে বিপ্লব করা যায়, পরাধীন দেশে করা যায় না এমন?
তাহলে, শেখ মুজিব তার গুরুর মত করেই ভাবতেন, ৯৮ ভাগ স্বাধীনতা তো দেওয়াই হয়েছে? উনি বাদবাকী জীবন লড়লেন বাকী দু পার্সেন্টের জন্য?
বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করার জন্য এর চেয়ে চমৎকার বাক্য বোধ করি হয় না। মুজিব একজন মুসলিম কাম মার্কিন কাম পাকিস্তানপন্থী নেতা??? আওয়ামী লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বর্জিত হল কেন তাহলে? অথবা রুশ-পন্থীদের কি করে ঠাই হল আওয়ামী লীগে? মুজিবের তো উচিত ছিল এগুলো ঠেকানো, তাই না? আমার অগাধ পড়াশুনো নেই, তবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে নীচের অংশটুকু কোট করছিঃ
অথবা,
জানি না, এগুলো আপনার কাছে কি বার্তা বয়ে আনবে, হয়ত এগুলোও পাতানো!
বেশ বোঝা যাচ্ছে, বামপন্থীদের নিজস্ব এচিভমেন্ট তো ছিলই, এমনকি আওয়ামী লীগের যেসব এচিভমেন্ট তাও বামপন্থীদের প্রণোদনা/প্রেরণা/ধ্যান-ধারনায় গড়া। মানে, বাম -পন্থীদের জয়জয়কার আর কি! সাদাকালো চোখে দেখলে এমনটাই মনে হয়। তো জানতে মন চাইছে, বামপন্থীরা নিজেরাই ছয়-দফার মত কিছু ঘোষণা করতে পারল না? খামোখা মুজিবের পাতে এচিভমেন্ট তুলে দেয়ার মানে হয়?
আপনি যে বললেন ‘স্বাভাবিক’, সেখানেই অনেক বিশ্লেষকের মতে উতর লুকানো আছে। মুজিব নিয়ন্ত্রিত আন্দোলন করে আস্তে আস্তে দেশকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত পথে নিয়ে গেছেন। নকশাল টাইপ বিপ্লব করে কখনোই স্বাধীনতা অর্জিত হত না, বিশ্ববাসীর সমর্থনও পেত না। পাকিস্তান কিন্তু ঐটাই চেয়েছিল। কিন্তু তারা মুজিবের কৌশলের কাছে হার মানে। মুজিব শেষ সময় পর্যন্ত কঠিন রাজনৈতিক চালে ইয়াহিয়াকে পরাস্ত করেছেন। বামধারার নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন,
যে বিজয়কে বলা হয় বাংলার মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সবচেয়ে বড় ধারক, তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করাটা এই নির্বাচনের তাৎপর্যকেই ছোট করা নয়কি? মনে রাখা দরকার, মুজিবের বিজয় কোন ব্যক্তির বিজয় নয়, এটা বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার বিজয় ছিল। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বাংলাদেশের মুক্তির দূত, অবিসংবাদী নেতা- এটা খুঁজতে খুব বেশী ইতিহাস চর্চা করতে হয় কি?
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনেরা (যাদের মধ্য রয়েছেন দেশবরেণ্য লোকেরা) বলেন, বঙ্গবন্ধু সবসময় স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেন, কিন্তু কৌশলগত কারণে সেটা প্রকাশ্যে বলতেন না। নীচের উদ্ধৃতিগুলো লক্ষ্য করুন:
আমার প্রশ্ন হল, তারা স্বাধীনতার দাবী তুললেন কেন? মুজিবতো তাদের স্বাধীনতার মন্ত্র শেখাননি? উনি চেয়েছেন ফেডারেশন, স্বায়ত্তশাসন? তাহলে জনতা এমন দাবী কেন তুললে? বামপন্থী প্রণোদনায় কি?
তো নির্মোহ আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটে এভাবেই যে, মুজিব ‘প্রধানমন্ত্রীর খোয়াবে বিভোর ছিলেন‘ আর শেষ পর্যন্ত ‘জনযুদ্ধের দাবি মেটাতে না পেরে কারাবরণ করেন’? এই বিষয়গুলো নিয়ে আর বিতর্কে যেতে মন চাইছে না। শুধু একটি কথা বলেই শেষ করি, যদি এমনটাই হয়ে থাকে আসলে, সেক্ষেত্রে শেখ মুজিব আর আমার শ্রদ্ধার পাত্র নন, বস্তুত, আপনার আলোচিত নির্মোহ ইতিহাসের আলোয় দেখলে উনাকে শ্রদ্ধার অন্তত কোন কারণ থাকতে পারে না। মানুষ প্রকৃত বীরকে সন্মান করে, সুযোগের মাধ্যমে তৈরি বীরকে নয়।
@বিপ্লব দা,
যদিও মন্তব্যটি মামুন ভাইকে স্মরণে রেখে করেছেন এবঙ তিনি উত্তরও দিয়েছেন; তবুও আমি কয়েকটি বিষয় যোগ করতে চাই।
প্রথমত
আমার কাছে মনে হয়- সময় একটি বড়ো বিষয়, যে কোনো কিছুর সঠিক বিচারের জন্যে। আজকের সময়ে যে বিষয়টি খুব সহজ বলে মনে হবে- তা একাত্তরের প্রেক্ষাপটে কেমন ছিলো আলোচনা করা অসম্ভব নয়, তবে দুরূহ। আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে অঙশগ্রহণটি যেমন এখনও উঠে আসেনি, তেমনি এটাও মানতে হবে যে- চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের বিষয়টিও এখনো সময়ের সঠিক ক্যালকুলেটরে হিশেব করা হয়নি। আমি কিন্তু এই বিষয়টি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকেই বিচারের চেষ্টা চালাচ্ছি, কেননা আমি কুয়াশাচ্ছন্ন পথ যেমন মাড়িয়ে এসেছি তেমনি স্বচ্ছ রোদের চোখেও চোখ রেখেছি। অর্থাৎ সময় এখন অনেক বেশি কৌতুহলী হয়ে উঠেছে, ইতিহাসের সত্য উদঘাটনও একটি ইতিহাস। আমি মানছি- আদিবাসীদের অবদান নিয়ে তেমন কোনো কাজই হয়নি, কিন্তু এখন কিছু কিছু হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও হবে। তবে বাঙলাদেশের জন্মলগ্নের দৃষ্টিকোণ থেকে আজকের বিচার করতে বসলে, একটা চার্জশীট হয়তো লেখা সম্ভব, ইতিহাস নয়।
দ্বিতীয়ত
প্রথমেই বলি- মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের আসলে কিছুই ছিলো না, অন্তত আমার বিবেচনায় কিছুই ছিলো না- কেবল গণহত্যার বিভৎস চিত্র ছিলো, বীরাঙ্গনাদের হাহাকার ছিলো, লণ্ডভণ্ড একটা শিশু রাষ্ট্র আর তার বয়সী যুদ্ধশিশুরা ছিলো। অতএব, আমাদের চলার পথটি মোটেও মসৃন ছিলো না, বরঙ ছিলো বন্ধুর। সে সময়েই আরও একটি ভয়ানক রূপ তৈরি হয়েছিলো বাঙলাদেশে, নিজস্ব রাষ্ট্রে বিভাজন। মনে রাখতে হবে- এই রাষ্ট্রেই তখনও বাস করেছে যুদ্ধাপরাধীরা, তারা অস্তিত্বের টানাপোড়নে নানাভাবে বির্পযস্ত করেছে রাষ্ট্রের ব্যাকরণকে। বিপ্লব দা- বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠিত হলেও তখনও পাকিস্তানি আদর্শ টিকে ছিলো, সেটাই সঙক্রমিত হয়েছে সর্বত্র। তবে এ দৃশ্যপটগুলো উন্মোচিত হয় আসলে পঁচাত্তরের পর, কেননা তখনই দেখা যায় মূল ছাতায় যারা ছিলো সকলেই আসলে লুসিফারেরই উপাসনায় ব্যস্ত ছিলো। অতএব ‘কোথায় আজ সিরাজ শিকদার’ বক্তব্যটিকেও বিশ্লেষণ করা দরকার। আপনার কাছে অনুরোধ রইলো সিরাজ সিকদারের যুদ্ধপরবর্তী সমযের জীবন নিয়ে একটি লেখা দেবার। আমিও বিষয়টি জানতে আগ্রহী।
মামুন ভাইয়ের মতো “মুজিব-জিয়া” স্বৈর শাসন বক্তব্যটির আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এদেশে বঙ্গবন্ধু যদি স্বৈর শাসক হন, তবে কিছুই বলার নাই। কেবল জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হবে- অদ্ভুত আঁধার এক.. ..
তৃতীয়ত
আমি জানি না- আপনি কী মনে করছেন কি না ১৯৪৭ সালেই আসলে বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা উচিত ছিলো। ১৯৪৭ এর দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক ভয়ানক প্রেতের প্রবক্তা আসলে জিন্নাহ এবঙ সেটা ছিলো একটি সেটেলম্যান পার্টিশন, যাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ব্রিটিশ সরকারের সাথে জিন্না, নেহেরুসহ আরও অনেকে। একটি চমকপ্রদ বিস্তারিত না হলেও হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা পাওয়া যায়- যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাসে। সেটি অন্য খাতের আলোচনা। কিন্তু মূল বিষয়টি হলো আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ২৩ জুন, ১৯৪৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বে। তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ঠিক এই জায়গাটিতে এসে- আওয়ামী লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ থেকে সরে গেছে, স্রেফ সরে গেছে এবঙ দলের প্রসঙ্গ-কাঠামো বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সূত্রপাতটি ঠিক এইখানেই।
চতুর্থত
ছাত্ররা তখন না, আমি বলি বায়ান্ন সালেই বুঝেছিলো; কিন্তু আন্দোলনের রূপরেখা সব সময়ই যদি জঙ্গিবাদী হয়, তবে তো আর রাজনীতির প্রয়োজন পড়ে না। আপনি বলতে পারেন, শেষ পর্যন্ত তো আমরা যুদ্ধই করলাম- হ্যাঁ করেছি, কিন্তু যদি ১৯৬২ থেকেই শুরু করতাম, তবে কোনো ফল হতো না, উল্টো ইতিহাসে লেখা হতো- এরা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করেছে, এদের কোনো রাজনৈতিক জ্ঞান ছিলো না। আপনি দেখেন- বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে আন্দোলনের ক্ষেত্র সুগঠিত হয়েছে, নেতৃত্বের বিষয় পরিস্কার হয়েছে। ঘটনা হলো- পাকিস্তানবাদ একটি আদর্শের নাম ছিলো, অতএব ‘বাঙালি জাতীয়তাবোধের’ চেতনায় সেই অপ-আদর্শকে পরাজিত করতে চাইলে প্রয়োজন ছিলো একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। সেই প্রেক্ষাপটটাই সুদৃঢ় হয়েছিলো সে সময়ে।
পঞ্চমত
অস্বীকার কারা করেন? আওয়ামী লীগ? সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিষয়টি আমার জানা নেই- আমি জেনে মন্তব্য করবো। আপনার কাছে কী কোনো রেফারেন্স আছে? থাকলে জানাবেন দয়া করে।
আরেকটি বিষয়- যদি সত্যিই ঘটনা তা-ই হয়, তবে কিন্তু এটা বলা অন্যায় হবে যে- বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীনতার চেষ্টা করেছেন, কেননা- এই স্ট্যাটম্যান্ট মতে- তিনি সশস্ত্র অভ্যুত্থানেরও চেষ্টা করেছিলেন।
ষষ্ঠত
আন্দোলন জঙ্গি হলেই যে সফল হবে- এমন কিন্তু নয়। এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। একটি নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দান করতে হয়। আপনি আলোচ্য অঙশে যে “যূথবদ্ধতার” কথা উল্লেখ করেছেন না, এটার জন্যে একটি সময় লাগে, একটি প্লাটফর্ম লাগে। বঙ্গবন্ধু সে প্লাটফর্মটাই রচনা করেছিলেন তাঁর নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনার মাধ্যমে।
সপ্তমত
ভাগ্যিস তিনি তাই করেছিলেন, নতুবা আজ আমরা বলতাম- বঙ্গবন্ধু সেদিন নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের পথে হাঁটলেই গণহত্যাটা ঘটতো না।
অষ্টমত
আমার মতে বোল্ড অঙশটুকু তাঁদের একটি বড়ো ভুল ছিলো। সত্তরের নির্বাচনের পর আমাদের দাবি আরও দাঢ্য হয়েছিলো। আমরা প্রবল বোধের উঠোন থেকে নিজেদের হিস্যা দাবি করতে পেরেছি। বলতে পেরেছি- পাকিস্তানিরা অন্যায় করেছে, আমার ভোটের রায়কে তারা কার্যকর করেনি। এবঙ ১৯৭১ সালে আমরা বলেছি- আমরা জালিমের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, ওরা (পাকিস্তানিরা) মানুষ মারছে, আমরা পশু (পাকিস্তানি) মারছি। বঙ্গবন্ধুর নির্বাচন কেন্দ্রীক প্রস্তুতিটাকেই আমার কাছে সময়োপযোগী কাজ বলে মনে হয়েছে। কারণ- তখন সেরকম না হলে, পাকিস্তানিরা এক তরফাভাবে বলতো- এরা বিচ্ছিন্নতাবাদী; এ কথা একাত্তরেও বলেছে, কিন্তু হালে পানি পায়নি। বিশ্ববাসী জানতো- নির্বাচিতরাই তাঁদের অধিকারের জন্যে লড়াই করছে।
নবমত
এখন আমার দুইটি প্রশ্ন আছে বিপ্লব দা-
১। মুক্তিযুদ্ধের জমিন তৈরিতে ব্যস্ত এই চীনপন্থীরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বললো?
২। মওলানা ভাসানী কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পর (যেহেতু তিনি জমিন প্রস্তুত করেছেন, জমিনের গড়ন তিনি জানেন) বললেন- কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করে ‘আল্লাহবাদ’ প্রতিষ্ঠা করুন- এই আল্লাহবাদ তো আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো না।
দশমত
দৃঢ় সাঙগঠনিক ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা সেদিন জনগণকে নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আর আমার মনে হয় না- বর্বর পাকিস্তানি সরকার সত্তরের নির্বাচনে পিঠা-পায়েস নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, অতএব আওয়ামী লীগ প্রবল প্রশাসনিক ও লুসিফারিয় স্রোতের বিরুদ্ধেই নির্বাচনে জয় লাভ করেছিলো, বাঙালির অমোঘ অঙশগ্রহণে।
একাদশতম
এইখানে আমার একটি বক্তব্য আছে। এটা ঠিক- বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনে তাঁর ছয় দফা কর্মসূচীকে নিয়ে এসেছিলেন। কর্মসূচীটি মূলত পাকিস্তানের বিভক্তির মৌলিক কর্মসূচী। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেখানোর ব্যাপারে তিনি কৌশলের আশ্রয় নেন। পেছনে ফিরে দেখলে একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যাবে যে- বঙ্গবন্ধু ০৪ জুন, ১৯৭০ সালে ঘোষণা করেন যে-
পিডিপি প্রধান নুরূল আমিন বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করে বলে-
পরবর্তী সময়ে দুটো নাটকীয় ঘটনায় তা-ই প্রমাণিত হয়। প্রথমত জনসমক্ষে নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শপথ নেন যে- ছয় দফা ও এগারো দফা প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো আপোস করবেন না। এর মাধ্যমে সমঝোতার পথ রুদ্ধ হবে। দ্বিতীয়ত, তিনি সামরিক শাসন অগ্রাহ্য করে একটি প্যারালাল সরকার পরিচালনা করেন। ঢাকার ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক বন্ধ করে দিয়ে এর দায়িত্ব অন্যান্য ব্যাঙ্কগুলোর উপর ন্যস্ত করেন। পাকিস্তানি নোটের উপর ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ছাপ দিয়ে তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন- অখণ্ড পাকিস্তানে তিনি আর বিশ্বাসী নন।
আর প্রধানমন্ত্রীত্বের কথা বললেন না? সাতই মার্চের ভাষণের একটি অঙশ কানে বাজে- আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না।
দ্বাদশতম
না- তিনি প্রথম থেকেই বাস্তবতার জমিনে ছিলেন, তবে নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরে গিয়ে নয়। আর একুশে ফেব্রুয়ারি তিনি কেবল ছয়দফার প্রসঙ্গেই নয়, ছাত্র-জনতার এগারো দফার প্রসঙ্গেও কথা বলেন। সকলকে শপথবাক্য পাঠ করান- ছয় দফা ও এগারো দফার উপর আস্থা রাখতে।
ত্রয়োদশতম
বিপ্লব দা, ছাত্র-জনতার জঙ্গি রাস্তাটি ধরলে আপনি কী মনে করেন- পাকিস্তানিরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতো? গণহত্যা পাকিস্তানিরা চালাতোই, এরা আমাদের খুড়তুতো-মাসতুতো ভাই ছিলো না- এরা ছিলো আমাদের অধিকার কেড়ে নেয়া দস্যু। এটা বাঙালি বায়ান্ন থেকেই টের পেয়েছে। আর “আত্ম-সমর্পন”? তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো, তার যথেষ্ঠ প্রমাণ আছে- আমি পোস্টে উল্লেখ করেছি।
চতুর্দশতম
কারণ তিনি রক্তপাতকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন।
পঞ্চদশতম
আমি তো বললাম আপনাকে দাদা; পাকিস্তানিদের অধীনস্ততা ছাড়া আর যে কোনো শর্তেই পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালাতো। আপনি পশুর কাছে মানব আচরণ আশা করতে পারেন না।
ষোড়শতম
মাসুদুর রহমানের বইটি থেকে বলছেন কি? আমার ক্ষুদ্র পড়াশোনা যেটুকু জেনেছি তা থেকে একটি রেফারেন্স উল্লেখ করছি-
সপ্তদশতম
শেষে এসে আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ঠিক এমন একটি কথাও আজ আমাদের লিখতে হতো মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে- যদি বঙ্গবন্ধু তখন সঠিক নেতৃত্বের জায়গাটি ঠিক না করতেন।
পরিশেষে অনেক ধন্যবাদ, আলোচনার জন্যে। শুভ কামনা নিরন্তর। (F)
@শনিবারের চিঠি,
আবারো আপনাকে ধন্যবাদ, প্রতি-মন্তব্যের পয়েন্ট বাই পয়েন্ট আলোচনার জন্য। আসলে এ পর্যায়ে বাক-বিতণ্ডার খুব বেশী অবকাশ নেই [এবং কাজী মামুন]। প্রশ্নটি হচ্ছে নির্মোহভাবে ইতিহাস দেখার দৃষ্টিভঙ্গী [নাকি চার্জশিট?] নিয়ে অথবা দেবত্ব আরোপে [দ্র. মনজুর মুরশেদ]।
সেই পুরনো পাঠ, বিরক্তি ঠেকলে আগাম ক্ষমা প্রার্থনা : তাহলে দেখা যাচ্ছে, ১৯৪৭-১৯৫২-১৯৭১-১৯৭৫ এর দীর্ঘ যাত্রায় বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত বঙ্গের বন্ধু থাকেননি। নায়ক থেকে উল্লম্ফন মহানায়ক, মহানায়ক থেকে উল্লম্ফন খলনায়ক রূপান্তরের ভ্রুণবীজ থাকে পেয়ারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর খোয়াবনামাতেই। স্বৈর শাসনের ভয়াল রূপেই তার উত্তোরণ, সেটি বেসামরিক হলেও জেনারেল জিয়ার সঙ্গে তার লক্ষ্যণজনিত পার্থক্য থাকে কমই। বিষয়টি শ্রেণীগত এবং আদর্শিক রূপ আপাত ভিন্ন ভিন্ন মনে হলেও [তত্বতালাশটি খতিয়ে দেখা আবশ্যক]। তবু মুক্তিযুদ্ধের মহানয়ক শেখ মুজিব তো বটেই, বিবিসির জরীপে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, [‘যে যাই বলুক – তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশে আসলে স্বাধীনই হত না। দেশের মানুষ একত্রিত হয়েছিল কেবল মুজিবকে বুকে ধারণ করেই।’ — অভিজিৎ দা, অবশ্যই]।
এইখানে ফ্ল্যাশব্যাকে সাতের নকশালী আমলের ছোটকথা। চারু মজুমদার [সিএম] কথিত ফাইট অব টু ডগস মানেই চীনাপণ্থী তাবৎ রাজাকার — কথাটি উগ্র জাতীয়তাবাদের মক্তবে গুলে খাওয়ানো হয়। খোদ সিরাজ সিকদার [এসএস] নিজেই চীনাপন্থী ছিলেন, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টও তাই, এবং বেশ খানিকটা সিএমপন্থী তো বটেই [দেবেন শিকদার, আজিজ মেহের], কিন্তু ত্রিমুখি লড়াইয়ে তারা কী পাক-সেনা-রাজাকার ঠেকান নাই? নাকি মুক্তিযুদ্ধ একা কারো পিতা বা স্বামীর দয়ার দানই ছিলো, জনযুদ্ধ নয়?
অধমের এসএস সংক্রান্ত নোটে লিংকটি ছিলো, দেখে না থাকলে আরেকবার দেখার বিনীত অনুরোধ, আপনার আগ্রহকে সেল্যুট। মাও ইজম ইন বাংলাদেশ।
উপ- ফ্ল্যাশবাকে বলি: মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী বিষয়ে সত্যিই খুব কাজ হয়নি। অনলাইনে তো প্রায় নয়ই [চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ই একমাত্র আদিবাসী নন, রাজাকার বা মুক্তিযোদ্ধা তো ননই]। এ নিয়েও অধমের একটি নোট ছিলো। পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধ: অন্য আলোয় দেখা। বাই লাইনে ছোট্ট প্রশ্ন, বাঙালির লড়াইয়ে স্বাধীন দেশে বাঙালির রাষ্ট্রই কায়েম হওয়ার কথা। তাহলে সাঁওতাল, মুণ্ডা, উঁরাও এবং চাকমরা কেনো বাঙাল মুলুকের জন্য অস্ত্র ধরে, জীবন দেয়? [‘তোরা সব বাঙালি হইয়া যা’]
আবারো ১৯৭১ এ শেখ মুজিবকে দেখি, [আপনার কথিত নির্বাচন ও অভ্যূত্থানের যুগলবন্দী কোনো নথি?] তিনি নির্বাচনের চীরচেনা পথেই তো হাঁটবেন, বৈঠকে বৈঠকে সমঝোতার গোল-টেবিল চাপড়ে বলবেন, আমিই পাকিস্তানের বৈধ প্রধানমন্ত্রী [লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান], এটিই তার জন্য সহজ ও স্বাভাবিক, আটার কলের কাছে আখের রস চাওয়া বাতুলতা। সিআইএ-র গোপন নথি [সম্প্রতি ফাঁস] সেই সাক্ষ্য দেয়। নথিটি লিংকসহ নীচে পুরোটাই, খুঁজলে পিডিএফ ফর্মে আরো দিস্তাখানেক আছে, আপনার পরবর্তী ধারাবাহিকে কাজে লাগলেও লাগতে পারে:
http://www.nidokidos.org/threads/171625-CIA-Archives-Pakistan-(1971)#.UDTNd6llTxo
উপসংহারে, ১৯৭১ এ জয় বাংলা! শ্লোগানের সঙ্গে বামেরা [মস্কো এবং চীন] আরেকটা শ্লোগান দিতেন: জয় সর্বহারা! এসএস কোং-এর হত্যা, ভ্রান্ত নীতিসমূহের মূত্যু [সংক্ষেপে, নকশালবাদের ইতি] এবং গোয়েবলসের আরাধনায় সে ইতিহাস এখন পাথরচাপাই বটে। এবং ইতিহাসের লীলা মেনে আমাদের বামেরা এরপর আর কখনোই টাইগার বাম হয়নি, ঝন্টু/মিল্লাত বামই এখন ভরসা, এলাহী ভরসার মতো।
অনেক শুভেচ্ছা জানবেন। (Y)
@বিপ্লব দা,
বস্তুত পারিবারিক দু একটি সমস্যার কারণে আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।
@কাজি মামুন ভাই,
এর কারণটাও আমি আসলে বুঝি না, বস্তুত লোকে কতোটুকু জেনে বা বুঝে এই মন্তব্যটি করেন- তা আমার বোধগম্য নয়। বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নানা আধুনিক তত্ত্ব, শাসনব্যবস্থার ভালোমন্দ নির্ধারণের নানা প্যারামিটার, হাজার রকমের জরিপের যুগেও তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত রাষ্ট্র চট করে কোনো সরকারকে ব্যর্থ বলতে পারে না। তাছাড়া গণতন্ত্রায়নের পদ্ধতিটা ভাত রান্নার মতো না- যে দুটো টিপলেই বোঝা যাবে, বাকিগুলোর অবস্থা কি। বঙ্গবন্ধু তাঁর আমলের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের সুযোগটাই পেলেন কোথায়? তিনি দক্ষ প্রশাসক কি না, তা তো প্রমাণের জন্য তাঁকে সময় দিতে হবে- সে সময়টা দিলাম কোথায়? বাকশাল নিয়ে অনেকেই বলে থাকেন- কিন্তু এটাও মানতে হবে আতুরঘরে ধ্বঙস করে ফেলা একটি তত্ত্ব “খুব খারাপ ছিলো”- এই কথাটা বলার যোগ্যতা সমালোচকদের থাকে না, যেহেতু তাকে বিকশিতই হতে দেয়া হয়নি।
আরেকটি বিষয় হলো- প্রতিটি সরকারের শাসনামলের কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। বঙ্গবন্ধু বাঙলাদেশের শাসন ব্যবস্থা যখন হাতে নিলেন, তখন প্রতিটি কাজই চ্যালেঞ্জ। তার উপরে নানা প্যারামিটার একেবারে প্রধান হিশেবে প্রতিষ্ঠিত। এক ধরণের অপ-প্রচারণা চালু রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্টেটসম্যানশিপ নিয়ে। এই বিষয়ে আমি একবার ব্লগার রায়হান রশিদের একটি মন্তব্যে পড়েছিলাম-
সেই সব বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যাঁরা এখনো জীবিত আছেন তেমনই দু’একজনের সাথে তাঁর কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তিনি একজনের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছিলেন-
বঙ্গবন্ধু অবশ্যই ভুল করেছিলেন, কারণ ভুলের বাইরে কেউ নয়। কিন্তু তিনি কতোটা ভুল করেছেন, আর তিনি কতোটা ব্যর্থ এ আলোচনা করার আগে তাঁর সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনা সম্ভবত জরুরী। বোধ করি- আমার মতো আপনিও এ যন্ত্রণাদগ্ধ ভাবনাটায় তাড়িত হন।
অনেক ধন্যবাদ মামুন ভাই।
@বিপ্লব রহমান,
এই মন্তব্য দেখার পরেই ভেবেছিলাম অবধারিতভাবে এর কিছু বিপরীত প্রতিক্রিয়া আসবে। কাজি মামুন তার মন্তব্যে অনেক কিছুই খন্ডন করেছেন, কিংবা বলা যায় নিদেন পক্ষে পালটা যুক্তি দিয়েছেন। তারপরেও ভিন্নদৃষ্টিকোন থেকে মন্তব্য করে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোর জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
একটি কথা বলেই শেষ করা যায় – মুজিবের হাজারো দোষ ছিল, কিন্তু দেশপ্রেমে সম্ভবতঃ ঘাটতি ছিল না। আর তার মত নেতা আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে খুব বেশি যে পেয়েছি তাও কিন্তু নয়। যে যাই বলুক – তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশে আসলে স্বাধীনই হত না। দেশের মানুষ একত্রিত হয়েছিল কেবল মুজিবকে বুকে ধারণ করেই। “শোন, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ স্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ…” কিংবা “যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান,/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান” …এগান/ কবিতাগুলো কিন্তু একাত্তরের উত্তাল সময় মানুষই লিখেছিল, গেয়েছিল তাকে ভালবেসে, তাকে যথার্থ নেতা হিসেবে মেনে নিয়েই। এগুলো কিন্তু মিথ্যা নয়।
যাই হোক, আলোচনা ভাল লেগেছে। বামপন্থী দৃষ্টিকোন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে লেখা নেটে খুব একটা দেখা যায় না। ইরতিশাদ ভাইয়ের এই লেখাটা এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল। আপনি এ ধরনের আরো কিছু লেখার সন্ধান দিতে পারেন? কিংবা বইয়ের নাম? নিজেও লিখতে পারেন, যেহেতু আপনার একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভবত আছে এ নিয়ে।
@অভিজিৎ,
আমার বক্তব্যের মূল স্পিরিটটিকে ধরতে পারার জন্য অনেক ধন্যবাদ অভি দা।
অবশ্যই। আমরা যারা প্রজন্ম ৭১, তারা অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই-পত্র পড়ে, চলচ্চিত্র দেখে, স্বাধীন বাংলা বেতারের গান শুনে, জহির রায়হান, তারেক মাসুদ, জাহানারা ইমাম, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তো বটেই..[এমন কি ড. আহমদ শরীফ এবং সিরাজ সিকদার]…ইত্যাদিতে মুক্তিযুদ্ধের সব ঘটনা প্রবাহ বুঝতে চেষ্টা করি। অনুধাবন করার চেষ্টা করি, বাঙালির গৌরবের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসের ঘটনাটিকে অনুধাবনের জন্য এবং যুদ্ধোত্তোর বাংলাদেশ। …এই পঠন-পাঠনটিও অব্যহত থাকে এবং ব্লগ বিতর্ক তো বটেই। এখানে ভাবনা-চিন্তার নির্মান-বিনির্মানটি খুব বেশী জরুরি।
[img]http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/biplob_33blog_1250404803_1-308a.img_assist_custom.JPG[/img]
ছবি: রিকশা পেইন্টিং, ন্যাট জিও ম্যাগ, ১৯৭২, সংগ্রহ, বিপ্লব রহমান
তবে ইতিহাসের ঘটনাবলিকে [ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিব তো বটেই] বোধহয় নির্মোহভাবেই দেখা ভালো। এখানে আবেগতাড়িত হয়ে ভাব-বুদ্বুদে মজে গিয়ে দেবোত্ব আরোপ করার যৌক্তিকতা দেখি না। মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত এই পাঠটিকেই আমি বিশেষ গুরুত্ব দেই; কারণ শেষ পর্যন্ত এটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধই ছিলো, নিছক স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিলো না। এখানেই মুক্তি সংগ্রামের জনযুদ্ধটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
এর সূচনা সাতের দশকে বাম ভাবাদর্শে সশস্ত্র পন্থায় হয়েছিলো, ১৯৭১ এ স্বাধীনতা একটি চূড়ান্তপর্ব মাত্র, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটি শেষ হয়ে যায়নি, এটি অব্যহতভাবে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম ও চেতনাটিকে অব্যহত রাখা জরুরি; যদিও শেখ মুজিব এবং আওয়ামী অনুসারীরা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এটিকে বরাবরই স্বাধীনতার সংগ্রামেই আটকে রাখতে চেয়েছে, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামটিকে তারা শেষ পর্যন্ত [এবং কি নিষ্ঠুরভাবে পরের সব কয়েকটি অধ্যায়ে] জিইয়ে রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। বাকশালী একনায়কতন্ত্র/ফ্যাসিজমের বিষবৃক্ষ মুজিব দর্শনের ঔরসজাত এই সীমাবদ্ধতারই ফল। অবশ্য আটার কলের কাছে আখের রস চেয়ে লাভ কী? 😕
দেখতে পাই, মুক্তিযুদ্ধকে নিজস্বপন্থায় সে সময় যেসব কমিউনিস্ট পার্টি এগিয়ে নিতে চেয়েছিল [অধিকাংশই দক্ষিনপন্থা এবং চরমপন্থার ঝোঁকের কারণে শেষ পর্যন্ত হঠকারিতার চোরাবালিতে আটকে যায়, নকশালী কায়দায় আত্নঘাতিতায় নিক্ষিপ্ত হয়], পুরো সাতের দশক ধরে মওলানা ভাসানী তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়/সমর্থন দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনিও তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন, অতি গুঢ় বাস্তবতা অনুভব করেই।
[img]https://fbcdn-sphotos-a-a.akamaihd.net/hphotos-ak-snc6/181085_10150963247063363_352801100_n.jpg[/img]
ছবি: পেপার ক্লিপিং, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অরপি’র ফেবু’র সৌজন্যে।
তাই আবারো বলি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধটি ছিলো জনযুদ্ধ এবং এতে ছাত্র-জনতা, বিভিন্ন বামপন্থী দল, এমন কি চরমপন্থী সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির অবদান যথেষ্টই ছিলো, যদিও মুক্তিযুদ্ধের [আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের] ব্যাপারী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বরাবরই তা অস্বীকার করে এসেছে, তারা খুব সচেতনভাবে বঙ্গবন্ধু বা শহীদ জিয়ার একচ্ছত্র অবদানকে ইতিহাসে ও পাঠ্যপুস্তকে প্রতিষ্ঠায় খুবই তৎপর । আমার আপত্তি ও প্রতিবাদ এখানেই।
অন্যদিকে, এর প্রভাবে জাতীয়বাদী ঝোঁকে মুক্তিযুদ্ধ/স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্লগ বারান্দাতেও এর অনেকটাই প্রভাব পড়বে, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মুজিব ও বাংলাদেশ সমর্থক হয়ে উঠবে [যদিও তারা প্রত্যেকেই এককভাবে বিশেষ ও ভিন্ন ভিন্ন মারত্নক অর্থ বহন করে], বরং এটিই তো স্বাভাবিক, তাই না?
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। (Y)
@অভিজিৎ,
এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ বিষয়টি নিয়ে আসলেই লেখালেখি প্রয়োজন।
@অভিজিৎ,
ইরতিশাদ- এর লেখাটি খুব চিন্তাশীল; এই লেখাটি ভীষণভাবে আমাকে নতুন ভাবনার খোরাক যোগাচ্ছে। অভি দা’কে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম; সে জন্য দুঃখিত। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। চলুক। (Y)
@বিপ্লব রহমান, ডঃ আহমদ শরীফের লেখার যে অংশটুকু আপ্নি উদ্ধৃত করেছেন তাতে করে মনে হচ্ছে ঊনি শুধুমাত্র নিজের বানানো মাইক্রোস্কোপ দিয়েই শেখ মুজিবর রহমানকে দেখার চেশ্টা করেছেন যাতে বেশ কিছু অসংগতি আছে। কাজি মামুন যার মধ্যে থেকে কয়েকটি উল্লেখ করেছেন।
@বিপ্লব দা, উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেলো- তাই দুঃখ প্রকাশ করে নিলাম প্রথমেই।
দেখুন, উনিশ শো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যতোটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছিলো- তার চেয়েও বড়ো কথা সেখানে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মূল আকাশ। সারা বাঙলার মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই যুদ্ধ করেছিলো, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে না হলেও। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল একাত্তর বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট আলোয় ধরা পড়বে না, এর জন্য সুদীর্ঘ ইতিহাসের পাঠ জরুরী। সেটা নিশ্চয়ই আপনার আছে। বাঙলা স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতিটি মোড় এমন একটি দিকে নির্দিষ্ট হচ্ছিলো, যেখানে বঙ্গবন্ধু-ই ছিলেন চেতনার পাখি। এর একটি বড়ো প্রমাণ সাতই মার্চের ঐতিহাসিক জনসভা। সবাই, সব দল-মত-মানুষ নির্বিশেষে সেখানে গিয়েছে তাঁর বক্তব্য শুনেছে। একাত্তরের জন্য আপনার উনসত্তরের দরজায় কড়া নাড়তেই হবে, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা এবঙ সেই মিথ্যা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে আনার জন্যে সর্বস্তরের জনগণের যে একীভূত আন্দোলন- তা তো অস্বীকার করবার উপায় নেই। সুতরাঙ এটা বললে ভুল হবে না যে- বঙ্গবন্ধু-ই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি পেরেছিলেন সবাইকে এক কাতারে আনতে। এখানে আওয়ামী লীগ মুখ্য নয়, বঙ্গবন্ধুই মুখ্য। তিনি-ই রচনা করেছিলেন আমাদের মুক্তির গোলার্ধটি। অতএব আমি ‘বঙ্গবন্ধু’ প্রশ্নে ভাব-বুদ্বুদ তো হই-ই নি, বরঙ আমি তাঁকে যোগ্য সম্মানটুকুই দেবার চেষ্টা করেছি।
বিপ্লব দা, বোল্ড অঙশটুকু আসলে মোটা দাগে চিহ্নিতকরণ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকাটি আসলে কেমন ছিলো, তা একটি দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই যুদ্ধ করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বামদের যে অংশটি চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিলো তারাও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। বলেছে, এটি দুই কুকুরের ( মার্কিন ও সোভিয়েট) লড়াই। একে প্রতিরোধ করা উচিত। অতএব ‘বামপন্থী’ বললেও বিষয়টি পরিস্কার হয় না, যেহেতু এখানে একটি পক্ষ ভয়ানকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। সিরাজ সিকদারের উপর লেখা আপনার প্রবন্ধটি আমি পড়েছি; গোছানো এবঙ সাবলীল উপস্থাপনা। কিন্তু উক্ত প্রবন্ধ থেকেই একটি বিষয় উল্লেখ করছি-
বিপ্লব দা, এই বক্তব্য কিন্তু অন্য কেউ করেননি, এক সময়ের নাকশালাইট ও প্রকাশক আজিজ মেহেরের। তিনি সিরাজ সিকদারের বিষয়টি বেশ ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, কেননা তিনি সিরাজের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবঙ বাঙলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের বিষয়টির একটি ফিগার আউট করার চেষ্টা করেছেন। অতএব আমি ডিটেইলে যাবো না; কেবল এইটুকু বলতে পারি- সিরাজ সিকদার দীর্ঘ একটি সময় পেয়েছেন, যদিও তা ছিলো প্রতিকূল- তবে তাঁর স্টেপসগুলো সঠিক ছিলো না বলেই আমার মনে হয়। তাঁর ভেতরে যতোটা ফ্যান্টাসি ছিলো, ততোটা বাস্তব চিন্তা ছিলো না। বিপ্লবী আজিজ মেহের তখন ঠিক বুঝেছিলেন, তাই তিনি ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন; সিরাজ সিকদার বোঝেননি। ইতিহাস বড়ো নিষ্ঠুর মেধাবী, সে কিচ্ছু ভোলে না।
বিপ্লব দা, এই জায়গাটা আমাকে একটু পরিস্কার করবেন; আপনি কি মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’কে একই ধারায় বিবেচনা করেন? তাহলে আমার আপত্তি আছে। বিএনপি কী কী অস্বীকার করে তা আমার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নয় কখনোই। এদের স্বীকার অস্বীকারের কোনো মানদণ্ড নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিষয়ে দুটো কথা আছে। স্বাধীনতার আগে যেমনি, তেমনি পরেও- বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একমাত্র যিনি সবাইকে ভালোবেসে একটি সার্বিক বৃত্তে আনার চেষ্টা করেছিলেন। লক্ষ্য করুন- স্বাধীনতার প্রশ্নে মস্কোপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই যুদ্ধ করলো, যুদ্ধ শেষে অস্ত্র সমর্পন করলো বঙ্গবন্ধুর কাছেই। একটি বড়ো বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ (হয়তো আপনি এ প্রশ্নটি করতেও পারেন) কেনো শুধু মস্কোপন্থীদের আলোচনা হবে, পিকিঙপন্থীদের আলোচনা কেনো আসবে না। সেটাও আসবে- তবে অন্য রেফারেন্স ফ্রেমে, কেননা তাদের একটি অঙশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে, মুক্তিযোদ্ধা হত্যাও করেছে। অতএব তারাও যুদ্ধাপরাধী। মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রধান অতিথি, অর্থাৎ তিনি বস্তুতই সকলের নেতা ছিলেন একাত্তরের পরেও। মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে একটি সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় বিএনপি চরিত্র বদল করেই জন্ম নিয়েছিলো। এর জন্মটাই অস্বাভাবিক এবঙ তীব্র রকমের মুক্তিযুদ্ধ পরিপন্থী চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে মূল আওয়ামী লীগ সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে এবঙ বহু স্রোতের বিরুদ্ধে তাঁদের টিকে থাকতে হয়েছে। অতএব ইতিহাস পাঠে বা বিবেচনায় যে কোনো কাজেই এ দুটো দলকে এক কাতারে রাখতে আমার ঘোর আপত্তি। আপনি শুরু থেকেই বললেন না- নির্মোহতার বিষয়টি, সেটাই- আমি হাল আমলের দুর্নীতির প্রশ্ন নিয়েও যদি আলোচনা করতে যাই- এই দুটো দলকে এক কাতারে রেখে করা সম্ভব না; কারণ ঐতিহাসিক বিবেচনায় দুটো দলের সৃষ্টি প্রক্রিয়া একেবারেই ভিন্ন। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার প্রশ্নে সৃষ্টি হয়েছিলো, বিএনপি স্বধীনতার চেতনা পরিপন্থী প্রশ্নে সৃষ্টি হয়েছিলো।
এবার বলি ‘মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারী’ প্রশ্নটি বিষয়ে আমার আপত্তি। আমার মতে- এই শব্দযুগল এমন এক প্রপঞ্চ যার হাজারটা দিক আছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত- এ অস্বীকার কোনোভাবেই করা যাবে না; আপনিও স্বীকার করেছেন প্রথম বাক্যে। তবে ব্যাপারীপনার প্রশ্নে আসলে বাজার চলে আসে। আওয়ামী লীগ অনেক কিছু নিয়েই ব্যবসা করে, তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তারা ব্যবসা করে না- অন্তত আমার তা মনে হয় না। এখন একটি রাজনৈতিক দলের তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যন্ত যে কারো অপরাধকে পুরো দলের ট্যাগ বানিয়ে দেয়া সম্ভব না, যেমন ধরুন- মধ্যপ্রাচ্যে কোনো বাঙালির অপরাধ দিয়ে গোটা বাঙালিকে নেতিবাচকভাবে বিচার করলে সেটা আসলে বোকামি হবে। এটা ঠিক- যে কোনো ইস্যুতেই আওয়ামী লীগের একটি বড়ো স্ট্যান্ড পয়েন্ট মুক্তিযুদ্ধে তাদের অঙশগ্রহণ এবঙ অবদান। আমি তো এতে ভিন্ন কিছু দেখি না। এটা সত্যিকার অর্থেই তাদের সবচেয়ে বড়ো অর্জন। কিন্তু বিএনপি যখন নিজেদের জন্যে নির্লজ্জভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপ্রশ্নে মিথ্যাচার করে (এখনও করে)- সেটা হয় ব্যবসা, ব্যাপারীপনা।
পাঁচ টাকা দিয়ে টিকেট কিনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন করতে যাওয়াটা হলো আমার ইতিহাসের শিক্ষা, অন্যদিকে জাদুঘরের কোনো বিষয় তুলে এনে বাইরে “আমারি সঙগ্রহ” বলে চালিয়ে বাহবা কামানোটা হলো ব্যাপারীপনা।
না, বিপ্লব দা- জিয়াউর রহমানের (তাকে আসলে শহিদ বলা যায় না, তাহলে মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুরকেও শহিদ বলতে হবে- কেননা দুজনকে একইভাবে হত্যা করা হয়েছে) কোনো একছত্র অবদান মুক্তিযুদ্ধে ছিলো না। বরঙ তিনি ছিলেন একজন ‘সুযোগ সন্ধানী’ মুক্তিযোদ্ধা। ‘সুযোগ সন্ধানী’ কেনো বললাম- তা বেলাল মোহাম্মদের একটি স্মৃতিভাষ্য থেকে উল্লেখ করছি।
বিপ্লব দা, আমার ধারণা আপনি ধরতে পেরেছেন আমি এই অঙশের ঠিক কোনখানে আপত্তি তুলেছি।
আহমদ শরীফ স্যারের বক্তব্য সম্বন্ধে
আপনি বক্তব্যটির যে লিঙ্ক দিয়েছেন, সেখানে এর কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে এর আগেও একদিন কথা উঠেছিলো। আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আহমদ শরীফ স্যারের চারখণ্ড রচনাবলীর মধ্যে তিন খণ্ড পর্যন্ত আমার পড়া, সেখানে নেই- প্রকাশনীতে খোঁজ নিয়ে যেটুকু জানি- চার নম্বর খণ্ডে এ রকম কিছু নেই। অতএব এর তথ্যসূত্র জানাটা জরুরী। আমি মূল লেখাটি আগে পড়তে চাই। আপনার দেয়া লিঙ্কে একজন এ প্রশ্নটি করেছে লেখককে, কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি। স্ক্রীনশট দেখুন।
স্ত্রীনশট- এক
স্ত্রীনশট- দুই
অতএব এর তথ্যসূত্রটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মূল লেখাটি পেলে আমি অবশ্যই আলোচনা করবো।
এখানেও আমার দুটো কথা আছে। দাদা, মঞ্চ নাটকের দু ধরণের দর্শক থাকেন। এক, যাঁরা টিকেট কেটে নাটক দেখেন, নাটক শেষ হলে ভালো কি মন্দ আলোচনা করতে করতে চলে যান। অন্য দলটি হলো- এরা নাটকের সঙ্গে জড়িত, এরা জানে কতো কষ্ট করে একটা নাটক নামাতে হয়, এরা জানে গ্রীণরুমে কেবল সাজসজ্জাই হয় না, কন্সপারেন্সিও হয়। এরাই আসলে পর্দার পিছনের দৃশ্যটা খোঁজে, জানতে চায় কী আছে সেখানে। আমি আপনাকে সে দলেরই মনে করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর শাসনামল কেবল একটি সরকার ব্যবস্থার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো, বঙ্গবন্ধুকে সঙগ্রাম করতে হয়েছে- দেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য, ভারতীয় সৈন্য বিদায় দেবার জন্য, একটি সঙবিধান, একটি শিক্ষাব্যবস্থা এবঙ একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আরও যা যা দরকার, সবকিছুর জন্য। এবঙ অফসোস- বঙ্গবন্ধু নিষ্কণ্টকভাবে কাজগুলো করতে পারেননি। নবগঠিত বাঙলাদেশ তখন বিপর্যয়ের বাঙলাদেশ; একদিকে ত্রিশ লক্ষাধিক শহিদ, দুই লক্ষাধিক নির্যাতিতা নারী, পঁচিশ হাজারের উপরে যুদ্ধশিশু ও তাদের ভবিষ্যত, সামাজিক অবকাঠামোর পুণর্নিমাণ, যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা; তার উপর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। দাদা- বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে আসেন, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট তাঁকে নৃশঙসভাবে হত্যা করা হয়- তিন বছর ছয় মাস পাঁচ দিন- বঙ্গবন্ধুর বাঙলাদেশে বেঁচে থাকার কাল। এবার কাজের পরিধিটা দেখুন। হিশেবটা মেলে দাদা। ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত আপনি সিরাজ সিকদারের কর্মপরিধি বিচার করেন (যা শেষ পর্যন্ত আসলে ব্যর্থ ছিলো এবঙ ভুলও ছিলো- কারণ ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মনি সিংহ-মোজাফ্ফরদের রুশপন্থী সংশোধনবাদের বিরোধী যে ইপিসিপি (এম-এল) এবঙ এর ধারাবাহিকতার অন্যান্য দল ও উপদলগুলোর সত্যিকার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী পার্টি হিশেবে প্রকাশ- সেই বৃত্তের বাইরে গিয়েই ১৯৬৮ সাল থেকেই কমরেড সিরাজ সিকদার শ্রমিক শ্রেণির একটি সত্যিকার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী–মাওসে-তুঙ চিন্তানুসারী বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে একটি নতুন প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই উদ্যোগের মূলে ইপিসিপি (এম-এল) ও এর থেকে বিভক্ত অন্যান্য দল-উপদলগুলো জন্মের শুরু থেকেই যে সংশোধনবাদী লাইন গ্রহণ অনুসরণ করে তার বিরোধিতা করা এবং এর বিপরীতে একটি সত্যিকার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলা। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে রুশ পার্টির আধুনিক সঙশোধনবাদী এবঙ দেশীয় ক্ষেত্রে মনি-খোকা-মোজাফ্ফর চক্রের লাইনের বিরোধিতা করলেও সঙশোধনবাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সঙগ্রাম পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছিলো। কারণ এরাই ইতিপূর্বে মনি-খোকা-মোজাফ্ফরদের নেতৃত্বে তাদের সঙশোধনবাদী, সঙস্কারবাদী, সুবিধাবাদী ও বিলোপবাদী লাইন অনুশীলন করেছিলো, পার্লামেন্টারী রাজনীতি তথা নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনীতির অনুসারী ছিলো। সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিভক্তির সময় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি, অনুশীলনের সঠিক ও সার্বিক সারসঙকলন এবঙ আত্মসমালোচনা করতে ব্যর্থ হয়। বরঙ অভ্যন্তরীন লাইনের ক্ষেত্রে তারা ওই সকল প্রকাশ্য গণসঙগঠনবাদী, সঙস্কারবাদী-অর্থনীতিবাদী অনুশীলনেই নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখে)। একটি দীর্ঘ সময় কাজ করেও তিনি শেষ পর্যন্ত সঠিক ফ্রেমটি ধরতে পারেননি (এটা মানব ইতিহাসের দীর্ঘ বৈপ্লবিক ধারায় কোনো সমস্যা না), আর বঙ্গবন্ধু কাজ করেছেন মাত্র তিন বছর ছয় মাস পাঁচ দিন।
যে হৃদয় দিয়ে সিরাজ সিকদারকে দেখছেন, সেই হৃদয় দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখলে বোধ হয় হিশেব মেলে।
এই জায়গায় আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। স্বাধীনতার একচল্লিশ বছর পরও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের রায়-ই সম্পূর্ণ রূপে কার্যকর হয়নি। বাকিগুলোর তো কোনো কোনোটির চার্জশিটই নাকি পাওয়া যায় না। তবে এ বিচারগুলো হতেই হবে।
(Y) (Y) (Y)
মার্জিনে মন্তব্য
মূলত পাকিস্তান কারাগারে বঙ্গবন্ধু এবঙ সেই সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের প্রহসনমূলক বিচারের ইতিবৃত্ত নিয়েই লেখাগুলো তৈরি করতে চাচ্ছিলাম। তবে আলোচনার জন্যে অনেক ধন্যবাদ দাদা। আমি পরবর্তীতে বামপন্থীদের ভূমিকা, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল- এগুলো নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। সেদিনের জন্য এ আলোচনাগুলো এসেট হয়ে রইবে।
[img][IMG]http://i45.tinypic.com/11ahiip.jpg[/IMG][/img]
@শনিবারের চিঠি,
আপনার বিনীত প্রতিমন্তব্য পেয়ে ভালো লাগলো। আপনার বক্তব্যে সব সময়ই চিন্তার যোগান দেয়, এবারও দিয়েছে।
প্রথমত, এরই মধ্যে আলোচনাটি নানান দিকে নানান দৃষ্টিকোনে বিক্ষিপ্ত হয়েছে, একদিক থেকে সেটি খুবই ভালো, নানা মত ও তথ্য চলতি থ্রেডটিকে সমৃদ্ধ করছে, কিন্তু সব আলোচনা একসঙ্গে চালানো মুশকিল। লক্ষ্যনীয়, সহ ব্লগার কাজী মামুন ও অভিজিৎ দাদার উদ্দেশ্যে দেওয়া আমার বিস্তারিত মন্তব্য বার বার উঠে এসেছে। তাই পুনরাবৃত্তির খুব বেশী প্রয়োজন নেই।
মনজুর মুরশেদ সুসংহত আলোচনায় যে প্রশ্নসমূহ উত্থাপন করেছেন, আমিও সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছি। এ পয়েন্টে আপনার চলতি লেখাটির শিরোনাম থেকে শুরু করে এর ছত্রে ছত্রে বঙ্গবন্ধু (?) শেখ মুজিবের বিস্তর স্তুতি করা হয়েছে, তাকে প্রায় দেবতার আসনে বসানো হয়েছে [বঙ্গবন্ধু- নিশীথের মতো ব্যাপ্ত, স্বচ্ছতার মতো মহীয়ান] , লেখাটি যথেষ্টই চিন্তাশীল ও তথ্যবহুল, কিন্তু একদম নিরমোহ নয় [সঠিক বানানটি আসছে না]।
ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই স্বীকার করবেন, পরিস্থিতি নেতা তৈরি করে, আবার নেতাও পরিস্থিতি তৈরি করেন। লেনিন না হলেও রুশ বিপ্লব অনিবার্য ছিলো, হয়তো বিপ্লবটি বিলম্বিত হতো মাত্র, বিপ্লবের পরিস্থিতিই লেনিনকে সৃষ্টি করেছিলো, আবার লেনিনও বিপ্লবটিকে সূত্রবদ্ধ করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, বাস্তবায়িতও করে দেখিয়েছেন [এর সফলতা/বিফলতার প্রসঙ্গটি চলতি আলোচনায় অপ্রসঙ্গ]।
এদিক থেকে বিচার করলে পাক-দুঃশাসন, এমনকি এর আগে মুঘল-ব্রিটিশ শোষণ-নির্যাতনের কবল থেকে এদেশের বাঙালি আদিবাসী — সব মানুষের মুক্তির আকাঙ্খা, অসংখ্য অসহযোগ, সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র আন্দোলন, একের পর এক প্রচণ্ড গণ বিক্ষোভ ১৯৭১ এর পটভূমি তৈরি করেছিলো। শেখ মুজিবের অসম্ভব জনপ্রিয়তা, প্রায় কিংবাদন্তী সমান নেতা হয়ে ওঠার নেপথ্য কারণ এটিই, তার দলের লোকদের অবদানও এখানে সমানভাবে কাজ করেছে [এবং ভাষানী, ছাত্র নেতাগণ প্রমুখ]।
দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিব বরাবরই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে হেঁটেছেন, মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম নিয়ে তিনি খুব বেশী ভাবিত ছিলেন না; [কাজী মামুনকে ইতিহাসের আলোকে এ বিষয়ে প্রতিমন্তব্যে বিস্তারিত বলেছি, পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই], অর্থাৎ পরিস্থিতিই মুজিবকে তৈরি করেছে, রণাঙ্গন তার নামেই মুখরিত এবং আওয়ামী নেতাদের নেতৃত্বে প্রধানত পরিচালিত হলেও বাস্তবত এই যে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’ তোল রণহুংকার দিয়ে নেতা আত্নসমর্পন করে বসেছিলেন পাক-কারাগারে, পুরো জাতি একে পর এক গণহত্যার কবল থেকে নিজেরাই লড়াই করে [এবং মিত্র বাহিনী] দেশ স্বাধীন করেছে, পরে মুজিবকে স্বাধীন দেশে এনে প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়েছে। যুদ্ধপূর্ব এবং উত্তর বাংলাদেশে তিনি যষেথ্টই প্রধানমন্ত্রীত্বর খোয়াবনামায় বিভোর ছিলেন, ক্ষমতার মসনদটিই শেষশেষ তারই হয়েছে, কিন্তু দেশ তার কাছ থেকে কী পেয়েছে?
তৃতীয়ত, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ মুজিব-আওয়ামী লীগের একক যুদ্ধ বা তাদের কারোই দয়ার দান নয়, এটি ছিলো ছাত্র-জনতা-কৃষক, ডান-বাম [এবং আদিবাসীর], সর্বস্তরের জনযুদ্ধ [এবং সিরাজ সিকদার]।
দৃশ্যমান এই যে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তিনি বঙ্গ-বন্ধু হিসেবে কোনো ভূমিকাই রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, যা যা করলে একজন শ্রেষ্ঠ স্বৈরশাসক হওয়া যায়, তার মধ্যে কোনোটারই কমতি ছিলো না, তাঁবেদার গোষ্ঠিসহ হুকুমের আসামী হিসেবে দায় প্রধানত তারই। বক্তৃতায় শেষ পর্যন্ত বাঙালির পেট ভরেনি [এবং আদিবাসীর, এমএন লারমা স্মরণীয়], সিরাজ সিকদার, চীনপন্থী, এবং মধ্যমপন্থী জাসদ-গণবাহিনীর থাবা তাকে প্রায় পেড়ে ফেলেছিল, রক্ষী বাহিনী, ১৯৭৪ এর আকাল — অন্যসব মুজিব দুঃশাসনের চূড়ান্ত বহিপ্রকাশ মাত্র, একমাত্র নয়…।
চতুর্থত, সিরাজ সিকদার সর্ম্পকিত আমার নোট পাঠে একথা স্পষ্ট ধরা পড়ে, তার পার্টি চরমভাবে বিপ্লব-ফ্যান্টাসীতে ভুগেছে, শেষ পর্যন্ত অনিবার্য ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়েছে [দ্র. আজিজ মেহের]। তবে সিরাজ সিকদারের সে সময়ের রণনীতি ছিলো ত্রি-মুখি, জোতদার নিধন+পাক সামরিক বাহিনী নিধন+ জোতদার ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ-ঘনিষ্ট মুজিব বাহিনী নিধন, এতে রাষ্ট্র বিপ্লবের আদৌ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছিলো কি না, সে প্রশ্নের বাইরে সিরাজ সিকদার প্রকৃত দেশ প্রেমিক বিপ্লবীই ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাও। চারু মজুমদার কথিত [ফাইটস অব টু ডগস] — তত্ত্ব মাত্রই এদেশের তাবৎ চীনা বিপ্লবী/রাজাকার — এই সরলীকরন/আপ্তবাক্য পাখি পড়ার মতো করে উগ্র জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের ইস্কুলে পড়ানো হয় [গুগল করলেই এ বিষয়ে অজস্র লেখার লিংক মিলবে] কিন্তু এর বিপরীত ও সত্যনিষ্ঠ পাঠ হচ্ছে, মস্কোপন্থী বামরা তো বটেই তাদের ছাত্র সংগঠন, এমন কী চরমপন্থী কয়েকটি দল ও উপদল চারু-তত্বের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে বীরত্বের সঙ্গে লড়েছে, এমনকি আজিজ মেহেরের পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্ট, তাদের লড়াইটিও ছিলো ত্রিমুখি।
পঞ্চমত, ড. আহমদ শরীফের মুজিব বিচার-বিশ্লেষনের উদ্ধৃত অংশটুকু তার ডায়েরী ভাব-বুদ্বুদ থেকে নেওয়া, বইটি হাতের কাছে নেই, তবে স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে উদ্ধৃত অংশটি সহব্লগারের সূত্রে ঠিকঠাকভাবেই প্রকাশিত হয়েছে, এর চেয়ে বিশেষ জরুরি এই লেখার আলোচনায় বিপ্লব রহমান কী বলছে, সেটিতে কেন্দ্রীভূত থাকার জন্যই সবিনয় অনুরোধ [দ্র. কাজী মামুনের উদ্দেশ্যে এর আগে লেখা আমার দীর্ঘ পাঠ প্রতিক্রিয়া/ ইতিহাসের আলোয় মুক্তিযুদ্ধ তথা মুজিব বিশ্লেষন।
অনেক ধন্যবাদ। চলুক। (Y)
তুমি বরাবর ই অসাধারন লেখ। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ জেনো। খুব ভাল লাগলো লেখাটা পড়ে।
@উদ্ভ্রান্ত, অনেক ধন্যবাদ উদ্ভ্রান্ত দা। কৃতজ্ঞতার নাগপাশে আবদ্ধ করলাম। অনেক ধন্যবাদ। 🙂
ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান কারাগারে থাকাকালীন সময় সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেল।
বঙ্গবন্ধুর নিশ্চয়ই কোন প্লান ছিল, এবং তা বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানোর সাথে সাযুয্যপূর্ণ ছিল; তবু উপরের যুক্তিটি আমার কাছে বোধগম্য নয়। বঙ্গবন্ধুকে পাওয়ার পরও ওরা মানুষ হত্যা বন্ধ করেনি কিন্তু। বিষয়টি নিয়ে লেখক সামান্য আলোকপাত করলে ভাল লাগবে।
@কাজি মামুন,
প্রথমে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই লেখাটি পড়বার জন্যে, তারপর দুঃখ প্রকাশ করি দেরিতে উত্তর দেবার জন্য। এবার মূল আলোচনায় আসি।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটুকু ধরে সেটুকু আলোকপাত করছি। বাঙালি সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করেছে, অতএব নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তার ক্ষমতায় আসার কথা, বাধা দিলো পাকিস্তানি সরকার। এরপরের সমস্ত ঘটনা, আমার ব্যক্তিগত অভিমত, দুটি ধারায় চলেছে। এক, পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র করেছে আলোচনার নামে; দুই, বাঙালিও নিজেকে প্রস্তুত করেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের এক সন্ধিক্ষণে লে. জে টিক্কা খান যখন ঢাকায় আসছিলো তখন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের জনসমুদ্রে ভাষণ দিচ্ছিলেন। বিমান থেকে তাদের চোখে ধরা পড়ে সে দৃশ্য। তখন গুজব রটেছিলো বঙ্গবন্ধু ‘এক তরফা স্বাধীনতা’ ঘোষণা দেবেন। এই ঘোষণার বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিদারুণভাবে উদ্বিগ্ন ছিলো। বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তানের জি.ও.সি বলে দিয়েছে-
এদিকে ৬ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোনে বলে-
এরপর ইয়াহিয়া টেলিপ্রিন্টারে একটি বার্তা প্রেরণ করে, যার একটি কপি সামরিক আইন সদর দপ্তরেও পাঠানো হয়। ইয়াহিয়া সেই বার্তায় উল্লেখ করে-
লক্ষ্য করুন- বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়া (এমনকি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. ফারল্যান্ড পর্যন্ত) যে সকল আলোচনা করেছে, তার ভাষা ছিলো এক রকম, এবঙ এটা বেশ মেকী ভাষা। বস্তুত তারা বাঙলাদেশ এবঙ বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে যে নীতি পোষণ করেছিলো তার একটি নমুনা পাওয়া যাবে ১৭ মার্চ, সন্ধ্যা ৭ টায়, ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে। সেখানে ইয়াহিয়া বলে উঠলো-
এখন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এটা ধারণা অসম্ভব নয় যে- পাকিস্তানি বাহিনী বস্তুত তাঁকেই চাইছিলো। ইয়াহিয়ার মন্তব্যটি খেয়াল করুন- মুজিব বিহেডিঙ, তাই টিক্কা খানকে রেডি হতে বলা হচ্ছে। ঘটনা হলো- বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষণবিন্দুতে অবস্থান করেছেন, অতএব তাঁকে আটক করতে পারলে এবঙ ‘রাজী করাতে পারলে’ পাকিস্তানের অসৎ উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এমনটা মনে হওয়াই কি স্বাভাবিক নয়? তাছাড়া তিনি চেয়েছিলেন, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও বাঙালির জীবন বাঁচাতে- সেটাও তিনি পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর প্ল্যান অবশ্যই ছিলো। এটাও বোঝা যায় একটি ঐতিহাসিক দলিল থেকে। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদী’র ৩৫ বছর পূর্তির বিশেষ সঙখ্যা- ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ এর ‘ইতিহাস’ শীর্ষক অধ্যায়ে ৪৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-
এখান থেকেই কি তাঁর প্ল্যানটা বোঝা যায় না? তবে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কেনো- আমার মনে হয় পৃথিবীর কারও-ই কোনো ধারণায় তা ধরা দেয় না। এতো নৃশঙসতা ইতিহাসে বিরল।
অসাধারণ লেখনী, শনিবারের চিঠি।
বাঙালি জাতির পিতাকে নিয়ে লিখার জন্য কৃতজ্ঞতা রইল।
ভাল থাকুন সতত 🙂
@কবি নীরব, অনেক ধন্যবাদ; কৃতজ্ঞতা রইলো লেখাটি পড়ার জন্যে। আপনার মন্তব্যের শেষ লাইনটি সত্যিই আমার খুব প্রিয়। দেখলেই ভালো লাগে। 🙂