মুলঃ* মোনা গার্ডনার
অনুবাদঃ ইরতিশাদ আহমদ
ঘটনাটা ঘটেছিল ঔপনিবেশিক ভারতে। এক ব্রিটিশ দম্পতি আয়োজন করেছেন এক জমকালো নৈশভোজের। অতিথিদের নিয়ে তাঁরা বসেছেন খেতে। এঁদের মধ্যে আছেন সামরিক বাহিনীর অফিসার, সরকারী কর্মকর্তা, আর তাঁদের গিন্নীরা। আরো আছেন সফররত একজন আমেরিকান প্রকৃতিবিদ। সবাই বসেছেন বাড়ির প্রশস্ত ডাইনিং রুমটাতে। ঘরের মেঝেটা মার্বেলের, অনাবৃত। ওপরে কড়িবর্গার ছাদ দৃশ্যমান। পাশেই বারান্দায় যাওয়ার জন্য রয়েছে কাঁচের চওড়া দরজা।
উত্তেজিত তর্ক হচ্ছিল এক তরুণী আর এক কর্নেলের মধ্যে। তরুণীর মতে ‘ইঁদুর-দেখলেই-লাফ-দিয়ে-চেয়ারে-ওঠা’র যুগ থেকে মেয়েরা অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে। আর কর্নেল সাহেব বলছেন, মোটেই না! “যে কোন সংকটে মেয়েদের অবধারিত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে” কর্নেলের ভাষায়, “চেঁচানো”।
“আর একজন পুরুষ, তার যতই চেঁচানোর ইচ্ছা হোক না কেন, সে তা করবে না। কারণ, পুরুষদের আত্মনিয়ন্ত্রণক্ষমতা মেয়েদের চেয়ে এক ছটাক হলেও বেশি। আর ওই এক ছটাকই আসলে কাজে লাগে”।
আমেরিকান ভদ্রলোক এ’তর্কে অংশ না নিয়ে অন্যান্য অতিথিদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। তাঁর নজর গেল গৃহকর্ত্রীর মুখের ওপর। দেখলেন তাঁর চেহারায় ফুটে উঠেছে এক অদ্ভূত ভঙ্গি । তাকিয়ে আছেন সরাসরি সামনের দিকে, দেখা যাচ্ছে পেশিতে সামান্য সঙ্কোচন। মহিলা ইশারায় ডাকলেন কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা দেশি কাজের ছেলেটাকে। কানে কানে কি যেন বললেন। ছেলেটা চোখ বড় বড় করে দ্রুতই বেরিয়ে গেল।
আমেরিকানটা ছাড়া এই ঘটনা আর কারো চোখে পড়লো না। আর কেউ দেখলো না ছেলেটা একবাটি দুধ নিয়ে এসে বারান্দায় খোলা দরজার পাশে রেখে দিল।
আমেরিকান ভদ্রলোক এবার চিন্তা করতে শুরু করলেন। ভারতে ‘মেঝেতে রাখা দুধের বাটি’র মানে একটাই – সাপ ধরার টোপ। তাঁর নিশ্চিত ধারণা হলো, এই ঘরে একটা গোখরা সাপ আছে। তিনি ওপরে কড়িবর্গাগুলোর দিকে তাকালেন, দেখলেন না কিছুই। ঘরের তিন কোণাই খালি, চতুর্থটাতে খাবার পরিবেশনের জন্য দাঁড়িয়ে আছে চাকর-বাকরেরা। টেবিলের নীচটা ছাড়া আর কোন সম্ভাব্য জায়গা নেই।
প্রথমেই তাঁর ইচ্ছা হলো লাফিয়ে উঠে সবাইকে সতর্ক করে দেয়ার। কিন্তু তিনি জানেন হৈচৈ হলে গোখরাসাপ ভয় পেয়ে আক্রমণ করতে পারে। তিনি দেরি না করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তাঁর কন্ঠস্বরের গাম্ভীর্যে সচকিত হলেন সবাই।
“আমি জানতে চাই এই টেবিলে উপস্থিত সবার মধ্যে ঠিক কি ধরনের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে। আমি এক থেকে তিনশত পর্যন্ত গুণবো – পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে – এই সময়ের মধ্যে আপনারা কেউ নড়াচড়া করতে পারবেন না, কারো একটা পেশিও যেন না নড়ে। যদি নড়েন তো পঞ্চাশ টাকা জরিমানা, রেডি?”
বিশ জন মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন। আমেরিকান সাহেব গুণতে থাকলেন।
“…দুইশত আশি…” উচ্চারণের সাথে সাথে চোখের কোণে দেখতে পেলেন সাপটা দুধের বাটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সাপটা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই তিনি লাফিয়ে উঠে বারান্দার দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলেন। আর সবাই চেঁচিয়ে উঠলো।
“আপনিই ঠিক, কর্নেল সাহেব!” রায় দিলেন গৃহকর্তা। “একজন পুরুষমানুষ আমাদের এইমাত্র দেখালেন পরিপূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ কাকে বলে!”
“এক মিনিট,” আমেরিকান ভদ্রলোক তাঁকে থামালেন। তাকালেন গৃহকর্ত্রীর দিকে, “মিসেস উইনেস, সাপটা যে ঘরের মধ্যে আপনি জানলেন কি করে?”
মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত মহিলার মুখমন্ডল, “ওটা যে আমার পায়ের ওপর দিয়েই যাচ্ছিল”।
______________________________________________________________________________________________________________________________
* “The Dinner Party” by Mona Gardner from The Saturday Review of Literature, vol. 25, no. 5, January 31, 1941 by General Media Communications, Inc.
নোটঃ গল্পটা পড়েছিলাম অনেকদিন আগে। মনে দাগ কেটেছিল। গল্পের বক্তব্য, সাবলীল ভাষা, আঁটসাঁট গাঁথুনি, আর চাবুকমারা সমাপ্তি, সবমিলিয়ে একটা আদর্শ ছোটগল্প। এই গল্পটা আমেরিকার বেশ কয়েকটা স্কুলে একটা ভালো ছোটগল্পের উদাহরণ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয়। আমি প্রথম পড়ি আমার মেয়ের স্কুলের ইংরেজি বই থেকে। বাংলায় অনুবাদ করে মুক্তমনার পাঠকদের মনিটরে তুলে দিলাম। মূল গল্পটা ইংরেজিতে পড়তে চাইলে, দেখুন এখানে। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
নতুন বছরের প্রথম দিন একটা অসাধারণ গল্প পড়লাম 🙂
দারুন ঝরঝরে অনুবাদ, অপূর্ব নির্বাচন আর লেখার ভঙ্গী।
লেখাটা খুব আরাম করে পড়লাম। সব মেয়েদের মধ্যেই যেন মিসেস উইনেসের মত সম্মান আদায় করে নেবার আত্মবিশ্বাসী চমৎকার নিয়ন্ত্রন গুনটা থাকে।
@কাজী রহমান,
ধন্যবাদ সদয় মন্তব্যের জন্য।
গল্পটা সুন্দর ধন্যবাদ লেখককে।
ছেলে বা মেয়ে কার আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেশী ? এটা নির্ভর করে পরিবেশ আর মানুষের জিনের ওপর । মুক্তমনাতে পড়া একটি প্রবন্ধে লেখা হয়েছিল মনে পড়ছে না কোন প্রবন্ধে, বস্তিতে কঠিন তম পরিবেশে বড় হওয়া সবাই যেমন খুনি সন্ত্রাসী হয় না, আবার ভাল পরিবেশে সবাই ভালো হয় না। জিন ও পরিবেশের এক মিথষ্ক্রিয়া কাজ করে । পুরুষ বা নারী যে কেউ একতরফা ভাবে বেশী আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারী নয় এটা গল্পের অতি সরলীকরণ।
@বিনায়ক হালদার,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। পুরুষ বা নারী কেউই একতরফা ভাবে বেশী আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারী নয়, এইটাইতো গল্পের বক্তব্য আমার মনে হয়।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম আপনার অনূদিত গল্প। নারীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সবখানে এবং সব সময়ই বেশি ইরতিশাদ ভাই। এমন চমক লাগানো আরও গল্পের অপেক্ষায়।
@গীতা দাস,
অনেক ধন্যবাদ।
আমার দ্বিমত আছে, আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা মনে হয় না সবখানে এবং সব সময়ই বেশি। তবে, নারীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যে প্রায়ই পুরুষের চেয়ে বেশি হয় তা আমার নিজের এবং পরিচিত আরো অনেকের অভিজ্ঞতা থেকে বেশ হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাই 🙁 ।
ইরতিশাদ ভাই,
তা’হলে প্রশ্ন করি? নিয়ন্ত্রন বা আত্ম নিয়ন্ত্রন কি খুব ই জরুরী ,খুব ই প্রয়োজন? বলতে চাইছি ক্রোধে ,উতকন্ঠায় যেমন আত্মনিয়ন্ত্রন আপাত দৃষ্টিতে শুভ কিন্তু কিছু আক্রোশ তো সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে, নয় কি? মরা মাছ ই তো শুধু নির্লিপ্ত স্রোতের পক্ষে চলে। আবেগের নিয়ন্ত্রন স্থবিরতা আনে না কি?
@কেয়া,
তোমার সিরিয়াস প্রশ্নটার একটা হাল্কা উত্তর দেবো, ভেবেছিলাম। তবে শেষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলাম। এবারে প্রশ্নের উত্তরঃ নিয়ন্ত্রণ/আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন/অপ্রয়োজন পরিস্থিতি-নির্ভর। গল্পে মিসেস উইনেস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সাপের ছোবল থেকে রক্ষা পেয়েছেন। ওদিকে আবার কোন এক গর্দভ অযথা (অপ্রয়োজনে) আবেগ-নিয়ন্ত্রণ করে বঞ্চিত হলো প্রেমচুম্বনের আস্বাদ থেকে। তোমার কথানুযায়ী তাকে মরা মাছ বলা যায়। হ্যাঁ, আবেগের নিয়ন্ত্রণ স্থবিরতা আনে, তবে কখনো কখনো প্রাণও বাঁচায়।
খুব ভালই লাগল গল্পটি। এরুপ গল্প মাঝে মাঝে উপহার দিবেন।
ধন্যবাদ
@আঃ হাকিম চাকলাদার, মনব্যের জন্য ধন্যবাদ।
চমৎকার একটি গল্প। (F)
@ব্রাইট স্মাইল্, ধন্যবাদ।
অসাধারণ! উৎকণ্ঠা, রস আর মোরালের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন লেখক!
এমনকি আমাদের সমাজেও দেখি, মেয়েদের পায়ের উপর দিয়েই যত প্রকার ‘সাংসারিক সাপ’ চলে যায়; তবু তারা স্থিরতা- ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষাগুলো ভালভাবেই টপকে যায় এবং এভাবেই আমাদের সংসারগুলোও উৎরে যায়!
তবে আমার জানতে ইচ্ছে করছে, লেখক কি বার্তা দিতে চেয়েছেন আসলে? সত্যি কি মেয়েদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পুরুষদের চাইতে বেশী? এ গল্পে স্পষ্টতই তরুণীটি জয়ী; কিন্তু এ বিতর্ক আসলে চিরন্তন এবং কোন স্থায়ী জয়-পরাজয় নির্ধারণ সম্ভব নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, মেয়েদের আত্মনিয়ন্তনক্ষমতা খানিক হলেও বেশী; যদিও পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা মুহূর্তেই ভুল প্রমাণ করতে পারে আমাকে!
পরিশেষে, ফাটাফাটি একটা ছোটগল্পের চমৎকার অনুবাদের জন্য অনেক ধন্যবাদ ইরতিশাদ ভাইকে!
@কাজি মামুন,
আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
এভাবে আমি নিজেও ভাবি নি। আপনার ভাবনাটা বেশ চমকপ্রদ।
আমার মনে হয় না, লেখক এই বার্তাটা দিতে চেয়েছেন। মেয়েদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে কম, এই ধরনের ঢালাও এবং ভিত্তিহীন পুরুষবাদী (male chauvinist) ধারণার বিপক্ষে মনে হয় বলতে চেয়েছেন।
এক কথায় চমৎকার।
এ ধরণের গল্প, পাঠকের মনে খুব দাগ কাটে, আর এ দাগটাই পাঠককে কিছুটা হলেও ভাবায়, কিছু কিছু পাঠক আবার, কিছুটা হলেও পাল্টায়।
আবারো বলছি, এ আসলেই চাবুক মারা গল্প।
এবার গালে হাত দিয়ে বসে থাকার পালা, কবে হবে আবার বরিষণ।
@স্বপন মাঝি,
ধন্যবাদ, সুন্দর মন্তব্যের জন্য। মেঘ জমুক আরো, তবেই হবে বরিষণ।
দারুন দারুন। অসাধারন একটা গল্প অনুবাদ করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
@অ বিষ শ্বাসী, খুশি হলাম।