আগের অধ্যায়ে কিছু পয়েন্ট বাদ পড়েছে মনে হওয়াতে তা সবিস্তারে এখানে দেয়া হচ্ছে। ইসলামি পন্ডিতরা দাবি করে- তৌরাত ও ইঞ্জিল কিতাব বিকৃত ও তা পাল্টে ফেলা হয়েছে। এর বিপরীতে খৃষ্টান পন্ডিতরা দাবী করে-তাদের কিতাবে তাদের ঈশ্বরের মূল যে বক্তব্য অর্থাৎ যীশুর মূল যে শিক্ষা তা ঠিক আছে তবে বিভিন্ন বর্ণনাকারী বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে লিখে রেখে গেছে। তাদের মূল কথা হলো-

কিতাব কে লিখল, কিভাবে লিখল সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো যীশু যে শিক্ষা দিতে চেয়েছে তা ঠিক আছে কি না।

তারা কখনই দাবি করে না যে সবকিছু একেবারে হুবহু তাদের কিতাব সমূহে লেখা আছে। তারা বলে- বর্ণনায় একটু হেরফের থাকতে পারে কিন্তু বাইবেলের যে মূল শিক্ষা তা সব বাইবেলে একই। এর কারণ সম্পর্কেও তারা যৌক্তিক ব্যখ্যা দেয়। যীশু খৃষ্ট মারা যাওয়ার পর খৃষ্ট ধর্ম প্রচারকরা রোম শাসকদের কোপানলে পড়ে। অনেককে তারা হত্যা করে, বাকীরা বাঁচার জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় কোনমতেই তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাদের কিতাবগুলোকে শুদ্ধ ও পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করা। কখন মূলত ইঞ্জিলকে সংকলণ করে সংরক্ষন করা হয় ? যখন রোমান সম্রাট খৃষ্টাণ ধর্ম গ্রহণ করে তখন। সে যীশু খৃষ্ট মারা যাবার প্রায় ৩০০ বছর পর অর্থাৎ ৩০০ খৃষ্টাব্দের পর সম্রাট কনস্টানটাইনের আমলে। তিনিই রোমান সম্রাটদের মধ্যে সর্ব প্রথম খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন ও রোম সাম্রাজ্যের প্রধাণ ধর্ম হিসাবে খৃষ্টাণ ধর্মকে স্বীকৃতি দেন। মূলত: এর পর থেকেই খৃষ্টাণ পাদ্রীরা স্থির হতে পারে ও তাদের কিতাবসমূহ ঠান্ডা মাথায় লিখতে পারে। তখন তাদের কাছে যে সব লিখিত পান্ডুলিপি ছিল তার ওপর ভিত্তি করে তারা তাদের কিতাব লেখে যাতে ঘটনার বর্ণনার বেশ কিছু তারতম্য ঘটে যায় কিন্তু যীশুর মূল শিক্ষাটা তাতে অবিকৃত থাকে। এটাই হলো খৃষ্টান পন্ডিতদের দাবি।বর্তমানে যেসব বাইবেলের কপি পাওয়া যায় তা মূলত: সে সময়কার আমলে সংকলিত। আর এ দুর্বলতাটাই ইসলামি পন্ডিতদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ও এটার ভিত্তিতে তারা প্রচার করে বাইবেল ও ইঞ্জিল কিতাব বিকৃত ও মনগড়া।তারা খুব উচ্চৈস্বরে বলে-দুনিয়ায় বহু সংস্করনের বাইবেল কিতাব পাওয়া যাবে আর দেখা যাবে তাদের যে কোন দুটির মধ্যে বেশ অমিল বর্ণনাতে, কিন্তু দুনিয়ার যে কোন প্রান্ত থেকে কোরান সংগ্রহ করা হোক না কেন তা হুবহু এক। গত ১৪০০ বছর ধরে কোরানের একটা দাড়ি কমাও পাল্টে যায় নাই, তার অর্থ – কোরান আল্লাহর বাণী না হলে এটা সম্ভব হতো না। যারা খৃষ্টাণ ধর্ম প্রচারের সময় কালীন ইতিহাস জানে না বা জানে না কিভাবে কোরান সংকলিত হয়েছিল ওসমান কর্তৃক, তারা এ ধরণের বক্তব্যে দারুনভাবে প্রভাবিত হতে পারে, তা হয়েও থাকে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও তা হতাম এক সময়।

পক্ষান্তরে মোহাম্মদ কি পরিবেশে তাঁর আল্লাহর বাণী প্রচার করেছেন ? প্রাথমিক মক্কার জীবন বাদ দিলে বাকী জীবনটা তিনি ছিলেন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, আর সে সময়টাও কম নয়, প্রায় ১৩ বছর। মদিনাতে গিয়ে তিনি সেখানে এক ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। যেটা বার বার বলা হয় তা হলো আসলে ধর্ম নয় বরং একটা ঐক্যবদ্ধ আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর মূল স্বপ্ন। এখন তিনি রাজ্যের দন্ড মুন্ডের কর্তা। তিনি নিজেই আল্লাহর কাছ থেকে সময়ে সময়ে যখন দরকার পড়ে তখনই ওহি প্রাপ্ত হন। ইসলাম ধর্ম প্রচার ও তার মাধ্যমে যদি গোটা মানব জাতিকে উদ্ধার করা তার একমাত্র লক্ষ্য হতো তাহলে তিনি অবশ্যই এমন ব্যবস্থা করতেন যে তাঁর কথিত আল্লাহর বাণীগুলো সুন্দরভাবে সংকলিত করে বহু সংখ্যক কপি করে রাখতেন যাতে কোন এক কপি হারিয়ে গেলেও সমস্যা না হয়। এটা তাঁর পক্ষে করা ছিল অতীব সোজা কারন তিনি ছিলেন রাজশক্তির অধিকারী। কিন্তু তা তিনি করেন নি। বিভিন্ন হাদিসে দেখা যাচ্ছে- মাঝে মাঝে তিনি আয়াত লিখে রাখতে বলতেন। একটু ভাল করে চিন্তা করলে দেখা যাবে- তিনি যখন মক্কাতে ছিলেন তখন সূরাগুলো লেখার তেমন উদ্যোগ নেয়া হয়নি, মোহাম্মদ কাউকে সেটা করতে বলেনও নি। তবে কিছু কিছু আয়াত বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ নিজেদের তাগিদে লিখে রাখত। এর একটা উদাহরণ দেখা যায়- খলিফা ওমরের বোনের কাছে এধরণের কিছু আয়াত লেখা ছিল, যেটা সে রাত্রে তেলাওয়াত করছিল, যা শুনে পরে ওমর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ বিষয়টি সবাই অবগত আছেন। তবে মোটেই সেটা সমন্বিত কোন প্রচেষ্টা ছিল না। মক্কার সে বিরূপ পরিবেশে তা সম্ভবও ছিল না। মক্কাতে যে সমন্বিত প্রচেষ্টায় কোরান সংরক্ষন করা হয় নি বা সেটা সম্ভব ছিল না সেটা কিন্তু কোরানের বাণী থেকেই বোঝা যায়, যেমন-

আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। সূরা-আল হিজর, ১৫:০৯ মক্কায় অবতীর্ণ।

লক্ষণীয়, উক্ত আয়াতটি মক্কাতে অবতীর্ণ। মক্কার বিরূপ পরিস্থিতিতে যেখানে মুসলমানদের টিকে থাকাই মুসকিল ছিল সেখানে কে সংকলন করতে যাবে কোরানের আয়াত ? সে কারনেই মোহাম্মদ কোরানের রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন।পরে মদিণাতে যাওয়ার পর মোহাম্মদ তাঁর সাহাবীদেরকে তা লিখে রাখতে বলতেন। এ থেকে মনে হতে পারে মোহাম্মদ বোধ হয় তার পূর্বের বক্তব্য – আল্লাহই কোরানের সংরক্ষক এ বিষয় থেকে সরে এসেছেন, অর্থাৎ তিনি আর আল্লাহর ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না, তাই তিনি মাঝে মাঝে তাঁর সাহাবীদেরকে আয়াত লিখতে বলছেন। মোহাম্মদ তাঁর গোটা জীবনে এরকম বহু সময়েই তার কথা পাল্টে ফেলেছেন। তবে সেগুলো কিন্তু তিনি আবার আল্লাহর বাণী দ্বারাই সিদ্ধ করেছেন। যাহোক এ বিষয়ে অন্য কোন এক সময়ে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু এমন কোন প্রমান পাওয়া যায় না যে তিনি তাঁর সব সূরাগুলোকে সংকলিত করে একটা কিতাব আকারে রাখার কোন ব্যবস্থা তিনি কখনো নিয়েছেন। তা যদি নিতেন, তাহলে মোহাম্মদের সবচাইতে প্রিয়পাত্র আবু বকরকে আর কষ্ট করে বিভিন্ন যায়গা থেকে পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য ব্যবস্থা নিতে হতো না। সে কি করেছিল তা এবার দেখা যাক-

যায়েদ বিন তাবিত ( যিনি আল্লাহর বাণী লেখায় নিয়োজিত ছিলেন) বর্ণিত – ইয়ামামা যুদ্ধে ( যে যুদ্ধে বহু সংখ্যক কোরানে হাফেজ মারা যায়) বহু সংখ্যক সাহাবী হতাহত হওয়ার পর পর আবু বকর আমাকে ডেকে পাঠালেন যেখানে ওমরও উপস্থিত ছিলেন, বললেন, ওমর আমার কাছে এসে বললেন, “ইয়ামামার যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মানুষ (যাদের মধ্যে অনেক কোরানে হাফেজও আছে) হতাহত হয়েছে এবং আমার আশংকা হয় অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে যাদের মধ্যে অনেক কোরানে হাফেজও থাকবে, আর এভাবে কোরানে হাফেজ মারা যেতে থাকলে কোরানের একটা বিরাট অংশই হারিয়ে যাবে যদি তুমি তা সংগ্রহ না কর।আর আমারও অভিমত যে তুমি কোরান সংগ্রহ কর”। আবু বকর আরও বললেন, “ কিভাবে আমি সেটা করতে পারি যা আল্লাহর নবী নিজেই করেন নাই ?” ওমর বললেন, “ আল্লাহর শপথ, এটা নিশ্চয়ই একটা ভাল কাজ”। “তাই ওমর আমাকে এ ব্যপারে চাপ দিয়ে যেতে লাগল, আমাকে তার প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য বুঝাতে লাগল, অবশেষে আল্লাহ আমার হৃদয় খুলে দিলেন এবং এখন আমারও ওমরের সাথে একই মত”। (যায়েদ বিন তাবিত আরও বললেন) ওমর আবু বকরের সাথে বসে ছিলেন ও আমার সাথে কথা বলছিলেন না। আবু বকর আরও বললেন “ তুমি একজন জ্ঞানী যুবক এবং আমরা তোমাকে সন্দেহ করি না: এবং তুমি আল্লাহর রাসুলের ওহী লেখার কাজে নিয়োজিত ছিলে। অতএব এখন খোজাখুজি করে কোরান সংগ্রহ কর”। আমি (যায়েদ বিন তাবিত ) বললাম- “ আল্লাহর কসম, কোরান সংগ্রহের মত এরকম কাজ করার চেয়ে যদি আবু বকর আমাকে একটা পাহাড়ও স্থানান্তর করতে বলত সেটাও আমার কাছে অপেক্ষাকৃত সহজ মনে হতো”। আমি তাদের উভয়কে বললাম- “ আপনারা কিভাবে সে কাজ করতে সাহস করেন যা আল্লাহর নবী নিজেই করেন নি?” আবু বকর বললেন-“ আল্লাহর কসম, এটা প্রকৃতই একটা ভাল কাজ। তাই আমি ওমরের সাথে এটা নিয়ে অনেক তর্ক করেছি যে পর্যন্ত না আল্লাহ আমার অন্তর খুলে দিলেন যা তিনি আমাদের উভয়ের জন্যই খুলে দিয়েছিলেন”। অত:পর আমি কোরান সম্পর্কিত বস্তু অনুসন্ধান করতে লাগলাম, আর আমি পার্চমেন্ট, খেজুর পাতা, হাড় ইত্যাদিতে লেখা এবং এ ছাড়াও যাদের কোরান মুখস্ত ছিল তাদের কাছ থেকে আয়াত সমূহ সংগ্রহ করতে লাগলাম। আমি সূরা আত-তাওবা এর শেষ আয়াতটি খুজাইমার কাছ থেকে সংগ্রহ করলাম যা আমি অন্য কারও কাছ থেকে পাই নি( সে আয়াতগুলো ছিল- তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। কোরান,০৯:১২৮)

যে পান্ডুলিপিতে কোরানের আয়াত সমূহ সংগৃহীত হয়েছিল, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা আবু বকর তা নিজের কাছেই রেখেছিলেন, অত:পর তা ওমর তাঁর কাছে রেখেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর, এবং অবশেষে তা ওমরের কন্যা হাফসার নিকট ছিল। সহি বুখারি, বই-৬০, হাদিস-২০

এ হাদিস কি বলে মোহাম্মদের সময়ে সম্পূর্ন কোরান সংকলণ করা হয়েছিল ? হয়ে থাকলে তো আর আবু বকরকে উদ্যোগ নিতে হতো না। পরবর্তী ঘটনা কি ? উক্ত হাদিস থেকে বোঝাই যাচ্ছে- খোদ যায়েদ ইবনে তাবিত কোরানের বিভিন্ন আয়াত সমূহ সংগ্রহ ও সংকলণ করেছিল যা পরবর্তিতে আবু বকর ও ওমরের হাত ঘুরে হাফসার কাছে যায় । আর ইতো পূর্বে আয়শার কাছে যে কোরান ছিল বলা হয়েছে তা নিশ্চয়ই সম্পূর্ন নয়। তা হলে তার পিতা আবু বকর এ কথা বলত না। আয়শার কাছে নিশ্চয়ই কিছু সূরার একটা সংকলণ ছিল, যা সম্পূর্ণ কোরান নয়। ইয়ামামার যুদ্ধে আনুমানিক ৭০০ জন মুসলমান মারা যায় যাদের মধ্যে অনেকেই কথিত কোরানে হাফেজ ছিল। যায়েদ শুধুমাত্র খুজাইমার কাছে ছাড়া আর কারও কাছে উক্ত সূরা আত তাওবার শেষ দুটি আয়াত ১২৮ ও ১২৯ পায় নাই। কিন্তু উপরে দেখা যাচ্ছে হাদিসে মাত্র ১২৮নং আয়াতটিরই উল্লেখ আছে। শেষ ১২৯ নং আয়াতটি লেখা নাই উক্ত হাদিসে যা হলো-

এ সত্ত্বেও যদি তারা বিমুখ হয়ে থাকে, তবে বলে দাও, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত আর কারো বন্দেগী নেই। আমি তাঁরই ভরসা করি এবং তিনিই মহান আরশের অধিপতি।

এখন প্রশ্ন হল বহু সংখ্যক কোরানে হাফেজ মারা যাওয়াতে, এমনও তো হতে পারে যে তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল যারা আরও আয়াত জানত? কিন্তু মরে যাওয়াতে যায়েদ তাদের কাছ থেকে আয়াত সংগ্রহ করতে পারে নি।

সূরা আত তাওবার একটি/দুটি আয়াত পাওয়ার জন্য যদি শুধুমাত্র খুজাইমাই একমাত্র ব্যাক্তি হয়ে থাকে , অন্য অনেক সূরার অনেক আয়াত সম্পর্কে সেরকম শুধুমাত্র অন্য যে কোন একজন লোক থাকবে না কেন ?সুতরাং আমরা কিভাবে নিশ্চিত হবো যে মুখস্থকারী ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথে অনেক আয়াত চিরতরে হারিয়ে যায় নি ?

এছাড়া দেখা যায়-কোরানের আয়াত ছাগলেও খেয়ে ফেলেছিল, যেমন-

আয়শা বর্ণিত-পাথর মারা ও প্রাপ্ত বয়স্কদেরকে স্তন্য পান করানোর বিষয়ে যে আয়াত নাযিল হয়েছিল, তা একটা পাতায় লিখে আমার বিছানার নিচে রাখা হয়েছিল।যখন নবী মারা গেলেন আর আমরা তার দাফন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তখন একটা ছাগল ঘরে ঢুকে আয়াত লেখা পাতা খেয়ে ফেলে। ইবনে মাজা, হাদিস-১৯৩৪

এ থেকে বোঝা যায় সেই সময় কোরানের আয়াতসমুহ কি ভাবে বিরাজমান ছিল।এভাবে ছাগলে যদি আয়াত লেখা পাতা খেয়ে ফেলে, আরও কত ছাগল বা দুম্বা আয়াত লেখা পাতা খায় নি বা পাগলে আয়াত লেখা পাতা বা চামড়া ছিড়ে ফেলে নি তার নিশ্চয়তা কোথায় ? এসব হাদিস থেকে পরিস্কার যে- সেই সময়ে সুষ্ঠুভাবে কোরানের আয়াত গুলোকে সংরক্ষণ করা হতো না অথচ যা ছিল ইসলামের মতে দুনিয়ার সবচাইতে মূল্যবান দলিল।আল্লাহ জিব্রাইলকে দিয়ে মুখে মুখে ওহি না পাঠিয়ে যদি একটা শক্ত কাগজে লিখে সময়ে সময়ে আয়াতগুলো পাঠাত, মোহাম্মদ সেগুলো সংরক্ষণ করে রাখতেন, পরে সেগুলোকে একত্রিত করলেই হয়ে যেত একটা পরিপূর্ণ কোরান। এটাই কি সবচাইতে সোজা পথ ছিল না , যেহেতু আল্লাহই বলছে যে সে নিজেই কোরানের সংরক্ষক ? এ কর্মটি করলে আজকে দুনিয়ায় কেউ আর কোরানের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারত না।

তা ছাড়া আমরা কিভাবেই বা নিশ্চিত হবো যে সবাই একেবারে পুরো কোরান মুখস্ত করে রেখেছিল ? বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায় দেখা যায়- মানুষের মূখস্থ করার ক্ষমতা একেবারে শৈশব ও বাল্য অবস্থাতেই বেশী থাকে। এর পর যত বয়স বাড়তে থাকে ততই তার মূখস্থ করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। একারনেই শিশুরা খুব দ্রুত যে কোন কিছু মুখস্থ করতে পারে। বিশ্বাস না হলে যারা এ নিবন্ধ পড়ছেন তারা একটা বড় বা মাঝারি ধরণের কবিতা মূখস্ত করতে গেলেই বিষয়টি ভালমতো টের পাবেন। আর কোরানে হাফেজ মানে একটা কবিতা মূখস্থ করা না। ১১৪ টা সূরার ৬৬৬৬(সংখ্যাটা গুনে দেখিনি) টা আয়াত মূখস্থ করা, এটা কোন ছেলেখেলা নয়। বর্তমানে দুনিয়াতে যে হাজার হাজার কোরানে হাফেজ আছে একটা সমীক্ষা করলেই দেখা যাবে এদের সবাই কোরান মুখস্থ করেছিল শৈশব ও বাল্য কালে যা পরবর্তীতে তারা ধরে রেখেছে চর্চার মাধ্যমে। সেই তারাও যে তা মূখস্ত করেছে , সেটা সম্ভব হয়েছে একটা পূর্ণাঙ্গ কোরান সামনে নিয়ে বছরের পর বছর দৈনিক ঘন্টার পর ঘন্টা অত্যন্ত অধ্যবসায় সহকারে পরিশ্রম করে। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে কেউ কোরানে হাফেজ হয়নি। আবু বকরের আমলে যে সব কোরানে হাফেজ ছিল বলে কথিত তারা প্রায় সবাই ছিল যুবক বা প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ আর প্রায় সে বয়েসেই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তখন কারো কাছেই একটি পূর্নাঙ্গ কোরান ছিল না যা বসে বসে মূখস্থ করবে। তবে কিছু কিছু সূরা বা আয়াত তারা যোগাড় করে মূখস্থ করে থাকতে পারে, এটা আশ্চর্য কিছু না। সুতরাং যেভাবে প্রচার করা হয় যে সে সময়ে শত শত কোরানে হাফেজ ছিল তা যথেষ্ট প্রশ্ন সাপেক্ষ। এখন তো মনে হচ্ছে-খোদ মোহাম্মদ সহ আবু বকর , ওমর , ওসমান এরা কেউই কোরানে হাফেজ ছিল বলে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারন তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত পরিণত বয়েসে এসে কোরানের আয়াত শুনতে পেয়েছে। ব্যাতিক্রম আলী্। সে বাল্য কাল থেকেই মোহাম্মদের কাছে ছিল আর সে বয়েসেই সে মোহাম্মদের কাছ থেকে কোরান শুনতে পেত। তারপরেও আলীও কোন পূর্ণাঙ্গ কোরান সেই বাল্য কালে হাতের কাছে পায় নি যা দেখে দেখে সে তা প্রতিদিন মুখস্ত করতে পারত। সুতরাং সেও কোরানে হাফেজ ছিল এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। আর এদের সবার জীবন তখন ছিল সংগ্রাম মূখর, বসে বসে কোরান পড়ার অত সময়ও ছিল না আজকের মত। সুতরাং তখনকার বাস্তবের নিরিখে বোঝা যাচ্ছে কথিত যে বহুসংখ্যক কোরানে হাফেজ যারা মারা গেছিল তারা যে পূর্নাঙ্গ কোরানে হাফেজ ছিল তা বিশ্বাস করার কোন সঙ্গত কারন নেই। যাহোক, আসল ঘটনা হলো-খুজাইমার কাছ থেকে ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে যেহেতু যায়েদ আর উক্ত ৯ নং সূরার ১২৮ নং আয়াত পায় নি , তাহলে এরকম বহু আয়াতই যেগুলো মাত্র একজন বা দুজন জানত তারা যুদ্ধে মারা যাওয়ার সাথে সাথেই হাওয়া হয়ে গেছে- এটা কি অসম্ভব কিছু?

তাছাড়া মক্কার জীবনে যে সব মুসলমান ছিল তারা ছিল প্রধানত নিম্ন শ্রেনীর মানুষ ও দাস দাসী। দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার জন্যই তাদেরকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হতো। এরা নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল, কারন মোহাম্মদ প্রচার করেছিলেন মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, তাদের এত সময় ছিল না যে বসে বসে কোরান মূখস্থ করবে, তাছাড়া তারা সবাই পরিণত বয়েসে ইসলাম গ্রহণ করেছিল যে বয়েসে মুখস্থ করা কঠিন। যতদুর জানা যায় মক্কাতে মোট ৯০ সূরা নাযিল হয়েছিল, তা কোন পুস্তক আকারে ছিল না, সেগুলো সুন্দরভাবে লিখে রাখা হয়েছিল এমন নজীরও নেই। সুতরাং সেগুলো তাই দৈনিক এক সাথে বসে পড়ার কোন উপায়ও ছিল না। যে যার মত কিছু কিছু দরকারী সূরা ও আয়াত হয়ত তারা লিখে রাখত হাড় বা খেজুর পাতায়। এটাই যেখানে বাস্তব অবস্থা ছিল সেখানে শত শত মানুষ পুরো কোরান মূখস্থ করে রেখেছিল এটা কিভাবে বিশ্বাস যোগ্য? আবু বকর ঠিক এটাই বুঝাতে চেয়েছিল উক্ত হাদিসে, দেখা যাক প্রকৃতপক্ষে সে কি বলেছিল-

এভাবে কোরানে হাফেজ মারা যেতে থাকলে কোরানের একটা বিরাট অংশই হারিয়ে যাবে যদি তুমি তা সংগ্রহ না কর। সহি বুখারি, বই-৬০, হাদিস-২০১

এর কি অর্থ? বোঝাই যাচ্ছে অনেক মানুষ তখন ছিল যারা কিছু কিছু সূরা বা আয়াত মূখস্থ করতে পেরেছিল, সেগুলো অন্য কারো মুখস্থ ছিল না, আর তারা যদি মারা যায় তাহলে কোরানের বিরাট অংশই হারিয়ে যাবে। অথচ যদি শুধু একজন মাত্রও কোরানে হাফেজ বেঁচে থাকে তাহলে তো তার মাধ্যমেই পূরো কোরান লিখে ফেলা সম্ভব, তাই নয় কি ? এখানে কোরানের একটা বিরাট অংশ শব্দ গুলোর মধ্যেই আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। সুতরাং বলা হয় তখন শত শত মানুষ কোরানে হাফেজ ছিল, এটা কি বিশ্বাস্য? অত:পর কি ঘটল? যায়েদ বিভিন্ন মানুষের কাছে গেছে , তারা যতটুকু মূখস্থ করেছে বা তাদের কাছে যে সব লিখিত সূরা বা আয়াত ছিল সেসব যোগাড় করে তা সংকলণ করেছে। অথচ সত্যিই যদি তখন প্রকৃত কোরানে হাফেজ থাকত অথবা যায়েদ যদি নিজেও কোরানে হাফেজ হতো তাহলে সে নিজেই পুরো একখন্ড কোরান লিখে ফেলতে পারত। হাড় বা খেজুর পাতায় লেখা আয়াত খোজার দরকার পড়ত না। এখন বোঝাই যাচ্ছে জনে জনে জিজ্ঞাসা করে কোন্ ধরণের কোরান যায়েদ সংকলণ করেছিল আবু বকরের আমলে।

আবু বকর মরে যাওয়ার পর তা গেছে ওমরের কাছে , ওমর মারা যাওয়ার পর তা গেছে তার কন্যা মোহাম্মদের স্ত্রী হাফসার কাছে। সুতরাং বোঝা গেল মোহাম্মদের আমলে যে সম্পূর্ন কোরান সংকলণ করা হয়েছিল বলে বলা হয় তা ঠিক নয়। বিষয়টা এপর্যন্ত হলেও হতো। কিন্তু এখানেই বিষয়টি থেমে নেই। এ কোরানকে তৃতীয় খলিফা ওসমান বিশুদ্ধ কোরান হিসাবে মেনে নিতে চায় নি। কারনটা ছিল মূলত: উচ্চারণগত বা এমনও হতে পারে, তার মনে হয়েছিল এর মধ্যে অনেক আয়াত বাদ পড়েছে।

অথচ তার পূর্ববর্তী খলিফা আবু বকর ও ওমর সে কোরান মেনে নিয়েছিল। তাহলে তারা কোন্ কোরান মানত ?

ওসমানের মনে হয়েছিল যে নিশ্চয়ই উক্ত কোরানে নানারকম আঞ্চলিক ভাষার সমাহার আছে। সেকারনে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণে কোরান পাঠ করছে বা এমনকি হয়ত অনেকে নিজেদের বানান আয়াত পড়ছে। কারন আবু বকর বা ওমর কেউই আগের কোরানের কপি তৈরী করে সব যায়গাতে পাঠায়নি। সে কারনেই সে একটা কমিটি করে দিয়েছে যাতে এই যায়েদ বিন তাবিতও ছিল। অত:পর সেই যায়েদ বিন তাবিত ও অন্য দুইজন মিলে নতুন করে কোরান সংকলণ করল, সেটাও তারা করল কোরাইশ আঞ্চলিক আরবী ভাষায়। কিন্তু তাতে করে যারা মুখস্ত আয়াত সমেত মারা গেছিল তারা তো আর তাদেরকে এসে বলে যায় নি যে আয়াতগুলো শুধুমাত্র তারাই মুখস্থ করেছিল। এছাড়া এবারও কিছু আয়াত যোগ করা হয় কারও কারও কাছ থেকে শুনে, যেমন দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র খুজাইমার কাছ থেকে শুনে তা কোরানে যোগ করা হয়েছে। সুতরাং ওসমান এমন এক কোরান সংকলণ করেছিল যাতে মোহাম্মদ কথিত অনেক আয়াতই নেই, যা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে কোরান কিভাবে সংকলণ করা হয়েছিল তার প্রক্রিয়ার বর্ণনার মাধ্যমে উপরোক্ত হাদিস(সহি বুখারি, বই-৬০, হাদিস-২০১) থেকে।

আসলেই যে কিছু কিছু আয়াত বাদ পড়েছে তার প্রমান পাওয়া যায় একটি হাদিসে-

ইবনে আব্বাস বর্ণিত- ওমর বললেন, আমার ভয় হয় অনেক দিন পার হয়ে গেলে লোকজন বলাবলি করতে পারে -“ আমরা কোরানে রজম(পাথর মেরে হত্যা) সম্পর্কে কোন আয়াত পাচ্ছি না এবং অত:পর তারা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ম ভূলে বিপথগামী হয়ে যেতে পারে।দেখ, আমি নিশ্চিত করে বলছি, যেই ব্যভিচার করবে তার ওপর পাথর মেরে হত্যার শাস্তি কার্যকর করা হোক এমনকি যদি সে বিবাহিত হয়, অথচ তার অপরাধ যদি সাক্ষী বা গর্ভধারণ বা স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রমানিত হয়, তাহলেও”। সুফিয়ান যোগ করল, “আমি বিবৃতিটি এভাবেই শুনেছিলাম যা আমি স্মরণ করি এভাবে যে ওমর আরও বলল-আল্লার নবী নিজেও পাথর মেরে হত্যার শাস্তি কার্যকর করেছিলেন এবং আমরাও তাঁর পর এটা কার্যকর করেছিলাম”। সহি বুখারী, বই-৮২, আয়াত-৮১৬

উক্ত হাদিসে পরিস্কার করে বলা হচ্ছে যে ব্যভিচারীর শাস্তি পাথর ছুড়ে হত্যা করা সম্পর্কিত একটি আয়াত নাযিল হয়েছিল।এ আয়াত মোতাবেক মোহাম্মদ নিজেও ব্যভিচারীর শাস্তি কার্যকর করেছিলেন আর তাঁর দেখা দেখি ওমর ও তার দলবলও তা পরে পালন করেছিল। বর্তমানে যে কোরান আমরা পড়ি তাতে কিন্তু এ আয়াত নেই, ওমর নিজেও সেটা তার কাছে থাকা কোরানে দেখতে পায়নি। তার মানে এটা বাদ দেয়া হয়েছে। ওমর কখন এ কথাগুলি বলছে? মোহাম্মদের মারা যাওয়ার পর তার শাসনামলে যখন সে দেখল তার কাছে যায়েদ সংকলিত কোরানে এ আয়াত নেই তখনই সে এই কথাগুলি বলেছিল।কারন, সে এ ধরণের শাস্তির পক্ষে ছিল।আর তার ভয় ছিল এ ধরণের শাস্তির বিধান বহাল না থাকলে লোকজন বিপথে চলে যাবে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বলেই কিন্তু ওমর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। কোরানে বহু কম গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বহীন, অর্থহীন বা এমনকি অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা আছে। এধরণের কোন আয়াত হারিয়ে গেলে ওমর নিশ্চয়ই এ নিয়ে কোন কথা বলত না।এখন আমরা কিভাবে নিশ্চিত হবো যে ওসমানের আমলে সংকলিত কোরানে এ ধরণের কম গুরুত্বপূর্ণ বহু আয়াত সংকলণ করা থেকে বাদ পড়েনি? একই সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও যে বাদ পড়েনি তার ই বা নিশ্চয়তা কি? অন্তত: হাদিস থেকেই তো একটা বড় উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা আয়াত বাদ পড়ে গেছে কোরান থেকে আর যার সাক্ষী ইসলামের সিপাহসালার ৩য় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব।এর পরেও কিভাবে বলা যাবে যে কোরান শতভাগ বিশুদ্ধ ও অবিকৃত?

এছাড়াও আরও একটা বিরাট সমস্যা আছে খেজুর পাতায় বা হাড়ে লেখা অথবা মানুষের মুখ থেকে শোনা আয়াত সংকলণের। মোহাম্মদের মক্কার জীবনে আরও দু একজন দাবিকারীর উদ্ভব ঘটেছিল আর তারাও দাবি করত আল্লাহ তাদের কাছেও ওহি পাঠাচ্ছে যা দেখা যায় নিচের আয়াতে-

অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে। কোরান, ০২: ৭৯

তাদেরও কিছু উম্মত নিশ্চয়ই ছিল যারা এসব নবীর আয়াত মুখস্থ করেছিল বা খেজুর পাতায় লিখে রেখেছিল। মক্কা দখলের পর নবীদেরকে কোতল করা হয়, কিন্তু তাদের উম্মতরা ইসলাম গ্রহণ করে ও মুসলমানদের সাথে মিশে যায়। মোহাম্মদের মৃত্যুর প্রায় ১৯/২০ বছর পর যখন ওসমান একটা কমিটির মাধ্যমে আবার কোরান সংকলণ শুরু করে তখন পূর্ব সংকলিত কোরানের সাথে মানুষের মুখের শোনা আয়াত সংগ্রহ করেও তা নতুন কিতাবে যোগ করা হয়। তাহলে এ সময়ে যে উক্ত ভূয়া নবীদের উম্মতের বলা আয়াত সেসব মুসলমানদের কাছ থেকে গ্রহণ করে কোরানে ঢুকানো হয় নি, তার নিশ্চয়তা কি ? আমরা দেখেছি সেই মক্কাতে উপরে উপরে ভাল মুসলমান হলেও তলে তলে মোহাম্মদকে ঘৃণা করত। আবু সুফিয়ান তার একজন অন্যতম। অনেকে শত্রুতা বশত:ও তো সেটা করে থাকতে পারে। কারন পুরো কোরান তো দেখা যাচ্ছে কারোরই মুখস্থ ছিল না, যদি থেকেও থাকে, তারপরও তো ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকে আয়াত সংগ্রহ করা হচ্ছিল যা আর কারও জানা ছিল না। বলা হয় যে, কোন আয়াত সংকলণের আগে কমপক্ষে দুজন আয়াত জানা ব্যক্তির সাক্ষী নেয়া হয়েছিল। আবু খুজাইমার ব্যপারে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় কোন সাক্ষী ছিল না। অনেক আয়াতই হয়ত বা দুইজন সাক্ষীর দ্বারা সত্যায়ন করা হয়েছিল কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে এ নিয়ম পালন করা হয়েছে তার কোন নিশ্চয়তা অন্তত হাদিসে দেখা যায় না। যায়েদ বিন তাবিত যখন প্রথমে কোরান সংকলণ করে তখন সে যে উক্ত নিয়ম অনুসরণ করেছে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।পরবর্তী সংকলণের সময় দেখা যাচ্ছে তার পূর্বোক্ত কোরানকে ভিত্তি করেই করা হয়েছিল। অর্থাৎ তার কোরানে যা লেখা ছিল তার অনেকটাই হুবহু গ্রহণ করা হয়েছিল, এছাড়াও নতুন আয়াতও যোগ করা হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছ থেকে শুনে। পরবর্তীতে হাফসার কোরান ধ্বংস করে ফেলায় এ সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় যে ওসমানের সংকলনে অনেক আয়াত পরিবর্তন বা পরিমার্জন অথবা নতুন করে সংযোজন করা হয়েছিল।খেয়াল করতে হবে, ওসমানের তৈরী করা কমিটিতে তখনকার সময়ে সবচাইতে ভাল কোরানে হাফেজ কেউ ছিল না।দেখা যাক, মোহাম্মদের মতে কারা কোরানের সবচাইতে বড় পন্ডিত ছিল-

মাসরুক বর্ণিত- আমরা আব্দুল্লাহ বিন আমর এর নিকট গমন করতাম ও কথা বার্তা বলতাম। একদা ইবনে নুমাইর তার নিকট আব্দুল্লাহ বিন মাসুদের নাম উল্লেখ করল। তখন তিনি(আমর)বললেন-তোমরা এমন একজন ব্যাক্তির নাম বললে যাকে আমি অন্য যে কোন মানুষের চেয়ে বেশী ভালবাসি। আমি আল্লাহর রসুলকে বলতে শুনেছি- চারজন ব্যাক্তির কাছ থেকে কোরান শিক্ষা কর, অত:পর তিনি ইবনে উম আবদ্( আব্দুল্লাহ মাসুদ) এর নাম থেকে শুরু করে মুয়াদ বিন জাবাল, উবাই বিন কাব ও শেষে আবু হুদায়ফিয়ার নাম উল্লেখ করলেন। সহি মুসলিম, বই-৩১, হাদিস-৬০২৪

দেখা যাচ্ছে মোহাম্মদের সার্টিফিকেট পাওয়া চারজনের কেউই কোরান সংকলনের দায়িত্ব পায় নি। এর রহস্য কি ? ব্যক্তিগত ভাবে তারা হয়ত কোরান সংকলন করে থাকতে পারে যা বিভিন্ন সূত্রে জানাও যায়, কিন্তু তাদের কোরানকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা হয় নি। পরবর্তীতে তাদের কোরানের কোন খবরও নেই। এখন মোহাম্মদ নিজে কোরান সংকলন করল না, তার সার্টিফিকেট পাওয়া ৪ জন কোরানে হাফেজ-এরও কেউ তা সংকলণ করল না, করল এসে ওসমানের মনগড়া এক কমিটি, এ কমিটির কোরান সংকলণ কতটা গ্রহণযোগ্য? এবারে কিছু তথ্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক।

আবু বকর, মৃত্যু:৬৩৪ সালে।ওমর, মৃত্যু: ৬৪৪ সালে।ওসমান মৃত্যু:৫৬ সালে।
আব্দুল্লাহ মাসুদ, জন্ম: মক্কা, মৃত্যু:৬৫০ সালে।উবাই ইবনে কাব,জন্ম: মদিনা মৃত্যু:৬৪৯ সালে। মুয়াদ বিন জাবাল, জন্ম:মদিনা- কখন মারা যায় সঠিক রেকর্ড নাই, তবে ওমরের আমলে বেঁচেছিল কারন ওমর তাকে বাইজান্টাইনের বিরুদ্ধে এক সেনাদলের প্রধান করে পাঠায়।আবু হুদায়ফিয়ার, জন্ম: মক্কা- আবু বকরের আমলে বেচে ছিল। (সূত্র: wikipedia.org)

উপরোক্ত তথ্য মোতাবেক জানা যাচ্ছে যে-আবু বকরের আমলে মোহাম্মদ কর্তৃক সত্যায়িত চারজন কোরানে হাফেজই বেঁচে ছিল, কিন্তু তারা কেউই আবু বকর কর্তৃক কোরান সংকলণের দায়িত্ব পায় নি।যায়েদ বিন তাবিত যদিও যুবক বয়স থেকেই কোরানের বানী লিখে রাখত, কিন্তু এর চাইতে পূর্বেকার চার জনের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা অনেক বেশী ছিল, আর তারা মক্কার জীবন থেকেই কোরানের কিছু কিছু বানী লিখে রাখত। কারন তাদের অন্তত দুইজন মাসুদ ও হুদায়ফিয়া মক্কা থেকেই মোহাম্মদকে চিনত, জানত ও তার কাছ থেকে কোরান শুনত। পক্ষান্তরে যায়েদ বিন তাবিতের জন্মই হয় যে বছর মোহাম্মদ মদিনাতে হিজরত করে সে বছর আর তার আগেই কোরানের ৯০ টি আয়াত নাজিল হয়ে গেছে। যেহেতু ইতোপূর্বে ধারাবাহিকভাবে কোরানের কোন লেখা কপি ছিল না, আর যা কিছু আয়াত লেখা ছিল তার সবটাই ছিল আব্দুল্লাহ মাসুদ ও আবু হুদায়ফিয়ার কাছে কারন তারা মক্কাতেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, সেহেতু এমতাবস্থায় কোন সংকলিত কোরানের কপি হাতে না থাকায় তাবিত কতটা কোরান সম্পূর্ন মূখস্থ করতে পেরেছিল তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।সার্বিক বিচারে দেখা যায়, উক্ত চারজনের যে কেউই কোরান সংকলণ করলে তা হতো আরো বেশী শুদ্ধ। উক্ত ঘটনা দৃষ্টে দেখা যায়, মোহাম্মদের কোরান সংকলনের ইচ্ছা থাকলে উক্ত চারজনের কাছে দায়িত্ব দিলেই তা হতো অনেকটাই সুন্দর , সুচারু ও শুদ্ধ। কিন্তু তিনি তা করেন নি, বা তার পরবর্তী খলিফারাও সেটা করেনি। এমতাবস্থায় ওসমানের সংকলিত কোরান কতটা শুদ্ধ সেটাই বিচার্য বিষয়।

হাফসার কোরান রক্ষা পেলে ওসমানের সংকলিত কোরানের অনেক ত্রুটি যে ধরা পড়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। এই হলো মোটা মুটি ভাবে মোহাম্মদের প্রচার করা কোরানের সংরক্ষণ বৃত্তান্ত। এর ফলে কি শতভাগ নিশ্চয়তা দেয়া যায় যে- মোহাম্মদ যে সব সূরা বা আয়াত প্রচার করেছিল তা হুবহু শতভাগ বিশুদ্ধভাবে নতুন সংকলিত কোরানে স্থান পেয়েছিল ?

আরও বড় প্রশ্ন- মোহাম্মদ যা রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, আবু বকর বা ওসমান মোহাম্মদকে ডিঙিয়ে কিভাবে তা নিজেরা সংরক্ষণ করতে পারে? এটা কি মোহাম্মদকে অবমাননা করা নয়? আবু বকর বা ওসমান কি মোহাম্মদের চাইতেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ?

ঠিক এ অভিযোগ তুলে রাশাদ খলিফা নামক এক নবী দাবিকারী লোক একটা কোরান সংকলণ করে যাতে ৬৬৬৬ টি আয়াতের স্থলে আছে ৬৬৬৪টি। পূর্বে সূরা আত-তাওবার শেষ ১২৮ ও ১২৯ নং আয়াতের কথা বলা হয়েছে, উক্ত আয়াত দুটি তার কোরানে নেই। সুতরাং দুনিয়ার সব কোরান হুবহু এক নয়। এই সেই ব্যক্তি যে কোরানের মধ্যে ১৯ এর অলৌকিকত্ব আবিষ্কার করে। মজার কান্ড হলো- মুমিন বান্দারা তাকে নবী হিসাবে না মানলেও বা তার কোরানকে গ্রহণ না করলেও তার ১৯ সম্পর্কিত অলৌকিকত্ব নিয়ে দারুন লাফালাফি করে। বলাবাহুল্য, তার এ অলৌকিকত্বের ভিত্তি ছিল উক্ত ২টি আয়াত বাদ দিয়েই। ৬৬৬৬ কে ১৯ দিয়ে ভাগ করলেই সেটা বোঝা যাবে, যেমন, ৬৬৬৬÷১৯=৩৫০.৮৪২১০৫২৬৩১৫৭৯ । আসলে সংখ্যাটা হতে হবে ৬৬৬৯, তাহলেই হবে ৬৬৬৯÷১৯=৩৫১, তখন সিদ্ধ হবে। পক্ষান্তরে যে কারন দেখিয়ে রাশাদ খলিফা উক্ত আয়াত দুটি তার কোরান থেকে বাদ দিয়েছে তা মোটেই ফেলনা নয়। যাহোক, তার দাবী ছিল সূরা ইয়াসিনের ৩ নং আয়াত তাকেই লক্ষ্য করে নাযিল হয়েছিল যা হলো-

নিশ্চয় আপনি প্রেরিত রসূলগণের একজন ৩৬:০৩

আর সেই রসূলগণের একজন হলো রাশাদ খলিফা। কিন্তু মুমিন বান্দারা সেটা মানতে রাজী হয় নি, তাই রাশাদ খলিফাকে ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে খুন হতে হয়।

রাশাদ খলিফা ও তার ইসলাম সম্পর্কে জানা যাবে -http://www.islam-watch.org/MuminSalih/KhalifaProphet.htm এবং http://en.wikipedia.org/wiki/Rashad_Khalifa

তার অনুবাদিত কোরান পাওয়া যাবে- http://www.quran.org/English.html

রাশাদ খলিফার চাতুরীর খবর পাওয়া যাবে – http://www.islamicweb.com/beliefs/cults/submit_trick.htm

রাশাদ খলিফার কৃতিত্ব ভাল ভাবে জানতে- http://www.masjidtucson.org/publications/books/qhi/qhi.html

বর্তমানে যে কোরান পাওয়া যায় তা মূলত: সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত কোরান যা তারা সারা দুনিয়ায় প্রচার করেছে।

পরিশেষে যে সমস্যার কথা উল্লেখ করতে হবে – তা হলো ওসমানের সংকলিত কোরানে কোন জের, জবর , পেশ এগুলো ছিল না। এটা অনেকটা বাংলায় রচিত কোন বই য়ে া, ি, ী, ু, ূ কার ব্যবহার না করার মত বিষয়। এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে অনেক শব্দ ও বাক্যের যেমন ইচ্ছা খুশী অর্থ করা যায়। যা কোরানে ঘোষিত বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। কোরানে আল্লাহ বার বার ঘোষণা করেছে- কোরানের বাণী হলো সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার। ৯ম-১০ম শতাব্দিতে এসে কোরানে জের, জবর, পেশ এসব ব্যবহার শুরু হয়। এটা তো কোরানের শব্দ ও বাক্য পরিবর্তনের সামিল। মোহাম্মদের সময়ের কোরানে যেহেতু এসব ছিল না ( তখনও তো কিছু কিছু আয়াত লিখে রাখা হতো), পরে এগুলো নিজেদের মত করে যোগ করার মাধ্যমে মোহাম্মদের কোরানের পরিবর্তন করা হল না ? তখন ইচ্ছামত সেগুলো বসিয়ে কোরানের বিভিন্ন বাক্য বা শব্দের অর্থ পাল্টিয়ে ফেলা হয় নি, সে ব্যপারে নিশ্চয়তা কি ? সুতরাং মোহাম্মদ কথিত কোরানের যে আকার, আয়তন বা অর্থ ১৪০০ বছর আগে ছিল, তা যে বহুলাংশে পাল্টে গেছে এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট সঙ্গত কারন আছে। এত কিছুর পর কিভাবে দাবী করা হয় যে – কোরান ১৪০০ বছর ধরে অবিকৃত?

অথচ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস সহকারে তথাকথিত মুসলিম পন্ডিতরা দাবী করে যে কোরানে কোন বিকৃতি ও ভুল নেই, এ সেই কোরান যা গত ১৪০০ বছর ধরে একই আছে। কিন্তু সে কোন্ কোরান ? সেটা হলো ওসমান সংকলিত জোড়াতালি মার্কা কোরান। এখানেই ইসলামি পন্ডিতরা একটা কৌশল অবলম্বন করে। তা হলো- তারা প্রচার করে ওসমান কোরান সংকলণ করে, কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় তা করে তা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। এ কৌশলকে ইসলামে বলে তাকিয়া বা সুকৌশলে প্রতারণা। এ বিষয়ে পরে লেখা হবে।অথচ সমস্ত সুযোগ-সুবিধা, ব্যবস্থা ও ক্ষমতা হাতে থাকা সত্ত্বেও মোহাম্মদ কোরান সংকলণ করে যান নি। এটাই সবচে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় মনে হয় যে মক্কা বিজয়ের পরও তিনি কোরান সংরক্ষনের তাগিদ অনুভব করেন নি, অথচ তখন তা সংরক্ষণের সমস্ত রকম ব্যবস্থাই তার হাতের নাগালে ছিল। কেন করে যান নি ? এর উত্তর মোহাম্মদের কাছেই ছিল- কোরানে আল্লাহ বলেছিল – তার নাযিলকৃত কোরান সে নিজেই সংরক্ষণ করবে। তাই যদি হয় তাহলে – কেন অত:পর আবু বকর ও ওসমান কে খেজুর পাতা , হাড্ডি গুড্ডি এসবে লেখা আয়াত কুড়িয়ে, মানুষের মুখের কথায় বিশ্বাস করে নিজেদের মত করে কোরান সংকলণ করতে হয়েছিল?

আসলে তার উদ্দেশ্য ছিল মক্কা বিজয় করে একটা আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার। তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একটা দর্শন দরকার ছিল। সেটা ছিল ইসলাম। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পর তার কাছে কোরানের বিশেষ গুরুত্ব ছিল না। তখন তার কাছে ছিল ইসলামী দর্শন বড় যার মূল ভিত্তি ছিল সুন্নাহ, যা মূলত আসে হাদিস তথা তার জীবনের কার্যাবলী থেকে। সুতরাং সেটাই ছিল তার কাছে বড়।

কোরান অবিকৃত ও বিশুদ্ধ এটা প্রমান করা যাবে একমাত্র মোহাম্মদ কর্তৃক সংকলিত কোন কোরানের পান্ডুলিপি যদি কেউ হাজির করে দেখাতে পারে শুধুমাত্র তাহলেই, অন্যথায় নয়। মোহাম্মদের সেটা করে যাওয়ার সমস্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা না করে মুসলমানদেরকে একটা বিরাট বিপদের মধ্যে ফেলে গেছেন। এতদিন বিষয়টি চ্যলেঞ্জের মুখোমুখি হয় নি শক্তভাবে। চ্যলেঞ্জের সামনে এখন ইসলামী পন্ডিতদের গলাবাজি আর মিথ্যাচারই সম্বল।

এখন দেখা যাচ্ছে খৃষ্টান ও ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময়ের প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে যেখানে কোরানকে সত্যিকার একটা বিশুদ্ধ কিতাব আকারে সংরক্ষণ সম্ভব ছিল, মোহাম্মদ সেটা হেলা করেছেন চরম ভাবে, কিন্তু খৃষ্টান পাদ্রীরা শত কষ্ট করে জীবন বিপন্ন করে যীশু খৃষ্টের শিক্ষাগুলোকে সংরক্ষণ করেছে শত শত বছর ধরে। এই যখন প্রকৃত বাস্তবতা , সেখানে কিভাবে তথাকথিত মুসলিম পন্ডিতরা দাবি করে যে- বাইবেল হলো বিকৃত ও অসম্পূর্ণ আর তাদের কোরান হলো অবিকৃত ও বিশুদ্ধ কিতাব ? গলাবাজি আর মিথ্যা প্রপাগান্ডা করে কি আর চিরকাল সত্যকে ধামা চাপা দেয়া যায়?


মোহাম্মদ ও ইসলাম , পর্ব-১

মোহাম্মদ ও ইসলাম , পর্ব-২
মোহাম্মদ ও ইসলাম , পর্ব-৩
মোহাম্মদ ও ইসলাম , পর্ব-৪
মোহাম্মদ ও ইসলাম , পর্ব-৫