লিখেছেনঃ মুরশেদ

পর্ব – ১ ও ২


হেলে দুলে শিষ দিতে দিতে যে লোকটি এলো তাকে দিয়ে বিশাল লোহার গেটটা খোলা যাবে কিনা আমার খুব সন্দেহ হলো। লোকটা মনে হয় ‘বাংলা’ খায়। মুখ দিয়ে ভক ভক করে গন্ধ বের হচ্ছে। এমন তেল তেলে ভুড়ি বানাতে কত লিটার বাংলা লাগে কে জানে?

– কে আপনি? তার প্রশ্ন করার ধরণটা ঠিক প্রশ্নের মত না। অনেকটা মুখস্ত বুলি আওড়ানোর মত।

– আমি স্বর্গদূত । ভুতেশ্বরের বার্তা দূত।

– আপনার সাথে কে?

-ভুতেশ্বরের নতুন শিষ্য। ঢাকাই মদন ওরফে মদনা।

-পরোয়ানা আছে?

-আছে।

নির্ধারিত প্রশ্নউত্তর পর্ব শেষ হলে প্রহরী আমার দিকে এগিয়ে এলো।

– অভিবাদন হে ভুতেশ্বরের শিষ্য! ভুতেশ্বর ছাড়া কোন ভুত নেই। মদন তাহার চামচা।

-তোমাকেও অভিবাদন।

এরপর কি হল হঠাৎ করে উপুড় হয়ে আমার পদধূলি নিতে লাগলো। আমি বললাম- এই থামো থামো, কি করছ? পদধূলি নেবার কি হল? স্বর্গে এ কোন নতুন রীতি?

– না বস। বার্তাদূতের কাছে হুনছি আপনি ভুতেশ্বরের শিষ্যদের মধ্যে সবচাইতে শিক্ষিত। বি এ ফেল! এর আগে আর কোন শিষ্যের এত পড়ালেখা ছিলনা। আপনাকে নিয়ে স্বর্গবাসীদের অহংকারের শেষ নেই।

– তাই নাকি। আমিতো শুনেছি আমার আগে যিনি শিষ্য ছিলেন তিনি সর্ব কালের, সর্ব যুগের, সর্ব মাপের, সর্ব দেশের, সর্বদিকের, সর্ব ভুতের সর্ব শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি, সম্রাট, যৌবন শ্রেষ্ঠ, যৌন শ্রেষ্ঠ, পুরুষ শ্রেষ্ঠ, মহান …..

– থামেন বস, আর হাসায়েন না। আপনি প্রত্যেক আকাশের উপ্রেই একজন কইরা শিষ্যের সাক্ষাৎ পাইবেন, কিন্ত তারে কোথাও পাইবেন না। তারে কোন আকাশ দেওয়া হয়নি।

-বলেন কি? কারণ?

-তারে ডাইকা আইনা ভুতেশ্বর যা যা বলছিল, সে যাইয়া তার মানুষরে তার উল্টা কইসে। যেমন ধরেন ভুতেস্বর তারে কইল- নারী পুরুষ সমান। একজন পুরুষের জন্যে একজন নারী। সে কাইন্দা কাইট্যা কইল তার জাতির লোকেরা বড়ই নারীবাজ। একটায় তাগো মানান যাইব না। শেষমেশ ভুতেশ্বর তার জাতির পুরুষের জন্যে চারটা পর্যন্ত বিবাহ মঞ্জুর করলেন। অথচ সে দেশে যাইয়া নিজেই ডজন খানেক বিয়া করল। দাসী বান্দি রাখল বেশুমার। আইজ পর্যন্ত তার মুলুকের মানুষের আগনিত বৌ আর বান্দী।

– বার্তাদূত তাড়া দিল। বলল- অনেক হয়েছ। এবার গেট খোল। বেচারা স্বর্গলোকে নতুন এসেছে। এতসব কেলেঙ্কারির কথা জানলে সে শিষ্যত্ব পরিত্যাগ করতে পারে।

-শিষ্যত্ব কি পরিত্যাগ করা যায়? আমার মধ্যে ক্ষীণ আশার সঞ্চার হল।

– যায়। ভুতেশ্বর আজ পর্যন্ত বাঙালিদের মধ্যে কোনো শিষ্য পাঠাতে পারেননি। একবার লালন ফকির নামে এক বাঙালীর কাছে ভুতেশ্বরের বাণী নিয়ে গেছিলাম। সে বাণী তো গ্রহন করলই না, উল্টা এমন বাণী শুনিয়ে দিল যা শুনে স্বর্গরাজ্যে অনেকে নাস্তিক হয়ে গেছে। বড়ই দুঃখের বিষয়।

-বড়ই দুঃখের বিষয়। পাশ থেকে বলল প্রহরী। তার চোখ দুটো ছল ছল করছে।

জানতে পারলাম শুধু প্রহরী নয়, অনেকেই তার পর থেকে আর স্বর্গের উত্তম মদ্য পান ছেড়ে দিয়ে বাঙলা মদ খায়। সেইথেকে ভুতেশ্বরও একজন বাঙালী শিষ্যের ব্যাপারে প্রায় আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।


গেটদিয়ে ঢুকে প্রথম আকাশের উপর চড়ে বসলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতক্ষণ তাও নিচের পৃথিবীটা দেখতে পাচ্ছিলাম। পৃথিবী! আহারে! আমার সাধের ভূতল। সেখানে কত কোলাহল, মানুষের নানা প্রয়জনের কত হাঁকডাক। ঝগড়া আর ভালবাসার কি নিরন্তর মেলবন্ধন!

এখন শুধু পায়ের নীচে খটখটে নীল আকাশ, উপরে দূরে আরও একটি আকাশ যার রঙ কমলা। চারিদিকে কোথাও কোনো জন মানুষ নাই। দূরে একটা ল্যামপোস্টের উপর একখানা সূর্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে পোস্টটার কাছে গিয়ে দেখি একজন মানুষ সটান শুয়ে আছে। বিশাল এক মানুষ, আনুমানিক ৭০ হাত লম্বা। বার্তা দূত বললেন- ঐ যে ওইখানে ভুতেশ্বরের এক প্রাচীন শিষ্য ঘুমুচ্ছে। তার নাম আদিম। বললাম-
-চলেন যাই। ওনার সাথে কথা বলি।

-কী যে বলেন! মাল খেয়ে ঘুমুচ্ছে। এখন হাজার ডাকলেও উঠবে না। স্বর্গীয় মদে এলকোহলের ভলিউম দুনিয়ার মদের ৭০ গুন। স্বর্গের এক পেগ সমান দুনিয়ার ৭০ পেগ। উনি এক বসায় ৭০ পেগ খান। তার পরে ৭০ দিন ঘুমান। স্বর্গের ১ দিন হল দুনিয়ার …….!!

মাথা ঝিম ঝিম করছিল। অঙ্কে আমি বরাবরই কাচা। বললাম- থাক, উনি ৭০ বছর ঘুমান। চলেন আমরা যাই।

-“মদন সাহেব, দাঁড়ান।“ পেছন ফিরে দেখি আদিম উঠে দাঁড়িয়েছেন। হাতে একটা হুইস্কির বোতল। লেবেল দেয়া আছেঃ VAT 69 X 70
বললাম- আপনি ঘুমাননি?

– কিসের ঘুম। দিন রাত মাল খাই আর পড়ে থাকি।
-আর কিছু করেননা?

-আভার খোজ করি। যদি খুজে পাই। কোথায় যে তারে রাখছে শালার ভুতের বাচ্চা!

-ছি ছি! ভুতেশ্বর সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে নেই। পাপ হয়।

– স্বর্গে আবার পাপ কি? এখানে যা খুশী তাই করতে পারবেন। নতুন করে পাপ পুন্য লেখার কোন ব্যাবস্থা নাই। পাপ-পূন্য হল মর্ত্যের বিষয়।

-আপনি তো স্বর্গে বসেই প্রথম পাপ করেছিলেন। জ্ঞান বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেছিলেন। মানুষের প্রথম পাপ। যার জন্যে আমরা সবাই মর্ত্যে গিয়ে শাস্তি ভোগ করছি।

– “হে হে হে! আপনি কচু জানেন।“ খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন তিনি। হাতের বোতলের ছিপি খুলে লাল তরল বেশ খানিকটা গলায় ঢাললেন। তারপর লম্বা একটা ঢেকুর তুলে বললেন- ফল খেলে পাপ হবে কেন? কিসের পাপ? জ্ঞান বৃক্ষ সম্পর্কে কি জানেন আপনি?

– না তেমন কিছু জানিনা।

– এটা স্বর্গের শ্রেষ্ঠ বৃক্ষ। লক্ষকোটি বছরে মাত্র একটাই ফল ধরে। সেই ফলটার লোভেই ছিল ঐ বুড়াটা। কিন্তু আভা খুব বুদ্ধি করে ফলটা পেড়ে নিয়ে আসে। আমরা তা খেয়ে কামশক্তি লাভ করি। ফলাফল অগণ্য বংশধর!

– তার মানে ঐ ফল না খেলে আপনারা নিঃসন্তান থাকতেন?

– ঠিক ধরেছেন। আমরা মানুষেরা বংশ বাড়িয়েছি। তাই মর্ত্যলোকে যেতে পেরেছি। কিন্তু ভুতেশ্বর নিঃসন্তান থেকে গেছে। তাই মর্ত্যে গিয়েও তার কোনো লাভ নেই। তাই কদিন পরপর সেখানে শিষ্য বানায় আর গালগল্প লিখে পাঠায়। বেটা বিরাট সাহিত্যিক।

– কিন্তু তার তো বৌ নাই। ফল খেলেই বা কি লাভ হতো?

– হাসালেন। তার পাজরে কি হাড় হাড্ডি নাই? এক সময় তার বৌ ছিল। অনেক ধর্মেই ভুতেশ্বরীর কথা শুনতে পাবেন। সেটাও কিন্তু মিথ্য নয়।

– এখন উনি কোথায়? স্বর্গে নাকি মর্ত্যে?

– কোথাও নেই। জ্ঞান বৃক্ষের ফল যখন হাতিয়ে নিতে পারলেন না, ভুতেশ্বর তারে আবার হাড্ডি বানিয়ে পিঞ্জরে লাগিয়ে নিয়েছেন। অযথা একখানা আস্ত হাড্ডি নষ্ট করার মত ভুত নয় সে।

মদ্যপ হলেও আদিম লোকটাকে ভালই লাগলো আমার। তার জন্যেই আমরা আজ মর্ত্যের অধিকার পেয়েছি। অগনন বংশ বিস্তার করতে পারছি। তার প্রতি মায়া পড়ে গেল। ধীরে ধীরে বললাম- স্বর্গ কাননে থাকলেই তো পারেন। আরাম আয়েশ, স্বর্গ বালা, মদের নদী, কী নেই সেখানে?

– যাচ্ছেন তো! নিজেই দেখবেন। আমি ভাই এখানেই ভাল আছি। মদ খাই। ঘুমাই। আর আভার খোজ করি। মাঝে মধ্যে আকাশের দরজার ফুট দিয়ে মর্ত্যের সুখী বাসিন্দাদের দেখি। কী সুন্দর করে সাজিয়েছে বিশ্বটারে আমার সাধের বংশধরেরা। গর্বে বুকটা ভরে যায়।

আদিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছাগীর পিঠে উঠতে যাব। এসময় আদিম পিছন থেকে ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন- আপনার মধুমালার জন্যে এই নরাধম আদিমের পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছো।
খানিকটা ভাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।

-আপনি তার কথা জানেন কি করে?

-ভুতেশ্বরও জানে। আজ শুক্লা পক্ষের শেষ তীথি না! এই দিনটাই আসলে ভালবাসার। এই দিনটাই তো মধুমিলনের। এই দিনেই সে ফল খেয়েছিলাম আমি আর আভা। এই দিনে চাঁদ তার সব প্রেম পৃথিবী তে উপুড় করে ঢেলে দিয়ে নিজে শুণ্য হয়ে যায়। মানুষের ভালবাসাবাসির কোন কিছুই আর এই দিনে গোপন থাকে না।

কেমন যেন লজ্জা পেলাম। আর কথা বাড়ালাম না। ছাগীর পিঠে উড়াল দিলাম পরের আকাশ পথে।