দ্বৈরথঃ দুই রথীর প্রত্যক্ষ সমর। দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের প্রকাশ বিভিন্ন মাত্রায়। সেই মাত্রা হতে পারে শারীরিক।

হতে পারে মানসিক।

অথবা হতে পারে এমন এক দ্বন্দ্ব যা শরীর ও মনের পরিমাত্রার পরিবেষ্টনীর একটু বাইরে। খুবই কাছে, তবু ধরা যায় না। দ্বৈরথ আমাদের প্রতিনিয়ত। দ্বৈরথ বাইরের জগতের উদাসীনতার সাথে, দ্বৈরথ নিজের হিপক্রিসির সাথে, দ্বৈরথ আপন অক্ষমতার সাথে।

দুবাই বিমানবন্দরে দূর থেকে তাকে দেখলাম। শ্যামলা, লম্বা চুল। নারী নয়, পুরুষ। আমার থেকে বছর পনেরো কম বয়েস হবে। কোট। লম্বা চুল যা সত্তরের দশককে মনে করিয়ে দেয়। আমার নিজেকে মনে করিয়ে দেয়।

সিনেমায় দেখি, বৈজ্ঞানিক কল্পপকাহিনীতে কিংবা হাস্য-রসাত্মক ভ্রান্তিতিবিলাস নাটকেঃ দুজন লোক, অথচ তারা একই। একই লোক – অথচ দুটি। প্রতিলিপি। তাদের প্রতিটি অপরটিকে নিজের নকল বলে চিনতে পারে। চিনতে পারে আর এখানেই আমার সমস্যা। আমি কি আমার নকল বলে আর একজনকে চিনতে পারব? আমার যতদূর মনে হয় – সমস্ত সম্ভাব্যতা বিচার করে – অন্য লোকটি যে আমার মতই হুবহু দেখতে সেটা আমি শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত হয়ে কখনই বলতে পারব না। কারণ আমি নিজের চেহারা চিনি না। নিজেকে চিনি না – সেটা বললেও ভুল হবে না (কে সঠিক ভাবে নিজেকে চেনে?) এবং হাজার লোকের মাঝে নিজেকে চিহ্নিত করা যে ভীষণ কঠিন কাজ সেই সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ। সেই জন্য যে সব শিল্পীরা নিজেদের সঠিক আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন (বিশেষতঃ ফটোগ্রাফী উদ্ভাবনের আগে) তাদের সূক্ষ্ম বিচারবোধকে বাহবা না জানিয়ে আমি পারি না। এই সব শিল্পীরা সত্যিই মহামানুষ – কারণ নিজের অবয়বকে চিহ্নিত করা, বিশ্লেষণ করা খুবই কঠিন কাজ। কাজেই দ্বৈরথ কথাটি আত্মপ্রতিকৃতি সৃষ্টির সময় প্রযোজ্য – আত্মদ্বৈরথের ওপর কি আছে ? তাই এই ক্ষেত্রে, দুবাই বিমানবন্দরে, দূর থেকে একজনকে দেখে নিজের প্রতিকৃতিকে তার ওপর আরোপ করার মধ্যে ভুল হতেই পারে। উপরন্তু আলোচ্য ব্যক্তিটি যখন এখনকার আমি নয়, পনেরা বছর আগের আমি। পনেরো বছর আগে আমি কি এই রকম দেখতে ছিলাম ?

ছেলেটির লম্বা চুল ও ধূসর কোট আমাকে আমার সোভিয়েত জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সত্তরের দশকের শেষে আমরা তখন ষাটের বেলবটম সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সংকটের সন্তান। সেই সময়কার রুশ দেশে আমরা যারা পড়তে গিয়েছিলাম তাদের মধ্যে দেশ ছেড়ে যেয়ে এক নতুন অনিশ্চয়তায়, শীতল তুষারে ও সোভিয়েত সামাজিক জীবনের মাঝে যে ধরনের আচার গড়ে ওঠার কথা সেই ছেলেটির মাঝে আমি যেন সেটারই প্রতিফলন দেখলাম।

বিমানে উঠে দেখি পারস্য উপসাগর অঞ্চল ফেরত বাঙ্গালীদের দিয়ে সব আসন ও আসনের ওপর জিনিষপত্র রাখবার জায়গা পরিপূর্ণ। জানলার ধারে আমার আসন, নিজের সারিতে এসে দেখি আমার পাশের সিটে বসে আছে – আর কেউ নয় – আমারই প্রতিভূ, আমি নিজে – পনেরো বছর আগে আমি যা ছিলাম।

এরকম কাকতালীয় ব্যাপার তো ঘটতেই পারে – সম্ভাব্যের সীমার মাঝেই কাকতালীয় ঘটনার অবস্থান। যেমন ধরুন সেই বিমানে যদি ২৫০টি আসন থাকে এবং প্রতিটি আসনই যদি পূর্ণ হয়ে যায়, তবে আমার পাশে আমার প্রতিবেশীর বসার সম্ভাব্যতা ২৪৯টি সুযোগের মধ্যে একটি। আপাতঃদৃষ্টিতে সম্ভাব্যতার এই মানটি ছোট হলেও সেটি শূন্য নয়, তবু পৃথিবীর আকাশে যাত্রাপথের এই সমাপতন আমাকে বিস্মিত করেছিল।

বিমান ছেড়ে দিল। স্বাভাবিকভাবেই আমি উৎসুক ছিলাম তার সাথে কথা বলতে। ঢাকা যাচ্ছেন? কোথায় থাকেন? কি করেন? কোথায় পড়াশোনা করেছেন? ইত্যাদি। বাঙ্গালীর কৌতূহল মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি জানার জন্য। অন্য সময় এই কৌতূহল সন্তর্পণে এড়িয়ে চললেও এই ক্ষেত্রে নিজেকে সামলাতে পারলাম না।

জানা গেল সে পড়াশোনা করেছে রুশ দেশে – রোস্তভে। আমি তার পনেরো বছর আগে রুশ দেশে পড়েছি – রোস্তভে নয়, লেনিনগ্রাদে (যা কিনা এখন আবার তার পুরোন নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে পরিচিত)। কাকতালীয়? আমার মত হুবহু দেখতে একটি ছেলে আমারই জীবন রেখা অনুসরণ করে বাংলাদেশ থেকে রুশ দেশে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল। পড়াশোনা শেষ করে সে ব্যবসা সূত্রে পূর্ব ইউরোপে থেকে গিয়েছে – ওয়ারশ, বুদাপেস্ট ও প্রাগে তার অফিস। তার নাম ছিল হাসান। চার ঘন্টার কথোপকথনে হাসান কি নিয়ে ব্যবসা করে জানতে পারলাম না, আমিও এসব নিয়ে তাকে খুব একটা জিজ্ঞাসাবাদ করলাম না।

ঢাকায় নামলাম বেশ রাতে। যথারীতি মাল আসতে প্রচুর দেরী হল। হাসান জিজ্ঞেস করল আমাকে কেউ নিতে আসবে কিনা। বললাম গাড়িতো আসার কথা। তার জন্য কি কেউ আসবে? তার ছোট ভাইএর আসার কথা ছিল, কিন্তু বনানীর বাসায় মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই নাও আসতে পারে। বললাম আমি যাচ্ছি পুরোন ঢাকায়, পথে নামিয়ে দিতে অসুবিধে হবে না।

ঘন্টা দেড়েক পরে মাল নিয়ে বের হলাম। রাত বারোটা বেজে গেছে। গাড়ির চালক ভিড় ঠেলে আমাকে খুঁজে পেল। আধ ঘন্টা পর হাসানের নির্দেশ মত বনানীর একটি বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল। আমি নামলাম না। হাসান অনেক অনেক ধন্যবাদ ইত্যাদি বলে জানলার মধ্যে দিয়ে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল, বলল কার্ড দিয়েছি আপনাকে, যোগাযোগ করবেন। প্রাগ আর বুদাপেস্টে আসবেন আমার কাছে বেড়াতে।

হাসানকে নামিয়ে দিয়ে আমি ভাবলাম জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠকে চিনতে পারে, কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠকে নয়। জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠকে আগলে রাখতে চায়, উপেদশ দিতে চায়। আমার হাসানকে অনেক উপদেশ দেবার ছিল – সম্ভাব্যতার বিচারে অনুরূপদের সাক্ষাৎকার দ্বিতীয়বার হবে না।

এর পরের ঘটনা নিতান্তই cliché। পাঠক বলবেন এত জানাই ছিল, আমারও হয়তো এই গল্পের রাশ টানা উচিত ছিল এখানেই। তবু শেষটুকু না বললে জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠের জীবন রেখা যে কত ভিন্ন তা পরিষ্কার হবে না।

বাড়ী আসলাম। চালক আমার সুটকেশ গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে নামিয়ে ঘরে দিয়ে আসল। আমি বললাম, আর একটা ব্যাগ কই? সে বলল, আপনার বন্ধু তো পেছন থেকে দুটা ব্যাগ নামিয়ে নিয়েছেন।

রাত তখন দেড়টা। বনানী যেতে আমার এক ঘন্টা লাগবে, আর কোন বাড়ীতে হাসান ঢুকেছে সেটাও বলতে পারব না। খুব সকালে উঠে গেলাম। যে বাড়ীতে সে ঢুকেছে ভেবেছিলাম সেখানে আটখানা ফ্ল্যাট। প্রতিটি তলায় অনেকের ঘুম ভাঙ্গিয়ে হাসানের কথা জিজ্ঞেস করলাম। না, দুবাই থেকে তাদের কেউ গতকাল আসে নি। পাশের দু-তিনটে বাড়ীতে খোঁজ করলাম। না, পূর্ব ইউরোপ তাদের জন্য খুবই অচেনা।

হাসান আমার ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। পারলে হয়ত সে ব্যাগটা ফেরত দিত, তার কাছে আমার ঠিকানাসহ কার্ড ছিল। কিন্তু আমার কনিষ্ঠ প্রতিলিপির জীবন রেখার সাথে আমার রেখার যোগাযোগের আর সম্ভাবনা ছিল না। হাসানের রেখে যাওয়া কার্ডটা ভাল করে দেখলাম। সেখানে নাম লেখা আছে আবিদুর রহমান। আবিদুর রহমানের ডাকনাম তো হাসান হতেই পারে। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অফিসের ঠিকানা লেখা। তার মধ্যে ই-মেইলের ঠিকানা দেখে ই-মেইল করলাম। আবিদুর রহমান প্রাগ থেকে উত্তর দিলেন। তাকে বিস্তারিত জানালে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে লিখলেন যে মনে হয় একজন তার চরিত্র চুরি করে বিশ্বময় ঘুরছে। খুবই চিন্তিত হলেন। তবে কোথায় হাসানের মত লোককে কার্ড দিয়েছেন মনে করতে পারেলন না।

পরবর্তীতে বিমানের কথোপকথনটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে স্মরণ করতে চেষ্টা করলাম। মনে পড়ল হাসানকে আমি আমার রাশিয়ায় প্রবাস জীবেনর কথা আগে বলেছিলাম। আমার সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে সে এমন একটা অতীত বানিয়েছিল যার সাথে একাত্মবোধ করতে আমি বাধ্য ছিলাম। কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠকে ঠিকই চিনেছিল, জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠকে নয়। জ্যেষ্ঠ যে নিতান্তই gullible – সহজেই প্রতারিত হতে পারে – সেটা বুঝে নিতে কনিষ্ঠের দেরি হয় নি।

হৃত ব্যাগে আমার স্মৃতি-বিজড়িত অনেক ফটো ছিল। সেগুলোর আঙ্গিকে আর আমার দেয়া কার্ডের বদৌলতে হাসান যে ভবিষ্যতের আর একটা ফ্লাইটে যে আমারই চরিত্র গ্রহণ করবে সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম। তাই ভাবলাম শেষাবধি প্রতিলিপি বা প্রতিফলন আয়না থেকে বের হয়ে মূল বস্তুই হয়ে উঠবে এবং এই কাহিনীরও একটি যথার্থ পরিণতি হবে।

তবুও বলব এই কাহিনীর যথার্থ পরিণতি হয় নি।

চার মাস পর মেজবা হক নামে একজন ই-মেইল করলেনঃ “আপনার কার্ডের ঠিকানা দেখে এই মেইল করছি। আপনি কি গতরাতের সিঙ্গাপুর-ঢাকা ফ্লাইটে ছিলেন? যদি থেকে থাকেন এবং আমার সঙ্গে যদি ঐ ফ্লাইটে আপনার পরিচয় হয়ে থাকে এবং ভুলবশতঃ আমার একটি ব্যাগ আপনার সাথে চলে গিয়ে থাকে, নিচের ঠিকানায় পৌঁছে দিলে মহাকৃতজ্ঞ থাকব।”

মেজবা সাহেবকে লিখলামঃ “ঐ ফ্লাইটে আমি ছিলাম না। তবে না থাকলেও কে আপনার ব্যাগ নিয়েছে সেটা আন্দাজ করতে পারছি, যদিও তাকে আমি চিনি না। তাকে কি আপনি বনানীতে নামিয়ে দিয়েছিলেন? ছেলেটি কি শ্যামলা ঋজু লম্বা চেহারার ছিল?”

মেজবা উত্তর দিলেনঃ “ ছেলেটিকে আমি বনানীর একটি বাড়ীর সামনে নামিয়ে দিই। পরবর্তীতে সেখানে যেয়ে আমি তাকে খুঁজে পাই নি। তবে সে ছিল মাঝারী উচ্চতার ও ফর্সা। হালকা নয়, একটু স্বাস্থ্যবানই বলা চলে। বলতে পারেন আমারই যুবক বয়সের একটি সংস্করণ।”

বুঝলাম আমার মত মেজবা সাহেবও খোঁজ করছিলেন তার অনুজ প্রতিলিপির – সেটা হাসানের বুঝতে দেরী হয় নি। তাই কনিষ্ঠ চরিত্রের সঙ্গে এই দ্বৈরথে মেজবা হকও হেরেছেন – আমারই মতন। আর এখন আর এক মেজবা হক ঘুরছে বিশ্বময় কোন এক অগ্রজের আশায়, যে অগ্রজ কনিষ্ঠ বহুরূপী প্রতিবিম্বের কাছে ধরা পড়বে বিনা বাধায়।
_________________________________