অনেক দিন ধরে অমল পালিত সন্ধ্যা হলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সামনের রাস্তা ধরে গন্তব্যহীন হাঁটে, অনেক দূর চলে যায়। মাঝে মাঝে পথ ভুল হয়, অচেনা মানুষের সাথে দেখা হয়, পথ চিনে নিয়ে ফিরতে হয়। মাঝে মাঝে নিজেই নদীর পারের হাসপাতালের চিকন রাস্তায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে মনে হয়-রাত হয়ে গেছে, ফিরতে হবে!
বাড়ীতে তার তিন বছরের ছেলে স্নিগ্ধ আর সাতাশ বছরের বউ পল্লবী তার জন্যে রোজই সারা সন্ধ্যা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে। প্রায় ই ছেলে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমায়। পল্লবী অবশ্য কোনোদিনই কাঁদে না। কান্নাকাটি, ঠোঁট ফোলানো, অভিমান এসব তার ধাতে নেই। দিনের গৃহপরিচর্যা, সন্ধ্যায় তুলসী তলায় আলো আর ছেলেকে পড়ানো সে অভিযোগ না করেই সম্পন্ন করতে অভ্যস্ত। সকালে সেদ্ধভাত খেয়ে বেরনো অমল পালিত কেন সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরেই বেড়িয়ে যায়, সারা সন্ধ্যা কি করে তা নিয়ে তার কোনো অভিযোগ আছে বলে কেউ বুঝতে পারে না। অমল পালিত রাতে বাড়ী ফিরে একা একা খেয়ে স্ত্রীর শয্যার একপাশে আশ্রয় নেয়। কখনো আচম্বিতে শরীর, কখনো শুধুই একা একা থাকা- এরকম ই তাদের ইদানিংকার যৌথ জীবন।
তাদের যৌথ জীবনের শুরুটা এরকম ছিলো না। অমল তখন সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে একত্রে খেতে বসত। খাওয়া শেষে গল্প করার মতন না হলেও দুজন বেশ অনেক্ষণ বসে এটা ওটা বিষয় নিয়ে কথা বলত। অফিস থেকে কীভাবে এখানে পোষ্টিং নেয়া যায়, পল্লবীর বেড়াল পোষার সখ আছে কী না এসব কথাও হতো। এরকম অনেক কথার পর বাতি নিভতো। শোবার আগে পল্লবীর শাড়ী খুলে ম্যাক্সি পরার মৃদু শব্দে সে বিছানায় উঠে বসত প্রায়ই। পোষাক বাহুল্য উড়ে গিয়ে উত্তাপে নিমজ্জিত হওয়া পর্যন্ত সবই অন্ধকারে। অন্ধকার হলেও সে অন্ধকার খুবই কোমল ছিল অনেকদিন ধরে।
অনেকদিন বলতে সেদিনের আগের দিন পর্যন্ত যেদিন পল্লবী তাদের অন্ধকারের শয্যায় বসে চিকন কন্ঠে জানতে চেয়েছিল-“ একটা সত্য কথা বলবে, তোমার মেজদাদা আত্মহত্যা করেছিলো কেন?”
অমল পালিত স্ত্রীর উষ্ণ স্তন হাতে নিয়ে বরফের মত স্থির হয়ে জমে গিয়েছিলো। সে কথার কোনো উত্তর দেয়নি, সরেও যায়নি। শুধু তারপর থেকে তার সন্ধ্যার পরবর্তী জীবনযাপন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।
পল্লবীর অনেক বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের আগেই সে আত্মহত্যার ঘটনাটি জানত। সে ঠিক করেছিল এই কথা নিয়ে কোনদিন আলোচনা করবে না। অমল পালিতের মেজদাদা এক রাত্রিতে আম গাছের উঁচু ডালে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলেছিল। সকাল বেলা পাড়ার সমস্ত মানুষ জমে গিয়েছিল গাছের নীচে; অমলের মা বুক চাপড়ে কাঁদছিল। খবর পেয়ে অমল বাড়ি ফিরেছিল আহাজারি, কোলাহল আর চিৎকারের মাঝে। আমগাছের দিকে না গিয়ে সে নাকি প্রথমেই মেজবউ কে খুঁজছিলো! মেজবউ সরলার নামে অমলের মায়ের হাহাকার আরো বেড়ে গিয়েছিলো। কেউ একজন তাকে জানিয়েছিল-“দ্যাখো গিয়ে, ঘরের কপাট বন্ধ করে বসে আছে, চোখে একফোঁটা জল নাই!”
অমলকে দেখে সরলা দরজা খুলেছিলো। শুধু দরজা খুললে কারো কিছু বলার ছিল না—সে একেবারে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিল অমলকে। এক উঠোন মানুষের সামনে অমলের বুকে মুখ গুঁজে “ তুমি এসেছ, তুমি এসেছ!” বলে হাহাকার করে কেঁদেছিল অনেক সময় ধরে!
পল্লবী ঠিক করেছিল এ কথা কোনদিন তুলবে না। তারপরও সে ভুলটি করলো। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল! মেজদাদার মৃত্যুর পর দুই বছর সরলা এখানেই ছিল। তার স্নানে যাওয়া কাপড় শুকানো, বাসন মাজার ব্যপারগুলো যথাসম্ভব লোচক্ষুর অন্তরালেই চলত। তার অস্তিত্ব ও ছায়ার কথা বাইরেরে কেউ খুব একটা বুঝতে পারত না। স্বামীর মৃত্যর পর তার চেহারায়, বাক্যালাপে কি ধরণের পরিবর্তন এসেছিল এমন কি কখনও কখনও মা’র পর্যন্ত ঠাহর হতো না। অমল শুধু মাসে একবার বাড়ি আসত মাকে টাকা দিতে এবং ধানিজমির খবর নিতে। প্রতিবারই মায়ের কাছে সে সরলার জন্যে কিছু টাকা রেখে যেত। সরলার সাথে তার দেখা সাক্ষাৎ হতো কিনা তাও নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারবে না। ফলতঃ মেজদাদার মৃত্যুদিনের কাহিনী সবার মনে থাকলেও সে কাহিনী ডালপালা মেলেনি এ বাড়িতে।
পল্লবীর বিয়ের সময় তাই এ পক্ষ ও পক্ষের সবাইকে আনন্দিতই দেখা গিয়েছিল। এ বাড়িতে আসার প্রথম দিনটিতে সরলা তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কপালের মাঝখানে চুমো খেয়েছিল। বলেছিল,’ অনেক কপাল তোমার, অনেক সুখে থাকবে!” বিয়ের পরে পল্লবী অবাক হয়ে দেখেছে অমলের বউদির জন্যে মায়ের কাছে টাকা রেখে যাওয়া, পূজোয়, পয়লা বৈশাখে তার জন্যে রঙ্গিন শাড়ী নিয়ে আসা। সে ভেবেছে স্বাভাবিক ভাবেই সরলাকে তো দেবার আর কেউ নেই। এরকম ভাবার পরও তার বুকের কোথায় যেন একটা তীক্ষ্ণ কাঁটা গাঁথার বেদনা আনুভূত হয়েছে অবচেতনে। সে নিজেকে বলেছে, এরকম হওয়া খুব অন্যায়; অমল পালিত ভাল লোক, তার সাথে উঁচু গলায় কোনদিন কথা বলেনি, তাকে অসম্মান করেনি! মধুর বাক্যবিনিময় তার স্বভাবে নেই, কিন্তু সে পল্লবীর কাছে যথেষ্টই কোমল, দয়াবান! তারপরও ভুলটা করল পল্লবী!
সেই রাতের পর এক সপ্তাহ পার হবার আগেই শ্বাশুড়ী তাকে বলেছে,’ অমল মেজবৌকে বাপের বাড়ী পাঠাতে চায়, কিছু হইছে নাকি, বৌ?” কিছু বলেনি পল্লবী, চুপ করে থেকেছে। বলার আসলে কিছু ছিলনা। এ বিষয়ে সে অমলের সাথেও কোনো আলাপ করেনি। সরলা নিজেই একদিন এসে বলেছে,” মা ঠিক ই বলেছে, আমার এখানে থেকে কিছু হবেনা পল্লবী, বাড়ি গিয়ে বি-এ টা প্রাইভেটে দেব ভাবছি।“
তারপর একদিন সকালে সে তার ছোট ট্রাঙ্কে কয়েকখানা শাড়ী গুছিয়েছে। বাড়িতে অমল ছাড়া তাকে পৌঁছে দেবার কেউ ছিলনা, অমলই পৌঁছে দিয়ে এসেছে তাকে বাপের বাড়ি। চার বছর আগের কথা, তারপর আর সরলাকে দেখেনি পল্লবী। তারপর থেকেই সন্ধ্যায় আর বাড়ি থাকে না অমল পালিত।
শিরীষ গাছের পাতা গলে আসা চাঁদের আলো অমল পালিত কে বাড়ি ফেরার কথা মনে করিয়ে দেয়। চারদিক অন্ধকার করে চাঁদই শুধু মাঝ গগনে জেগে আছে আলোর কথা মনে করিয়ে দেবার জন্যে। অমল পালিতের ছেলের কথা মনে হয়, পল্লবীর কথা মনে পড়ে। মেজবৌকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে তার। লঞ্চঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সরলা। অমল তাকে হাত ধরে লঞ্চে তুলেছিল।
সন্ধ্যাবেলা নিজের বাড়ির দাওয়ায় পৌঁছে সরলা বলেছিল,” আজ তুমি যেও না। কাল বাড়ি যেও!”
অমল পালিতের আবার পথ ভুল হয়-। গভীর রাত্রে সরলার চুড়ি খুলে রেখে আসা হাতের দশটা আঙ্গুল জুড়ে বকুল ফুলের গন্ধ লেগে থাকে।
-‘একবার আসতেই হতো। আজ এলাম!”
সরলা কি বকুল ফুল নিয়ে এসেছিল সেই রাতে! তা না হ’লে এতবছর পরেও সে গন্ধ এত জেগে থাকে কি করে!
অসাধারণ,ছোট্ট পরিসরে গল্পটি চমৎকার হয়েছে
খুব ভাল লাগল।
কিছু প্রশ্ন ছিল, কিন্তু পরে ভাবলাম পাঠকের কিছু প্রশ্ন থাকাই ভাল।
কী যে ভীষণ সত্যি একটা কথা, কখনও কখনও, কোন কোন ক্ষেত্রে! আগেও মন্তব্য করেছিলাম কিনা মনে নেই – গল্পটা চমৎকার লেগেছে!
@স্নিগ্ধা,
পড়েছেন জেনে সত্যি ভালো লাগলো স্নিগ্ধা!
মানব মানবীর কত রকমের বিচিত্র সম্পর্কের কোন ব্যাখ্যা কোনদিন পাওয়া যাবে? মনে হয় না।
তাই জীবন একই সাথে এতো সুন্দর, আবার কখনো বা কদর্য।
লেখায় ৯ তারা (১০) এ, কারন সাহিত্যে পুরো নম্বর কখনো দেওয়া যায় না।
@আদিল মাহমুদ,
ধন্যবাদ! তারা দিয়ে আমি কি করব! ভাবনাগুলো শেয়ার করার যে সুযোগ পেলাম সেটিই কিন্তু আমার কাছে অনেক। ভাল থাকুন।
অমল পালিতের মনের বিক্ষিপ্ত অবস্থার কথা ছোট পরিসরে ভালো ভাবেই ফুটে উঠেছে দিদি।
পড়তে ভালো লাগলো গল্পটি।
@জুয়েইরিযাহ মউ,
ব্যক্তিগতভাবে আমি কিন্তু পল্লবীর প্রেমে পড়ে আছি অনেকদিন যাবৎ! 🙂
মণিকা,
ছোট পরিসরে চমৎকার কয়েকটি চরিত্র চিত্রণ করেছেন।
ভালো লাগলো আপনার গল্পটি।
@গীতা দাস,
ধন্যবাদ, গীতা দি! পড়েছেন এইজন্যে।