সমরেশ বসুঃ এক বেপরোয়া গদ্যের জনক

 

হিমাদ্রিশেখর সরকার

 

       বাংলাসাহিত্যে এখন পর্যন্ত একটি উপন্যাসেরই নাম করা যায় যেটি  নিম্ন আদালত কর্তৃক অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ থাকার পর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দীর্ঘ ১৭ বছর পর মুক্তি পায়সমরেশ বসুর প্রজাপতির কথা বলছিইতোমধ্যে বইটি এক ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছে

 

      কথিত অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ হলেও বইটির প্রধান বৈশিষ্ঠ্য এর ব্যতিক্রমী গদ্যশৈলী১৩৭৪ বঙ্গাব্দের (ঐক্যে১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ) দেশশারদীয় সংখ্যায় যখন নাতিদীর্ঘ এ উপন্যাসটি বেরোয় সমসাময়িককালে কিংবা তারও আগে এরকম উজ্জ্বল গদ্যের উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি নেই

 

      মূলত সমরেশের প্রথাবিরোধী দুঃসাহসিক গদ্য তাকে বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে এক ব্যতিক্রমী আসন দিয়েছেএক অসা ধারণ স্বাতন্ত্র্যে দীপ্যমান তার গদ্যশৈলীতিনি প্রচলিত গদ্যরীতিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে নূতন এক গদ্যের জনক হয়েছেনযে গদ্য অন্য কারও সঙ্গেই মেলে নাএমনকি তার নিজের বইয়েও একটির থেকে আরেকটির ভাষাশৈলী স্বতন্ত্রতার উপন্যাস এবং ছোটগল্পের বিষয়বস্তুও আর দশজন কথাশিল্পী থেকে ভিন্নমধ্যবিত্ত হয়েও মধ্যবিত্তের ভন্ডামি, নোংরামি, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতার স্বরুপ উদঘাটন করেছেন তিনি তার সাহিত্যেতার তীব্র গদ্যের চাবুকে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে মেকি, অন্তঃসারশূণ্য, পমন্ডূক মধ্যবিত্ত চরিত্রউত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার শিল্পাঞ্চলের শিল্প-শ্রমিকেরা যেমন তার লেখার উপজীব্য হয়েছে (তিনি নিজেও প্রথম জীবনে ঐ এলাকায় শিল্প-শ্রমিকদের মাঝে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ছিলেন) তেমনি পাশাপাশি এসেছে গঙ্গাপাড়ের জেলেরাপদ্মা নদীর মাঝি’,‘তিতাস একটি নদীর নামএদুটো কালজয়ী উপন্যাসের পাশে স্থান করে নিয়েছে সমরেশ বসুর গঙ্গা

 

      সমরেশের পাতক’, ‘প্রজাপতি’,‘ বিবর’,‘ স্বীকারোক্তি’, ‘অপদার্থএ পাঁচটি উপন্যাস সম্পর্কে বার বার অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছেএ উপন্যাসগুলো যারা পড়েছেন তারা জানেন দুঃসাহসিক কাহিনীর প্রয়োজনেই এসব উপন্যাসে যৌনতা এসেছেএসব উপন্যাসে যৌনতা কখনও কাহিনীকে অতিক্রম করেনিপ্রজাপতিউপন্যাসের নায়ক সুখেন প্রচলিত ধারার রাজনীতির ধারক-বাহকদের হাতের পুতুলপ্রচলিত ধারার রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা সুখেনকে জন্মদাতা পিতা ও শিক্ষকের প্রতিও বীতশ্রদ্ধ করে তুলেনারীপ্রেমে তার আজন্ম সন্দেহএহেন সুখেন সম্পর্কে অন্যত্র সমরেশ বসু বলেন, ‘আমি সুখেনের স্রষ্টা নইপাঠকরা চিন্তাশীল অনুসন্ধিৎসু মানুষসুখেনের স্রষ্টাদের আপনারা নিশ্চয়ই চিনে নিবেনআমি সুখেনের অন্যতর এক সত্তার সন্ধানী মাত্রযে সত্তার মধ্যে ছিল প্রেম ও উত্তরণের আর্তি’ (‘প্রজাপতি’, আমার কথা, সমরেশ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ১৯৮৯)

 

      সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা’, ‘যুগ যুগ জীয়ে’,‘ মহাকালের রথের ঘোড়া’, ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘বাঘিনী ’,‘শাম্ব ’,‘বিটি রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতি কাফে’,‘ বিপর্যস্ত’,‘ টানাপোড়েন ’ ’ইত্যাদি উপন্যাসে তিনি তার গদ্যরীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেনএকটি উপন্যাসের ভাষাশৈলী তিনি পরবর্তী উপন্যাসে বর্জন করেছেন

 

        ভিন্ন স্বাদের লেখায় সমরেশ ভিন্ন নামের আশ্রয় নিয়েছেনকালকূটছদ্মনামে লেখা তার উপন্যাস অমৃত কুম্ভের সন্ধানেবিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেচলো মন রুপনগরে’, ‘মুক্তবেণীর উজানে ইত্যাদি গ্রন্থ একাধারে উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনীএক অভিনব গদ্যশৈলীতে এসব লেখার বিষয়বস্তুও ভিন্নস্বাদেরবাউল আর সাধু-সন্ন্যাসীদের নিয়ে এসব লেখা বাংলাসাহিত্যে এক আশ্চর্য সংযোজন

 

        সমরেশের বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাসের কাহিনী  অবলম্বনে বাংলা ও হিন্দিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছেএক্ষেত্রে নাসিরউদ্দিন শাহ্ ও শাবানা আজমী অভিনীত পারচলচ্চিত্রটির নাম করা যায়তার ছোটগল্পের তীব্র জীবনবাদিতা কোন কোন ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ছাড়িয়ে গেছে

 

      বাংলা কথাসাহিত্যে সমরেশ বসুর তুলনা সমরেশ বসুইতিনি জন্মেছিলেন ঢাকা জেলার ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুরের রাজানগর গ্রামেজন্ম ১১ ডিসেম্বর ১৯২৪ খ্র্স্টিাব্দআর এ পরিশ্রমী লেখক ১৯৮৮-এর ১২ মার্চ যখন মারা যান তখনও তার লেখার টেবিলে ১০ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস দেখি নাই ফিরে

     

তথ্যসূত্রঃ

০১.প্রজাপতি’,‘আমার কথা ’,সমরেশ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ১৯৮৯

০২.সমরেশ বসু, দুঃসহ সময়ের রুপকার’,তাজুল ইসলাম ফিরোজী, ‘জনকন্ঠ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৩

০৩. দেশ ’, সমরেশ বসু স্মরণ সংখ্যা, কলকাতা ১৯৮৮

০৪.বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, ঢাকা ১৯৯৭