সিরকারের বিদায়ী কামড়
ছগীর আলী খাঁন
জাতীয় সংসদের সিট বণ্টন নিয়ে আউটগোয়িং স্পীকার জমিরউদ্দিন সিরকার যে ভানুমতির খেলা দেখিয়ে গেলেন তা দেখে একটি গ্রাম্য গল্পের কথা মনে পরে গেল। এক গ্রামে এক গিরিঙ্গিবাজ মাতব্বর ছিল, যার কাজই ছিল যতোভাবে পারা যায় লোকের পোঁদে বাঁশ দেয়া। বিচার-শালিশ, মামলা-মোকদ্দমা, কাজিয়া-ফ্যাসাদ ইত্যাদি নানা কাজে মাতব্বরদের দরকার পরে গ্রামে। মাতব্বর সাব যেখানে সুযোগ পান, নিজের কুটবুদ্ধি প্রয়োগ করেন। ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মামলা-মোকদ্দমার পাঁচে পড়ে লোকের জেরবার অবস্থা। তো এহেন মাতবর সাব একদিন বিছানায় পড়লেন, বাঁচার আশা নাই। মাতবর সাব ছেলেদের ডেকে বললেন- ‘বাবারা, আমার আর দিন বাকী নাই। মৃত্যুর পর আমার শেষ ইচ্ছাটা পুরণ করবা তোমরা’?
ছেলেরা বলল- ‘নিশ্চয়ই। কী করতে হবে বলো’।
মাতবর সাব বললেন- ‘জীবনে লোকের অনেক অনিষ্ট করেছি, অনেকের পোঁদে বাশ দিয়েছি। মরার সময় বড়ো অনুশোচনা হচ্ছে এখন। আমার শেষ ইচ্ছা, মৃত্যুর পর আমার লাশের পোঁদে একটা বাঁশ দিয়ে তেরাস্তার মোড়ে টাঙিয়ে রেখো। এতে করে যদি আমার পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হয়’।
বাপের শেষ ইচ্ছা পুরণ না করে তো আর পারা যায় না। সুতরাং ছেলেরা বাপের লাশটি যথানিয়মে তেরাস্তায় নিয়ে টাঙিয়ে দিল। সংবাদ পেয়ে পুলিশ এসে গ্রামের লোকদের ধরে ধরে হাজতে পুড়তে থাকল। তাদের ধারণা- নিশ্চয়ই গ্রামের লোকেরা মাতব্বরকে মেরে ফেলে তেরাস্তায় টাঙিয়ে রেখেছে। লোকেরা বলতে লাগল- ‘ব্যাটা বেঁচে থাকতেও আমাদের জ্বালিয়েছে, এখন মরার পরও জ্বালাচ্ছে’।
প্রেসিডেন্ট, স্পীকার, প্রধান বিচারপতি ইত্যাদি পদগুলি অত্যন্ত সম্মানিত সাংবিধানিক পদ। প্রেসিডেন্ট-স্পীকার যদিও দলীয়ভাবেই নির্বাচিত হয়ে থাকে, নির্বাচনের পর তারা দলীয় আনুগত্যের উর্ধে উঠে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এটাই সভ্য সমাজের বিধি। বিএনপি’র বিগত স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলীর বিরুদ্ধে দলীয় সঙ্কীর্ণতার খুব বড়ো ধরণের অভিযোগ এসেছে বলে আমার জানা নেই। তার সময়েও বিরোধী দলগুলো সংসদ বর্জন করেছে, তবে তা রাজ্জাক আলী সাহেবের জন্যে নয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সিষ্টেমের দাবী আদায়ের জন্যে। ৯৬-০১ মেয়াদকালের এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধেও বড়ো কোন অভিযোগ আছে বলে শুনিনি। তবে সিরকার সাব তার পুর্বসুরীদের ট্র্যাডিশন ধরে রাখতে পারেননি কিংবা চাননি। বিভিন্ন সময়ে তার আচরণ দেখে মনে হয়েছে- তিনি কি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সম্মানিত স্পীকার নাকি বিএনপি নামক একটি দলের তৃতীয় শ্রেণীর মস্তান! শাহ কিবরিয়া হবিগঞ্জে গ্রেনেডের আঘাতে মৃতপ্রায় হয়ে কাতড়াচ্ছে, একটি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে তাড়াতাড়ি ঢাকা আনতে পারলে তার প্রাণটি হয়তো বেঁচেও যেতে পারে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যানে এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির সংবাদ রাতের মধ্যেই সারা বিশ্বের লোক জেনে গেছে, জানতে পারেননি শুধু একজন। তিনি আর কেউ নন- জনাব জমিরউদ্দিন সিরকার, জাতীয় সংসদের অভিবাবক হিসেবে সর্বাগ্রে যার জানার এবং এ্যাকশনে যাওয়ার কথা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন- ঘটনাটির কথা তিনি শুনতে পেয়েছেন পরের দিন সকালে সংবাদপত্রের পাতায়! শুধু কি তাই, ঘটনাটি নিয়ে সংসদে সামান্য আলোচনা বা সাধারণ একটি নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করার সুযোগ দিতেও অস্বীকার করেন জ্বনাব সিরকার।
একুশে আগষ্টের গ্রেনেড হামলার কথায়ই ধরা যাক। তারই পরিচালিত সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রীর জীবননাশের জন্যে হামলা চালানো হয় যার ফলে তেইশ জন নিরীহ নরনারী প্রাণ হারায়। এত বড়ো একটি ঘটনা সভ্য সমাজের আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই, তবে সিরকার সাবের ভাবচক্কর দেখে মনে হয়েছে যে তার কাছে কোন ঘটনাই না এটি। যথারীতি এই ঘটনার উপরেও সংসদে কোন আলোচনা করার সুযোগ দেননি তিনি, যার পরিণতিতে বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াক আউট করার একটি মোক্ষম অজুহাত পেয়ে যায়। যে সংসদে এত বড়ো একটি ঘটনার উপর আলোচনা করার সুযোগটি পর্য্যন্ত নেই, সে সংসদে গেলেই বা কি আর না গেলেই বা কি- বিরোধী দলের এই যুক্তির সারবত্তা কি অস্বীকার করা যায়?
গত দু’বছর সংসদ ছিল না, তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে সংসদ-স্পীকারের চেয়ারটির শোভাবর্ধন করে বিরাজমান ছিলেন তিনি। চেয়ার আছে, সুযোগ সুবিধা সবকিছু পুরোমাত্রায় আছে, শুধু কাজকাম নাই। সময় কাটে কী করে? সুতরাং তিনি জোট আয়োজিত বিভিন্ন সভাসমিতিতে বিপ্লবী ভাষণ দিতে শুরু করলেন যা শুনলে কারও মনে হতে পারে যে জাতীয় সংসদের সম্মানিত স্পীকার নয়- ভাষণ দিচ্ছে বিএনপি’র কোন থার্ডগ্রেড ক্যাডার। ফলও হাতে হাতে পেয়েছেন। পঞ্চগড়ের যে সিটটিতে গত তিন তিনটি নির্বাচনে বলতে গেলে মৌরুসী পাট্টা গেড়ে বসেছিলেন তিনি, একজন অখ্যাত প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। একজন সিটিং স্পীকারের এই লজ্জাজনক পরাজয়ের ভেতর নিশ্চয়ই কোন মেসেজ আছে, তবে মেসেজটিকে নেগেটিভভাবেই নিয়েছেন সিরকার। মরার আগের শেষ কামড়টি দিয়ে গেলেন তিনি; সমস্ত নিয়মনীতি ভঙ্গ করে হুইপদের মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে তার দলকে সামনের সারির দশটি আসন বরাদ্দ করে গেলেন। অথচ গত সংসদে এই স্পীকারই আওয়ামী লীগের ৬২ আসনের বিপরীতে তাদেরকে সামনের সারির আটটিমাত্র আসন দিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তার সদম্ভ উচ্চারণ- ‘আমার ক্ষমতা আছে দিলাম। পারলে আগামী স্পীকার এসে বদলাক’।
স্পীকার হিসেবে সিরকার সাবের মৃত্যু ঘটেছে, তবে মরার আগে গ্রাম্য মাতব্বরের পথ ধরে শেষ কামড়টি দিয়ে গেছেন তিনি। বর্তমান স্পীকার আব্দুল হামিদ বলতে বাধ্য হয়েছেন- ‘বিগত স্পীকার আমার কাঁধে একটি ঝামেলা চাপিয়ে দিয়ে গেছেন’।
এই ঝামেলার সুযোগটি সিরকারের দল কতটা সফলতার সাথে ব্যবহার করে সেটিই এখন দেখার বিষয়। তার দল সুযোগটি লুফে নিয়েছে এবং এখন পর্য্যন্ত সংসদ বর্জন অব্যাহত রেখেছে। আশা আছে, আওয়ামী লীগ ঔদার্য্য দেখিয়ে দু’একটি সিট বাড়িয়ে দেবে না এবং বর্জন অব্যাহত রাখার সামনে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না। তবে যদি বাই চান্স আওয়ামী লীগের সুমতি হয় এবং সীটসংখ্যা বাড়িয়ে দেয়, তবে উপায়? সিরকারের বিদায়ী কামড়ের অপমৃত্যু ঘটবে কি?
মনে হয় না। সিরকার সাবের মতো প্রথিতযশা বহু লোক ম্যাডামকে ঘিরে আছেন। নির্বাচনে ডাব্বা মারার ফলে ম্যাডামকে সময়োচিত এডভাইজ দেয়া ছাড়া তাদের হাতে বর্তমানে কোন কাজকাম নাই। বর্জনকাজের জন্যে দু’একটি ছুতো খুঁজে বার করা তাদের জন্যে কোন বিষয় না। পরম বশংবদ যে রাষ্ট্রপতি পাঁচটি বছর ধরে বিএনপি’র খেদমত করে গেলেন, ম্যাডামের পারমিশন ছাড়া যে লোক নাকি বাথরুমে ঢুকতেও অস্বস্তি ফিল করতেন এবং এক এগার নামক সিডরটি আনয়নের জন্যে বলতে গেলে এককভাবে দায়ী যিনি, সেই রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের দাবী তুলে তারা অলরেডী ওয়াকআউট করে ফেলেছেন। আগামী দিনগুলিতে ঘটনা আরও ঘনীভুত হবে এবং ওয়াকআউট করার উপযোগী পর্য্যাপ্ত ইস্যু পাওয়া যাবে ইনশাল্লাহ।
কথায় আছে- মলমুত্র ত্যাগ ছাড়া আর কোন ত্যাগ বাঙালীর ধাতে সয় না। কথাটা আমরা ইতিমধ্যেই মিথ্যা প্রমান করেছি, প্রমান করেছি যে সংসদ-বর্জন তথা সংসদ-ত্যাগেও যথেষ্ট পারঙ্গম আমরা।
একটামাত্র সমস্যা আছে। এক এগার’র পরে একটা অদৃশ্য শক্তি বুনো ষাড়ের মতো সাজানো বাগানে ঢুকে সব তছনছ করে দিয়ে গেছে, বিদগ্ধ হেভী ওয়েটদের ধরে নাজিমুদ্দিন রোড ও মানিক মিয়া আ্যভিন্যু’র লাল দালানে ঢুকিয়ে তাদের মনে বিষম ত্রাসের সৃষ্টি করে দিয়ে গেছে। সরকারীভাবে শনাক্ত না হলেও সেই ষাড়টি যে বহাল তবিয়তে আছে তা সবাই জানে।
সুতরাং কথায় ও কাজে আরেকটু সংযত আচরণ দেখালে তা উভয় পক্ষের জন্যেই ভাল। দেশের জন্যেও।
(সিরকার পদবীটি সরকার শব্দের ইংরেজী পদায়ন কিনা আমার জানা নেই। ডেইলি ষ্টার, বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর ইত্যাদি ইংরেজী সংবাদ মাধ্যমগুলিতে এভাবেই লেখা হয়। অনেক বাংলা শব্দ আছে যেগুলিকে ইংরেজীতে লেখার সময় একটু বেঁকিয়ে লিখলে ভ্যানিটি বেড়ে যায়। যেমন- আব্দুল করিম যখন ইংরেজীতে Abdel Carrim হয়, তার ওজন ও মর্য্যাদা দুটোই বাড়ে। একটু ইংরেজ ইংরেজ গন্ধ ছড়ায়, মনে হয় যেন ক্যারিনার সাক্ষাৎ মাসতুতো ভাই। ডেইলি ষ্টার সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করে সরকার শব্দটিকে Sircar হিসেবে রূপান্তর করেছে কিনা জানি না। তবে এজন্যে কোন অপরাধ হয়ে থাকলে মাফি মাংতা। আফ্টার অল তিনি আমাদের জাতীয় পরিষদের অভূতপুর্ব স্পীকার তো বটে।)
ভাটপাড়া, সাভার, ঢাকা।
তারিখ- ২রা ফেব্র“য়ারী,২০০৯।
Contemporary and relevent article, should be published on national daily. Many thanks.