বিলায়েতনামা

 

ফরিদ আহমেদ

 

এ যুগের বিচক্ষণ ও দক্ষ ব্যক্তিদের যেন অবিদিত না থাকে যে ভাগ্যক্রমে এই অধমকে চাকরি ব্যপদেশে ইংল্যান্ড যাত্রা করতে হয়েছিল। সমুদ্রে ও নানা দেশে যে আশ্চর্য ঘটনা ও বৈশিষ্ট সে লক্ষ্য করেছে তার বিবরণ অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হবে তাতে সন্দেহ নাই।       – মির্জা ইতিসামুদ্দীন।

 

থ্যাংকস গিভিং ডেতে বীর বিক্রমে হামলা চালিয়েছিলাম ইরতিশাদ ভাইয়ের বাসায়। প্রেসিডেনশিয়াল পার্ডন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতভাগ্য এক তরুণ টার্কির সুস্বাদু স্বাদ নিতে। বিপুল খানাপিনা এবং জম্পেস এক ম্যারাথন আড্ডার শেষে হঠা করেই ইরতিশাদ ভাই জিজ্ঞেস করলেন যে বিলায়েতনামা নামের বইটা আমি পড়েছি কিনা। আমার যে পড়াশোনার মান তাতে উত্তর না বোধক হওয়াটাই অতি স্বাভাবিক। (আমিতো আর অভি বা ইরতিশাদ ভাই নই।) আমার মাথা ডাইনে বায়ে আনুভূমিক ঘুরতে দেখে শেলফ থেকে লাল রং এর পুরনো একটা বই বের করে আমার হাতে গছিয়ে দিলেন তিনি। ছোটখাটো একটা ভূমিকা দিতেও কার্পণ্য করলেন না। বললেন যে, এই বইটা বিলেত ভ্রমণকারী কোন ভারতীয়ের লেখা প্রথম ভ্রমণ কাহিনী। এবং সেই ভারতীয় মূলতঃ আমাদের বঙ্গ দেশেরই এক বাঙালি মুসলমান। নদীয়া জেলার পাঁচপুর গ্রামের মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন। শিক্ষিত ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে যারা ইয়োরোপ ভ্রমণ করে ভ্রমণ-কাহিনী লিখে গেছেন তিনি তাদের মধ্যে সর্ববপ্রথম। আড়াইশো বছর আগে ১৭৬৫ সালে এক কূটনৈতিক মিশন নিয়ে বিলেতের মাটিতে পা রেখেছিলেন এই বাঙালি তরুণ।

 

শুনে স্বাভাবিকভাবেই বইটা পড়ার ব্যাপারে বিপুল আগ্রহ তৈরি হয়ে গেল তাক্ষণিকভাবেই। এমনিতেই প্রাচীন মানুষদের প্রতি আমার কৌতুহল সীমাহীন। কাজেই এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না ভেবেই বইটাকে বগলদাবা করে ফিরে এলাম বাসায়। তারপর অবশ্য নানা উছিলায় পড়া হয়ে উঠছিল না আর কিছুতেই। আজ পড়বো কাল পড়বো করতে করতে কেটে গেলো প্রায় সপ্তাহ দুয়েক। গতরাতে অবশ্য সব অজুহাতকে জোর করে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম গোটা বইটা।

 

 

চিত্র ১: ১৯৮১ সালে মুক্তধারা কর্তৃক প্রকাশিত বিলায়েতনামার প্রচ্ছদ

 

ক্ষীণদেহী বই। কাজেই সময় বেশি লাগেনি পড়তে। পড়ার পর প্রথম যে অনুভূতি হলো তা হচ্ছে এই বইটা আমার হাতে আসতে এত দেরি হলো কেন? একজন দুরন্ত দুঃসাহসী, বিদ্বান এবং দুর্দান্ত বুদ্ধিমান তরুণ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অচেনা এক দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানুষকে অসীম কৌতুহল নিয়ে পর্যবেক্ষন করেছেন এবং সেই পর্যবেক্ষণকে সহজ সরল ভাষায় বর্ণনা করে গেছেন। ভিন্ন সেই সমাজ ব্যবস্থা এবং সংস্কৃতির সাথে তার নিজের দেশের সমাজ ব্যবস্থা এবং সংস্কৃতির তুলনাও করেছেন তিনি। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন বিস্ময়কর মুক্তমন নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনার বর্ণনা এবং বিশ্লেষণ হয়তো খুব উচ্চমার্গের হয়নি। হয়তো হয়ে গেছে সরলরৈখিক, সাদামাটা এবং শিশুসুলভ (Naïve)। কখনো কখনো আজকের যুগের বিচারে কিছুটা বর্ণবাদীও বৈকি।  কিন্তু সেই সরলরৈখিক সাদামাটা বর্ণনাটাই পাঠকের মনে গেঁথে যাবে শুধুমাত্র তার অকপট সারল্য এবং আন্তরিক বর্ণনার কারণে। মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র সাদা চোখে তিনি যা দেখেছেন তাকেই বর্ণনা করে গেছেন তার নিজস্ব অবস্থান থেকে, তার নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে। কোন বইয়ের জ্ঞান বা গবেষণাগ্রন্থের সাহায্য তিনি পাননি তার বিশ্লেষণকে সম্মৃদ্ধ এবং নিখুঁত করার জন্য। এ ছাড়া ইংরেজী ভাষাটাও তিনি জানতেন না। আর তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে ঘটনাপ্রবাহকে নির্মোহভাবে বিচার করার জন্য দূর থেকে পাখির চোখে দেখার যে সুযোগ তা তিনি পাননি। বিলাতী সমাজে তার বিচিত্র বেশভূষা এবং গাঢ় গাত্র বর্ণ এবং ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের অসীম কৌতুহল প্রতিনিয়ত তাকে অনায়াসে ঠেলে দিয়েছে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে।  

 

 

চিত্র ২: লণ্ডনে আঁকা মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীনের প্রতিকৃতি।

 

ভারতবর্ষীয় একজন মুসলমানের চোখ দিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুধু ইংল্যান্ডের চিত্রায়নই তিনি করেননি, ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যখন ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে ব্রিটিশ অধীনে চলে যাচ্ছ্‌ সেই পালাবদলের সময়টাও মূর্ত হয়ে উঠেছে তার লেখায়। নিঃসন্দেহে ইতিহাস সচেতন পাঠকদের জন্য তা দারুণ চিত্তাকর্ষক এবং রোমাঞ্চকর।

 

বক্সারের যুদ্ধের পরের বছর অর্থা১৭৬৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কর্তৃক প্রেরিত কূটনৈতিক দলের অন্যতম সদস্য হয়ে তিনি ইংল্যান্ড যান এবং প্রায় তিন বছর পর দেশে ফিরে আসেন। বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ১৭৮৪ সালে তিনি তার অভিজ্ঞতা ফার্সী ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। ফার্সী তখন ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের সরকারী ভাষা এবং তিনি ছিলেন সেই ভাষায় সুপণ্ডিত ব্যক্তি। ভ্রমণ বৃতান্ত গ্রন্থাকারে লেখার কারণ তিনি নিজেই এভাবে উল্লেখ করেছেনঃ

 

হিজরী ১১৯৯ (১৭৮৪ খ্রীঃ) সনে। যখন এই দিন লেখক অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল, চারিদিকের বিশৃঙ্খলায় যখন সে দুর্দশাগ্রস্থ এবং তার মন অশান্ত ও তার চিন্তাশক্তি লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল, তখন বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে (এই বৃতান্ত) লিখতে বাধ্য হয়।

 

মূল বইটির নাম ছিল শিগার্ফ-নামা-এ-বিলায়েত। বইটি কখনো ছাপা হয়নি এবং এর পাণ্ডুলিপিও খুব বেশি সংখ্যক নেই। ১৮২৭ সালে ক্যাপ্টেন জ়ে, ই, আলেকজাণ্ডার এর ইংরেজী অনুবাদ করেন। কিন্তু তা ছিল কাটছাট করা এবং ত্রুটিপূর্ণ। সেই ইংরেজী অনুবাদটিও এখন দুস্প্রাপ্য। ঢাকার হাকিম হাবিবুর রহমান তার সম্পাদিত উর্দু মাসিক পত্রিকা যাদুতে সেই পান্ডুলিপির বিষয়ে সর্বপ্রথম দৃষ্টি আকর্ষন করেন ১৯২৩ সালে। এর ফলে কলকাতায় প্রবাসী এবং মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ভ্রমণ কাহিনীর বিষয়ে কৌতুহল প্রকাশ করা হয় এবং মূল পাণ্ডুলিপির অনুসন্ধান করা উচিত বলে মন্তব্য করা হয়। পরে ক্যাপ্টেন আলেকজাণ্ডারের ইংরেজী অনুবাদের ভিত্তিতে আলতাফ হোসেন নামের এক ভদ্রলোক স্টেটম্যান পত্রিকায় ইতিসামুদ্দিনের উপর পূর্নাঙ্গ একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৯৩৪ সালে স্টেটম্যানের সাথে এক সাক্ষাকারে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কয়েকটি মূল পাণ্ডুলিপির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন।

 

সৌভাগ্য বাঙালি পাঠকদের। ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে ফার্সী পাণ্ডুলিপির তালিকাভুক্তির করার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ এ, বি, এম হবিবুল্লাহ শিফার্গ-নামা-এ-বিলায়েতের সন্ধান পান। তিনি এশিয়া সোসাইটি, বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা জাদুঘরের মহাপরিচালকও ছিলেন একসময়। মূল পাণ্ডুলিপির অনুসরণে তিনিই এর বাংলা অনুবাদ করেন বিলায়েতনামা নামে। মুক্তধারা তা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে ১৯৮১ সালে।

 

মীর জাফরের নিজামতকালে মুন্সী সলিমুল্লাহ এবং মুন্সী মির্জা কাসিমের সাহচর্যে ইতিসামুদ্দীন লেখাপড়ায় দক্ষতা অর্জন করেন। নবাব কাসিম আলি খানের আমলে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর মেজর পার্কের অধীনে চাকরি নেন। বীরভূমের রাজা আসাদুজ্জামানের সাথে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর যুদ্ধে মেজর পার্কের সাথে তিনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই যুদ্ধের পর মেজর পার্কের সাথে তিনি আজিমাবাদে গিয়ে দিল্লী থেকে বিতারিত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে সাক্ষা করার সুযোগ পান।

 

বক্সারের যুদ্ধে অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলা, সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম, এবং মীর কাসিমের সম্মিলিত বাহিনী ইষ্ট ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বাহিনীর কাছে পরাজিত হলে এলাহাবাদে শান্তি চুক্তির জন্য সকল পক্ষকে ডাকা হয়। এই সময় ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর দায়িত্বভার হাতে নিয়ে লর্ড ক্লাইভ দ্বিতীয়বারের মত বাংলাদেশে আসেন।

 

এই শান্তি চুক্তির সময়েই সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম সজলনেত্রে লর্ড ক্লাইভের কাছে তাকে দিল্লীর সিংহাসনে বসানোর জন্য ইংরেজ সৈন্যদের সহযোগিতা কামনা করেন। সম্রাটের ক্রন্দনে দ্রবীভূত ক্লাইভ তাকে জানান যে, ইংল্যাণ্ডের রাজা এবং কোম্পানীর হুকুম ছাড়া তার ইংরেজ সৈন্য সরবরাহের কোন ব্যবস্থাই করতে পারবেন না। ফলে, বাদশাহের ইচ্ছানুসারে ইংল্যাণ্ডের রাজার কাছে প্রেরণের জন্য একটি চিঠি খসড়া তৈরি করা হলো এবং সেই চিঠির সাথে রাজার জন্য উপঢৌকন স্বরূপ এক লক্ষ টাকা পাঠানোরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। পরে কোলকাতায় সেই চিঠি চূড়ান্তভাবে লেখা হলো এবং বাদশাহী সীলমোহর দিয়ে তা ক্যাপ্টেন সুইনটনের হাতে ন্যস্ত করা হলো ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সম্রাটের তরফ থেকে ফার্সী ভাষায় একজন দক্ষ লোক প্রয়োজন হওয়াতে মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীনকে নির্বাচিত করা হয়। তারুণ্যের উসাহে এবং ভাগ্যের টানে ইতিসামুদ্দীনেরও ইংল্যাণ্ড যাত্রার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠেছিল। কাজেই তিনি কালবিলম্ব না করে ক্যাপ্টেন সুইনটনের সাথে ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজে চড়ে বসেন।

 

জাহাজে চড়ার এক সপ্তাহ পরে ক্যাপ্টেন সুইনটন তাকে জানান যে, সম্রাটের চিঠিটা লর্ড ক্লাইভ তার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছেন। বেনারস থেকে সম্রাটের উপঢৌকন এসে পৌঁছায়নি বলে শুধুমাত্র চিঠিটা নিয়ে যাওয়া সুবিবেচনার কাজ হবে না বলে ক্লাইভ মত দিয়েছেন। পরের বছর সম্রাটের উপহারসহ চিঠিটা তিনি নিজেই রাজার কাছে নিয়ে আসবেন বলে অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন। এই কথা শুনে ইতিসামুদ্দীন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এবং স্পষ্টতই বুঝতে পারলেন যে এর কোন গূঢ় অর্থ আছে এবং এর ফলে এই কঠিন এবং বিপজ্জনক যাত্রা নিস্ফল হতে বাধ্য। জাহাজের কষ্ট এবং যাত্রার বিপদ সব সহ্য করে ভগ্ন মনে ছয়মাস পরে ইংল্যাণ্ডে যেয়ে পৌঁছান তিনি।

 

এর পর শুরু হয় অপেক্ষার পালা, সেই চিঠির জন্য। বছর দেড়েক পরে ক্লাইভ হাজির হলেন ইংল্যাণ্ডে। ধূর্ত বণিক বাদশাহের প্রেরিত উপঢৌকন নিজের নামেই রাজার কাছে পেশ করে রাজার অনুগ্রভাজন হলেন। আর বেমালুম চেপে গেলেন সম্রাটের প্রেরিত চিঠির কথা। কি কারণে ক্লাইভ এই চিঠির কথা গোপন করেছিলেন পরে অবশ্য তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। বাংলা দখল নিয়ে ইংল্যাণ্ডের রাজা এবং ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর মধ্যে যে বিবাদ চলছিল, সেই বিবাদে কোম্পানীর স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতেই ক্লাইভ এই অপকর্মটি করেছিলেন।

 

ক্যাপ্টেন সুইনটন মির্জা ইতিসামুদ্দীনকে আরো তিন চার বছর ইংল্যাণ্ডে রাখার চেষ্টা করেন। তার জন্য আর্থিক সুব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। কারণ সেই সময় ইংল্যাণ্ডে ফার্সী ভাষায় অভিজ্ঞ কেউ ছিল না। কোম্পানীর বাংলা বিজয়ের কারণে ইংল্যাণ্ডের অনেক লোকেরাই তখন ফার্সী শেখার জন্য দারুণ আগ্রহী ছিল। কিন্তু দেশ ও আত্মীয় স্বজনের বিচ্ছেদ-বেদনা তাকে এত অধীর করে তুলেছিল যে তিনি তাতে রাজী হননি। দেশের প্রতি তার অপরিসীম মমতা ফুঁটে উঠেছে এই রকমভাবেঃ

 

সুলেমানের সিংহাসন অপেক্ষা নিজ জন্মভূমির মমতা মহত্তর। জন্মভূমির কাঁটা (বিদেশের) সুবাসিত ফুল অপেক্ষাও মধুরতর।

 

শেতাঙ্গ রমণী বিয়ে করার প্রস্তাবও করা হয়েছিল তাকে। তার জবাবে তিনি বলেছিলেন যে, আমি যাকে বিয়ে করতে চাইবো সে আমাকে বিয়ে করবে না। আর যারা আমাকে বিয়ে করতে চাইবে তাদেরকে আমি করবো না। কারণ আমার পক্ষে নীচু বংশে বিয়ে করা সম্ভব নয়।

 

বিলাতে নেমে অবশ্য লোকজনের কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে গেলেন তিনি। এর আগে চাঁটগাইয়া এবং ঢাকাইয়া হতদরিদ্র খালাসিদেরকেই দেখেছে তারা। কিন্তু ইতিসামুদ্দীনের মত হিন্দুস্থানী জমকালো পোষাক পরা কাউকে তারা দেখেনি। সেখানকার লোকজনদের ভারতবর্ষীয়দের চাল-চলন ও পোশাক-পরিচ্ছদের কোন জ্ঞানই ছিল না। ফলে তারা তাকে বাংলাদেশের একজন গন্যমান্য ব্যক্তি বলে মনে করে নিয়েছিল। এমনকি কেউ কেউ তাকে বাংলার নবাবের ভাই বলে মনে করে দূর দূরান্ত থেকে তাকে দেখার জন্য আসতো। তিনি শহরে বেড়াতে বা তামাশা দেখতে বের হলে উলটো তাকে ঘিরেই তামাশা জমে উঠতো। বহু লোক তার সাথে সাথে ভীড় করে চলতে থাকতো। অনেকেই জানালা দিয়ে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। বালক-বালিকা এবং যুবক যুবতীতা দৌঁড়ে বাড়ীর দোতলায় তিনতলায় গিয়ে পুরুষদের খবর দিত চিকার করে এই বলে যে, তাড়াতাড়ি এসো, দেখবে একজন কালো মানুষ যাচ্ছে। আর সেই ডাক শুনে গৃহকর্তারা বাইরে এসে তাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো এবং আশ্চর্য হতো। শিশু ও বালকেরা তাকে ব্লাক ডেভিল মনে করে ভয়ে তার কাছে আসতো না। তবে মাস দুয়েকের মধ্যেই লোকজনের তার সম্পর্কে অহেতুক মনে যে আতংক ছিল তা দূর হয়ে যায় এবং তারা তার সাথে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ কৌতুক এবং রসিকতা করা শুরু করে। অনেক মহিলাই রাস্তাঘাটে তাকে দেখে বাজারী মেয়েদের মত রসিকতা করে বলতো, প্রানেশ্বর, একটি চুম্বন দাও

 

বাঙালির আত্ম-প্রশংসা এবং বাগাড়ম্বর করার বদ অভ্যাস সেই মধ্য যুগেও ছিল। এর বিপরীতে বিলাতের লোকজনদের সযত্নে আত্মপ্রশংসা পরিহার করা দেখে অবাক হয়েছেন তিনি। যুদ্ধ জয়ে দারুণ পারদর্শিতা ও বীরত্ব প্রদর্শনের পরেও ইংরেজ সেনাধক্ষ্যরা নিজেদের ভূমিকাকে লোক সম্মুখে বলা থেকে বিরত থাকতেন। এমনকি কেউ যদি তাদের সামনে প্রকাশ্যে তা বলতো তাহলে তারা লাজরাঙা হয়ে মাটির সাথে মিশে যেতেন। এর বিপরীতে সামান্য শৌর্য বীর্য প্রদর্শন করে তখনকার হিন্দুস্তানী সিপাহী বা সেনাধক্ষ্যরা নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যেতেন। যেখানে চাটুকারিতা এবং তোষামোদকে বিলাতে ঘৃণ্য চোখে দেখা হতো সেখানে ভারতবর্ষে তা ছিল খুবই প্রচলিত।

 

নিজেদের কৃতিত্ব বা শৌর্যবীর্য নিয়ে দর্প করা ইংরাজদের চরিত্র-বিরুদ্ধ। যারা এ রকম করে তাদেরকে ওরা নিন্দনীয় মনে করে। কখনো যুদ্ধের কথা উঠলে কোনও অধিনায়ক, যে সুকৌশল ও বীরত্বের বলে যুদ্ধ করেছে, সে যুদ্ধের কেবল বস্তুতান্ত্রিক একটা বর্ণনা দিয়ে যাবে, নিজের ভূমিকা মোটেই উল্লেখ করবে না। সে মজলিশের কেউ যদি অধিনায়কের প্রশংসা বা তার কৃতিত্বের কথা বলতে থাকে, তা হলে সে অধিনায়ক অত্যন্ত অপ্রতিভভাবে নিজের পায়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চুপ করে বসে থাকে, আর লজ্জায় ঘামতে থাকে। তাদের সম্মুখে তারিফ করা ইংরাজরা পছন্দ করে না। কেউ এ রকম করলে ওরা তাকে খোশামুদে মিথ্যাবাদী মনে করে। এ জন্য এদের মধ্যে খোশামদ করার রীতি নেই। সব দেশে খোশামদ ও আত্মভরিতাকে বুদ্ধিমান লোকেরা ঘৃণ্য মনে করে; কেননা তা কাপুরুষ ও নীচ প্রকৃতির লোকের কাজ। কিন্তু হিন্দুস্তানের সেপাই ও সর্দাররা আজকাল আস্ফালন ও চাটুকারিতাকে গৌরবের একমাত্র উপজীব্য বলে মনে করে। যেমন, কেউ যদি অতি কষ্টে ও বহু চেষ্টার পর একটা শৃগাল মারে তাহলে সে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকে আজ আমি এক বিরাট সিংহ শিকার করেছি, আর বীরত্বব্যঞ্জক অঙ্গভঙ্গি করে, বুক ফুলিয়ে গোঁফে তাও দিতে থাকে, আর এমন ভাব দেখায় যে অন্য কারও সাহস তার সমতুল্য নয়, এমনকি মহাবীর রুস্তমও তার কাছে বালক মাত্র।

 

 

মির্জা ইতিসামুদ্দিনের পর্যবেক্ষণ এখনকার যুগের জন্যেও সমানভাবে প্রযোজ্য। আত্ম-প্রশংসা এবং আত্মম্ভরিতা থেকে এখনো আমরা মুক্তি পাইনি। এখনো সেই নিজের ঢোল নিজে বাজানোর প্রবণতা দূর হয়নি আমাদের। কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন যে ঢোলটা যেহেতু আমার, কাজেই বাজাতেও হবে আমাকেই। এই অন্তর্জালেই দেখি শিশুসুলভ আবোল তাবোল কবিতা লিখে কেউ কেউ নিজেই নিজের পরিচয় দেন স্বনামধন্য বিশিষ্ট প্রবাসী কবি বলে। কেউ কেউ আবার দুই পাতা ভুলভাল এবং অসংলগ্ন গদ্য লিখে ফুটনোটে নিজেকে খ্যাতিমান কথাশিল্পী বা জাতীয়, আন্তর্জাতিক কিংবা মহাজাগতিক বিবিধ গ্রন্থের প্রণেতা বলে দাবি করে বসে থাকেন। আচ্ছা, ভাল কথা! আন্তর্জাতিক গ্রন্থ জিনিষটা আসলে কি? 😆

 

বিলাতের লোকজনের সন্তানকে শিক্ষাদান এবং বাংলাদেশের লোকজনদের সন্তানকে শিক্ষাদানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছিলেন মির্জা ইতিসামুদ্দীন। কীভাবে অন্ধ অপত্য স্নেহের কারণে বাংলাদেশের বাবা মায়েরা সন্তানকে সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে সে বিষয়ে খুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন তিনি।

 

বিলাতে উচ্চশ্রেণীর লোকের পুত্র-কন্যার শিক্ষা দেওয়ার রীতি হিন্দুস্তান ও বাঙলার ধনীদের মত নয় যে শিক্ষক ও ওস্তাদকে বেতন দিয়ে নিজ গৃহে নিযুক্ত করা হবে, ছেলেমেয়েরা গৃহের বাইরে যাবে না যাতে তাদের উপর কুনজর না পড়ে কিম্বা ভূত-প্রেতের দৃষ্টি লাগে, কিম্বা বিদেশে অসুখে পড়ে। ইংল্যাণ্ডের অভিজাতদের রীতি হিন্দুস্তানের বিপরীত। আমীর বা উজীর ইত্যাদি হওয়া সত্ত্বেও এরা নিজ পুত্রকন্যাদেরকে দূর দূরান্তের শিক্ষালয়ে পাঠিয়ে শিক্ষকের হাতে তাদেরকে সোপর্দ করে দেয়। …….যদিও বিলাতের লোকদেরকে নিজ সন্তানদেরকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য দূরদেশে পাঠিয়ে তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে বলে বাঙলার লোক দোষারোপ করে থাকে, কিন্তু বিচার করে দেখলে মানতেই হবে যে সন্তানের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন করে বিলাতের পিতামাতা পরম বন্ধুর কাজই করেন, যাতে তারা বিদ্যা ও শিল্পে সুশিক্ষিত হয়ে সারা জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারে। পিতামাতার যে স্নেহমমতা সন্তানকে বিদ্যাশিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে তা তার পক্ষে শ্ত্রতা ও নিষ্ঠুরতা বই আর কিছু নয়।

 

বিলাতের লোকজনেরা জ্ঞান বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদেরকে সুশিক্ষিতি করার জন্য কিভাবে সহজ-সরলভাবে পুস্তক রচণা করে রেখেছেন সে বিষয়টাও নজর এড়ায়নি তার। আমাদের দুর্ভাগ্য আজ এত বছর পরেও আমরা বাংলা ভাষায় আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ সরল করে বিভিন্ন বিষয়ের উপর গ্রন্থ রচণা করতে পারি নাই।

 

বিলাতের শিক্ষক ও পণ্ডিতেরা কঠিন শাস্ত্রের এমন সহজ ও সরল পুস্তক রচণা করে থাকে যে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রারম্ভিক শিক্ষার্থীদের কোন অসুবিধা হয় না। আর মুদ্রিত পুস্তকের প্রাচুর্য এত বেশী যে কেউ যদি প্রত্যেকটি শাস্ত্র ও বিদ্যার উপর লিখিত দশ হাজার করে বই কিনতে চায়, তা এক দোকান থেকেই পাওয়া যেতে পারে।

 

 

বাঙালি মুসলমানদের মদ্যপান নিয়ে ভণ্ডামিকেও তিনি ক্যাপ্টেন সুইনটনের ভাষ্যে প্রকাশ করেছিলেন। অন্য কোন মুসলমান না দেখার পরেও মির্জা ইতসামুদ্দীনের হালাল খাবার নিয়ে অত্যাধিক গোঁড়ামি এবং পান-ভোজনে বা মিষ্ট মদ্যপানে মোটেও আগ্রহ না দেখে আশ্চর্য হয়ে তিনি একদিন বলেই বসেছিলেনঃ

 

আমি বাঙলাতে বিশ বসর কাটিয়েছি, মুসলমানদের আচার-ব্যবহার আমার বেশ দেখা আছে, কারণ আমি নবাব ও আমীরজাদাদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন করেছি। দেখতাম, মুসলমান আমীর ও আভিজাত্যরা প্রকাশ্যে মুসলমানদের সামনে মদ্যপান থেকে বিরত থাকত, বলত, আমরা মদ্য পান করি না। কিন্তু মজলিশ তকে অভ্যাগতরা উঠে যেতেই সাকীর হাত থেকে মদের পাত্র নিয়ে একাধারে পান করে যেত, আর বলত, মদ অত্যন্ত ভাল জিনিষ, এর মত নেয়ামত পৃথিবীতে আর নাই। শরীয়তে মানা আছে বলে অনভ্যস্ত লোকের সামনে মদ্যপান করা দূষণীয় বটে, কিন্তু গোপনে আড়ালে এক আধটুকু পান করাতে আপত্তি নাই

 

পাঠক, এখনকার ভণ্ড মুসলমানদের সাথে সেই সময়কার ভণ্ড মুসলমানদের কোন পার্থক্য কি খুঁজে পেলেন? শত শত বছর পরেও ভণ্ডামিগুলো সেই একই রকমই রয়ে গেছে।

 

একাধিক শেতাঙ্গ মেয়েকে বিয়ের লোভনীয় প্রস্তাবসহ বিলাতে থেকে যাওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন সুইনটনের চাপাচাপি সত্ত্বেও দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। এর মধ্যে অবশ্য তিনি বুঝেও গেছেন যে, তাকে বিলাতে রাখার জন্য ক্যাপ্টেন সুইনটনের এত আগ্রহের কারণ কি। মূলত তার বেশভূষা, আভিজাত্যে মোড়া চাল-চলন, এবং পাণ্ডিত্য দেখে লোকজন তাকে বাঙলার নবাবের ভাই বলে মনে করতো। এতে করে বিলাতী সমাজে ক্যাপ্টেন সুইনটনের মর্যাদাও বেড়ে গিয়েছিল খুব। মির্জা ইতিসামুদ্দীনকে সাথে নিয়ে যেতে পারলে সব জায়গাতেই সমীহ এবং আগ্রহ পেতেন তিনি। ফলে, সব প্রলোভনকে পায়ে ঠেলে বাংলা সন ১১৭৩ সালের কার্তিক মাসে তিনি নিজ প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে ফেরত আসেন।

 

বিলাত থেকে ফেরত আসার পরে মির্জা ইতিসামুদ্দীন দারুণ মর্যাদাসম্পন্ন এবং গণ্যমান্য লোক বলে পরিগণিত হতে থাকে। সবাই তাকে বিলাতী বলে ডাকতো।  ইষ্ট কোম্পানীর সাথেই তিনি পুনরায় কাজ করা শুরু করেন মারাঠাদের সাথে ইংরেজদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে কূটনৈতিকের ভূমিকা পালন করেন। ১৭৭৫ সালে জন হ্যামিল্টনের সাথে পুনায় যান মারাঠা সেনাধক্ষ্যদের সাথে শান্তি আলোচনার জন্য। মারাঠাদের সাথে আলোচনায় তিনি দূত হিসাবে যান এবং মারাঠা চীফ নারদ শাখারাম এবং নানা ফাদনবিসের সাথে আলোচনার সাপেক্ষে শান্তিচুক্তি প্রনয়ণ করেন।

 

মির্জা ইতিসামুদ্দীনের বিলাত সফর যদি সফল হতো, ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়তো ভিন্নভাবে লেখা হতো। লর্ড ক্লাইভের একটিমাত্র চিঠি লুকিয়ে ফেলার ফলে ইতিহাস হয়তো মোচড় নিয়েছিল ভিন্ন খাতে। এক বিরাট জনগোষ্ঠী, এক বিশাল প্রাচূর্যশালী অঞ্চলের উপর দিয়ে দুশো বছর যে স্টীমরুলারটা চলেছে, যে ভয়াবহ অত্যাচার নির্যাতন আর অপমান সহ্য করতে হয়েছে কোটি কোটি মানুষকে, তা হয়তো  হতো না। অক্ষম ক্রোধে নিজ জন্মভূমিকে বিদেশী বেনিয়াদের কাছে বার বার ধর্ষিত হতে দেখতেও হয়তো হতো না তাদের। একজন মাত্র ধূর্ত লোকের একটুখানি শঠতার কারণে ইতিহাসের গতিপথটা অপ্রত্যাশিত বাঁক নিয়ে চলে গেছে তাদের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত সম্পূর্ণ ভিন্ন  এক খাতে। যার প্রভাব আজো বয়ে চলেছে এই অঞ্চলের মানুষেরা। এর থেকে মুক্তি মিলবে না হয়তো কোনদিন, হয়তো চলবে এই প্রতিঘাত অনন্তকাল ধরে।

 

(পাঠকদের উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটা কথা। সাহিত্যের সাথে আমার সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। কাজেই এই লেখাটির সাহিত্যমান নিয়ে আশা করি কেউ প্রশ্ন তুলবেন না।)

 

মায়ামি, ফ্লোরিডা

[email protected]