লিখেছেন: মুমতাহিনা জামান
নারী দিবস পালিত হওয়ার পিছনে মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নারীকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং নারী পুরুষ সমতা অর্জন নিশ্চিত করা। অবশ্য এটা আদৌ সম্ভব হয়েছে কিনা এখনও সেটা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রতি বছরের মতো এ বছরেও ৮ ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের পিছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাস।১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। এরপর ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সম্মেলনে জার্মান রাজনীতিবিদ ও সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সাল থেকে ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
আজকের আধুনিক বিশ্বে দাঁড়িয়ে এখনো নারীদের অবস্থান বেশ শোচনীয়। নারী বলতেই আমাদের কল্পনাতে ভেসে ওঠে দুধে আলতা গায়ের রঙ, মেঘবরণ কেশ, গোলাপি ঠোঁট আর কাজল কালো চোখ। অন্যদিকে পুরুষ বলতে আমরা বুঝি, সুঠাম দেহ, উচ্চশিক্ষিত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম। অর্থাৎ নারীরা রূপবতী-গুণবতী হয়ে ঘর-সংসার সামলাবে আর পুরুষরা বাইরের জগত সামলাবে। কিন্তু কেন? এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়। কারণ বিগত কয়েক যুগ ধরে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, ক্লারা জেটকিন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সিমোন দ্য বোভোয়ার, সুফিয়া কামাল, সুলতানা কামালসহ অসংখ্য নারীবাদীরা নারী অধিকার অর্জনের জন্য কাজ করে গেছেন। নারীবাদীদের আন্দোলনের সূত্র ধরেই নারীরা রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছে, ভোট দেওয়ার অধিকার পেয়েছে, নিজের শরীরের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণের অধিকার পেয়েছে, পেয়েছে শিক্ষার অধিকার, পেয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সর্বোপরি নারী নিজেকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে শিখেছে। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন কি নেই!
আসলে যা পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে এগুলোর মধ্যে অনেক কিছুই নারী প্রকৃত অর্থে এখনো বোধ হয় পায় নি। যদি সত্যিই নারীর শিক্ষার অধিকার থাকতো তাহলে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই কোন মেয়েকে বাল্যবিবাহের সম্মুখীন হতে হতো না। বাবা মাকে এ কথা শুনতে হতো না যে মেয়ে মানুষ তাকে এত পড়িয়ে কি হবে? সেইতো পরের ঘর সামলাবে। নারীর শরীরের উপর যদি তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ সত্যিই থাকতো তাহলে “বৈবাহিক ধর্ষণ” নামক শব্দ ডিকশনারিতেই থাকতো না।কারণ, “ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ”এর করা সাম্প্রতিক এক জরিপে ভয়াবহ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। সেটি হচ্ছে , এই দেশের শহর ও গ্রামের শতকরা ৬৩ ভাগ পুরুষ এখনো মনে করেন ‘সহবাসে রাজি না হলে বউকে মারাটা জায়েজ’। অন্যদিকে শতকরা ৬২ জন পুরুষ এখনো বিশ্বাস করেন যে ‘এমনও সময় আসে, যখন বউয়ের নিজের কাজের জন্যই তার মার খাওয়াটা উচিৎ হয়ে যায়’। সত্যিই কি হাস্যকর আর নির্মম বাস্তবতার মুখে আমরা দাঁড়িয়ে আছি! মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে নারীর নেই সেটা আর বলার অপেক্ষাই রাখে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গুলোতে পুরুষের কথাই হচ্ছে শেষ কথা। সেখানে নারী যাই বলুক না কেন, সেটা যতই যুক্তি সঙ্গত হোক না কেন,দিন শেষে সেই কথাটির কোন মূল্যই দেওয়া হয় না।নারীকে পুরুষের মতামতকেই মেনে নিতে হয়, সেটা যদি অযৌক্তিকও হয় তবুও সেই মতামতকেই নারীরা সর্বদা বেদবাক্য বলে মেনে নিয়ে থাকে। নারীবাদীদের অসংখ্য আন্দোলনের ফলে বর্তমানে নারীদের অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটলেও নারী-পুরুষ সমতা অর্জন এখনো সম্ভব হয়নি। আর হবেই বা কি করে? যেখানে নারীকে প্রতিনিয়ত পুরুষ কর্তৃক নির্যাতন,ধর্ষণ,হত্যার মুখে পড়তে হচ্ছে সেখানে নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের কথা ভাবাটাই তো বোকামো।
গত বছর ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির কারণে সারা বিশ্ব মহামারী আকার ধারণ করেছিল। যেহেতু সমাজের নিয়ম নীতির কারণে নারীরা বরাবরই কোণঠাসা হয়ে থাকে সেহেতু এই মহামারী পরিস্থিতিতে নারীরা আরো বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। তারই ফলস্বরূপ আমাদের বাংলাদেশে “মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)” এর তথ্য মতে, গত বছর করোনাকালে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও শিশুদের জনসমাগমের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর এই সময়ের মধ্যে ৬২৬টি মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে । শুধু তাই নয়, এসময় বাল্যবিয়ে বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর পর্যায়ে রয়েছে। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে ঘর বন্দী থাকা অবস্থায়ও নারীরা নিরাপদ নয়। কিছু ঘৃণ্য মস্তিষ্কের নরপশুর হিংস্র থাবার বলি হতে হয়েছে অসংখ্য নারী ও মেয়ে শিশুকে। তারা নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারছে না । কারণ, এইসব ধর্ষকদের আইনের আওতায় আনা সত্ত্বেও সঠিক বিচার করা হচ্ছে না। অনেক প্রভাবশালী ধর্ষকরা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অথবা হুমকি দিয়ে এসব ধর্ষণকে মাটিচাপা দেয়ার চেষ্টা করে।আর এসব ধর্ষণের ঘটনা কোনো কারনে প্রকাশিত হয়ে গেলে আইন ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা খুব সহজেই সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের দেশে ধর্ষিতাকে অপমান-বঞ্চনার মুখে পড়তে হলেও, তাকে অবাঞ্ছিত করে রাখা হলেও, ধর্ষককে বেশ সমীহ করে চলা হয়। কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক । আর এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ষক হচ্ছেন পুরুষ এবং ধর্ষিতা হচ্ছেন নারী।আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থা যদি আরও কঠোর না হয় তাহলে অচিরেই আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে।
প্রকৃত অর্থে যতদিন না নারী-পুরুষ সমতা অর্জন নিশ্চিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত বোধ হয় নারীকে পুরুষের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।পুরুষ নিজের পুরুষত্বকে জাহির করতে যেয়ে ভুলেই যায় যে, তার পৃথিবীতে আসার পিছনে সবথেকে বড় ভূমিকা কোনো নারীর ছিল।তাই অন্য নারীকে অসম্মান করতে, তাকে দমিয়ে রাখতে, নির্যাতন করতে সে দু’বার ভাবে না। নারীরা যদি গতানুগতিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে না পারে, তাহলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সে কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।বরং সমাজের কর্তা স্থানীয় পুরুষরা তাকে আরো বেশি করে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। ঠিক যে মুহূর্ত থেকে নারীরা নিজেদের কে নারী মনে না করে মানুষ বলে মনে করবে,নিজেদেরকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের স্থান দেবে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই নারীর অধিকার অর্জন নিশ্চিত হওয়া শুরু হবে।
কিন্তু পৃথিবীর সব পুরুষকে একই মাপকাঠিতে বিচার করা রীতিমতো অসম্ভব। কারণ, পৃথিবীর সব পুরুষ যদি একই রকম হতো তাহলে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে কখনোই নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দিতেন না।দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী কাদম্বিনী গাঙ্গুলী কে কখনোই বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার হতে দিতেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একের পর এক লেখায় নারীকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাতেন না এবং যৌতুক আদান প্রদানের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করতেন না।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কখনোই বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করতেন না কিংবা রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলোপ করতেন না। বেল হুকস ,জন স্টুয়ার্ট মিল কখনোই নারীবাদীদের পাশে তাদের সহযোদ্ধা হয়ে দাঁড়াতেন না। আসলে এসব মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল বলেই আজ সভ্যতার এতটা বিকাশ সাধন সম্ভব হয়েছে। ঠিক যেমন অসংখ্য পুরুষ নারীদের পাশে তাদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টায় সঙ্গী হয়েছিলেন ঠিক তেমনি অসংখ্য নারী যারা কিনা নারী হওয়া সত্ত্বেও বারংবার এক নারী হয়ে অন্য নারীর অধিকার অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
আমাদের সমাজে এমন হাজারো শাশুড়ি রয়েছেন যারা কিনা পুত্রবধূকে নিজের প্রতিপক্ষ বলে মনে করেন। পুত্রবধূকে নিজের পায়ের তলায় দমিয়ে রাখতে চান। কোনো বিবাহিত নারী অর্থ উপার্জনকারী হলে তার উপার্জিত সমস্ত অর্থের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় শাশুড়ি কিংবা স্বামী অথবা উভয়েই। এমন ও নারী আছে যারা কিনা এক নারী হয়ে অন্য নারীর উন্নতি হতে দিতে চান না এবং সমাজের শৃংখলার নামে বিভিন্ন নিয়ম-নীতির বোঁঝা অন্য নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এই যে সমাজের নারীদের এক নারী হয়ে অন্য নারীর বিপক্ষে দাঁড়ানোটা এটি সমাজের এক নির্মম বাস্তবতা ছাড়া আর কিছুই না। এই বিষয়টি ভারতের অ্যানিমেশনের জনক হিসেবে পরিচিত রাম মোহন “মিনা কার্টুন”এর মাধ্যমে খুব সহজ ও সাবলীল ভাবে তুলে ধরেছেন। এখানে মিনা কোনো প্রশংসনীয় কাজ করলে খুব সহজেই মিনার বাবা তাকে সমর্থন করেন , যিনি একজন পুরুষ। কিন্তু অপরদিকে খুব অযৌক্তিকভাবে মিনার বিপক্ষে এবং তার ভাই রাজুর স্বপক্ষে থাকেন মিনার দাদী, যিনি একজন নারী। আর সমাজের এমন পরিস্থিতি কখনোই কাম্য নয়।
যখন কোনো পুরুষ নিজের পুরুষত্বের বাইরে গিয়ে মনুষ্যত্বকে আঁকড়ে ধরবে এবং একইভাবে কোনো নারী নিজের নারীত্বের বাইরে গিয়ে মনুষ্যত্বকে অগ্রাধিকার দেবে তখনই সমাজ আলোর পথ দেখবে। নারী-পুরুষ সম্মিলিত ভাবে একে অপরের সহযোদ্ধা হয়ে পাশে দাঁড়ালেই একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। আর তখনই নারীর অধিকার অর্জিত হবে এবং নারী পুরুষ সম-অধিকার নিশ্চিত হবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন সেদিন সার্থকতা লাভ করবে যেদিন নারীর অধিকার অর্জন এবং নারী পুরুষ সমতা অর্জন নিশ্চিত হবে। যেদিন নারীরা পুরুষের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে সমাজ সংস্কারের পথে এগিয়ে যেতে পারবে সেদিনই কেবল এই নারী দিবস উদযাপন প্রকৃত অর্থে সফল হবে।
বাংলাদেশের অনেক নারীই আছেন যারা পুরুষতন্ত্রবাদে দীক্ষিত এবং তারা পুরুষতন্ত্রবাদকে আরো প্রশ্রয় দিচ্ছেন উদাহরণস্বরূপ হিজাব এবং বোরকা পরিহিত মেয়েগুলো যারা ইসলামী মূল্যবোধসহ পুরুষতন্ত্রবাদকেও ধরে রাখছেন তাদের পোশাকে।
ধর্মীয় অনুশাসন এর তোয়াক্কা করে না অথচ পুরুষতন্ত্রবাদে দীক্ষিত এমন হাজারো নারী আমাদের সমাজে রয়েছে। ইসলামী মূল্যবোধ আর পুরুষতন্ত্রবাদ সম্পুর্ণ আলাদা।পুরুষতন্ত্রবাদকে তারাই প্রশ্রয় দিচ্ছে যারা সমাজে নারীদের পিছিয়ে রাখতে চায়।কিন্তু ইসলাম সেটা চায় না।আর, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হযরত খাদিজা রাঃ যিনি একজন নারী এবং ব্যবসায়ী ছিলেন।তাই পোশাক আর ধর্মের বাইরেও মানসিকতা নামক একটা বিষয় আছে আর নারীদের সেটাকেই প্রশস্ত করতে হবে।তাহলেই পুরুষতন্ত্রবাদ থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।