প্রথম পর্ব: দাসত্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: প্রথম পর্ব

আমরা আত্মবঞ্চনার মোহে নিজেদের ভুলিয়ে চিরাচরিত সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছি যে, সব মানুষই সমানভাবে, সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, শিখেছি কিছু সত্যের মত মিথ্যা বুলি। তবে এটা অস্বীকার করা যায় না যে প্রকৃতি প্রতিটি মানুষকে অন্তর্নিহিত ও শারীরিক গুণাবলীর সমন্বয়ে সমানভাবে সৃষ্টি করেছে এবং সেই গুণাগুণের অধিকার কেউ তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। যেমন জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের অন্বেষণের অধিকার। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের শুরুতেই মানুষের জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের অন্বেষণের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, যে দলিলের উপর ভিত্তি করেই অর্জিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশটার স্বাধীনতা। কিন্তু যে শব্দগুলোর উপর ভিত্তি করে একটা দেশ ও জাতির জন্ম হল সেখানেই কিছু কূটাভাস ও ভাষার রাজনীতি আছে। এমনকি যারা মুক্তির বিজ্ঞাপন দিয়ে উপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করলো তারাও স্বাধীনতার পরে ঠিকই দাসত্ব টিকিয়ে রাখল এবং সংবিধানে দাসদের জীবন যাপনের অধিকার ও স্বাধীনতার কোন ছিটেফোঁটা অস্তিত্ব রইল না। ডুবন্ত মানুষের ন্যায় খড়কুটোর মত যেকোনো কিছু আঁকড়ে ধরে তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল দাসত্বের অভিশাপে জর্জরিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। এদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় বিপ্লবী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। ধীরে ধীরে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়া পেনসিলভানিয়া, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সির মত রাজ্যের কারণে অন্যরা যেন একটু ভরসা পেল। যেমন নিউ ইয়র্কে ৪ঠা জুলাই ১৭৯৯ সালের পরে জন্ম নেয়া শিশুরা ২৫ বছরে পদার্পণ করলে আইনগতভাবেই স্বাধীন হয়ে যাবে। মেয়েরা ২৮ বছরে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারবে প্রথমবারের মত। আর যদি পূর্ণবয়স্ক কেউ যদি দাস থাকে তাহলে দাস মালিককে দাসের কর্মক্ষম বছরের পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে হবে।

তবুও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোর তুলা চাষের জন্য দাসের প্রয়োজন বাড়তেই থাকল। ১৮০৮ সালে মার্কিন কংগ্রেসে দাস আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আইন পাস হয়, ফলে দেশটির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দাস ব্যবসার সমাপ্তি ঘটে কিন্তু বেড়ে চলে অভ্যন্তরীণ দাস ব্যবসার পরিসর। ইতিমধ্যেই যারা দাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্ম নিয়ে স্থানীয়ভাবে বেড়ে উঠেছে সেইসব মানুষদের কেনা বেচার মাধ্যমে ক্রম বর্ধমান চাহিদা মেটানো হয়। দাসের মালিক যখন ইচ্ছা বাজারই পণ্যের মত দাসদের বেচাকেনা করতে পারতো। আপন সন্তান, স্ত্রী, প্রিয়জন ছেড়ে হয়ত দাসকে চলে যেতে হতো নতুন মালিকের কাছে। দাসের আন্তর্জাতিক ব্যবসা নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও আইনকে আড়াল করে অবৈধভাবে দাসের ব্যবসা কিন্তু থাকেনি। কিন্তু দাস আমদানির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দাস ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় দশ লক্ষাধিক আফ্রিকান দাসের বাধ্যতামূলক অভিবাসন ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে। অবৈধ দাস প্রবাহের পিছনে ছিল শক্তিশালী রাজনৈতিক তদারকি। যুক্তরাষ্ট্র সংবিধানের (Article I, Section 2, of the U.S. Constitution of 1787)Three-Fifths ধারা বলে সংবিধানে সামন্ত জমিদার, অভিজাত শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে। অভিবাসী কালো দাস শ্রেণি যার মালিকানায় কাজ করত বস্তুত সেই দাস সেই মালিকের সম্পত্তি হয়ে গেল। তারা আমেরিকার নাগরিক এবং আইনত তারা রাষ্ট্রের অংশ হলেও অধিকার বলতে কিছু ছিল না, কারণ তারা নিজেরাই পরাধীন। কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিক বানিয়ে তাদেরকে পরিণত করা হয় চিরস্থায়ী দাসে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ের অভিজাত শ্রেণি আইনের মারপ্যাঁচে পুনরায় বর্বর দাস ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে।

একটা সুদূরপ্রসারী চিঠি

বিপ্লবী যুদ্ধের পর টমাস জেফারসন এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদ সবার মালিকানাতেই দাস ছিল যারা আমেরিকার সংবিধান লিখেছিলেন এবং গঠিত হয়েছে একটা দেশ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রাথমিক খসড়ায় দাস ব্যবসা বলবত রাখা এবং দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে না ফেলে বরং উপেক্ষা করার জন্য জেফারসন ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জকে সরাসরি দায়ী করেন। জেফারসন দাসদেরকে জাগ্রত করে তোলেন এবং ব্রিটিশদের পক্ষে উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেন। মানুষের জন্য সুখের বিজ্ঞাপনের মত স্বাধীনতা কথাটি মূল ঘোষণাপত্র থেকে সুকৌশলে বাদ দেয়া হয়, যদিও সব ধরণের দাসত্ব নির্মূলের কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রাথমিক খসড়া এবং চূড়ান্ত দলিলে কী সীমাহীন ফারাক। সীমাহীন প্রতিযোগিতার মাঝে সাম্যতার প্রশ্নে সব মানুষ আসলেই সমান নয়। টমাস জেফারসন নিজের গৃহস্থালি কাজের জন্য আজীবন দাস রেখেছিলেন, তিনি জন্মসূত্রেই দাস হিসেবে কালো মানুষের মালিক হয়েছিলেন, তার পারিবারিক মালিকানায় কালো রঙের দাস নতুন দাসের জন্ম দিয়েছিল এবং তিনি নিজের জীবন, জীবিকা এবং আরাম, আয়েস ও বিলাসের জন্য দাসদের ব্যবহার করেছিলেন। জেফারসন প্রকাশ্যে বলতেন কালো মানুষেরা সাদা মানুষের থেকে নিকৃষ্ট এবং ক্রমাগত কালোদেরকে আমেরিকা থেকে বের করে দেয়ার জন্য প্রচার চালাতেন। ১৭৯১ সালে বেঞ্জামিন ব্যানেকার নামের একজন মুক্ত কালো মানুষ যিনি একাধারে গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ এবং ভূমি জরিপ বিশেষজ্ঞ তিনি জেফারসনের হিংসা বিষাক্রান্ত মনস্তত্ত্বের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে একটা চিঠি লেখেন। তখন জেফারসনের স্টেট সেক্রেটারি বেঞ্জামিনকে বলেন যে তার “কুসংস্কারাচ্ছন্ন সংকীর্ণতা” বেরিয়ে আসতে হবে, সেই সাথে অবান্তর, ভ্রান্ত ধারণা এবং কালোদের বিরুদ্ধে প্রচলিত মতবাদ নির্মূল করতে হবে কারণ সাদাকালো নির্বিশেষে সবাই মানুষ কিন্তু ঘৃণার সংস্কৃতি আমাদের মাঝে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজমান। দাস রাখার জন্য ব্যানেকার তার চিঠিতে টমাস জেফারসনকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং জেফারসনের মালিকানায় কত সংখ্যক কালো মানুষ শ্রম দাস হিসেবে নিয়োজিত ছিল চিঠিতে তার তালিকা পেশ করেন। তারপরের বছরই ব্যানেকারের তত্ত্বাবধানে দাসদের তালিকা প্রকাশিত হয়। কিন্তু শুধু আফ্রো-আমেরিকান কালো রঙের মানুষ হওয়ার কারণেই জেফারসন তাদের প্রতিভা স্বীকার করেন না। শুধুমাত্র বিতর্ক এড়াতেই জেফারসন অতিদ্রুত অনেকটা দায়সারাভাবে ব্যানেকারের চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেন এবং ব্যানেকারকে বলেন, “এরকম প্রতিভা যার আছে সে যেন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। কালো মানুষ যদি গবেষণা, মেধার চর্চায় সাদা মানুষদেরকে অতিক্রম করতে পারে তাহলে তাদেরকে স্বাগত”।
মাম ব্রেট ওরফে এলিজাবেথ ফ্রিম্যান নিজের স্বাধীনতা দাবি করে আদালতে মামলা করেন।

১৮১১ সালে সুসান অ্যান লিভিংস্টোন রিডলি সেডভিক’র আঁকা মাম ব্রেটের ক্ষুদ্রাকৃতির প্রতিকৃতি

বিপ্লবী যুদ্ধের নবজাগরণের পর আফ্রিকান-আমেরিকান কালো মানুষেরা রাজ্যভবন, আদালত, সরকারি সম্পত্তি দখলে নেয় এবং সেখান থেকেই প্রবল বিক্রমে তাদের স্বাধিকারের জন্য, দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এলিজাবেথ ফ্রিম্যান যিনি সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন ‘মাম ব্রেট’ নামে, তিনি ম্যাসাচুসেটসে একজন ক্রীতদাস ছিলেন যার স্বামী বিপ্লবী যুদ্ধে নিহত হন। এলিজাবেথ ফ্রিম্যান ছিলেন ভীষণ ইতিবাচক এবং স্বপ্নদ্রষ্টা নারী। ১৭৮০ সালে গৃহীত ম্যাসাচুসেটসের নতুন সংবিধানে উল্লেখিত আছে “সব মানুষ জন্মসূত্রে স্বাধীন এবং সমতার দাবিদার এবং অতি প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা যাবে না। তাদের স্বাধীনভাবে জীবন যাপন, আনন্দ উপভোগ, জীবিকা ও স্বাধীনতা রক্ষা করার অধিকার আছে।” দাসত্ব মানুষকে মানুষ হিসেবে জীবনযাপনের অধিকার দেয় না এই যুক্তি দেখিয়ে মাম ব্রেট তার স্বাধীনতা দাবি করে আদালতে মামলা করেন এবং তিনি সেই মামলায় জিতেও যান। মামলায় জিতে ব্রেট তার নতুন সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘এলিজাবেথ ফ্রিম্যান’ রাখেন। তার দৃষ্টান্তমূলক কাজের মাধ্যমে ম্যাসাচুসেটস থেকে দাসত্ব নির্মূলে কার্যকরী ভূমিকা রাখেন। মাম ব্রেট বলেন, “আমাকে কেউ যদি এক মিনিটের স্বাধীনতা দিয়ে বলত, এক মিনিট পরেই তোমার মৃত্যু হবে তবে আমি জীবন বাদ দিয়ে মৃত্যুকেই গ্রহণ করতাম”।

From the Smithsonian’s Museum of African American History and Culture [আফ্রিকান আমেরিকান ইতিহাস এবং সংস্কৃতি যাদুঘর]

১৯১৬ সালে প্রকাশিত ফিয়াডেলফিয়ার মাদার বেথেল এ. এম. ই চার্চের পোস্টার এবং পোস্টারের মাঝে চার্চের প্রতিষ্ঠিত রিচার্ড অ্যালেনের ছবি।
ঈশ্বর নিশ্চয় পৃথক পৃথক অভয়ারণ্য প্রত্যাশা করেন না।

আমেরিকাতে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ সে মুক্ত হোক বা স্বাধীন তার দুর্গতির কোন শেষ নেই, ভয়াবহ অমানবিক পরিস্থিতিতে নিয়তিই তাদের একমাত্র মানবিক ভরসা। শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ খ্রিষ্টানদের জন্য আলাদা ধর্মসভা আয়োজনের প্রতিবাদে ১৭৮৭ সালে রিচার্ড অ্যালেন এবং গির্জার আরও কিছু কৃষ্ণাঙ্গ সভ্য ফিলাডেলফিয়ার সেন্ট জর্জ মেথোডিস্ট এপিস্কোপাল গির্জা থেকে বেরিয়ে যান। অ্যালেন ছিলেন একজন জন্মসূত্রে দাস এবং তিনি দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি নিজের মুক্তি কিনে নিয়েছিলেন তার মালিকের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে। মুক্ত হয়ে তিনি ফিলাডেলফিয়াতে চলে আসেন এবং সেন্ট জর্জ গির্জায় যোগ দেন এবং সেখানেই খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার প্রসারে মনোনিবেশ করেন। তিনি দ্রুত বুঝতে পারলেন সাদাকালোর সহাবস্থান সুদূরপরাহত। গির্জা থেকে তার উপর নির্দেশ আসে, তিনি শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য যিশুর বাণী শোনাবেন। গির্জার মত পবিত্র স্থানেও কৃষ্ণাঙ্গদেরকে নিকৃষ্ট বিবেচনা করা হচ্ছে দেখে অ্যালেন খুব মর্মাহত হন। ফলশ্রুতিতে অ্যালেন কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা আফ্রিকান তরিকার বিশপের তত্ত্বাবধানে মাদার বেথেল এ.এম.ই চার্চের সূচনা করেন। সেখানে সবার অবারিত প্রবেশ, কারো উপর নিষেধাজ্ঞা নাই, বর্ণের ভেদাভেদ নাই। অ্যালেনের প্রতিষ্ঠিত চার্চ হয়ে উঠল বর্ণের কুটিল রাজনীতিমুক্ত মানুষের অভয়ারণ্য, সেখানে শিশুদের জন্য আছে শিক্ষার ব্যবস্থা, সামাজিক এবং জনকল্যাণমূলক কাজে অংশ নেয়, বর্ণবাদী দাস সমাজে জন্ম নিয়েও উত্তরণের পথ দেখায়। অ্যালেন এবং পরবর্তীতে চার্চের পুরোহিতদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মাঝে যোগাযোগ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে এবং ধীরে ধীরে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়েছে। আফ্রিকান কায়দার এই নতুন চার্চ দ্রুত জনপ্রিয় হতে লাগল। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অ্যালেনের প্রতিষ্ঠিত মাদার বেথেল এ.এম.ই চার্চের সংখ্যা ৭০০০ ছাড়িয়ে গেছে।

তুলার মেশিনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব:

কাঠের উপর খোদাই করা তুলার আঁশ এবং তুলার বীজ আলাদা করার যন্ত্রের ছবি। হারপার’স উইকলি

শ্রম-দাস বৃদ্ধির সাথে সাথে সারাদেশব্যপী দাসত্ব এবং দাসমুক্তির আলোচনা এবং দাবী ছড়িয়ে পড়তে লাগল দেশের সর্বত্র। ১৭৯৪ সালে ইলি হুইটনি তুলার আঁশ থেকে তুলার বীজ আলাদা করার যন্ত্র আবিষ্কার করেন ফলে তুলা পরিষ্কার করার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হয়ে এবং বাজারে দ্রুত তুলার চাহিদা যোগান দেয়া সম্ভব। তুলা তখনকার সময়ের প্রধান অর্থকরী ফসল এবং তুলা উৎপাদনকারী দেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দ্রুত চালকের ভূমিকায় চলে আসে। স্বাভাবিকভাবেই তুলার চাষ বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে আবাদি-জমি। কিন্তু তুলা-চাষের জমি প্রস্তুত করা প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রমের কাজ। ওদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহত বাড়তে থাকে তুলার চাহিদা। ১৮০৩ সালে টমাস জেফারসনের সাথে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের চুক্তি হয় ইতিহাসে যেটা লুইজিয়ানা ক্রয়-চুক্তি বলে পরিচিত। ১৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আমেরিকা ৮৩০,০০০ বর্গমাইলের মালিকানা লাভ করে যা তৎকালীন আমেরিকার মোট আয়তনের দ্বিগুণ। এই জমিতে আমেরিকা বাড়াতে থাকে তার দাস ও তুলার ব্যবসা।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের চুক্তির পরেই আমেরিকা তার ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক দাসব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে এর কূটবুদ্ধির পেছনে ছিল শ্রমিকের স্বল্পতা দেখিয়ে অভাব তৈরি করা। এমতাবস্থায়, দেশব্যাপী দাসব্যবসা ব্যাপক প্রসার লাভ করে, আনুমানিক দশলাখ ক্রীতদাস কৃষ্ণাঙ্গকে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে তুলা, আখ এবং ধানের ক্ষেতে কাজ করা জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়।

দাসত্বের নির্মম বঞ্চনা

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রান্স-আটলান্টিক দাস ব্যবসা বন্ধ হওয়ার দিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে স্মরণীয় ভাষণে রেভারেন্ড পিটার উইলিয়াম জুনিয়র বলেন, “কিছু দরদী মানুষ স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর বছরের পর বছর চলতে থাকা অমানবিক নির্যাতন এবং অবিচারের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। সেই মহৎপ্রাণ মানুষেরা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রাকৃতিক অধিকার আদায় আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তারা কৃষ্ণাঙ্গদেরকে সমাজে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। সেই মহৎপ্রাণ মানুষেরা চেষ্টা করেছেন যাতে দাসত্বের মত খারাপ আবার ফিরে না আসে।” দাস ব্যবসার উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের দিন ১৮০৮ সালের ১জানুয়ারি শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রোতার সামনে উইলিয়াম বলেন, একজন মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ ম্যানহাটনে ‘সেন্ট ফিলিপ আফ্রিকান চার্চ’ প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্যই আইন পাশের সাথে সাথে দাসত্ব বন্ধ হয়ে যায় নি, প্রায়ই আইন ভঙ্গের অভিযোগ এসেছে। রেভারেন্ড উইলিয়াম উপস্থিত জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন দাসত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। উইলিয়াম তার ভাষণে বলেন, “দাসত্ব অত্যন্ত কদর্য-পূর্ণ, এটা অত্যন্ত ক্ষতিকর যে মানুষের পদক্ষেপে লেগে আছে রক্তের দাগ, মানুষের লোভাক্রান্ত নিঃশ্বাসের গরম বাতাসে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে; বাড়ছে পারষ্পরিক বৈপরীত্য ও আস্থাহীনতা। নিষ্ঠুরতা আর ঘৃণার জ্বালানির মধ্যে ভঙ্গুর বন্ধনে আবদ্ধ এখন মানুষ। আমেরিকা নামের জন্মলগ্ন থেকেই সবাই স্বাধীন। এক সময়ে দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী কবি ফিলিস হুইটলি ১৭৭৪ সালে লিখেছেন “প্রতিটি মানুষের বুকে একটা ঈশ্বর একটা স্বপ্ন বপন করে দিয়েছেন। আমরা আদর করে সেই স্বপ্নের নাম দিয়েছি মুক্তি যা অত্যাচারীর জন্য যা অস্বস্তির কারণ”।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (The New York Times) এ প্রকাশিত মূল প্রবন্ধ: এখানে