নাসির আলী মামুনের কবিতার জীবন (১৯৯৬, অপ্রকাশিত) প্রামাণ্য চিত্রের চিত্রগ্রহণকালে তিতাস নদীতে তোলা আল মাহমুদের (জন্ম: মোড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৯৩৬)

বাংলা সাহিত্যে আল মাহমুদ একজন বড় কবি। তার কোন সৃষ্টিকে অস্বীকার কিংবা ছোট করার করার কোন উপায় নেই। তিনি তার জীবনে অনেকবার অনেকভাবে নিজের মতাদর্শ কিংবা পক্ষ বদল করেছেন। মানুষ হিসেবে কবি আল মাহমুদ সারা জীবন সুবিধাভোগী ছিলেন। প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্পকলা একাডেমির উপপরিচালক পদ দেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর বাকশালের সদস্য ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা উপন্যাসও রচনা করেন, নাম- “কাবিলের বোন”। এরপর জিয়া ক্ষমতায় আসলে তার সেখানেও নারিকেলের মতন মিশে যান! জিয়ার নামে একটি গল্প লেখেন “তৃষিত জলধি”। এরশাদের জন্যেও নাকি কবিতা লিখতেন তবে এটা প্রমাণ করার উপায় নাই যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেরা এটা স্বীকার না করেন। তবে এরশাদের সমর্থক ছিলেন তাই এরশাদ থেকে গুলশানের প্লটও পেয়েছেন। (বিস্তারিত জানতে আল মাহমুদকে কি মুক্তিযোদ্ধা কবি বলা যায় ? ও আল মাহমুদনামা)। অনেকের হয়তো জানা নেই, মুক্তিযুদ্ধের সময় আল মাহমুদ যেন (অন্যদের মতন) ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নজরে না পড়েন, এছাড়া কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় যেন ঘুরে বেড়াতে পারেন; তার জন্যে আল মাহমুদের দুলাভাই এইচ টি ইমাম তারে একখান মুক্তিযোদ্ধা কার্ড বানাই দিয়েছেন। সে সময় এইচ টি ইমাম ছিলেন মুজিব নগর সরকারের প্রধান আমলা। আল মাহমুদ অন্যদের মতন কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখিও করে নাই (তার নিজের লেখা আত্মজৈবনিক রচনাতে আছে) কিন্তু সারা জীবন দুলাভাইয়ের দেওয়া সেই মুক্তিযুদ্ধের কার্ড ব্যবহার করে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধের কবি বনে গেছেন।

আল মাহমুদ সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ

রাইসু: আপনার নারী নিষিদ্ধ হওয়ার পর ইত্তেফাক-এ আল মাহমুদ বললেন যে, আপনার লেখার বক্তব্য ও মনোভাব নাকি কুৎসিত। এবং আপনার বইয়ের মাধ্যমে ক্ষতি যা করার তা নাকি করা হয়েছে। এখন আড়াই বছর পরে এই বই বাজেয়াপ্ত করা অর্থহীন। আপনার সতীর্থ আল মাহমুদ, তিনি এ-রকম বললেন!

হুমায়ুন আজাদ: আল মাহমুদ, একটি অমার্জিত রুচিসম্পন্ন, অসৎ, কপট মানুষ। এই আল মাহমুদ অনেক আগে পাড়ার মসজিদ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনে আনন্দিত হয়ে কবিতা লিখেছে। যে, ‘হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে পাড়ার মসজিদ’। সে জায়নামাজে বসে পরস্ত্রী সঙ্গমের স্বপ্ন দেখে। তার কবিতার মধ্যে রয়েছে। যে একসময় কৃষকেরা এসে সচিবালয় দখল করে ফেলবে এবং দেশে কৃষকের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এই স্বপ্ন দেখেছে।

এখন সে একটি রুচিহীন, অসৎ, কপট, জামাতী মৌলবাদী। এবং তার মধ্যে একটি মজার কপটতা হচ্ছে সে যখন বাংলাদেশের পত্রিকায় কবিতা লেখে তখন সে ইসলামের কবিতা লেখে। আর যখন ভারতীয় পত্রিকায় কবিতা লেখে তখন হিন্দু আর বৌদ্ধের কবিতা লেখে।

আমি কয়েকদিন আগে তার একটি কবিতা দেখেছি যেখানে সে নিজেকে গৌতম বুদ্ধ হিসেবে দেখেছে। যে, সে যেন পূর্বজন্মে গৌতম বুদ্ধ ছিলো।

এইটি একটি অত্যন্ত কপট লোক, এবং সুবিধাবাদী। সে জামাতের অর্থেই এখন পালিত বলে আমি শুনেছি। তার কথায় কিছু আসে যায় না। তার কবিতা সেই ষাটের দশকেই শেষ হয়ে গেছে।

রাজু: তিনি কবে থেকে শুরু করেছেন?

হুমায়ুন আজাদ: পঞ্চাশের দশকে শুরু করেছিলো, ষাটের দশকে কয়েকটি বই বেরিয়েছিলো। সত্তর আশি এরপর যে সমস্ত কবিতা লিখেছে এগুলো কিছু না।

রাইসু: এগুলো তার ঐ মন্তব্যের কারণে বলছেন স্যার?

হুমায়ুন আজাদ: তার সম্পর্কে যে দু’চারটি মন্তব্য আমার কয়েকটি প্রবন্ধে করেছি তা-ও একই। ও, আরও একটি কারণ হতে পারে। সে আমার ওপর ক্ষিপ্ত নানা কারণে। একটি কারণ সম্ভবত, ওর একটি খুবই আত্মগর্বী কবিতা ছিলো যে, ‘আমার মাকে যেন কেউ গোলামের গর্ভধারিণী বলতে না পারে’। ঐ কবিতাটিকে আমি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে একটি কবিতা লিখেছিলাম। নাম ‘গোলামের গর্ভধারিণী’। আমি দেখিয়েছিলাম যে, আপনার এই পুত্রটি যদি, হে জননী, এই তিতাসের পাড় ছেড়ে ঢাকায় না আসতো তা হলেই ভালো হতো। আপনার ছেলেটি হয়তো মাছ ধরতো তিতাসে। বা রাখালের কাজ করতো। ভালো থাকতো। এই ঢাকায় মোগলদের শহরে এসে সে যে নষ্ট হয়ে গেছে। সব প্রভুকে সেজদা করতে করতে এখন তার পিঠে একটি বড় রকমের কুজ্ব দেখা দিয়েছে। এখন তার দিকে তাকালে একটি কুজ্বই চোখে পড়ে। আর কিছু চোখে পড়ে না। এখন আপনার যখন মৃত্যু হবে তখন হয়তো দেখবেন যে আপনার কবরের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে এবং শব্দ হচ্ছে যে এখানে একজন গোলামের গর্ভধারিণী ঘুমিয়ে আছে। এবং আল মাহমুদ এখন গোলাম আল মাহমুদের মতো আচরণ করছে।

রাজু: তো এটা স্যার ব্যক্তিমানুষকে আক্রমণ করা হয়ে গেলো না?

হুমায়ুন আজাদ: আচ্ছা, ব্যক্তি এবং কবিকে আমরা কীভাবে পৃথক করবো? এটা পারি না। এখন বলবো, তিনি কবি হিসেবে এই, আর ব্যক্তি হিসেবে এই — এটা এই সময়ে করা যাবে না। আমরা অবশ্যই দেখবো যে, এই কবিটি ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলো — সৎ ছিলো না অসৎ ছিলো। এটা আমাদের দেখতে হবে। এর রুচি কেমন ছিলো। আরো বলা ভালো যে, এই আল মাহমুদ এরশাদের সময় এরশাদীয় দলে ছিলো, আবার এখন বোধহয় জামাত এবং অন্যান্য শক্তিমানদের সঙ্গে রয়েছে। সুবিধাবাদী মানুষ।

রাজু: আচ্ছা এটা কি সাহিত্যকে কোনোরকম ক্ষতি করে কিনা?

হুমায়ুন আজাদ: সুবিধাবাদী মানুষের সাহিত্য আসলে সাহিত্যই নয়। আল মাহমুদের যে কিছু লেখা এখন কবিতা নামে ছাপা হয় ওগুলো কবিতাই নয়। ওগুলো হচ্ছে কতগুলো বাজে কথা। ওর একটি আত্মজীবনী আমি পড়েছি। এবং পড়ে মজা পেয়েছি এই জন্য যে পাতায় পাতায় মিথ্যে কথা রয়েছে।

[হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষফেসবুক থেকে নেওয়া

দুপুর মিত্রের সাথে রাজু আলাউদ্দিনের আলাপচারিতা:

দুপুর মিত্র: সম্প্রতি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আপনি। জামায়াত ইসলাম সম্পর্কিত বেশ কিছু বিষয় আপনি সেখানে প্রশ্ন করেছেন। আল মাহমুদের এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

রাজু আলাউদ্দিন: সম্প্রতি নয়, এটি আমি নিয়েছিলাম ১৪ বছর আগে। তবে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ১০/১১ বছর পর। আল মাহমুদ কবি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ–এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি জামায়াতের রাজনীতি হয়তো সমর্থন করেন না, কিন্তু যেহেতু তাদের নজরানা তিনি গ্রহণ করেন তাই ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেন না। এটা মানুষ হিসেবে তার অসততা। তবে এই অসততা দিয়ে তিনি নিজের কবিতাকে কলুষিত করেন নি। (সাক্ষাৎকারের লিংক-এখানে)

সারা জীবন রাজনীতি করে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে শেষ বয়সে আল মাহমুদ বলছেন তার সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। তিনি নিরপেক্ষ মানুষ!

বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে একজন কবি হিসেবে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।
আল মাহমুদ : আমার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নাই। সময়ের কারণেই বর্তমানে দেশের এরকম হয়েছে। আবার সময়ই সমাধান করে দেবে। আমি রাজনৈতিক লোক নই। রাজনৈতিকভাবে কোনো কিছু চিন্তা করি না। আমি রাজনৈতিক নিরপেক্ষ লোক। আমি কোনো দল করি না। কোনো দলের প্রতি আমার পক্ষপাত নেই। কে গেল আসলো কিছুই যায় আসে না। (৭ অক্টোবর, ২০১১, সাক্ষাৎকারের লিংক-‘আমার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নাই’ – আল মাহমুদ)

প্রয়াত কবি আল মাহমুদের এই সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয়েছিল বাংলা ১৪০৩ সনে, তার মগবাজারের বাসায়। সেখানে তিনি বলছেন; একমাত্র আমি ছাড়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা লেখক বাংলাদেশে নাই। সেখানে তিনি তার বামপন্থী থেকে ইসলামপন্থী হওয়ার বিষয়টিও পরিষ্কার করলেন।

রাইসু : আপনি রাজনীতি আগে শুরু করেন, নাকি কবিতা ?
মাহমুদ : আমি কখনো রাজনীতি করি নি।
রাইসু : তো আপনি বামপন্থী রাজনীতি করতেন বলে বলা হয় ?
রাজু : জাসদের রাজনীতি ?
মাহমুদ : না, এটা বলা হয় ঠিকই, আমি কিন্তু প্রফেশনাল জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করি এবং যখন আমি দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক তখনও আমি, হ্যাঁ তখন হয়তো মার্ক্সবাদ দ্বারা খুবই আপ্লুত ছিলাম। কিন্তু, ডাইরেক্ট পলিটিক্সে আমি কখনো অংশগ্রহণ করিনি।
রাইসু : মার্ক্সবাদ দিয়ে কি আপনি এখন আর আপ্লুত নন ?
মাহমুদ : না।
রাইসু : কেন ?
মাহমুদ : আমি মনে করি যে মার্ক্সবাদ ব্যর্থ হয়েছে। মানবসমাজের কল্যাণে, সমসমাজ গঠনের ফর্মুলা, যে ফর্মুলা কার্ল মার্ক্স দিয়েছেন তা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
মশিউল আলম : প্রথম দিকে মার্ক্সবাদের কোন জিনিসটা আপনাকে সবচে আকর্ষণ করেছিলো ?
মাহমুদ : সব তরুণদেরই যেটা আকর্ষণ করে। সেটা হলো যে ‘কম্যুনিস্ট ইশতেহার’ পড়ে মানবসমাজ যে এরকম হতে পার– ‘কম্যুনিস্ট ইশতেহার’কে আমি খুব বাস্তবসম্মত একটি বিবৃতি বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পেরেছি এটিও একটি ইউটোপিয়া।
রাইসু : এখন আপনি কোন পর্যায়ে আছেন ?
মাহমুদ : আমি মনে করি যে মানবমঙ্গল ইসলামেই সম্ভব।
রাইসু : এটাও যে একটা ইউটোপিয়া না আপনি কিভাবে বুঝবেন ?
মাহমুদ : এটা এজন্য যে, এটা মানুষের দ্বারা তৈরি কোনো ধর্ম নয়। এটা হলো আল্লাহর নির্দেশিত ধর্ম এবং পবিত্র কোরআন যে সময় অবতীর্ণ হয়েছে তখন হলো সামন্ততন্ত্রের একেবারে উজ্জ্বল সময়। এ সময়ে ধনতন্ত্রেরও স্ফূরণ হচ্ছে ইহুদীদের হাতে। এই সময়ে ইসলাম এসেছে। ইসলামের কোরআন পাঠ, প্রাথমিক পাঠেই একটা লোক তার জায়গা থেকে নড়ে যাবে। যদি সে বোঝে। যদি তার কনটেমপোরারি, সেই সময়কার ইতিহাস, সমাজ, অন্যান্য পরিস্থিতি, ধর্ম সম্বন্ধে পরিচ্ছন্ন জ্ঞান থাকে, মুহূর্তের মধ্যে সে অভিভূত হয়ে যাবে যে এগুলি ইঙ্গিতময় ভাষায় বলা হচ্ছে, কিন্তু প্রত্যেকটির একটি বাস্তবনির্দেশিত পথনির্দেশ রয়েছে। আমি মনে করি যে পৃথিবীতে এখন সামাজ্যবাদ গত হয়েছে, এখন পুঁজিবাদের যুগ। বিশ্ববিচরণশীল পুঁজিতে আমরা এখন। ধনতন্ত্রের এটা হয়তো একেবারে অন্তিম একটা সময়। ধনতন্ত্রকে পরাজিত করে একটা মঙ্গলময়, কল্যাণময় মানবসমাজ করতে পারে এরকম যদি কোনো নীতি থাকে, তাহলে সেটা আমি মনে করি পবিত্র কোরআন। এটা আমি বিশ্বাস করি। এতে আমার ঈমান রয়েছে। তবে এর জন্য যে ঠিক আমি রাজনৈতিক সংগ্রাম করি, তা আমি করি না। কারণ আমার সংগ্রামটা হলো–
রাইসু : ‘সংগ্রাম’ পত্রিকায় ?
মাহমুদ : এটা ঠিক না। আমি ‘সংগ্রাম’ পত্রিকায়ই লিখি এমন কোনো কথা না। আমি এদেশের অনেক পত্রিকাতেই লিখি। যেহেতু আমি একজন রিটায়ার্ড পারসন, দশটা কাগজে লিখে খাই।
রাইসু : বামপন্থা থেকে আপনি হঠাৎ করে ঝুঁকলেন কিভাবে ইসলামের দিকে ?
মাহমুদ : হঠাৎ করে ঝুঁকি নাই। আমার বই যেভাবে বেড়ে উঠিতে আছে। আমার কৈশোরকালে আমি একটা পাঠাগারে কিছু লোকের সঙ্গে পরিচিত হই। ওরা সবাই ছিলেন কম্যুনিস্টপার্টির লোক। এরা একটা পাঠাগার চালাতেন। লালমোহন স্মৃতি পাঠাগার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেই পাঠাগারে গিয়ে আমি জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে এমন বিচিত্র কিছু বইয়ের সন্ধান পাই এবং কম্যুনিস্ট মতবাদ সম্পর্কে ক্লাস করে এরা কম্যুনিস্ট অর্থনীতি বোঝাতে চেষ্টা করেছে। আমি বুঝতে পেরেছি এবং তাদের সাথে ঐকান্তিকতা বোধ করেছি। শুধু তাই না, আর একটা জিনিস তাদের মধ্যে দেখেছি, সেটা হলো আত্মত্যাগ। তারা নিজকে কিভাবে উৎসর্গ করে দিয়েছে কম্যুনিস্ট সমাজব্যবস্থা গড়বার জন্যে। অধিকাংশ লোকই ধ্বংস হয়ে গেছে পরিবারের। এসব দেখে আমার মনে একটা গভীর আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এখন মনে হচেছ যে কী ভুল পথেই না এই এতগুলো জীবন ধ্বংস হয়েছে।

কমিউনিজম সম্পর্কে কবি:

মশিউল : আচ্ছা মাহমুদ ভাই, একটু আগে আপনি বললেন যে, স্যোশালিস্ট ইকোনোমিক সিস্টেম, স্যোসাল সিস্টেম যেটা সেটা ব্যর্থ। এটা আমাদের চোখের সামনে প্রমাণিত।

মাহমুদ : ওটা আর ভাই আসবে না, কবর থেকে উঠে আসবে না। একটা কথা আছে না, একটা গল্প পড়েছিলাম যে ইল্লোল আর বাতাপি বলে দুটো রাক্ষস ভেবেছিলো যে সমস্ত ব্রাহ্মণদের নিকেশ করে ফেলবে। তো ইল্লোল নিজে একটা ভেড়া সাজতো, বাতাপিকে একটা ভেড়া সাজিয়ে দিতো, সে ভেড়া হয়ে যেতো যাদুমন্ত্র বলে। আর ইল্লোল সেটাকে কেটে-টেটে ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতো। যখন ব্রাহ্মণরা খেয়ে-দেয়ে ঢেকুর তুলছে তখন সে আড়ালে গিয়ে ডাকতো : বাতাপি, বাতাপি! আর বাতাপি পেট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতো। তো এই কথা শুনে অগস্ত্য মুনি একদিন বললেন যে, এই দুই বদমাইশের হাত থেকে তো ব্রাহ্মণদের রক্ষা করতে হয়। তখন তিনি গেলেন, তাকে দাওয়াত করা হলো। তিনি আহার করলেন। ইল্লোল পেছনে গিয়ে ডাকলো, বাতাপি, বাতাপি। অগস্ত্য এদিক থেকে বলছে, আর আসবে না, হজম করে ফেলেছি। তো সেরকম কার্ল কম্যুনিজমকে মার্ক্সবাদকে হজম করে ফেলেছে, আর ডাকলেও আসবে না।

জামাত প্রসঙ্গে কবি

রাজু: ঠিক আছে। আপনার সম্পর্কে ভুল বা সঠিক যেটাই হোক না কেন তা হলো আপনি জামায়াতের সক্রিয় সদস্য কিনা?

মাহমুদ: না। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না।

রাজু: তাহলে জামায়াত আপনার পৃষ্ঠপোষক কেন?

মাহমুদ: আমি দৈনিক সংগ্রামে চাকুরি করি। আপনি তো জানেন আমি সরকারী কর্মচারী হিসেবে রিটায়ার করেছি। লিখে-টিখে খেতে হয় আমাকে। সংগ্রামে লিখি, পালাবদলে লিখি এবং আরও কয়েকটা পত্রিকায় লিখে-টিখে খাই। এখন আপনি বলছেন যে তারা পৃষ্ঠপোষক কিনা। হতে পারে। আমি যেহেতু ধর্মে বিশ্বাস করি, ধর্মের কথা বলি; শুধু এখানেই নয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে। তারা আমাকে সমর্থন করে।

রাজু: তারা ভাবে যে আপনি তাদের লোক।

মাহমুদ: তারা হয়তো ভাবতে পারে। তাদের লোক বলে আমাকে ভাবে কিনা সেটা তো আমি আর তাদের মনের কথা জানি না।

রাজু: তাদের মনের মানুষ ভাবে আপনাকে।

মাহমুদ: আমাকে তারা ভালোবাসে।

রাজু: ভালোবাসে? সাধারণত ভালোবাসা তখনই ঘটে — একটা লোককে আমরা ভালোবাসি কেন? কিংবা আপনার কবিতা আমার ভালো লাগে কেন? ভালো লাগে এই কারণে যে মনে হয় যেন এটা আমার মনের কথা। তো ওরা যে আপনাকে ভালোবাসে, তার মানে ওদের মনের সঙ্গে আপনার মনঃগঠনের কোনো ঐক্য আছে বলেই কি ভালোবাসে?

মাহমুদ: আমি আগেই বলেছি যে আই অ্যাম নট এ পলিটিশিয়ান। আমি যেহেতু ইসলামে বিশ্বাস করি ইসলামের কথা বলি…

রাজু: ইসলামের নাকি ‘জামায়াতে ইসলামী’র?

মাহমুদ: না, এই ধরনের প্রশ্ন করা সঠিক নয়। দলকে নিয়ে একজন কবিকে এই ধরনের প্রশ্ন করা কি সঠিক? আমি তো আগেই বলেছি আমি রাজনীতিক নই।

রাজু: কিন্তু আপনাকে তো জামায়াতে ইসলামীর অনেক দলীয় কর্মকাণ্ডে দেখা গেছে।

মাহমুদ: না, এটা আপনি ঠিক বলেন নি।

রাজু: অনেক অনুষ্ঠানে দেখা গেছে; আপনি সভাপতিত্ব করছেন বা গেস্ট হিসেবে আছেন।

মাহমুদ: আমি হয়তো তার কোনো ছাত্র সংগঠনের কালচারাল অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছি। অনেক ছাত্র সংগঠনেই আমি করে থাকি। কিন্তু যেহেতু আমি কোনো একসময় বা কোনো একবার বা দুইবার বা তিনবার তাদের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি তাতে আমাকে এভাবে চিহ্নিত করা ঠিক না।

রাজু: আপনি জামায়াতের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন কিনা?

মাহমুদ: জামায়াতের রাজনীতি কী — সেটা আমার কাছে প্রথম ব্যাখ্যা করতে হবে। তাহলে আমি বুঝতে পারবো আমি সমর্থক কিনা। জামায়াতে ইসলাম ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী শরিয়ত প্রচলনের জন্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। আমি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী, আমি একজন কবি। কোথাও যদি তাদের সাথে আমার মিল হয় সেটা তো ভালো কথা আমি মনে করি, অসুবিধা কী? এবং তারা যদি সে-কারণে আমাকে খানিকটা পৃষ্ঠপোষকতা দেয় তাহলে সেটা আমার লভ্য; এটাকে বলি না যে এটা দোষনীয়। যেহেতু তারা আদর্শগতভাবে আমার কবিতা বা আমাকে সমর্থন দেয় তাহলে এটা দোষণীয় মনে করি না। এ কারণে আমাকে রাজনীতি করতে হবে বা রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে — এটা জরুরী না।

রাজু: না, কিন্তু ওদের রাজনীতিতে আপনি বিশ্বাস করেন কিনা?

মাহমুদ: আমি ইসলামে বিশ্বাস করি। জামায়াতে ইসলাম দেশের নানান ঘটনায় নানা রকম রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালায়, এটার সাথে ইসলামের সম্পর্ক থাকতেও পারে। নিশ্চয় থাকবে, কারণ তারা তো ইসলামী দলই। ( কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার- রাজু আলাউদ্দিন)

ব্লাসফেমী আইন সম্পর্কে কবি

রাজু: ঠিক আছে, ব্লাসফেমী আইন কি আপনি সমর্থন করেন?

মাহমুদ: ব্লাসফেমী হলো একটা বৃটিশ আইন। তাদের দেশে যীশুখৃষ্টের বিরুদ্ধে… যদিও তারা খুবই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বলে, কিন্তু তাদের একটা আইন আছে: সরাসরি কেউ যদি খৃষ্টবিরোধী কোনো আচরণ করে তাহলে তাকে ব্লাসফেমী আইনে সাজা দেয়া হবে। এ ধরনের আইন তাদের আছে। এখন একই রকম ব্লাসফেমী আইন আমাদের নাই তবে ধর্মীয় কতগুলো আজ্ঞা-অনুজ্ঞা আছে: কেউ মুসলমান হয়ে যদি ইসলামের বিরোধীতা করে, রাসুলুল্লাহ আলায়হে সাল্লামের নিন্দা রটনা করে তাহলে আমাদের ধর্মে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, আমাদের শরিয়ত মতে সে মৃতুদণ্ডের যোগ্য।

রাজু: এবং আপনি সেটা সমর্থনযোগ্য মনে করেন?

মাহমুদ: আমি সমর্থনযোগ্য অবশ্যই মনে করি।

রাজু: এটা কী করে হয় যে বারশ’ বছর আগের একটি ধর্মীয় আইন বারশ’ বছর পরের মানুষের সৃষ্টিকে চিন্তাকে রোধ করার কাজে ব্যবহার করা হবে।

মাহমুদ: এক শ’ বিশ কোটি মানুষ যাকে পথপ্রদর্শক বলে মনে করে তাকে গাল দেবার অধিকার কারো নাই। আমরা মুসলমানরা সব সময় মনে করি যে রসুলের নিন্দা আমরা সহ্য করিনি, এটা আমাদের ঐতিহ্য, এটা আমাদের ইতিহাস। আমরা আল্লাহর নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসসালামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করাকে দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে ধারণা করে এসছি।

রাজু: কিন্তু এই আইনগুলো যারা প্রয়োগ করবে ইসলামের নামে তারা হয়তো এক সময় যৌনতার অপরাধে সোনালি কাবিন ব্যান্ড করে দেবে। এই যৌনতা নৈতিকভাবে বিপদগামী করে দিতে পারে।

মাহমুদ: ইসলাম একটা সহনশীল ধর্ম। আপনি জানেন যে ইসলামের আগের যুগের এক ইমরাউল কায়েস অসাধারণ কবিত্ব শক্তির অধিকারী ছিলেন….