করোনার কারণে ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসের সকালেই ১৬ দিনের অনানুষ্ঠানিক লকডাউনের খপ্পরে দেশ। ট্রেন-লঞ্চ-বিমান বন্ধ হয়েছে আগেই, এবার হলো গণপরিবহন।

অবশ্য ঘোড়ার আগেই গাড়ি ছুটেছে বেশ। প্রথম ঘোষণা এলো টানা স্কুল-কলেজ ছুটি। বাঙালিকে আর পায় কে? ‘ফেরারী এই মনটা আমার, মানে না কোনো বাঁধা’…

দলে দলে সবাই বন্ধু-বান্ধব, স্বপরিবারে ছুটলো কক্সবাজারে সাগরপাড়ে, অনেকেই সেন্ট মার্টিন প্রবাল দ্বীপে। উপচে পড়া পর্যটকে রোহিঙ্গা উপদ্রুত সীমান্ত শহরটি ফিরে পায় প্রাণ। টিভির পর্দায় হেসে হেসে শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বয়ান দেন, ‘পরীক্ষার পর এই লম্বা ছুটি, তাই বন্ধু-বান্ধব নিয়া দল বাইন্ধা ঘুরতে আসছি, খুব মজা লাগতেছে’… ইত্যাদি।

কিসের কোয়ারেন্টিন? সামাজিক দূরত্ব বা সঙ্গরোধ? স্বাস্থ্যবিধি, শাবান-পানি, হাঁচি-কাশির শিষ্টতা? নাকি শুধুই মুখোশ?

মোদিজীর ভিডিও কনফারেন্সে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ, প্রতিদিন টিভি, রেডিও, সংবাদপত্র, মোবাইল টেক্সটে গুচ্ছের প্রচার—সবই কী তাহলে বৃথা?

সরকারি বাধ্যবাধকতায় অবশেষে খালি হলো কক্সবাজার, নটে গাছটি মুড়োলো না তখনই।

ওদিকে, খবরে প্রকাশ, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবিরে ঘনবসতির কারণে সবচেয়ে করোনা ঝুঁকিতে আছেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ঘিঞ্জি বস্তির ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা প্রায় ১১ লাখ মানুষের জন্য হোম কোয়ারেন্টিন কতোটা কার্যকর? তাছাড়া লকডাউনে সেবা কার্যক্রম সীমিত করার পরেও সেখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি এনজিওর শত শত স্বেচ্ছা সেবক ও রোহিঙ্গাদের নিজেদেরও অবাধ চলাচল। পরিস্থিতি সত্যিই ভীতিকর।

২.

করোনা ভীতির কিছুটা স্টিম রিলিফ খালেদা জিয়ার মুক্তির খবরে। দুর্নীতির মামলায় দুবছর কারারুদ্ধ বিরোধী নেত্রীর জামিন, প্যারোল, আন্দোলনে মুক্তি, রিভিউ পিটিশন, বিদেশে চিকিৎসা ইত্যাদিতে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে যথেচ্ছ। এন্তার সংবাদ শিরোনামের ঘাটতি পূরণ হয়েছে কতোই না! টক শোর পর টকেটিভ শো, টেবিল চাপড়ে গ্রন্থিকগণ কতো কথারই ফুলঝুড়ি না ঝরালেন! কিন্তু হুকুম যেন আর নড়ে না।

অবশেষে বরফ গললো পরিবারের স্বজনদের ধর্ণায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে তিন শর্তে বিএনপি নেত্রী, জামাতের অঘোষিত নায়েবে আমির, খালেদার কারাদণ্ড ছয়মাসের জন্য স্থগিত হলো। তবে এই সময় তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন, বিদেশে যেতে পারবেন না এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও করতে পারবেন না।

এদিকে, এই মুক্তিকে ঘিরে বিএনপির শত শত নেতা কর্মী শাহবাগের বন্ধবন্ধু মেডিকেলে হাসপাতালে ও গুলশানের নেত্রীর বাসভবন ‘ফিরোজা’র সামনে ভীড় জমায়, করোনা সতর্কতা? সঙ্গরোধ? ইহা হয় কি বস্তু?

আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে শ্লোগানে, ‘দেশ গড়েছেন শহীদ জিয়া, নেত্রী মোদের খালেদা জিয়া’…ইত্যাদি। অসংখ্য মিডিয়া, মোবাইল ক্যামেরা, ভীড়-ভাট্টা, পুলিশের মুহুর্মুহু বাঁশি, নিরাপত্তা সাইরেনে কেমন একটি উত্তেজনাময় আনন্দমুখর পরিবেশ।

কিছুতেই বাঙালিকে দাবায়া রাখতে পারবা না!…

৩.

আগেই ২৪ মার্চ এসেছে টানা ১০ দিনের গণছুটির ঘোষণা। ব্যাগ গুছিয়ে দলে দলে ম্যাংগো পাবলিক ছুটলেন বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন, সদরঘাটে। সবার চোখেমুখে চিকচিক করছে ঘরে ফেরার খুশী। এ যেন ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা।

২৪/৭ টিভি ওয়ালাদের পোয়াবারো। ঘণ্টায় ঘন্টায় মুখোশ পড়ে লাইভ। ‘হ্যাঁ সাদিয়া, আমি কমলাপুর থেকে আপনাকে শুনতে পাচ্ছি, এখনো ঘরমুখো মানুষ গাদাগাদি করে লাইন দিয়ে ট্রেনের টিকিট কিনছেন, একেকটি ট্রেনে উপচে পড়া, কোনো রকম করোনা সুরক্ষা, সঙ্গরোধ ইত্যাদির বালাই নেই। যেন ঈদের খুশীতে বাড়ি ফেরার ধুম। সবাই বলছেন, করোনা ভীতির কারণেই ঢাকা ছাড়ছেন তারা, মরিবাঁচি, গ্রামের বাড়িতে গিয়েই মরবো’…ইত্যাদি।

এরপর হলো ট্রেন-লঞ্চ-অভ্যন্তরীণ বিমান বন্ধ। ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস থেকে গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণায় ১৬ দিনের অনানুষ্ঠানিক লকডাউনের পড়লো দেশ।

আগের দিন থেকেই দেশজুড়ে সঙ্গরোধে নামে নিরাপত্তা বাহিনী। ঢাকার অলিগলিতে মাইকিং-এ বন্ধ করা হয় সব দোকানপাট, মার্কেট, শপিং মল। শুধু নিত্যপণ্যের দোকান, ওষুধ, মুদিখানা ইত্যাদি খোলা। খা খা করতে থাকে শহর।

এরশাদ বিরোধী কড়া হরতালেও এমন দৃশ্য দেখেনি কেউ। যেন অঘোষিত কারফিউ।

তবে জুমা বারে মসজিদে মুসুল্লির অভাব পড়েনি। যার কেউ নাই, তার আল্লাহ আছে। কোনো কোনো মসজিদ উপচে রাস্তাতেও নেমে আসে ঈমানদার মানুষের নামাজের কাতার। এক-দেড় মিটার দূরত্ব, সঙ্গরোধ-টোধ ওসব বোধকরি আল্লা-ওয়ালাদের জন্য নয়।

সৌদিতে নামাজ বন্ধ, মক্কা-মদীনায় ঘুঘু চড়তেছে তাদের ঈমান নষ্ট বইলা। হু হু বাবা, আমাগো লগে যুক্তিতে পারবা? এইটা অলি-আল্লার দ্যাশ, এইখানে করোনা-মরনো পাত্তা পাইবো না…!

৪.

“বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি”… স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকার, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১।

ওদিকে, খবর আসতে থাকে সারাদেশে নিম্নবিত্ত, দিনমজুর, নিত্য আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে। হকার, পান-বিড়ি-সিগারেট, চা ওয়ালা, রিকশা ওয়ালা, মুটে-মজুর স্রেফ অনাহারে পড়েছেন।

সরকার বাহাদুর নিম্নবিত্তদের ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়া কথা বলছেন, তবে কাজীর গরু এখনো বোধকরি খাতাতেই।

লকডাউনের প্রথম দিনে, স্বাধীনতা দিবসের সকালেই জাতি দেখলো এক কিম্ভুত বাংলাদেশ।

ঢাকাসহ সারাদেশে হত-দরিদ্র দিনমজুর, যারা উপায় না দেখে দুমুঠো ভাতের তাড়নায় বের হয়েছিলেন, উর্দি বাহিনী তাদের কান ধরে ওঠবস করায়। কোথায় আইল্যান্ডের ওপর নি ডাউন করিয়ে রাখে। কোথাও চালক বিহীন রিকশা ওয়ালাকে রোজগারে রিকশাটিকে সাক্ষী রেখে রোদে ভেতর কান ধরিয়ে রাখে। ফেসবুক উপচে পড়ে গ্লানিময় ছবির পর ছবিতে। অবশেষে মূলধারার মিডিয়াতেও দুজন গোবেচারা বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে রাখার ছবি চলে আসে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাস্ক না পড়ার অভিযোগে সাধারণ মানুষকে উপনিবেশিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বলে খবরে প্রকাশ। সেক্ষেত্রে কী রাষ্ট্রের প্রতীক উর্দির দায়িত্ব নয় এসব অভাবী, দিনমজুরদের অহেতুক নির্যাতন না করে দু-চারকেজি চাল-ডালের সাথে বিনামূল্যে একটি মাস্ক ধরিয়ে দেওয়া?

নাকের বদলে নরুণের এই ঘৃণ্য পুলিশরাজ আর কতোকাল?

সবশেষ : সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) অনলাইন ব্রিফিং-এ জানাচ্ছে, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৫ জন। আর ২৭ মার্চ পর্যন্ত দুজন চিকিৎসকসহ আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ জন।

তিনটি হাসপাতাল ছাড়া দেশের আর কোনো হাসপাতালে করোনা শনাক্তের ল্যাব নেই। চিকিৎসক-নার্সদের করোনা সুরক্ষা ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত মেডিকেল কিট ইত্যাদি অল্প কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও নেই। ঢাকা মেডিকেলসহ অধিকাংশ হাসপাতালই এখনো করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতই নয়। যে ১০ টি হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, তার সবই আবার ঢাকাতেই।

করোনা ভীতির কারণে দেশের অধিকাংশ হাসপাতালই সীমিত করেছে চিকিৎসা সেবা। সাধারণ রোগিরা বিপাকে। এই বাস্তবতায় দ্রুত করোনার বিস্তার হতে থাকলে কী আছে আগামীতে? …