শাসক শোষকরা সব সময়ই চেয়েছে সাধারণ নাগরিকের মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে আর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সেরা সুযোগ সুবিধাগুলো ভোগ করতে। চতুর এইসব শাসক শোষকদের বিরোধিতা যারাই করেছে অথবা নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার দাবি করেছে তাঁরাই পড়েছে শাসকের রোষানলে। হাজার হাজার বছর ধরেই চলছে এমন দাপুটে অন্যায়, ছলে বলে ও কৌশলে। সাধারণ মানুষদের মধ্যে যারা প্রতিবাদী, সাহসী ন্যায়পরায়ণ অথবা অপেক্ষাকৃত তথ্যাভিজ্ঞ তারাই গণ্য হয়েছে শাসকের শত্রু হিসেবে। শোষকগোষ্ঠী স্বার্থবাদীদের সাথে আঁতাত করে খুন করেছে এইসব এগিয়ে থাকা সু-নাগরিকদের অথবা করেছে নির্যাতন নিপীড়ন প্রতারণা ও বঞ্চনা। টিকে থেকেছে ক্ষমতায়। বাংলাদেশে জন্মানো এমন সুনাগরিকদের মধ্যে নির্মোহ ও মুক্তমনের অত্যুজ্জ্বল একটি মানুষ ছিল অভিজিৎ রায়। নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছিল তাঁকে ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। একই হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্কটজনক ও ভাবে গুরুতর আহত হয় আরেকজন মুক্তমনের মানুষ, উজ্জ্বল মানবতাবাদী রাফিদা আহমেদ বন্যা, অভিজিতের স্ত্রী। এই তারিখের আগে ও পরের মাস এবং বছরগুলোতেও খুন হয়ে যায় যুক্তিবাদী প্রগতিশীল ও মুক্তমনের আরো অনেক লেখক। মুক্তমত প্রকাশের চেষ্টা করলেই লেখক বক্তা সাংস্কৃতিক কর্মী, মানবতাবাদী অথবা সাধারণ মানুষের প্রতি আরোপ করে দেওয়া হয় কঠিন সব ভীতিকর ও শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা। এই সব দেখেশুনে ধারণা বদ্ধমূল হয় যে এ সবকিছুর মূলই হল শাসক শোষকের ক্ষমতায় টিকে থাকবার নিষ্ঠুর স্পৃহা কারণ এই সব হত্যাকাণ্ডের বিচারে তাদের আলস্য অনীহা খুবই স্পষ্ট।
ড: অভিজিৎ রায় বিজ্ঞান নিয়ে যেমন লিখেছে তেমনি লিখেছে সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, নির্মোহ ও সংশয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে নানাবিধ বিষয়ে, অথচ খুন হতে হল ধার্মিক মৌলবাদীদের হাতে। এই ষড়যন্ত্রে কারা আসলে জড়িত ছিল বেরুবে ঠিকই একদিন, কিন্তু আপাতত দায় চাপানো হলো ধর্মের মিথ্যে অনুভূতির উপর। ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে শাসক শোষকদের আড়ালে রয়ে যাওয়া নতুন নয় মোটেও।
শাসক শোষক আর চতুর পূজারীদের সেই অজুহাতের যে অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ধর্ম সেইটার শুরুর দিকের ঘটা করে আনুষ্ঠানিক চর্চা নিয়ে একটু দেখা যাক। বেছে নেওয়া যাক পণ্ডিতদের পছন্দের একটি এলাকা। আধুনিক মানুষ ভালোভাবে বেঁচে থাকবার জন্য যখন কিছুটা গোত্রবদ্ধ হতে শিখেছে, আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের একটি সময়কে নির্দেশ করে ঐতিহাসিকেরা সেই সময়ের বেশ কয়েকটি গোত্রের প্রার্থনা বা পূজা অনুষ্ঠানের কথা বলেন। এই জায়গাটি বহুল আলোচিত সেই মেসোপটেমিয়া। আজকের ইরাক এর অনেকটা জুড়ে রয়েছে। ইরাকের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ইউফ্রেটিস আর টাইগ্রিস নদীর বেশীর ভাগটা আশপাশের একটি অর্ধচন্দ্র আকৃতির উর্বর এলাকা উপহার দিয়েছিল, আর এই কারণেই এইটি ছিল সেই সময়কার অনেক মানুষের বেশ পছন্দের এলাকা। আজকের ইরাক, সিরিয়া, ইরান কুয়েত আর তুরস্কের আশেপাশের কিছুটা এলাকা জুড়ে ছিল এর বিস্তার। এখানকার মানুষরা গড়ে তোলে এক ধরণের গোষ্ঠীবদ্ধ সভ্যতা। উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রথম শুরু করে চাষবাস, আবিষ্কার করে সহজে গড়াবার জন্য চাকা, ব্যবহার করা শেখে লোহার আর শেখে ছবি এঁকে লিখে ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহার করে বর্ণের মত কিছু। পাশাপাশি গড়ে তোলে ঈশ্বরের নানান মন্দির। তবে এটাও বটে যে সেই একই সময়ে এই গোটা পৃথিবী গ্রহে বিচ্ছিন্ন ভাবে মানুষের আরো অনেক উত্তরণ ঘটতে থাকে। সেই সময়ের মানুষ সহ আরো আগের সময়ের মানুষ যখন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ত, রোগ ব্যাধি, বন্যা খরা, ঝড় ঝঞ্ঝা শিলাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, ব্জ্রপাত অথবা যে কোন ব্যাখ্যাতীত অস্বাভাবিকতা এদের সামনে এসে পড়ত তখন আতঙ্কে সিঁটকে যেত তারা। তাদের জীবনযাত্রা হয়ে পড়ত প্রায় অচল। এসব ছিল মানুষের জন্য খুবই ভয়ের। জীবনের যাপনে এইসব হত সমাধানবিহীন মারাত্মক হুমকির ব্যাপার। স্বভাবত কাজেই মানুষ খুঁজত এই সব থেকে রক্ষার উপায়। তারা সম্ভবত দেখত সূর্যকে সব থেকে শক্তিমান রূপে, আর দেখত নদী সাগরের শক্তি, দেখত বন্যা, ভূমিকম্প থেকে শুরু করে আগুনের ভয়াবহতা অথবা শক্তিমান পশুদের নৃশংসতা। ভাবত এইসব দেখা বা না দেখা শক্তিমানদের সন্তষ্ট করলেই হয়ত মিলবে শান্ত জীবন। তাই ভয়ের চোটে করত তাদের পূজো। শাসক গোত্রপ্রধান সর্দার বা মাতব্বরদের ছত্রছায়ায় এইসব পূজো প্রার্থনার পদ্ধতি বাৎলে দিত চতুর কিছু মানুষ যারা ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠেছিল পাদ্রী পুরোহিত বা মোল্লাদের মত চরিত্র, সুবিধাবাদী দালাল চরিত্র। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেই ছিল শাসক রাজা রানীর বাস যারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি অথবা নিজেকেই ঈশ্বর বলে দাবি করত, অথবা ধরে রাখত পূর্বতন শাসক বংশধরের পরিচয়। সাধারণ শান্তিপ্রিয় তথ্যাভাবী অজ্ঞ আলসে নির্বিরোধী মানুষ মেনে নিত তা’ই, কুঁজো হয়ে পড়ত, দেখাত আনুগত্য। পূজারী পাদ্রী পুরোহিত মোল্লা আর রাজা রানীরা সেই সব ভিতু কুঁজো হয়ে পড়া মানুষের কাছ থেকে লুটতো ফায়দা। থাকত ক্ষমতায় আর দেখাত ক্ষমতা ইচ্ছেমত। এসব করতে রাজা রানীরা করত পূজারীদের সাথে নির্লজ্জ আঁতাত। আজকের এই কালেও গোটা পৃথিবীব্যাপী এই পদ্ধতি রয়েছে একেবারে একই রকম। বদলায়নি কিছুই, বাংলাদেশেও নয়।
আজকের মানুষ কখনো যখন নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসেন যে সে কোত্থেকে এলো, তার আসবার আগের ইতিহাসটি কি, কিভাবে কি কেন’র মত অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজে যখন মানুষ, তখনি শুরু হয় তাঁর নিজের জন্য সত্যি নিয়ে আসল ভাবনা। অথচ একটুখানি স্থির হয়ে এমন সহজ স্বাভাবিক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার সময় নেই অনেকের। আসলে প্রশ্নটি তুলবার ইচ্ছেই হয় না অনেক মানুষের। শাসক শোষক আর পুরুত মোল্লা পাদ্রীদের নির্দেশনা মানতেই যেন ভালো লাগে তাদের। আলসে ঘুমঘুম ভাব আর অতি আয়েশের জীবন যে অন্ধত্বের এটা বুঝতে পেরে যেসব মানুষ জ্ঞানের আলো খুঁজতে বেরোয় তাদের জন্য কিন্তু পৃথিবী আর অন্য সকল সত্য বড্ড সুন্দর হয়ে ওঠে। ধরা দেয় জীবন সম্পূর্ণ অন্য আলোকিত কোন বোধে। উত্তর খুঁজতে যারা সাহায্য করেন, হাজার হাজার বছর ধরে যারা করেছেন আর আজকেও যারা আলোর পথ দেখান তাঁরাই মুক্ত মনের মানুষ, তাঁরাই জ্ঞান সন্ধানী। এদেরকে মেরে ফেলা, ঘৃণা করা অথবা ছোট করা কোন কাজের কথা নয়, ভালো কথা তো নয়ই। সত্যি জানতে হলে নিজে উদ্যোগী হয়ে জ্ঞানার্জনের কোন বিকল্প নেই। অভিজিৎ রায়’দের মত আদর্শিক মানুষদের বেঁচে থাকতে হয় সত্যকে কাছে পাবার জন্য।
নিজের জন্য প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, কল্যাণের জন্য সত্যের অনুসন্ধান, উপলব্ধির জন্য জ্ঞানের চর্চা এসব দোষের হতে পারে না। অথচ এই সামান্যতেই দোষ খুঁজে পায় শাসক শোষক আর পূজারী। গদি হারিয়ে ফেলবার ভয় পেয়ে যায় তারা। নিজ স্বার্থে বানায় স্বরচিত স্বর্গ-নরক অথবা ষড়যন্ত্রের কালো আইন, এড়িয়ে যায় ন্যায়বিচার। অভিজিৎ রায় যে বাংলাদেশে জন্মেছিল সেই বাংলাদেশ আজ মৌলবাদীদের দখলে। এই দেশের শিক্ষাক্রম নিয়ন্ত্রণ করে মোল্লারা। এদেশের পণ্ডিত লেখক গবেষক বা সাধারণ মানুষ কি লিখবে তা নির্ধারণ করে পুলিশ। এই দেশের শুধুমাত্র একটি ধর্ম হয়ে পড়ে হিংস্র প্রাণীর মত অনুভূতিপ্রবণ। আলোচনা সমালোচনায় ধর্মের অনুভূতিতে লেগে যায় আঘাত আর তাই সমালোচক খুন হলে শাসক উদাস হয়ে বসে থাকে, যেন কিছুই যায় আসে না তাদের।
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচারে রাষ্ট্রের নির্লজ্জ আলস্য ও অবজ্ঞা চোখে পড়বার মত। খুনি বা ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগকৃত উকিলটি খুনের দিন তারিখ পর্যন্ত জানে না। মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর স্বপ্নপূরণের ঠিকাদার হয়েছে যেন শাসক দল। হেফাজতে ইসলামের মত উগ্র মৌলবাদী দলগুলোকে তারা পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে কুঁজো হয়ে। নাগরিকের মুক্তমত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়ে, ভয় দেখিয়ে ধর্মানুভূতির কালো আইনে মুখ বেঁধে দিয়েছে নাগরিকের। তৃণমূলের সাধারণ বাউল বয়াতিদেরও পুরছে জেলে। প্রগতিশীল মানুষ হত্যার প্রেক্ষাপটে সুবিধাবাদী রাজনীতি এবং ধর্মীয় মৌলবাদের এই আড়াল আপোষ মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ বলে গণ্য করা দরকার।
ধর্মওয়ালা আর শাসক শোষক সুযোগ সন্ধানী প্রবঞ্চকরা মিলেই ঠেকিয়ে রাখে জ্ঞানের চর্চা, থামিয়ে রাখতে চায় সত্যের অনুসন্ধান। কিন্তু প্রগতি যে থামবার নয়, কখনো হয়নি সেটা, বাধাগ্রস্ত হয়েছে মাত্র, ইতিহাস তার সাক্ষী। আশার কথা এই যে অনেক বড় সত্যই কঠিন বাধাবিঘ্নকে তুচ্ছ করে সময়ের সাথে সাথে উন্মোচিত হয়েছে, এগিয়েছে পৃথিবী, এগিয়েছে মানুষ আরো অনেক নতুন মানুষের হাত ধরে, বদলেছে শুধু এগিয়ে চলার পথ। সত্যি ঠিকই উন্মোচিত হয়েছে এক সময়ে।
মুক্ত চিন্তার, জ্ঞান চর্চার জয় হোক। নিপাত যাক স্বৈরতন্ত্র। জয় হোক মুক্তমনা’র, অবিরাম।
I think I will die of suffocation…
There are no Free thinkers around me.
Fanatics smothered my throat & I’ll be beheaded later…
Please dethrone the fanatic businessmen
মুসলীম,হিন্দু,ক্রিস্টান বা অন্যরা কখনো মুক্তমনা বা মুক্ত চিন্তা করতে পারবেনা যতদিন না তারা মানুষ হয়,ধর্মই হচ্ছে মুক্ত চিন্তা,মুক্ত চেতনার প্রধান ও একমাত্র অন্তরায়।অভিজিৎদের বাঁচাতে হলে আমাদের মানুষের মতো মানুষ ( ধার্মিক নয় )যারা তাদের কণ্ঠস্বরে,লিখনিতে আরো জোর দিতে হবে…
অবশ্যই। পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির — বীরের মৃত্যু এই রকমই হয়। তবে অভিজিৎ চেতনার মৃত্যু নাই।
অভিজিতরা হারায় না। মুক্তচিন্তার জয় হোক।
মুক্তচিন্তকদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল।আজ অভিজিৎ বেঁচে থাকলে,তার থেকে আরো নতুন নতুন চিন্তার ক্ষেত্র পেতাম।
মুক্তচিন্তা বেঁচে আছে এবং থাকবে। প্রগতির জয় হোক।
ধর্ম এক দারুন অস্ত্র যা পারমানবিক অস্ত্রের চেয়েও মারাত্বক শক্তিশালী।
সত্যিই, মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর অস্ত্র এই ধর্মাস্ত্র।