‘লামিয়া আজি বাসার’ একজন ১৮ বছরের ইয়াজিদি মেয়ে যে ইসলামিক স্টেটের যৌন-দাসীদের বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
খানকে, ইরাক — মোবাইলের টেলিগ্রাম অ্যাপের পর্দায় ভেসে উঠল একটা ভীষণ অস্বস্তিকর বিজ্ঞাপন: “১২ বছরের অত্যন্ত সুন্দরী কুমারী মেয়ে বিক্রয় হবে……অনলাইন নিলামে তার দাম উঠেছে ১২৫০০ মার্কিন ডলার এবং সে অতি শীঘ্রই বিক্রি হয়ে যাবে।” অন্য কেউ কেনার আগেই আপনি কুমারী মেয়েটিকে কিনে নিন।
নিলামকারীর সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে দেখতে পেলাম, আরবি ভাষায় সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে পোষা বিড়াল, আগ্নেয়াস্ত্র, যুদ্ধে ব্যবহার উপযোগী কারিগরি যন্ত্রপাতি সরঞ্জামের সাথে ইয়াজিদি বন্দী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি অ্যাসোসিয়েট প্রেসের কাছে শেয়ার করেছে সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের এক অধিকার সংরক্ষণ কর্মী। তিনি গণমাধ্যমের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের নারী এবং শিশুরা আইসিস জঙ্গিদের কাছে যৌন-দাসী হিসেবে বন্দী আছে এবং নিরুপায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
যখন ইসলামিক স্টেট তাদের স্বঘোষিত খেলাফতের শাসন এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল তখন তাদের হাতে বন্দী থাকা ৩০০০ নারী ও কিশোরী যৌন-দাসীদের উপর কড়া নজরদারি শুরু করে। অন্ধকার যুগের বর্বর নিষ্ঠুরতার সাথে আধুনিক প্রযুক্তি মিশিয়ে আইসিস স্মার্ট ফোনের অ্যাপ, মেসেঞ্জার, ক্রেতার সাথে আলাপ, ভোগ্যপণ্যের মত ইয়াজিদি মেয়েদের ছবি আদানপ্রদান করে। ছবির মেয়ের সাথে তার “মালিকের নাম” উল্লেখ থাকে যাতে তারা আইসিসের চোখে ধুলো দিয়ে তল্লাশি অতিক্রম করে পালাতে না পারে। চোরাকারবারিদের সাহায্যে কোন বন্দী পালানোর চেষ্টা করলেই আইসিস জঙ্গিরা চোরাকারবারিকে তৎক্ষণাৎ গুলি করে যাতে যৌন-দাসী হিসেবে মেয়েদের বিক্রি খাত থেকে অর্থ সমাগম বন্ধ হয়ে না যায়।
২০১৪ সালের আগস্টে ইরাকের উত্তরাঞ্চলের মশুল, রাকা দখলের পর আইসিস সেখানকার কুর্দি ভাষাভাষী সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। ইয়াজিদিদের একটাই অপরাধ তাদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস। আইসিস ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের পুরুষ, কিশোরদের নির্বিচারে হত্যা করে বন্দী করে নারী ও শিশুদের। নারীদের যৌন-দাসী হিসেবে ব্যবহার করে আর শিশুদেরকে মগজ ধোলাই করে মানবঢাল হিসেবে যুদ্ধের ময়দানে ছেড়ে দেয়। তখন থেকে আরব এবং কুর্দি চোরাচালানিরা বিভিন্ন প্রতিকূলতা পেরিয়ে প্রতি মাসে গড়ে ১৩৪ জন ইয়াজিদি বন্দিকে মুক্ত করতে পেরেছিল। কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের দেয়া হিসাব মতে, আইসিস চোরাচালানির খবর পাওয়ার পর নিরাপত্তা চৌকি এবং অতর্কিত হামলা আরও বাড়িয়ে দেয় ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই আইসিসের কবল থেকে মুক্তির পরিমাণ মাত্র ৩৯ জনে নেমে আসে।
জার্মান-ইরাকি সাহায্য সংস্থা Luftbrucke Irak’এর প্রতিষ্ঠাতা মির্জা দানি এই প্রতিবেদককে বলেন, “গত দুই থেকে তিন মাসে আইসিসের কবল থেকে পালিয়ে আসাটা আরও দুরূহ এবং ভয়ানক হয়ে উঠেছে।”
ইসলামিক স্টেটের নথিতে প্রতিটি দাস, তাদের অধিকারে থাকা প্রতিটি বন্দীর নাম, ঠিকানা, বয়স, ছবিসহ নিবন্ধন করা আছে। ফলে কোন বন্দী, যৌন-দাসী যদি পালাতে চায় তাহলে তাকে আইসিস নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি তল্লাশির চৌকি অথবা দায়েশ সদস্যের মুখোমুখি হতে হবে। আইসিসের সবাই মুহূর্তে জেনে যাবে কোন একজন মেয়ে বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। আইসিস প্রতিটি বন্দীর জন্য আরবি ভাষায় সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করত।
এপি নিউজ এরকম ৪৮ জন বন্দীর পালানোর ছবি হাতে পেয়েছে, যারা আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা সবাই জঙ্গিদের কাছে পরিচিত, আইসিসের নিবন্ধিত তথ্যভাণ্ডারে তাদের নাম ঠিকানা ঠিকুজি লেখা আছে। এমনকি আইসিস জঙ্গিদের স্মার্ট-ফোনের নিজস্ব অ্যাপেও তাদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আছে।
লামিয়া আজি বাশার আইসিসের বন্দীদশা থেকে চারবার পালানোর চেষ্টা করে, কুর্দিশ সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পৌঁছানোর জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে দৌড়াতে থেকে, তার পিছনে ধাওয়া করে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। দৌড়ানোর সময় একটা স্থল মাইন বিস্ফোরিত হয়, বিস্ফোরণে মারা যায় তার পালানোর সঙ্গী ৮ বছরের আলমাস এবং ২০ বছরের ক্যাথরিন। সে আর কোনদিন তাদের নাম নিশানা পর্যন্ত জানতে পারবে না।
বিস্ফোরণে লামিয়ার ডান চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে গেছে, তার মুখের ত্বক যেন আগুনে ঝলসে গেছে। একজন পাচারকারী তাকে আইসিস কবল থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। চোখ হারিয়ে, মুখের জ্বলে যাওয়া ত্বক নিয়েও সে মনে করছে সে যেন অন্যদের থেকে সুপ্রসন্ন ভাগ্যের অধিকারী।
১৮ বছরের লামিয়া ইরাকের উত্তরাঞ্চলের বাদরে শহরে তার চাচার বাসায় আহত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থেকেই এপি সংবাদকে বলেন, “আমি শেষ পর্যন্ত নরক থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছি, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, আমি এখন আইসিস বর্বরদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যদি আমার দুইটা চোখই নষ্ট হয়ে যেত তবুও আমি আইসিসের কবল থেকে বাঁচার জন্য সেটাই করতাম”।
উগ্রপন্থী সুন্নি আইসিস জঙ্গিদের কাছে ইয়াজিদিরা উনমানুষ। ইয়াজিদি একটা অন্যতম প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাস যারা ইসলাম, খ্রিস্টান, জরোয়াস্ট্রিয়ান এবং পার্সিয়ান ধর্মের মিশেলে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস লালন পালন করে। এমন ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই আইসিস ইয়াজিদিদেরকে সমূলে বিনষ্ট করতে চায়। যুদ্ধের আগে ইরাকে ইয়াজিদিদের জনসংখ্যা ছিল ৫০০,০০০ কিন্তু এখন তাদের সংখ্যা কত কেউ তার সঠিক হদিস দিতে পারবে না। চিরতরে হারিয়ে গেছে তাদের কেউ, কেউ যুদ্ধে নিহত হয়েছে, কেউ আইসিসের জঙ্গি যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে, কেউ হয়ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
নাদিয়া মুরাদ এরকম একজন পালিয়ে আসা মেয়ে। সে মার্কিন কংগ্রেস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদে উপস্থিত হয়ে আন্তর্জাতিক দরবারের কাছে আবেদন জানায় যাতে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র এবং সংস্থা ইয়াজিদিদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে এবং আইসিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
নাদিয়া মুরাদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদে বলেন, “আইসিস ইয়াজিদিদের সাথে যা কিছু করেছে তার জন্য আইসিস গর্ববোধ করে, আইসিসের উপর যখন মিত্রবাহিনী বোমা ফেলে তখন আইসিস ইয়াজিদি শিশুদের ব্যবহার করে মানব ঢাল হিসেবে, তারা ইয়াজিদি বন্দীদের পালানোর সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে এবং সম্ভবত তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হবে। একটা পুরো জনগোষ্ঠীর সাথে এত বড় অমানবিক ঘটনা ঘটছে, তখন পৃথিবীর অন্য সবাই কে কী করছে? এখন মানবতা কোথায়?”
আইসিসের যৌন-দাসী ব্যবসায়ের আর্থিক লেনদেনে জড়িত একজন মধ্যস্থতাকারী নিরাপত্তার স্বার্থে নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদ মাধ্যমকে জানায়, “আইসিস সাংকেতিক ভাষায় স্মার্ট ফোনের অ্যাপের মাধ্যমে ইয়াজিদি বন্দী নারী, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিক্রি করে”।
এপি’র কাছে নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়াজিদি বন্দী মেয়ের সাথে একজন সক্রিয় আইসিস জঙ্গি সাংকেতিক ভাষায় লিখিত চ্যাটিং দেখাচ্ছিল। সে এপি নিউজকে জানায়, ইয়াজিদি মেয়ে যৌন-দাসী হিসেবে বেচাকেনার পোস্টিং দেয়া হয় “টেলিগ্রাম অ্যাপে”, ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপে এসবের তেমন আঁচ পাওয়া যায় না। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ বা টেলিগ্রাম যে মাধ্যমকেই ব্যবহার করা হোক না কেন প্রত্যেকের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে পুরো যোগাযোগটা সেরে নেয় সাংকেতিক ভাষায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহারকারীদের গোপন আলাপ, ছবি, মেসেজ, সেক্সটিং ইত্যাদি বিষয়কে গোপন রাখে। কোনদিন কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলায় না, তথ্য ফাঁস করে না।
টেলিগ্রামের মুখপাত্র মারকুস রা বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে টেলিগ্রাম আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়, অন্যান্য অঞ্চলেও চলছে সমানতালে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সহজলভ্যতার কারণেই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে অবাধ প্রবেশ ঘটেছে, খুঁটিনাটি বিষয়গুলো চলে আসছে প্রকাশ্যে। এমন অনেক প্রসঙ্গ, ঘটনা ঘটছে যা আইনসম্মত নয়। ফেসবুক, টেলিগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ সবাই চেষ্টা করছি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে অপব্যবহার মুক্ত রাখতে, এগুলোকে যেন ফাঁদের মত ব্যবহার করতে না পারে। তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমের অপব্যবহার রুখতে আমরা নিয়মিত আইসিসের ব্যবহৃত চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দিই”।
এপি জানতে পেরেছে ২০০ সদস্যের গোপন এক হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে ১২ বছর বয়সী কিশোরীর মা তার তিন বছর এবং ৭ মাসের শিশুসহ নিজেকে বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন দিয়েছে, ছবির নিচে মূল্য লেখা আছে ৩৭০০ ডলার। সেই ইয়াজিদি নারী চাচ্ছে তার মালিক শিশুদেরকে বেচে দিক।
এই ধরণের পোস্ট এবং একাউন্টের ক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নীতি বহির্ভূত কিছু পোষ্ট দিলে কেউ তার তথ্য প্রমাণ হাজির করলেই একাউন্টটি অকার্যকর করে দিই। হোয়াটস অ্যাপের মুখপাত্র ম্যাট স্টাইনফিল্ড বলেন, “আমরা মানুষকে উৎসাহিত করি যাতে তারা আমাদের রিপোর্টিং টুল ব্যবহার করে সামাজিক অনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করুক।”
বাইবেলের মতই কোরানেও কিছু সুরা, আয়াতে দাসত্বের প্রসঙ্গ এসেছে যদিও সেক্ষেত্রে আধুনিক মডারেট মুসলিম সমাজ সযত্নে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায়। যদিও ইসলামের প্রসারের সময় কোরআনের ব্যাপক প্রচার ঘটলে দেখা যায় কোরআনে দাস ব্যবস্থার অনুমোদন আছে। সুরা নিসাতে উল্লেখ আছে “একজন পুরুষ নিজের স্ত্রীগণ ছাড়াও তাদের দক্ষিণ হস্তের অধীন সমস্ত (দাসীদের) নারীদের ভোগের অধিকারী।”
কিন্তু উনবিংশ এবং বিংশ শতকের বেশীরভাগ ইসলামি চিন্তাবিদগণ দাসত্ব বন্ধের জন্য সোচ্চার হন। তারা কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, গোলামকে আজাদ করে দেয়া আল্লাহর অশেষ রহমতের কাজ। কিন্তু কিছু কট্টরপন্থী মুসলিম ধর্মীয় ব্যাখ্যাকারী শরিয়া মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার উপর গুরুত্বারোপ করে। তাদের মতে যৌন দাসত্বকে অবশ্যই অনুমোদন দিতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান আধুনিক যুগে আইসিস প্রথমবারের মত যৌন দাসত্বকে সাংগঠনিক চর্চার মধ্যে নিয়ে এসেছে।
এপি নিউজের ধারণকৃত ছবিতে দেখা যাচ্ছে কিশোরী ও নারীদেরকে সুন্দর দামি পোশাকে সাজানো হয়েছে। কারো মুখে কড়া মেকআপ। তারা ছবি তোলার জন্য ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে পোজ দিয়েছে। ছবির আশেপাশে মূল্যবান আসবাবপত্র আর পিছনে ভারি পর্দা যেন মনে হয় কোন বিলাসবহুল হোটেলের বলরুম। সবারই বয়স কম, কেউ সবে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডী পেরিয়েছে, তাদের কারোরই তিরিশ বছরের অধিক বয়স হবে না।
তাদেরই একজনের নাম নাজদার মুরাত, আইসিস দুই বছর আগে যখন তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তখন তার বয়স মাত্র ১৬। ২০১৪ সালের আগস্টে তার মত এরকম হতভাগ্য আরও কয়েক ডজন মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় জঙ্গি দলটি। ইয়াজিদি জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলের মূলকেন্দ্র সিনজার দখলের সময় আইসিস মুরাতের বাবা, চাচা, ভাইদের হত্যা করেছে। একদিনেই মুরাতের পরিবারসহ ৪০ জন নিহত হয়।
ইরাকের উত্তরাঞ্চলের ডাহুক শহরের বাইরে একজনকে তাড়িয়ে দিয়ে তার সুদৃশ্য তাবুর ভিতরে রাখা হয়েছে নাজদারের মাকে। নাজদার কোনক্রমে ছয় মাস আগে তাদের অবস্থান জানিয়ে বাইরে কোথাও ফোনে কথা বলতে পেরেছিল। নাজদার মুরাত এপি নিউজকে জানায়, “আমরা কয়েক সেকেন্ড কথা বলেছিলাম, শুধু জানালাম এখন মসুল আছি। প্রতিবারই কেউ না কেউ ফিরে আসে, আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি সেই মেয়েটার কী হয়েছে? যদিও কেউ মেয়েটিকে চিনতে পারে না। কেউ হয়ত আমাকে বলে, মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে।”
মুরাতের পরিবার নিখোঁজ বা মৃত ইয়াজিদিদের নাম ঠিকানা, তালিকা মোবাইলে সংরক্ষণ করে। যারা আইসিস খেলাফতের দোযখ থেকে বের হতে পেরেছে তাদের কাছে হারিয়ে যাওয়া ইয়াজিদিদের ছবি দেখায় আর জিজ্ঞেস করে কেউ তাদের দেখেছে কী না। অন্য পরিবার হয়ত আশায় বুক বাঁধে হয়ত পেয়েও যেতে পারে তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজন।
একজঙ্গি দল থেকে আরেক জঙ্গি-দলের অধীনে যেতে কেটে গেল এক বছরের অধিক সময়, এরমধ্যে বাসার আল আসাদ সিরিয়া থেকে পালাতে চেয়েছে কয়েকবার। মার্চ মাসে বাসারের পঞ্চম-বারের মত পালানোর চেষ্টার সময়, নাজদার মুরাত কুর্দিশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। সামনের দিনগুলোতে পালানোর পথ আরও সংকুচিত হয়ে যাবে। মানবপাচারকারীদের কল্যাণে যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় তারাই আইসিস জঙ্গি-নেতাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অলাভজনক এনজিও ‘ইয়াজদা’র স্বেচ্ছাসেবক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক অ্যান্ড্রু স্লেটার বলেন, “আইসিস যেকোনো মূল্যে ইয়াজিদি বন্দি-নারীদের ধরে রাখতে চায়।” তিনি ইরাকের উত্তরাঞ্চলে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের উপর ঘটে যাওয়া অপরাধ নথিবদ্ধ করেন, যারা আইসিস কবলে থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।
যেসব ইয়াজিদি পরিবার আইসিসের কবল থেকে তাদের আত্মীয় স্বজনকে মুক্ত করতে পাচারকারীদের টাকা খরচ করেছে কুর্দিস্তানের প্রাদেশিক সরকার সেসব পরিবারকে ১৫,০০০ ডলার পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করে। কোন আইসিস জঙ্গি বন্দিকে উদ্ধার করে দেয়ার জন্য মুক্তিপণ চাইলে সে অর্থ প্রাদেশিক সরকার দেয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু কুর্দিশ প্রাদেশিক সরকারের কাছে এখন আর যথেষ্ট তহবিল বরাদ্দ নেই। তেল বাণিজ্যে ধ্বস, ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে সংকট, আইসিসের সাথে যুদ্ধের কারণে বিগত কয়েক বছরে কুর্দিস্তান ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে।
আইসিস যখন একের পর এক তাদের অধিকৃত শক্ত ঘাঁটি রামাদি বা ফালুজার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল তখনও কোথাও হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। অ্যান্ড্রু স্লেটার বলেন, “ইয়াজিদি মেয়েদের উদ্ধার তৎপরতা শিথিল হয়ে আসে, এক সময়ে থেমেও যায়। মানুষের কাছে ফুরিয়ে যায় টাকা, আমি অনেক পরিবারকে চিনি যারা হাজার হাজার ডলার ঋণের বোঝা কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছেন। এখনও হাজার হাজার ইয়াজিদি মেয়ে, নারী, শিশু, কিশোর আইসিসের কাছে বন্দী এবং তাদেরকে উদ্ধার করা ক্রমেই কঠিনতর থেকে দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে”।
২০১৪ সালের গ্রীষ্মের এক সুন্দর দিনে সিনজার শহরের কাছাকাছি কাচো গ্রাম থেকে লামিয়াকে অপহরণ করে আইসিস। ধারণা করা হচ্ছে তার মা বাবাকে ইতিমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে। তার নয় বছরের ছোট বোন মায়দাকেও অন্য কোথাও আটকে রেখেছে আইসিস। মায়দা যেকোনো কায়দায় একটা ছবি পাঠাতে সক্ষম হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটা ইসলামিক স্টেটের কালো পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
লামিয়ারা পাঁচ বোনই আইসিসের কবল থেকে পালিয়ে আবার একত্রিত হতে পেরেছে জার্মানিতে। তাদের ছোট ভাইও মশুলে কয়েক মাস আইসিসের ক্যাম্পে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিল তারপর একদিন কোনক্রমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, সে এখন অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে কুর্দিশ এলাকার ডাহুকে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে।
জড়সড় সংকুচিত হয়ে বসে আর একই রকম উদাস ভঙ্গিতে লামিয়া তার বন্দী জীবনের কথা গণমাধ্যমকে বলছিল কীভাবে এক আইসিস জঙ্গির হাত থেকে অন্য জঙ্গির কাছে হাত বদল হতো, সবাই তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করত, শ্লীলতাহানি করেছে, ধর্ষণ করেছে। তার কণ্ঠস্বর একেবারে নিস্তরঙ্গ, যেন ভাবলেশহীন। লামিয়া সব সময় পালানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ছিল।
লামিয়া এপি নিউজকে বলেন, “তার প্রথম মালিক ছিল আইসিসের ইরাকি কমান্ডার আবু মনসুর। আইসিসের স্বঘোষিত ইসলামিক স্টেটের রাজধানী রাকা শহরে আবু মনসুর থাকত তখন। আবু মনসুর লামিয়াকে ভীষণ যন্ত্রণা দিতো এবং প্রায়ই তাকে হাতকড়া পরিয়ে রাখত।
লামিয়া দুইবার পালানোর চেষ্টা করে এবং দুইবারই ব্যর্থ হয় এবং ধরা পড়ার পর তার উপর শুরু হয় সীমাহীন অমানুষিক নির্যাতন, নিপীড়ন এবং ধর্ষণ। একমাস পরে তাকে অন্য একজন আইসিস জঙ্গির কাছে বেচে দেয়া হয়। নতুন মালিকের কাছে সে দুইমাস কাটানোর পরে তাকে আবার বেচে দেয়া হয়। এবারের মালিক ছিল আইসিসের বোমা বানানোর কারিগর। সে লামিয়াকে জোর করে তাকে বোমা বানাতে সাহায্য করার জন্য, আত্মঘাতী হামলা করার সুইসাইড পোশাক পরে কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য লামিয়াকে ব্যবহার করত। এপি নিউজকে লামিয়া জানায়, “আমি তার কাছ থেকে পালানোর চেষ্টা করি, কিন্তু ধরা পড়ে যাই, তখন সেই জঙ্গি আমাকে ভীষণভাবে মারধোর করে।”
যখন লামিয়ার নতুন মালিক আইসিসের বোমা কারিগরের কাছে লামিয়াকে একঘেয়ে মনে হয় তখন সে লামিয়াকে আইসিসের একজন ডাক্তারের কাছে হস্তান্তর করে। ডাক্তারটি ইরাকের ছোট্ট একটা শহর হাওইজা নিয়ন্ত্রণ করত, সে ছিল হাওইজা শহরের হাসপাতালের প্রধান। সেও লামিয়াকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। সেখান থেকেই লামিয়া প্রায় এক বছর পরে গোপনে তার আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়।
লামিয়ার চাচা স্থানীয় মানবপাচারকারীদেরকে ৮০০ ডলার দিয়ে লামিয়াকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে। মুক্ত হয়ে সে জার্মানিতে তার অন্যান্য ভাইবোনদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু এত কিছুর পরেও লামিয়ার মন পড়ে থাকে ইরাকে, শৈশবের স্মৃতি ঘেরা ইরাকের জন্য তার মন পোড়ে। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে লামিয়া সাংবাদিকদের বলতেই থাকে “আমাদের সুন্দর একটা বাড়ি ছিল, সেখানে বিশাল একটা খামার, আমি স্কুলে যেতাম, তখন কত সুন্দর দিন কাটাতাম।”
পড়লাম, কিন্তু পারলাম না।
অমানবীয়!