লিখেছেন: অভি বর্মন

কানাডা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ (রাশিয়া বৃহত্তম) এবং সেখানে ৬টি ভিন্ন টাইম জোন রয়েছে। এর অর্থ এই যে, সূর্য সমগ্র দেশ জুড়ে একই সময়ে উদয় হয় না। এটি আমাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হলেও, আব্রাহামিক ধর্মগুলি সমতল পৃথিবীর তত্ত্বের উপর বিশ্বাস অনুমোদন করে। পৃথিবীর আকার যে একটি oblate spheroid তা আমরা এখন জানি। যার ফলে, সারা পৃথিবীর সব এলাকা প্রতিদিন একই পরিমাণ সূর্যরশ্মি উপভোগ করে না। সূর্য প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তকে আলোকিত করে যায় এবং আরশের নিচে গিয়ে সেজদা দেবার সময় সুযোগ পায় না। এই বছর দক্ষিণ গোলার্ধে বসবাসরত মুসলিমরা তুলনামূলক-ভাবে সহজ রমজান উপভোগ করবে, উত্তর মেরুর কাছাকাছি বসবাসরত মুসলমানদের হবে ঠিক তার উল্টো। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়াতে বসবাসকারী একজন ব্যক্তিকে দৈনিক ১২ ঘণ্টার জন্য রোজা রাখতে হবে এবং নরওয়েতে বসবাসরত একজন ব্যক্তির ২০ ঘণ্টা রোজা রাখতে হবে। কিছু মুসলমান সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত মেনে রোজা রাখে এবং অন্যেরা মক্কার সময় মেনে রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় নরওয়েতে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে এ অঞ্চলের মানুষের জন্য নির্ধারিত কোনও নিয়মের বিধান না থাকায় এই সমস্যাটি কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, তার বিষয়ে মুসলমানরা একমত নন। আবার গ্রীষ্মকালের বদলে, শীতকালে রমযান মাস পড়লে ঠিক তার উল্টোটা ঘটত। ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা কি অঞ্চলভেদে সময়ের পার্থক্য সম্পর্কে জানতেন? তিনি কি জানতেন যে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বিশাল স্থলভূমি রয়েছে যেখানে একদিন সুবিশাল জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবে?

রমজানের রোজা ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়টি। মুসলমানদের কাছ থেকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গুনাহের কাজ এবং (স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে) যৌনসংগম বিরত থাকার অভ্যাস অনুশীলন করা এবং পাপপূর্ণ আচরণ এড়ানোর আশা করা হয়। রমজানের শেষ হয় ঈদের চাঁদ দেখার মধ্যে দিয়ে। যদিও চাঁদের অবস্থান আগে থেকেই নির্ণয় করা যেতে পারে, তবু চাঁদকে মুসলমানদের নিজেদের খালি চোখে দেখেই ঈদের দিন ঠিক করতে হবে। হয়ত, দেখা গেল যেদিন চাঁদ দেখার কথা সেদিন আকাশ মেঘলা এবং খালি চোখে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। পরিশীলিত টেলিস্কোপ ব্যবহার করে বা চাঁদের অবস্থান নির্ণয় করে ঈদের দিন ধার্য করা কি তখন সমুচিত? আরও বলা হয় যে শয়তানকে এক মাসের জন্য শৃঙ্খলবদ্ধ করা হয় এই পবিত্র রমজানের মাসে। রমজান মাসে তাই বলে কি অপরাধ এবং দুর্নীতি ঘটছে না? রমজান মাসে সংগঠিত অপকর্মের দায়ভার কে নেবে? আবার প্রতি বছর রমজানের শেষে শয়তানকে মুক্ত বিহঙ্গের মত ছেড়ে দিয়ে মহান আল্লাহ্‌ কি আমাদের সঙ্গে “ব্যাটম্যান আর জোকার” খেলছেন?

অতঃপর, রোজা পালনের এই অনুশীলন থেকে সবচেয়ে উপকৃত কে হন? লাভবানদের বেশির ভাগই দোকান অথবা ব্যবসার মালিক, যাদের ব্যবসা রমজানের ফলে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে, হিন্দু হোটেলের জন্য এটি বছরের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময়। ছাত্রদের মূল্যবান ক্লাস সময় থেকে ছুটি দেয়ার কারণে শিক্ষকরা পরিবারের সাথে দীর্ঘ একটা ছুটি কাটানোর সুযোগ পায়। দানের অর্থে কিছু বড় মসজিদের ইমামদের কপাল খুলে যায় ঈদের। দরিদ্র মানুষদের জাকাতের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য প্রদানের মধ্য দিয়ে আর রোজা রেখে গরীবদের কষ্ট অনুভব করে বিত্তবান মুসলমানরা। গরীব লোকরা কেন বাকি ১১ মাস অবহেলার শিকার হন?

কিছু রোজা পালনকারী মুসলমান রমজান মাসে দিনের বেলা অন্যদের খেতে দেখলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। শরিয়ত বিরোধী এই সকল ব্যক্তিদের বাড়ির বাইরে প্রকাশ্যে খাবার খাওয়া বা পান করার অপরাধের বিরুদ্ধে দলগত ভাবে ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন এই মুসলিম সমাজকর্মীরা। এ ছাড়া, কিছু মুসলিম দেশেও, পবিত্র মাস চলাকালীন রেস্তোরাঁগুলি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়। আমার কিছু মুসলিম দেশে গরম আর নরমের নিয়মের মিশ্রণে এক ধরনের বৈজ্ঞানিক যুক্তিসঙ্গত অনুশাসন তৈরি করা হয় যেমনটা দেখা যায় বাংলাদেশে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না এড়াতে বুরকার মত কালো আচ্ছাদন দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয় রেস্তোরাঁগুলি। এতে করে “খারাপ” মুসলমানরা বাইরে খেতে পারেন এবং সেই সঙ্গে সমাজের অবক্ষয় ঘটে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা মুসলিম দেশে থাকলে কেন অন্যের খাদ্য খাওয়ার কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পান? আবার তারাই আবার পশ্চিমা দেশে গিয়ে কীভাবে সুন্দর করে রমজানকে ব্যক্তিগতভাবে উদযাপন করেন?

ইকনমিক্সের চাহিদা আর যোগানের নিয়ম মেনে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এই মাসে লোকজনের ক্রয় কমিয়ে দেবার কথা। কিন্তু অধিকাংশ মধ্যম এবং উচ্চ-শ্রেণীর পরিবারের মধ্যে প্রায়ই বিপরীত প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী আরও বেশি পরিমাণে কিনতে দেখা যায় তাদের অনেককেই এবং অপচয় ও অপব্যয়ে মেতে ওঠেন। অনেকেই দাবি করেন যে রোজার মাসে তাদের শরীরের ওজন বেড়ে গেছে। ফ্রিজগুলি স্টক করে স্বেচ্ছায় সারাদিন অনাহারে থেকে পরে প্রচুর খাবার খেয়ে রোজা ভাঙ্গাতে কি ক্ষুধার্ত ও গৃহহীনদের উপহাস করা হয়না?

যখনই আমি রমজানের কথা মনে করি, আমার মনে দুটি স্মৃতি চলে আসে। প্রথমত, সুস্বাদু খাবারের বিশাল আয়োজন যার বেশিরভাগ তেলেভাজা ছিল। পাল্প ফিকশন থেকে জুলস যদি কখনও বাংলাদেশে আসেন, তবে তিনিও ভাজা খাবারের প্রেমে আটকে পড়তে বাধ্য। কিন্তু যতই সুস্বাদু, হোক না কেন ১২ ঘণ্টার বেশি রোজা পালনের পরে ভাজা খাবারের এই সমারোহ কারো স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। পানিশূন্যতা দূর করতে তখন শরীরের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা। কিন্তু ইদানীং অনেক মুসলমানদের দেখা যায় বিভিন্ন সন্দেহভাজন ও ছদ্ম-বিজ্ঞানের উৎস হতে রমজানের রোজা রাখার উপকারিতা সম্পর্কে সক্রিয়ভাবে প্রচার করছে। অনেক সময় পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক দর্শনকে ভুল এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে ধর্মপ্রাণ সরল মুসলমানদের কাছে। এই ধরনের ব্যাখ্যা আসলে বৈজ্ঞানিক হচ্ছে না বৈজ্ঞানিক উপস্থিত করতে চান কারণ বিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে আছে। অনেক সময় অসুস্থ লোকেরাও বাধ্য হয় রোজা রাখতে সমাজ ও পরিবারের চাপে যা তাদের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার কারণ হতে পারে। ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে ২0 লাখেরও বেশি লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৮ লাখেরও বেশি নিয়মিত ডায়ালিসিস প্রয়োজন (২০১৭)। খাবারের দোকান বন্ধ করে আর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে অসুস্থ লোকের স্বাস্থ্য বিপন্ন করাটা কি গ্রহণযোগ্য?

রমজান থেকে আমার উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলা দ্বিতীয় জিনিস হল সাইরেনের বধির করা শব্দ যা প্রতিদিন ভোর এবং সন্ধ্যায় শুনতে বাধ্য হয়েছিলাম। মসজিদ থেকে ভেসে আসা সে উচ্চস্বরের শব্দে হাসপাতালের রোগীদের ও মানুষের জন্য কোনও সমবেদনা নেই। একজন মানুষ যিনি নিজেকে সারাদিন ক্ষুধার্ত রেখেছেন, সাইরেনের তীব্র শব্দ কানে না গেলে কি তিনি সময়মত খাবার খেতে বসবেন না?

সবশেষে আরেকটি প্রশ্ন বিবেচনা করা উচিত যে, মানুষ যদি মঙ্গলে বা অন্য দূরবর্তী গ্রহের উপর বসতি স্থাপন করে তাহলে কেমন হবে? প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলস্বরূপ, যদি মানুষ মঙ্গলে স্থাপনে সক্ষম হয় তবে তা রোজা পালনকারীদের জন্য খুব একটা অসুবিধের সৃষ্টি করবে না কারণ মঙ্গল গ্রহটি তার নিজ অক্ষে পৃথিবীর চেয়ে মাত্র ৪০ মিনিটের বেশি সময় ধরে ঘুরে। যেহেতু মঙ্গল গ্রহ থেকে খালি চোখে পৃথিবীর চাঁদ দেখা যায় না, তাহলে কি মঙ্গলে মাইগ্রেট করা মুসলমানরা রোজা-ঈদ উৎসব পালন করবে না? আবার মঙ্গল পার হয়ে আমরা যদি কোনও সুপার আর্থে বসতি স্থাপন করতে পারি আর সেটা যদি ২৪ ঘণ্টার বদলে ৪৮ কিংবা আরও বেশি সময় নিয়ে নিজের অক্ষের উপর ঘুরে আর যেখানে আমাদের সূর্যের আলো পৌঁছায় না তখন কি আরও বেশিক্ষণ রোজা রাখতে হবে?

আজকের দিনে যে ফ্যানফেয়ারের সাথে ইসলামের অনুসরণ করা হয় তা কি চিরটা কাল চলবে সেটা অন্য দিনের বিতর্কের জন্য তুলে রাখছি। পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং পৃথিবী সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে এই সত্যের সাথে বেশিরভাগ ধার্মিক পরিচিত এবং ধর্মগুরুরাও এটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে, বিবর্তনের তত্ত্ব সত্ত্বেও, ধর্ম এখনও পদচারণ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস যদি আমাদের কিছু শেখায়, বাস্তবতা থেকে পালানো যায় না। একসময়কার পরাক্রমশালী, গ্রীক, রোমান ও মিশরীয় দেবদেবীরা কালের অবর্তমানে হারিয়ে গেছে।