ধর্মের গুরুত্ব কী – এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলে থাকেন সমাজের স্থিতিশীলতা ও নৈতিকতা রক্ষা করা, অনেকে বলেন যদি ধর্ম না থাকে তবে মানুষ অনৈতিক কাজ করা শুরু করবে। কেউ খারাপ কাজ করলে ইহকালে বা পরকালে তার শাস্তি হবে, আর ভাল কাজ করলে তিনি পুরস্কৃত হবেন এটা মোটামুটি সব ধর্মেরই সারকথা। এই ব্যাপারটা মানুষকে নৈতিক আচরণ করতে উৎসাহিত করে, অনৈতিক কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে, ও এভাবে সমাজকে স্থিতিশীল করে, এটাই সমাজে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যা। অনেকে, বিশেষ করে ধর্মদার্শনিকগণ বলেন, এরকম নৈতিকতা সম্পর্কিত ধর্ম বৃহত্তর সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য, এটা ছাড়া বৃহত্তর সমাজই গঠিত হতে পারত না।
 
যাই হোক, সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই ধারণাটাকে ভুল প্রমাণ করেছে। এই গবেষণাটি বলছে জটিল সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তনেরও কয়েক শত বছর পর নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার আবির্ভাব ঘটেছে। নৈতিক ঈশ্বর বা মোরালাইজিং গড বলতে সেই ঈশ্বর বা ঈশ্বরদেরকে বোঝানো হয় যারা খারাপ কাজ করা ব্যক্তিকে শাস্তিপ্রদান করে আর ভাল কাজ করা ব্যক্তিকে পুরষ্কৃত করে। মানবেতিহাসের ঠিক কোন সময়ে মানুষ নৈতিক ঈশ্বরে বিশ্বাস করা শুরু করে এই প্রশ্নটি বর্তমানে বর্ধিষ্ণু নিধার্মিক বা ধর্মহীন সমাজগুলোতে নৈতিকতার কী পরিবর্তন করবে সেসম্পর্কিত বিতর্কের ক্ষেতে প্রাসঙ্গিক।
 
গত ১০,০০০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মোট ৪১৪ টি সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে আমরা যা যা জানতে পেরেছি তার উপর ভিত্তি করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ প্যাট্রিক স্যাভেজ নৈতিক ঈশ্বরের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আবির্ভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, সামাজিক নথিতে নৈতিক ঈশ্বরের উপস্থিতি দেখা যায় মেগাসোসাইটিগুলোর এর আবির্ভাবের পর। স্যাভেজ ও তার সহকর্মীগণ মেগাসোসাইটি হিসেবে সেইসব সমাজকে নির্দেশ করেন যেসব সমাজে প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি আন্তঃসম্পর্কিত জনসংখ্যা রয়েছে।
 
ঐতিহাসিকভাবে সব মানবসমাজেই “ঈশ্বর” বলা যেতে পারে এমন অতিপ্রাকৃতিক সত্তায় বিশ্বাস দেখা যায়, এবং সম্ভবত এটি সার্বজনীন, সকল সমাজেই এর অস্তিত্ব ছিল বা আছে। অবশ্য, স্যাভেজ বলিদান দাবি করা বা কোন পবিত্র স্থানকে পরিহার করে চলতে আদেশ দেয়া ঈশ্বরের সাথে “নৈতিক ঈশ্বর”-কে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেন। নৈতিক ঈশ্বরের মধ্যে এরকম বলিদান চাওয়া বা পবিত্র স্থানকে এড়িয়ে চলতে আদেশ দেয়ার মত গুণ ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু নৈতিকতা-সম্পর্কিত গুণ থাকে। তারা মানুষের মধ্যকার নৈতিক আইনগুলোর লঙ্ঘনের জন্যেও শাস্তি প্রদানও করে থাকে।
 
স্যাভেজের এই নৈতিক ঈশ্বরের শ্রেণীতে কেবল খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম, ইহুদি ধর্মের মত ধর্মের ঈশ্বররাই অন্তর্ভূক্ত নয়, তিনি হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের “কর্ম” এর ধারণাকেও (লেখকের কথায় Karmic tradition) নৈতিক ঈশ্বরের শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। আব্রাহামীয় ঈশ্বরদের মত মোরালাইজিং হাই গড (MHG) এবং কার্মিক ট্রেডিশনগুলোর মত ব্রড সুপারন্যাচারাল পানিশমেন্ট (BSP) উভয়কেই লেখক মোরালাইজিং গড এর শ্রেণীতে ফেলেছেন। এইসব ধারণার মধ্যে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিটি হচ্ছে, যদি আপনি অন্য কোন মানুষের ক্ষতি করে থাকেন, তবে আপনি এই জীবনে বা পরবর্তী জীবনে আপনাকে তার মূল্য পরিশোধ করতে হবে। “ক্ষতি করা” এর সংজ্ঞায় যৌন আচরণকে সীমাবদ্ধ রাখার মত (যেমন হস্তমৈথুন না করা) অযৌক্তিক বিধিনিষেধও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যাই হোক, এতদিন ধরে ভাবা হত যে, কিন্তু চুরি বা সহিংসতার জন্য শাস্তির ভয় এমন বৃহৎ সমাজ গঠন করতে সহায়তা করতে পারে যেখানে সবার সাথে সবার ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়, বা সেই সমাজের একজন সবাইকে চেনেনা।
 
গবেষণাটি নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সময়ের সাথে বিভিন্ন সমাজের সামাজিক জটিলতার মাত্রার কিভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তার স্বাধীন মুল্যায়নের জন্য স্যাভেজ এই গবেষণায় সেশাত গ্লোবাল হিস্টোরি ডেটাব্যাংক (Seshat Global History Databank) এর উপাত্ত ব্যবহার করেন। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যা, অধিক স্তরবিণ্যাস (hierarchy), আনুষ্ঠানিক আইনি বিধান এবং পরিবহন অবকাঠামো এর মত বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করে সমাজে জটিলতার মাত্রার বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ সমাজে জনসংখ্যা, সামাজিক স্তরবিণ্যাস বা ক্রমস্তর, আনুষ্ঠানিক বিধান, অবকাঠামোর মত বিষয়গুলো যত বৃদ্ধি পাবে সমাজের জটিলতার মাত্রাও তত বৃদ্ধি পাবে।
 
এরপর বিভিন্ন সমাজের এই জটিলতার মাত্রাকে ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কিত প্রতিবেদন, নথি – এগুলোর সাথে তুলনা করা হয়। গবেষণায় পাওয়া যায়, এই ৩০টি অঞ্চলের সব সমাজেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে অতিপ্রাকৃত সত্তাকে সন্তুষ্ট করার সাথেই ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কিত ছিল। এদের মধ্যে ১০টি অঞ্চলে ঔপনিবেশী ক্ষমতার আবির্ভাবের পূর্বে নৈতিক ঈশ্বরের কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। অন্য ২০টি অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে নৈতিক ঈশ্বরে বিশ্বাস এর উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তা সেইসব অঞ্চলে লিখন পদ্ধতির আবির্ভাবের গড়ে ৪০০ বছর পর আবির্ভূত হয়। যদি লিখন পদ্ধতির আবিষ্কারের আগেই নৈতিক ঈশ্বরের আবির্ভাব হত, তাহলে ঈশ্বরকে নিয়ে সেরকম নৈতিকতা-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি সেইসব সমাজের প্রথম প্রাচীন নথিগুলোতে নথিবদ্ধ থাকত। নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার সব থেকে প্রাচীন উদাহরণটি পাওয়া যায় মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ অব্দে। কিন্তু তারও অনেক পূর্বেই মিশরীয় সভ্যতার সূচনা হয়ে গিয়েছিল। গবেষণাপত্রটিতে লেখক উল্লেখ করে, খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ অব্দে মিশরের পর মেসপটেমিয়া, আনাতোলিয়া, চীন, ভারত, পারস্যে ধীরে ধীরে নৈতিক ঈশ্বরের আবির্ভাব ঘটে, কিন্তু এরকম ঈশ্বরের ধারণার আবির্ভাবের অনেক আগেই এসব স্থানে বৃহদ সমাজ ও সভ্যতার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।

বিভিন্ন অঞ্চলে কত হাজার বছর পূর্বে নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার আবির্ভাব ঘটেছে তা এখানে বৃত্তের মধ্যে সংখ্যার দ্বারা দেখানো হয়েছে। গোলাপির দ্বারা জরাথ্রুস্টবাদ, কমলার দ্বারা আব্রাহামীয় ধর্ম, হলুদ দ্বারা অন্যান্য মোরালাইজিং হাই গড ভিত্তিক ধর্ম, নীল দ্বারা বৌদ্ধধর্ম, বেগুনীর দ্বারা অন্যান্য ব্রড সুপারন্যাচারাল পানিশমেন্ট ভিত্তিক ধর্ম বোঝানো হয়েছে, ধূসর বর্ণের দ্বারা নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার অভাবকে বোঝানো হয়েছে

 
সামাজিক জটিলতার সাথে ধর্মের বৈশিষ্ট্য এর পরিবর্তনের ব্যাপারটা এই গবেষণায় গ্রাফের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে (নিচে দেখানো হয়েছে)। এখানে সমাজের জটিলতা বৃদ্ধির সাথে মানুষের ধর্মীয় আচরণের বা ধর্মের দুটো অবস্থার ব্যাপারটা উঠে এসেছে। দেখা গেছে, সমাজ গঠনের পর সামাজিক জটিলতা যখন কম ছিল তখন ডকট্রিনাল রিচুয়াল বা আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় আচারের জন্ম হয়। এগুলো ধর্মগ্রন্থের দ্বারা বা বিভিন্ন বিধানে বর্ণিত থাকতে পারে। নিয়ম করে রুটিনমাফিক এই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো পালিত হত, আর মানুষও এই ধর্মীয় আচার-প্রথা, নিয়মকানুন অনুসরণ করত। দেখা যায় এরকম ডকট্রিনাল রিচুয়ালের ফলেও যে বৃহৎ সমাজ গঠিত হয়েছে তাও বলা যায় না। বরং এই সমাজের জটিলতাই নির্ধারণ করে দিয়েছে সমাজের এরকম ডকট্রিনাল রিচুয়াল ভিত্তিক ধর্মের আবির্ভাবকে। এই গবেষণা এটা নির্দেশ করছে যে এই ডকট্রিনাল রিচুয়ালগুলোই মানুষের মধ্যকার বৃহৎ ধর্মীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠার কারণ ছিল। নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার আবির্ভাবের পূর্বে সকল সমাজে গড়ে ১,১০০ বছর যাবৎ এই ডকট্রিনাল রিচুয়াল ভিত্তিক ধর্মের অস্তিত্ব ছিল।
 
নিচের গ্রাফগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, সমাজ বিবর্তনের ধারায় সামাজিক জটিলতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে এক পর্যায়ে মোরালাইজিং গড বা নৈতিক ঈশ্বরের আবির্ভাব ঘটে। দেখা যায় সমাজের জটিলতা বৃদ্ধির একটি পর্যায়ে ধর্মগুলো পরিবর্তিত হয়ে সেখানে নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার আবির্ভাব ঘটে, অর্থাৎ মানুষের মধ্যে তখন পরকালে শাস্তি বা পুরস্কার, কর্মফল এসবের ধারণা প্রবেশ করে।

বিভিন্ন অঞ্চলের গণনার গড় হিসেবে এখানে সামাজিক জটিলতার সাথে ডকট্রিনাল রিচুয়াল ও নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার সম্পর্ককে তুলে ধরা হয়েছে। ডায়াগ্রামটি দেখে বোঝা যাচ্ছে কিকরে সমাজ গঠনের পর সামাজিক জটিলতা বৃদ্ধির একটি পর্যায়ে ডকট্রিনাল রিচুয়াল-ভিত্তিক ধর্মের জন্ম হয়েছে, আর তারপর আরও উচ্চতর সামাজিক জটিলতা অর্জনের পর নৈতিক ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে।

 

বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষেত্রে সামাজিক জটিলতা ও ধর্মের সম্পর্ক কেমন ছিল তা দেখানো হয়েছে। নীল বর্ণের দ্বারা ডকট্রিনাল রিচুয়াল ভিত্তিক ধর্ম ও লাল বর্ণের দ্বারা নৈতিক ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মকে বোঝানো হয়েছে।

গবেষণার লেখকগণ উপসংহার টানেন, সমাজের গঠনের জন্য নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার প্রয়োজন ছিল না। এই গবেষণাটি আমাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে নৈতিক ঈশ্বরের ধারণা সামাজিক জটিলতা ও বৃহদ সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত ছিল না, বরং সামাজিক জটিলতা ও বৃহৎ সমাজই নৈতিক ঈশ্বরের ধারণার পূর্বশর্ত ছিল। গবেষণাটি আমাদেরকে দেখায়, কিভাবে সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের পরিবর্তন হওয়ার ফলে মানুষের বিশ্বাসব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে ও মানুষ ক্রমে নৈতিকতা-বিহীন ঈশ্বর এর ধারণা থেকে নৈতিক ঈশ্বরের ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। নৈতিক ঈশ্বরের মত ধর্মের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আসলে সমাজ বিবর্তনের ধারায় নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থারই একটি ফল, ধর্মীয় নৈতিকতা বা নৈতিক ঈশ্বরের ধারণাও এভাবেই তৈরি হয়েছে। এই আবিষ্কারটি আমাদের বর্তমান সমাজের ক্ষেত্রে এরকম নৈতিক ঈশ্বর সম্বলিত “নৈতিক ধর্মের” প্রয়োজনীয়তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। ধর্ম সমাজের পূর্বশর্ত ছিল নয়, বরং সমাজই ধর্মের পূর্বশর্ত, আর সমাজ-বিবর্তনের ধারায় সমাজের গঠনের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে, হচ্ছে, আর পরেও হবে।
 

তথ্যসূত্র

পূর্ণাঙ্গ পেপারটি দেখুন এখানে –
4. ধর্মহীন নৈতিকতার বিরুদ্ধে এপোলজেটিক্সদের দাবির নমুনা –