ক্যালাও গুহা

মানব পরিবার আরও বড় হয়ে গেল। ফিলিপাইনের নর্দার্ন লুজন-এ একটি গুহায় কিছু হাড় পাওয়া গেছে যা আমাদের নিজস্ব গণ বা genus এরই। কিন্তু এগুলো আমাদের প্রজাতির কোন প্রাণীর হাড় নয়, এমনকি আমরা আগে কখনও দেখেছি বা আমাদের জানা এমন কোন প্রজাতিরও হাড় এগুলো নয়। হাড়গুলো নিয়ে যেসব বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন তারা এই নতুন প্রজাতির নাম দিয়েছেন হোমো লুজনেন্সিস (Homo luzonensis)।

২০০৭ সালে লুজন এর ক্যালাও গুহায় একটি উর্বাস্থি বা থাই বোন পাওয়া গিয়েছিল, এবং এটি অন্তত ৬৭,০০০ বছর পুরনো কোন মানুষ প্রজাতির বলে নিশ্চিত হয়েছিল। অর্থাৎ, অন্য কোন জীবিত গ্রেট এপ এর তুলনায় আমাদের সাথেই এই হাড়গুলো বেশি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল। ফিলিপাইনের আমাদের কোন নিকট আত্মীয়ের উপস্থিতি অবাক হওয়ার মত ছিল, কারণ শেষ বরফ যুগে এর সর্বোচ্চ শীতলতার সময়ও এই দ্বীপগুলি এশিয়ার মূল ভূখণ্ড বা মেইনল্যান্ড এশিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, যার ফলে সেখানে স্তন্যপায়ীদের পৌঁছানো সীমাবদ্ধ ছিল। এজন্য এই হাড়গুলো বিজ্ঞানীদেরকে হতবুদ্ধি করে দেয়। তবে কি আমাদের প্রজাতি বা হোমো সেপিয়েন্সদের (Homo sapiens) বিচরণ পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল বলে ধরে আসা হয়েছে তা ভুল ছিল, তারা আরও অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছিল যা আগে জানা হয়নি? নাকি এই হাড়গুলো হবিট বা হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস (Homo floresiensis) প্রজাতির, যা সেই সময়ের মধ্যে ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে? নাকি এই হাড়গুলো সম্পূর্ণ নতুন কোন প্রজাতির?

এখন একই গুহায় কমপক্ষে তিনজনের আরও বারোটি জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই তিনজনের মধ্যে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ও একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক। নেচার সাময়িকীতে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। আবিষ্কৃত এই জীবাশ্মগুলোর মধ্যে হাত ও পায়ের হাড় এবং দাঁত রয়েছে যেগুলো অন্তত ৫০,০০০ বছর পুরনো। এগুলোর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য, যেমন পায়ের আঙ্গুলের আকৃতি, অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেন্সিসের (Australopithecus aferensis) মত প্রাচীন পূর্বপুরুষদের সাথে মিলে যায়, যা আফ্রিকায় ২ মিলিয়ন বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে লম্বা সংকীর্ণ আঙুলের হাড়ের মতো অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো হোমো ইরেকটাসের মতো আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের তুলনায় হোমো সেপিয়েন্স এর সাথেই বেশি যায়।

জীবাশ্মের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো, যেমন তাদের অস্বাভাবিক ছোট মোলার দাঁতের মত বৈশিষ্টগুলো এপর্যন্ত পাওয়া কোন মানব প্রজাতি বা আমাদের কোন পূর্বপুরুষের সাথেই মেলে না।

হোমো লুজনেন্সিসের মোলার ও প্রিমোলার দাঁত

হাড়গুলো নিয়ে গবেষণা করে জানা গেছে, এগুলো যেসব প্রাণীর শরীর থেকে এসেছে তাদের উচ্চতা ১.২ মিটার (৪ ফুট) এর থেকে কম, আর তারা বিপদ থেকে পালানোর জন্য বা খাদ্য গ্রহণের জন্য সম্ভবত তারা গাছে চড়ত। তবে এগুলো ছাড়া এই নতুন মানব প্রজাতির প্রাণীদের জীবনধারা সম্পর্কে হাড়গুলো আর কিছুই বলছে না।

প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬০ মাইল) প্রশস্ত সমুদ্রের পথ ফিলিপাইন এবং এশিয়ার মূল ভূখণ্ডকে পৃথক করে রেখেছে। কিন্তু শেষ বরফ যুগের সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এত কম ছিল যে মালয়েশিয়ার উপদ্বীপ থেকে বোর্নিও পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া সম্ভব ছিল। পালাওয়ানের দ্বীপ প্রায় বোর্নিওকে স্পর্শ করেছিল এবং সেখানে ৫০,০০০ বছর বয়সী মানব-জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। তবে, পালাওয়ান এবং ফিলিপাইনের বাকি অংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে জল অনেক গভীর, যা লুজন এবং ছোট দ্বীপগুলিকে বাস্তুসংস্থানিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

গত বছর ক্যালাও থেকে দূরে নয় এমন উপত্যকায় অনেক পুরাতন পাথরের সরঞ্জাম এবং হাড় পাওয়া যায় যেগুলো পরিষ্কারভাবে এই হোমো লুজনেনসিস এর শরীরেরই অংশ। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ফিলিপ পাইপার বলেন, “আমরা জানি হোমিনিডরা কমপক্ষে ৭,০০,০০০ বছর ধরে লুজনে রয়েছে।” তবে তিনি এও বলেন, “সেখানে অতীতের হোমিনিডরা কী রকম ছিল তা আমরা জানি না।”

এই হোমো লুজনেনসিসের বিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পাইপার বলেন, “সবচেয়ে সম্ভাব্য হিসেবে যে ব্যাখ্যাটি দেয়া যায় তা হল, ১৮.৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিচরণ করা হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus) কোন এক সময়ে ফিলিপাইনে প্রবেশ করে, আর ফিলিপাইনে প্রবেশ করা এই হোম ইরেক্টাসরা তারপর হোমো লুজনেনসিসে বিবর্তিত হয়।”

একটি অনুরূপ ব্যাখ্যা হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস বা হবিটদের ক্ষেত্রেও জনপ্রিয়। তবে, সীমিত অবশিষ্টাংশ এবং ক্রান্তীয় পরিবেশে প্রাচীন ডিএনএ নিষ্কাশন করার সমস্যাগুলোর কারণে, এই ব্যাখ্যার বেশিরভাগই এখনও অনুমান। এটাও সম্ভব যে, লক্ষ লক্ষ বছর আগে একটি অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতি আফ্রিকা ছেড়ে চলে যায় এবং লুজনে এসে পৌঁছায়, আবার এও সম্ভব যে হোমো লুজনেন্সিসরা তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক কালে এসেছে। যেভাবেই আসুক না কেন, হোমো লুজনেন্সিসের পূর্বপুরুষদের মধ্যে নৌকা নির্মাণের জন্য যথেষ্ট প্রযুক্তিগত দক্ষতা ছিল, তা নাহলে তাদেরকে পালাওয়ান থেকে ছিটকে গিয়ে লুজনে আসতে হয়।

লুজনে যে হোমো সেপিয়েন্সের জীবাশ্ম পাওয়া যায় তা প্রায় ২৮,০০০ বছর পূর্বের, এবং সেটাও পাওয়া যায় এই ক্যালাও গুহাতেই। তাই বলা যায় না যে আধুনিক মানুষ আর হোমো লুজনেন্সিস এই অঞ্চলে উপরিপাতিত হয়েছিল কিনা, অর্থাৎ এই অঞ্চলে একই সময়ে বসবাস করেছিল কিনা। যদি আধুনিক মানুষ আর হোমো লুজনেন্সিসের মধ্যে উপরিপাতন ঘটেই থাকে তাহলে কিন্তু হোমো লুজনেন্সিসের বিলুপ্তিতে আমাদের প্রজাতি মানে হোমো সেপিয়েন্স এর কোন হাত ছিল কিনা সেই প্রশ্নটাও চলে আসে।

স্বাভাবিকভাবেই পাইপার আশা করছেন যে, ক্যালাও গুহায় আরো খননের ফলে আরও হোমো লুজনেন্সিস জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হবে। কিন্তু বর্তমানে সেই কাজটিতে একটি অস্বাভাবিক বাধা রয়েছে: ক্যালাও গুহার অভ্যন্তরে স্থানীয় জনগণ একটি চ্যাপেল বা খ্রিস্টীয় ভজনালয় তৈরি করেছে, আর সেই চ্যাপেলের বেশিরভাগ স্থানের উপরেই কনক্রিট এর ঢালাই দেয়া হয়েছে।

তথ্যসূত্র

  1. https://www.nature.com/articles/s41586-019-1067-9