মার্কিন দেশের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের খুব দক্ষিণ দিকটায় লেগুনা নিগুয়েল, এখন থেকে অল্প ক’মিনিট গাড়ি চালালেই পৌঁছে যাওয়া যায় এক্কেবারে প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ে, ওখানটাতেই ক্ষুদে বাঙালি এই ফোকলা ছেলেটা আমাকে কষে মারলো ল্যাং। কথার ধাক্কায় আমি চিৎপটাং; বলে উঠল আমি বাংলা বলতে পারি। ভেবেছিলাম আমাদের ছানা যখন ওর মত চার পাঁচ বছর বয়স তখন পেটে বোমা মারলেও দুটো কথা বলতে চাইত না, বাংলা তো স্বপ্নিল আশা আর কি’না এই ঝাল ট্যাটনা বলে কি? এমনি তেমনি ঝাল না, একেবারে ধানি মরিচ, আবার বলে ফাইভ মানে হলো পাঁচ; বুঝলা? এমন কটকটিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ালো, সরি টরি বলে, বাংলা বলে বলে একটা ছবি তুলে ফেললাম। অপূর্ব বোশেখি সাজে সাজা মা’টির অনুমতিও পাওয়া গেল, ফোকলা’র ছবি তুললাম আর নাম ভুলে গেলাম।
ফোকলা [ফোকলা বাবুর নাম সায়ান 🙂 শুধু তাই না, বাংলা শেখানোর গুরু মা বাবার নামও পেয়ে গেলাম, লোপা আর তানভীর]
‘ক্রান্তি’ নামের একখানা চমৎকার সংগঠনের আমন্ত্রণে বাঙলা নববর্ষের একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম কাল, আচারে আয়োজনে আর বাঙালিপনায় মন জুড়ালো। খোলা মাঠ, মিষ্টি রোদমাখা মহাসাগরের ভেজা বাতাস, অনেক বছর পরে, ‘উপ’ কে যেন ছেঁটে দিয়ে খুব করে ভোগ করলাম প্রশান্তি। দেশের অনুষ্ঠানগুলোতে লস এঞ্জেলেসের মত মূল শহরগুলোতেও খুব ভিড় হয় আজকাল, ভাবি বেশি আয়োজন হয়, ভালো; তবু মনে হয় যে কিসের যেন অভাব; মন ভরে না। কাল বেশ লাগলো। ভালো লাগলো কারণ আয়োজনটা ছিল এদেশে বাঙালি শিশু কিশোর কিশোরীদের বাংলা সংস্কৃতির সাথে জড়াবার প্রচেষ্টা; বাঙালি সংস্কৃতিতে ওদের অংশ নেবার জন্য পুরস্কৃত করা। এই তো চাই। মা বাবারা হৃদয়ে পুরে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, বাঙালিত্ব; কিস্তু দেশটা তো আসলে এখানে নেই। মানে বাঙালি সংস্কৃতির প্রকান্ড আর একান্ত একখানা উপাদান, স্থান বা দেশ সেটাই তো নেই। তা’হলে? বড়রা এখানে মার্কিন দেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের কি করে অন্তত কিছুটা হলেও বাঙালি রাখবে? এই ধরণের বাঙালি অনুষ্ঠানগুলো তাই সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রহের কোত্থেকে এখানে এলাম বলে কথা।
চা শিঙাড়া, পিঠেপুলি; গল্পে আড্ডায়, চমৎকার সাজের বাঙালি মেয়েদের দেখে এত ভালো লাগছিলো যে আমরা দুজনও ফিরে পেয়েছিলাম পুরনো দিনের বোশেখী আমেজ।
ওদিকে আমাদের টিনএজার ছোট ছানাটিও টুকে নিচ্ছিল ওর ‘ওর্য়াল্ড মিউজিক’ প্রজেক্টের দরকারি নোট্, ছবি আর উপাদানগুলো।
বাচ্চাগুলোকে দেখে বারবার সুখী হচ্ছিলাম; মনে মনে অবিরাম ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম ওদের মা বাবাদের আর আয়োজন উদ্যোক্তা ‘ক্রান্তি’ কে। এমন নিপুণতায় খাবার দাবার পরিবেশন হচ্ছিল যে মনে হল কেউ একটু ট্যাঁফোঁ করবারও সুযোগ পেল না। আহা রে।
ছবি তুলবার ব্যাপারে আমি বেশ আলসে হয়ে গেছি। তবু তুলেছি ক’খানা। এখানে সেখানে সেঁটে দিলাম।
ছোটদেরকে নিয়ে আসবার জন্য বড়দেরকে মনে মনে যে ধন্যবাদগুলো জানাচ্ছিলাম সেটা মুখে বলবার সুযোগটাও পেয়ে গেলাম; খুব আনন্দের সাথেই বিলিয়ে দিতে পারলাম ছোট্টমনিদের হাতে পুরস্কার। ওদেরকেও ধন্যবাদ বললাম, আসবার জন্য। বড়দের অনুরোধ করলাম জোর করে কিছু চাপিয়ে না দিতে ওদের ওপর। বড়দের জন্য এ হয়ত পরবাস কিন্তু ছোটদের জন্য তো নয়।
শেষ বিকেলে গাছতলায় গান শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল অন্ধকার পর্যন্ত থেকেই যাই। ভালো লাগছিল। ভাবছিলাম গাছতলায় আমিও একটু নষ্টালজিয়ার গল্প শোনাই; হল না। শোনাতে চেয়েছিলাম আভিমানি জলপদ্ম আর শ্যাওলার আড়ি নেবার গল্প। পুরোনো দিনের গল্প ক’জনা কেনই বা শুনবে? সময়ের সাথে সম্ভবত সবাই এগুতে চায়। আজকের দিনটাতে আমার খুব করে পেছন ছুটতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ফিরে যেতে, ফিরে পেতে; আমার ছোটবেলা। সময়টা আসলে স্বার্থপর, আমার জন্য দ্রুত থেকে দ্রুততর; আর সবার জন্য মনে হয়; খুব ধীর লয়ের। আমি সেকেন্ড মিনিট ঘন্টার হিসেবে বুঝতে পারি না; বুঝতে চাইও না; শুধু ফিরে চাই আমার সেই ছোটবেলা।
বুনোফুলে ঘোরে কাঠপিঁপড়ে,
কয়েকটা ফড়িং, সঙ্কর সুঘ্রান,
ঘাসডোবা স্বচ্ছ জল; আর আমি,
থেমে পড়া অনেক বৃষ্টি, ব্যস্ত প্রজাপতি।
বেশ অনেকদিন পরের কথা, হয়ত সন্ধ্যা,
অট্টালিকা শালবন কিংবা, বেলী না-হয় টিউলিপ
দূরদেশে অনেক দূরপথে, সাগর অথবা মরুতে,
তন্দ্রাচ্ছন্ন আমি, ধীর বাতাস; ঝিমুনি; নস্টালজিয়া ।
বিশ্রাম খোঁজে মন, অতঃপর, থেমে যাই,
ফিরে চাই আমার প্রজাপতি ফড়িং,
ধরাবৃষ্টিতে ভেজা বাতাসেরা ফেরে;
নিয়ে, নিঃশ্বাসে; প্রশান্তিনবায়ন।
.
শুভ নববর্ষ।
বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের সংস্কৃতি দেখে ভালো লাগে। ছবিগুলোতে যেহেতু বাঙ্গালিপনা জরিয়ে আছে তাই অনেক আপন আপন লাগে।
পড়লাম ও ছবিগুলো দেখলাম। আপনার সুন্দর এই অনুভূতি নিজের মধ্যেও সঞ্চারিত হল।
ধন্যবাদ সৈকত 🙂
হাঁসের ছানাগুলোও কিন্তু ওখানেরই; শুধু জলপদ্ম নেই 🙁
আমি যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, এমনকি উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি, তখনও পহেলা বৈশাখ নিয়ে কারও মধ্যে মতভেদ দেখি নি। চৈত্রসংক্রান্তি অথবা পহেলা বৈশাখের মেলায় ছেলেবুড়ো, হিন্দু-মুসলমান, পৈতাযুক্ত, ধূতিপড়া, হাওয়াইশার্ট, টুপিযুক্ত-দাড়িযুক্ত সবাইকে দেখা গেছে। এই মেলাকে কেউ বলে আড়ঙ, আমরা বলতাম বান্নি। এই বান্নির জন্য কয়েক মাস পূর্ব থেকেই দিন গুণতে শুরু করতাম। এই দিন গুণা ছিল আমার সুখরোমন্থনের পথ। ছোটবেলায় দিন গুণার জন্য অথবা অপেক্ষার জন্য একটি কারন আমরা লাগতই সবসময়। সেটি হতে পারে ঈদ, কারও বিয়ের তারিখ অথবা বার্ষিক বান্নি, যা আয়োজিত হতো বাজারের পাশে মেঘনার তীর ঘেঁষে। এখন থাকি শহরে। আপনি যেমন শেকড়ের কাছে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করেন, সেটিও আমি করতে পারি না। কারণ এখন আর পহেলা বৈশাখ সবার উৎসব নেই। সবকিছুতে এখন মতভেদ, এমনকি জাতীয় সঙ্গীত নিয়েও অনেকের মনে বিভেদ।
আহা। আমিও দেখেছি সেইসব মেলা। কোথাও ভেদাভেদ ছিল না ওই সবা সময়ে। কি যে মজা হাত। সবাই আসতো। সকাল সন্ধ্যা কি আন্তরিক বাঙালিপনা; কি দারুন। আমার ছোটবেলায় সেই রকমের একটা আনন্দের স্মৃতি লিখেছিলাম ‘মেলা প্যাঁ পোঁ ধূপখোলা’ এখানে ক্লিক করলেই পেয়ে যাবেন লেখাটা। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।